ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

অমর পালের গান ও স্মৃতির তরণী

মাহবুব পিয়াল : || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অমর পালের গান ও স্মৃতির তরণী

অমর পাল

মাহবুব পিয়াল : সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির ‘কতই রঙ দেখি দুনিয়ায়’ গানের বদৌলতে অমর পালের কণ্ঠ এ দেশের অনেককেই আপ্লুত করেছিল। যদিও এর আগেই তার রেকর্ড হওয়া গানের সংখ্যা ছিল অনেক। তখনো ওভাবে নাম ছড়িয়ে পড়েনি। দেশ ভাগের কিছু আগে ২৬ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাট চুকিয়ে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। দেশত্যাগ যে তিনি আনন্দচিত্তে করেছিলেন, ব্যপারটা তা নয়। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে এ দেশের অসংখ্য শাখার লোক গান বুকে নিয়ে যান তিনি।

কণ্ঠের যাদুতে বাংলার লোকজীবন সমাজ, প্রকৃতি ও মানব সম্মিলন, সংস্কৃতির সমন্বয় সুরবদ্ধ করে রেখেছেন গায়ক অমর পাল। আমাদের কৈশোরেই অমর পাল প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তার সরল গায়কী দিয়ে। তিনি চর্চা শুরু করেছিলেন ভাটিয়ালী গানের ধারা নিয়ে, পরে এল প্রভাতী, তারপর তো লোক গানের সকল ধারাতেই পরিব্রাজকের মতো ভ্রমণ করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রভাতীর সুর-বৈচিত্র্য ও প্রাণ নিজের কণ্ঠে পৌঁছে দিয়েছেন সবার কানে। ভাটিয়ালী, প্রভাতী, ভাওয়াইয়া, দেহতত্ত্ব, মুর্শীদি, চট্কা, পালা এসব লোক সুর ধারার সমন্বয়ে প্রকাশ করা তার একটা ক্যাসেট আমাদের শহরে (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) আসে বেশ আগে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গল্পকার ও বর্ণমালা প্রেসের মালিক মুহম্মদ সিরাজ সেটা আনিয়েছিলেন আগরতলা থেকে।

১৯৮৫ সালে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে অমর পাল এসেছিলেন গান গাইতে। কয়েক হাজার মানুষ সেদিন তার গান শুনেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক হারিয়ে যাওয়া গান শুনিয়েছিলেন সেদিন। সেইসব গান ও গানের ভেতরের নাটকীয় মুহুর্তগুলোর কথা আজো মানুষ ভুলেনি। ‘গুম্মরিয়া মারে কিল দুম্মুরিয়া উঠে’, গানের এমন কথার তোড়ে প্রায় হাজার দশেক মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হাসির ঢেউয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকেন। করুণ সুর আবার তাদের শান্ত করে দেয়। কণ্ঠের মোহনীয় জাদু আর সহনীয় ভাষার সব নিত্য পরিচিত ভাটিয়ালী-সারি গানের লহরীতে শ্রোতা দর্শকরা তন্ময় হয়েছিল সেদিন। মনে হতো তার গলার সুরের ভাজ খেলানো ঢেউ বুকে এসে আঘাত হানে।

‘শয়নে গৌর স্বপনে গৌর’ এই ভোর কীর্তন তখন আমাদের সারা দিনের সাথি। ওই ভোর কীর্তন ছাড়াও ‘আমি স্বপ্ন দেখি মধুমালার মুখ’, ‘মনা কি করলি রে’, ‘চিকন গোয়ালীনি’ -এসব গান ছিল নিত্য দিনের সাথি।    

বিষয়ভিত্তিক আয়োজন করতে গেলেই দেখি লোকগানের সব শাখাতেই অমর পালের বিচরণ। এফ.এম. রেডিওতে লোকগানের আয়োজন করতে এসে তার উপযোগিতা হাড়ে হাড়ে টের পাই। ‘হাওয়া বদল’ অনুষ্ঠানের (এবিসি রেডিও) সব আয়োজনেই অমর পালের কোনো না কোন গান এসে যায়। এবিসি রেডিও-র আনুষ্ঠান প্রযোজক ও আর জে শারমীন আহেমদও অমর পালের একজন ভক্ত। বছর তিনেক আগে আমি এবিসি রেডিও এফ এম ৮৯.২  হতে একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য অমর পালকে ফোন করি। উদ্দেশ্য জেনে তিনি সম্মতি দিলেন। প্রায় ২০ মিনিটের একটা টেলিফোন আলোচনা রেকর্ড করি। সে সময় তিনি ছিলেন বেশ আবেগ আক্রান্ত। বাংলাদেশ ও ব্রাাহ্মণবাড়িয়া তার মনে কিভাবে গেঁথে রয়েছে, সেই বর্ণনাই তিনি দিচ্ছিলেন নানাভাবে।

নিজ শহরের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) মাঝখানে লোহারপুলের কাছে ফকিরের কণ্ঠে ‘মুসলমানে বলে আল্লা, হিন্দু বলে হরি’ ফেলে আসা এই গানের মর্মবাণী তার কানে এখনো বাজে। জগৎবাজারে অমর পালদের দোকানের সামনে ফকিরদের গাওয়া পাঁচালী গান এখনো গেয়ে চলেন একটুও না থেমে। বাড়ির আঙিনায় হওয়া গাজির গান, বেদেদের গান,  তিতাস পাড়ের স্মৃতি তিনি বুকে এমনভাবে আগলে রেখেছেন আজো তা ম্লান হয়নি। সেদিন তিনি বেশ কয়েকটা গানও শুনিয়েছিলেন। এবিসি রেডিওর শ্রোাতারা বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন তা শুনে।    

২.
সহধর্মীনি লিজাকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটেই ট্যাক্সি চেপে বিকেলবেলা পূর্ণ দাস রোড হতে এমএন নস্কর রোডে অমর পালের  বাড়ি পৌঁছাই। টালিগঞ্জ লাইন হয়ে কিভাবে সেখানে যেতে হবে, সব তিনি ফোনে আগেই বলে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ পেয়ে তার আনন্দের সীমা রইলো না। খুটিনাটি নানা বিষয়ে জেনে নিচ্ছেন। বয়স ৯৪ পেরিয়ে গেছে। কোমরের হাঁড় ভাঙা। যাওয়া হয় না কোথাও। আমেরিকা-কানাডা কত দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ আসে। কিন্তু  কোথাও যেতে পারেন না। অথচ  ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার কী আকুতি তার। বাড়ি থেকে পালিয়ে ট্রেনে করে কিভাবে প্রথম কলকাতা আসার গল্প শুনতে থাকি। নাটকীয়তার শেষ নেই সেই যাত্রায়। পরে গোয়ালন্দেও ট্রেনে প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া, ওই যাত্রায় তাকে অভিভাবকের মতো আগলে রাখা- এসব  কথা যেন ফুরোতে চায় না। তার প্রকাশিত বইয়েও লিখেছেন কথাগুলো। আমি ওসব পাশ কাটিয়ে আরো অনেক না জানা কথা জানার চেষ্টা করি।
 
অমর পালের সারা ঘর ভরে আছে বহু পুরস্কারে। রাষ্ট্রীয় সম্মাননারও অভাব নেই। একটা ঘরে রাখার জায়গা নেই বলে সারা বাড়িতেই এখন ছড়িয়ে রেখেছেন সেসব। সারা জীবনে সহস্রাধিক গান তিনি রেকর্ড করেছেন। তার স্মৃতিশক্তি এখনো প্রখর, গানের কথা সহজে ভোলেন না। আমি তাকে গানের প্রথম লাইন বলে শেষ করার আগেই ধরে ফেলেন পুরোটা গান। গাজীর গান, বেদে বেদেনীর গান,


ওই দেখ বলাই করে শিঙ্গার ধ্বনি
আমরা যে শুনিরে.........  

 

 

 


লেখক : লোকসংগীত গবেষক ও গায়ক।
বিভাগীয় প্রধান, নৃবিজ্ঞান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
    



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুলাই ২০১৫/মাহবুব পিয়াল/শান্ত 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়