ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উৎসবে, ঐতিহ্যে পিঠা

আফরিন শাহনাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৮ জুন ২০১৯   আপডেট: ১৭:০৪, ৬ জানুয়ারি ২০২২
উৎসবে, ঐতিহ্যে পিঠা

টোনাটুনির গল্পে পিঠা বানানোর কথা তো আমরা অনেক শুনেছি। সেই যে পিঠা বানানোর প্রস্তুতি- টোনা বাজার থেকে চাল আনলো, গুড় আনলো, টুনি আগুন জ্বালালো; করলো পিঠা বানানোর আয়োজন। গ্রাম বাংলার পিঠা বানানোর আয়োজন ঠিক তেমনই। খুব উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরি হয়। বছরব্যাপী তৈরি হলেও পিঠা বানানোর মৌসুম আছে। গ্রাম বাংলায় পৌষ মাসে নতুন চালের গুঁড়ায় পিঠা তৈরি হয়, এই উৎসবকে বলে- পৌষ পার্বণ। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ‘পৌষ পার্বণে’ এই উৎসবের যে বর্ণনা পাই তা শুনলেই খিদে পেয়ে যায়।

                   ‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।

                  গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।

                   বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।

                   হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’

প্রাচীনকালে পিঠাকে মিষ্টান্নের মধ্যেই ধরা হতো। ‘পিঠা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ শব্দ থেকে। আবার ‘পিষ্টক’ এসেছে ‘পিষ’ ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট’ থেকে। পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। ধান থেকে চাল হয় এবং সেই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ। ভারতীয় সভ্যতার প্রেক্ষাপটে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে পিঠার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ নেই, তবে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পিষ্টক’ শব্দটির উল্লেখ মেলে। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী, রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা আখ্যানের সূত্র ধরে আনুমানিক পাঁচশ বছর সময়কালে বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার কথা পাওয়া যায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখার পিঠা তৈরির বিবরণে রয়েছে :

                   ‘নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত। 

                   চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রের আকিরত ॥

                   চই চপরি পোয়া সুরস রসাল।

                   তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল ॥

                   ক্ষীর পুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া।

                   রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া ॥’


 

 বরিশালের বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে পাই নানা প্রকার পিঠার বর্ণনা:

                   ‘মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস।

                   দুই তিন প্রকারের পিষ্টক পায়েস ॥

                   দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ।

                   রন্ধন করিয়া হৈল হরসিত মন ॥’

         

পৌষ পার্বণেই হোক বা নবান্ন- পিঠা তৈরির সঙ্গে ধর্মীয় ও লোকাচারের অনুষঙ্গ জড়িয়ে নিয়েছে হিন্দুরা। পৌষসংক্রান্তির পিঠেপর্ব তো বটেই অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠলে যে নবান্ন উৎসব হতো তার অপরিহার্য অঙ্গ ছিল নানা ধরনের পিঠা। নতুন ধানের পিঠাপুলি নৈবিদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। চিতই পিঠা ক্ষেত্রদেবতার পুজোয় আর পুলিপিঠা লক্ষ্মী পুজোয়। ছড়ায় আছে :

                   ‘নয়া ধানের চিড়ামুড়ি পুলিপিঠা করে

                   মা লক্ষ্মীরে পুজো আরো পরতি ঘরে ঘরে।’

মূলত শীতকালই নতুন গুড়ের পিঠা খাওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা, পাটিসাপটা বা ছিট পিঠার মতো কিছু পিঠা সারা বছরই হয়ে থাকে। ঢাকার রাস্তায় সারা বছরই গরম পিঠা বিক্রি হয়। পুরনো ঢাকার অলিগলিতে ও খাবারের দোকানগুলোতে পিঠা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ঢাকার প্রায় প্রতিটি খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকানে সারা বছরই পাটিসাপটা পিঠা পাওয়া যায়। পিঠা তৈরির সাধারণ উপাদান চালের গুঁড়া, ময়দা, নারকেল, খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, আখের গুড়, তেল ইত্যাদি। কখনও কখনও সবজি, মাংস ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পৌষপার্বণ, নবান্ন উৎসব কিংবা পুজোআচ্চা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও রীতি-নীতি পালনের ক্ষেত্রেও পিঠার ব্যবহার হয়ে থাকে। মুসলমান সমাজে বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান- বিশেষ করে বিয়ে, আক্‌দ, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, নাইওর বা ফিরানি, সুন্নত, সাতোশা, নববর্ষ, সাকরাইন, অতিথি আগমন ইত্যাদি উপলক্ষ্যে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব বাড়িতেই পিঠা তৈরি করা হয়।

একসময় ফুলপিঠা, পাক্কন পিঠা ছাড়া বিয়ে-শাদী, সুন্নত দেয়া, কুটুমবাড়ি যাওয়া ইত্যাদি সামাজিক আচার ভাবাই যেত না। বিয়ের পরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে আর যা পাঠানো হতো তা হলো বিশাল ডালাভর্তি অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি ফুল পিঠা। বিয়ে বা সুন্নতের বাড়িতে আত্মীয় স্বজন, নাইওরি যারা আসতেন তারাও বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি করে পিঠা নিয়ে আসতেন। এই হাঁড়িগুলোও আবার কুটুমবাড়ি পাঠানোর জন্য চিত্রিত করা হতো। বাড়ির মেয়েরাই হাঁড়িতে নকশা আঁকতো। এখন অবশ্য এরকম শখের হাঁড়ি কিনতে পাওয়া যায়। এমনিতে তো এই পিঠা দু’বার ভাজতে হয়, কোথাও পাঠানোর সময় ভাজা হয় একবার। যা খাওয়ার আগে ডুবোতেলে ভেজে নিয়ে গরম গরম গুড় বা চিনির রসে ডুবিয়ে খাওয়া হয়। এই পিঠার অনেক নাম। নকশি পিঠা, পাক্কান পিঠা, ফুল পিঠা, আবার খাওয়ার সময় কড়মড়ে আওয়াজ হয় বলে গ্রামাঞ্চলে একে মড়মইড়া পিঠাও বলে। ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বেশি তৈরি হয় এই পিঠা। চালের আটা মোটা মোটা করে বেলে তার ওপরে খেজুর কাঁটা দিয়ে একটু গভীর করে পাতা, মাছ, পদ্ম, পাখি, আলপনা আঁকা হয়। নকশা অনুযায়ী এই পিঠার নামও ভিন্ন : কাজললতা, শঙ্খলতা, পানপাতা, হিজলপাতা, ভেটফুল, উড়িফুল, পদ্মদীঘি, চান্দা মাছ, আবার কইন্যামুখী, কইন্যাবরণ, জামাই বরণ, সাজন বাহার, জামাইসুখ, চম্পাবরণ ইত্যাদি।

                             ‘আইলো নকশা নাচিয়া

                             খাওলো নকশা বাছিয়া

                             হন্ধ্যাব্যালা বিয়া দিমু

                             কন্যা যাইও নিয়ারে

                             কন্যা যাইও নিয়া ॥

                             আইলো নকশা পাল্কীতে চইড়া

                             পাল্কীত থাইকা গ্যালো পইড়া

                             হায়রে নকশার ভাইঙ্গলো ঠ্যাং

                             আইলো এক ঠ্যাং দিয়া রে

                             কন্যা যাইও নিয়া ॥’

                                                [মেয়েলি গীত/সিরাজগঞ্জ]

গ্রাম বাংলার বিয়ে বাড়িতে পিঠা তৈরি ও আপ্যায়নের ব্যস্ততার চিত্র পাই সামরান হুদার ‘আইলো নকশা পিঠাতে চড়িয়া’ প্রবন্ধে :



‘বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীনই চালের যোগাড় রাখা এক বিরাট দায়িত্ব। পিঠার চাল, কুটুমেরা যে আসবেন সেই গায়ে হলুদের আগের দিন থেকে আর থাকবেন সেই বিয়ের পরদিন বা তারও পরদিন পর্যন্ত, তাদের দু’বেলা ভাত আর সকালের নাশতায় পিঠার চাল, বরযাত্রীকে খাওয়ানোর জন্য স্পেশাল কালিজিরা চাল। আমার দাদি সারাদিন ব্যস্ত শুধু যে এতদিন আলাদা আলাদা করে গোলায়, বস্তায় ধান তুলে রেখেছেন সেই ধান ভাঙিয়ে চালের ব্যবস্থা করায়। এক এক রকম পিঠার জন্য এক এক রকম চাল চাই, মড়মইড়া পিঠার জন্য ধবধবে সাদা আলোচাল, পাক্কনের জন্য একই চাল কিন্তু তার সঙ্গে আবার সোনামুগ চাই। পোয়া পিঠা অবশ্য একটু লালচে রঙের চাল হলেও চলবে, এমনিতেও তো গুড় দিয়ে বানানো হবে কাজেই চালের রঙ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সকালের নাশতার চিতই, ছিটেরুটির জন্যেও সাদা চাল হলেও ভাল হয় নইলে মাংসের সঙ্গে পাতে ঠিক রঙ খোলে না।’    

বিয়ে বাড়িতে সারাদিন বসে মেয়েরা পিঠা তৈরি করে আর বিয়ের গীত গায়। মুগপাক্কনও সেই সুঁই কাটা দিয়ে নকশা করা পিঠা তবে এটি গোলাতে মুগ ডাল লাগে। সোনামুগের ডাল খোলায় ভেজে জলে ভিজিয়ে শিল পাটায় বেটে চালের আটার সাথে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি হয়।  তারপর সেখান থেকে নকশা কাটা হয়। সেই পিঠা তেলে ভেজে সিরায় ডুবানো হয়।

ঢাকার বিয়েতে যে পিঠা না হলেই নয় তা হলো থাউকা বড়া, অঞ্চলভেদে এ পিঠাটিকে পুয়া, মালপোয়া, ভাজা পিঠা, তেলের পিঠাও বলা হয়ে থাকে। বিয়ের সময় মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে দুই প্রস্থে পিঠাটি দেয়া হয়। প্রথম বারে বিয়ের পরের দিন সকালে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পাটিসাপটা ও অন্যান্য পিঠার সাথে এই পিঠাটিও নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে জামাইকে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ জানাতে পিঠা পুনরায় পাঠানো হয়ে থাকে। প্রতিবার একশ, দেড়শ, দুইশ হিসাবে পিঠা পাঠানো হয়।

                             ‘ভাদর মাসে ভাদই ধানের পুয়া কত মিঠ্যা

                             ভ্যাসকা গুড় ভালো লয় গুড় ভালো চিট্যা।

                                                                   [খ্যামটা/নবাবগঞ্জ]

খেজুর গুড় কিংবা আখের গুড় দুটোতেই এই পিঠা তৈরি হয়। চালের গুঁড়ায় গুড়ের শিরা মিশিয়ে তৈরি হয় পিঠার গোলা। কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে হাতায় করে গোলা ছাড়া হয়। কড়াইয়ের তলা থেকে ফুটন্ত পোয়া চাঁদের মতো ফুলে ঢোল হয়ে তেলের উপরে উঠে আসে। সোনালি রং ধরলে পিঠা নামানো হয়।

উৎসবপ্রিয় বাঙালির আর একটি প্রিয় সামাজিক অনুষ্ঠান হলো ‘সাতোশা’। অঞ্চলভেদে একে ‘সাধ’ বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পর মেয়ে যখন প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হয় তখন তার বাবার বাড়ির লোকজন উৎসবটির আয়োজন করে। গর্ভের সন্তানের বয়স যখন সাত মাস হয় তখন এই অনুষ্ঠানটি করা হয়। এসময় পুরি পাকন পিঠা বা চন্দ্রপুলি পিঠা তৈরি করা হয়। নারিকেল, চিনি বা গুড় দিয়ে তৈরি হয় পিঠা। অর্ধচন্দ্রের আকারে তৈরি এই পিঠায় মিহি করে কোরানো নারিকেল অথবা শিল পাটায় বাটা নারিকেলের সাথে চিনি বা গুড় মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে হালুয়ার মতো আঠালো পুর তৈরি করা হয়। ময়দার কাই তৈরি করে করে রুটি বেলে তার ভিতরে নারিকেলের পুর ভরে রুটি ভাঁজ করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকার দেয়া হয়। আবার একই পিঠা নোয়াখালী অঞ্চলে করা হয় একটু অন্যরকমভাবে। রুটির ভিতর পুর দিয়ে নকশা করে উপরে আর একটা রুটি রেখে তারকা, মাছ, ফুল বিভিন্ন নকশা করে পিঠাকাটার বা ছুরি দিয়ে কাটা হয়। তারপর তেলে ভেজে অথবা তাওয়ায় সেঁকে পরিবেশন করা হয় গরম গরম পিঠা। ঠিক একইরকম ভাবে চালের গুঁড়ার রুটি তৈরি করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির পুলি পিঠা তৈরি করে ঢাকনাসহ বড় হাঁড়িতে ভাপে সেদ্ধ করা হয়। একে ঢাকা অঞ্চলে হাত কুলিও বলা হয়।

উৎসবের আরেকটি পিঠা হলো কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা। সাতোশা এবং ঈদ-উল-ফিতরে তৈরি করতে দেখা যায়। পিঠা তৈরির জন্য ২ কাপ চালের গুঁড়ার সাথে ১/৪ কাপ ময়দার মিশ্রনে মণ্ড তৈরি করা হয়। তা বিশ ভাগ করে প্রতি ভাগ হাতের তালুর সাহায্যে লম্বা সরু লতার মতো করে তালুর কৌশলে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি অন্তর কাটা হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে আবার শুধু চালের গুঁড়ার মণ্ড দিয়েই পিঠাটি তৈরি করা হয়। এই পিঠা কাটার কৌশল সবাই রপ্ত করতে পারে না। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলারাই সেমাই পিঠা তৈরিতে বেশি পারদর্শী হন। খেজুরের গুড়, দুধ ও নারিকেল দিয়ে রান্না করা হয় এই সেমাই পিঠা। গ্রামাঞ্চলে কড়া রোদে শুকিয়ে পিঠা বৈয়ামে তুলে সংরক্ষণও করা হয়।



ঐতিহ্যবাহী আরেকটি পিঠা হলো চিতই পিঠা। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র সবার কাছেই এ পিঠা পরিচিত ও প্রিয়। চিতই পিঠার ব্যাপকতা দেখা যায় শহরের অলিগলিতেও। শীতকালে তো বটেই বছরের অন্যান্য সময় এই পিঠা তৈরি করা হয়। অনেক রকম ভর্তা দিয়ে এই পিঠা খাওয়া হয়; আবার মাংসের ঝোল, কলিজা ভুনা, হাঁস ভুনার সাথেও দিব্যি চলে চিতই পিঠা। গ্রামাঞ্চলে চিতই পিঠা তৈরির ছাঁচ পাওয়া যায়। অঞ্চলভেদে এই ছাঁচও হয় নানারকম। কোথাও মাটির আবার কোথাও লোহার তৈরি ছাঁচে তিন পিঠা, পাঁচ পিঠা, সাত পিঠা পর্যন্ত করা যায়। এই ছাঁচগুলোতে বিভিন্ন আকৃতির যেমন গোল, ডিম্বাকৃতি, অর্ধচন্দ্রাকৃতি, হৃদয়াকৃতি পিঠা বানানো যায়। পিঠার গোলা গরম ছাঁচে পরিমাণ মতো ঢেলে ঢাকনি দিয়ে ছাঁচটি ঢেকে দিতে হয় যেন গরম বাষ্প বের হতে না পারে। কয়েক মিনিট পর পিঠাটি খুন্তি বা অন্য কিছুর সাহায্যে তুলে নিতে হয়। অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত এই পিঠা দেখতে অনেকটা প্যানকেকের মতো। কথিত আছে, একবার এক ইংরেজ এই চিতই পিঠা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, পিঠার ভিতর এত ছিদ্র কীভাবে করা হলো! চিতই পিঠা খেজুরের রস/খেজুরের রসযুক্ত দুধে ভিজিয়ে তৈরি হয় দুধ চিতই বা ভিজা পিঠা। দুধ চিতই মূলত পৌষপার্বণ ও নবান্ন উৎসবের পিঠা। নতুন চাল কুটে পিঠা বানিয়ে খেজুরের রসে সারা রাত ভিজিয়ে শীতের হিম ভোরে এই পিঠা না খেলে শীতকালটা ঠিক জমে না।

বাংলাদেশের আরেকটি খানদানী পিঠা হলো ভাপা পিঠা/ ধুপি পিঠা/ ধুকি পিঠা। বাষ্পে সিদ্ধ করা হয় বলেই এই পিঠার নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া দিয়ে সেদ্ধ করা ছোট ছোট পিঠার মাঝখানে খেজুরের রসের নতুন গুড় আর নারিকেল ভর্তি থাকে। মোগল আমলে ঢাকার অন্যতম পিঠা ছিল ভাপা পিঠা। তবে উপকরণ ও তৈরির পদ্ধতির দিক থেকে তা বর্তমান সময়ের ভাপা পিঠার থেকে ভিন্নতর ছিল। সেই পিঠায় ব্যবহৃত হতো ঘি, জাফরান, মালাই, খিরসা, পেস্তা বাদাম, মোরব্বা। ব্যবহার হতো যশোরের খেজুরের গুড়, সুগন্ধি চাল। আকারে বড় এই পিঠাগুলোকে বলা হতো শাহি ভাপা পিঠা। এই ভাপা পিঠাগুলো কেকের মতো কেটে খাওয়া হতো।

আরও যেসব পিঠা মোগল আমল থেকে এই বাংলায় রাজত্ব করে যাচ্ছে সেগুলো হলো পাটিসাপটা, গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছিটপিঠা, ছানার মালপোয়া, দুধ পুলি। এছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল যেমন, নবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সোনার গাঁ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য পিঠার মধ্যে মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, গুলগুলা পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, ঝাল পাটিসাপটা, বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, তিল পুলি, সাবুর পিঠা, ম্যারা পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, ছিটরুটি, জামাই পিঠা অন্যতম। এছাড়াও নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, মাগুরা, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর তথাপি সারা বাংলাদেশেই পিঠা তৈরি হয়। সব অঞ্চলের পিঠাতেই নিজস্ব লোকঐতিহ্য আছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের নিজস্ব পিঠা হলো খোলাজা পিঠা, ম্যাড়া পিঠা, ডিমের বিস্কুট পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, গোলাপ পিঠা, সুজির পিঠা, ডিমের পানতোয়া, ঝাল পানতোয়া, ঝুনঝুনি পিঠা, নারিকেলের চিড়া। আবার চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হলো বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। চট্টগ্রামে কলা, নারিকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে পিঠা তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এ পিঠার নাম আতিক্কা পিঠা। আবার বিন্নি চালের গুঁড়ার সাথে নারিকেল, গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিন্নি পুলি যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত হাফাইন্না পিঠা বা গোইজ্জা পিঠা নামে। শরিয়তপুর বিখ্যাত বিবিখান পিঠার জন্য। জামালপুরের রোট পিঠা বা ওট পিঠা তৈরি হয় রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ সব মিশিয়ে। মাটির কলসিতে মিশ্রণটি ঢেলে চুলার আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় বিচিত্র পিঠাটি। সিলেটের গ্রামাঞ্চলের একটি পিঠা হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা। বাঁশের মধ্যে কলাপাতা দিয়ে তার মধ্যে ভেজানো বিন্নি চাল (সিলেটি ভাষায় বিরণ চাল) ভরে খের (খড়) দিয়ে মুখ আটকে চুলায় পোড়াতে হয়। এছাড়াও সিলেটের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠা হাত সেমাই পিঠা। সেমাই কাটার মেশিনে চালের গুঁড়ার মণ্ড দিয়ে চিকন চিকন সেমাই কাটা হয়। তারপর ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হয়।

এরকমই সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী পিঠা। শীতকালজুড়ে বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায় পিঠামেলা বা পিঠা উৎসব। এইসব উৎসবে থাকে অনেক রকমের পিঠার আয়োজন। ঢাকায় শিল্পকলা ও বাংলা একাডেমি, চারুকলায় আয়োজন করা হয় পিঠা উৎসব। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় পৌষমেলা উপলক্ষ্যে পিঠার আয়োজন করা হয়। আজকাল পাঁচতারা হোটেলগুলোতেও জায়গা করে নিয়েছে গ্রাম বাংলার পিঠাপুলি। পিঠা আমাদের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এখন যদিও শহরের  পরিবারগুলোতে সেভাবে পিঠা তৈরি হয় না; তার অনেক কারণও আছে। সময় এবং লোকের বড় অভাব আমাদের। তাছাড়া গ্রামের মাটির চুলার তৈরি পিঠার স্বাদ শহরের আধুনিক চুলায় পাওয়া যায় না। তবুও উৎসবপ্রিয় বাঙালি বছরের পর বছর উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবেই বাঁচিয়ে রেখেছে পিঠা সংস্কৃতিকে।

তথ্যসূত্র:

১। বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা
২। ঢাকাই খাবার, এশিায়াটিক সোসাইটি, ঢাকা
৩। নুনেতে ভাতেতে: খাদ্য সংস্কৃতি বিষয়ক সংকলন, কলকাতা
৪। নুনেতে ভাতেতে-২: হারিয়ে যাওয়া খাবারের গল্প, কলকাতা
৫। বাঙালির খাদ্যকোষ, মিলন দত্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়