ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একটি গানের কথা || ফজল-এ-খোদা

ফজল-এ-খোদা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ২৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ১৩:৫২, ৩ জুলাই ২০২১
একটি গানের কথা || ফজল-এ-খোদা

আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে

নিজেরে বিলিয়ে দিলাম,

প্রতিদানে শুধু আঁধারের কাছে

শূন্যতা খুঁজে পেলাম ॥

 

যে দিল নিজেরে উজাড় ক’রে

ক্ষয়ে ক্ষয়ে একা জীবন ভ’রে

পৃথিবীর কাছে একটুও সে

পেল না তো কোনো দাম ॥

 

সূর্যের আলো আছে বলে

কে তারে মূল্য দেয়,

চাঁদেরে সবাই মুগ্ধ নয়নে

কাছে তারে ডেকে নেয়।

 

যে সুরে ভ্রমর আকুল হল

যে গানে ফুলেরা ব্যাকুল হল

শিল্পী সে তো হারিয়ে গেল

[কেউ] খুঁজল না তার নাম ॥

 

 

অনেকেরই প্রশ্ন ও গানটি কখন কীভাবে কী করে সৃষ্টি হলো? এককথায় এর উত্তর হয় না। উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। এবং যে কথাগুলো না বললে যেমন উত্তরদাতার তেমনি প্রশ্নকারীর কারোরই তৃপ্তি হবে না। তাই ধান ভানতে কিছু শিবের গীত গাইতে হবে। তাতে কোনো সুধী পাঠক-পাঠিকার যদি ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, সে জন্যে আগেই আমার অক্ষমতাকে বিবেচনা করতে অনুরোধ করছি। কারণ এ গানটিই জনগণের সমীপে প্রচারিত আমার প্রথম গান।

শৈশব থেকেই গানের প্রতি দারুণ ঝোঁক আমার। পাবনা জেলার বেড়া থানা এলাকায় সংগীতের পরিবেশও ছিল চমৎকার। বর্ধিষ্ণু হিন্দুপ্রধান অঞ্চল বলেই সংগীতের চর্চার কোনো কমতি ছিল না। এখানেই আমার জন্ম, এখানেই আমি বেড়ে উঠেছি।

 

বারো মাসের তেরো পালা-পার্বণে গ্রামে রামযাত্রা, জামালযাত্রা, রূপভানযাত্রা, দোলযাত্রা, বড়যাত্রা ছাড়াও বারাসি, জারি ও সারি, ফকিরান্দি, ধুয়াগান, লালনের গান, মুকুন্দ দাসের গান, কবিগান, চাপানগান-পাল্লাগান, শাস্ত্রগানের আসর বসত। বিশেষ করে চাপানগান-পাল্লাগানে দুই স্বভাব কবির লড়াই- তাৎক্ষণিক গান রচনা ও তাতে সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে একে অন্যকে হারিয়ে দেবার যে প্রতিযোগিতা হতো, তাতে বিস্ময়ের অন্ত থাকত না আমার। মনে হতো কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। এমনকি সাত দিন সাত রাত্রি পর্যন্ত এই লড়াই অব্যাহত থাকত। এ ছাড়া যাত্রার বিবেকের গান আমাকে ভীষণভাবে আক্রান্ত করত। এবং আজও করে। কী করে যেন বোধ জন্মেছিল সরাসরি সত্য কথা স্পষ্ট করে বলতে হলে তা গানের মাধ্যমে বলাই সবচেয়ে সহজ। এবং স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, গ্রাম-শহরের বিভিন্ন বৈঠকি জলসায় আর গ্রামোফোন রেকর্ডে নজরুলসংগীত শুনে শুনে গান গাইবার ও গান রচনার ইচ্ছা মনের ভেতর গুঞ্জরিত হতে থাকে।

 

বড়দের কাছে শুনতাম যারা কবির লড়াই করেন তারা কেউই তেমন শিক্ষিত নন, এমনকি অনেকে একেবারেই নিরক্ষর। তারা মনে মনে গান রচনা করেন এবং সেই গান স্মৃতিতে রেখে দেন, গানের আসরে ডাক পড়লে তা গেয়ে শোনান। আবার এমন অনেকে ছিলেন যারা রচনার পর একটি গান একবারই গাইতেন, কখনো পুরোনো গান গাইতেন না; গাইতে হলে তাৎক্ষণিক গান রচনা করতেন এবং গাইতেন। ভাবতাম ওরা তো আমার মতোই মানুষ, ওরা যদি পারেন আমি কেন পারব না? হায় দু-একটি গান যা-ও রচনা করা গেল কিন্তু তাদের মতো গান আর মনের মতো করে গাওয়া হলো না।

বাবার মৃত্যুর পর নানাবাড়িতে ১৯৫২ সালে এসে যখন বেড়া জুনিয়র স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন পেয়ে গেলাম ক্লাসবন্ধু মদনমোহন দাসকে। মদনের কত গান যে জানা ছিল মনে হয় সেও জানত না। আমরা যখনই গান শুনতে চাইতাম সে নতুন নতুন গান শোনাত। জিজ্ঞেস করলে বলত কলেরগানের নতুন রেকর্ডের গান; না হয় বলত অমুক সিনেমার গান। মদনকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে গান নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল।

 

১৯৫৯ সাল। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি আর মদন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিই। এয়ারফোর্স রিক্রুটিং স্কুলে প্রায়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। একদিন আমাদের গ্রাউন্ড ট্রেনিং ইনস্ট্রাক্টর কাপল জহুরুল হক ওরফে জহুর [আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত যখন তিনি সার্জেন্ট] আমাকে বললেন, তুই নাকি লিখতে-টিকতে পারিস? দেশের ওপর একটা গান ল্যাখ না। মদন সুর করে গেয়ে দেবে। ওরা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পশতু গান গায়, তোরা একটা বাংলা গান গাইতে পারবি না? তার বলা মানে অর্ডার। আমি লিখে ফেললাম ‘আমাদের দেশটা সুজলা সুফলা, কী সুন্দর কী চমৎকার মুখে যায় না বলা’ গানের সব কথা মনে করতে পারছি না; যে অস্থায়ীটা লিখলাম তাও ঠিক এ রকম ছিল কি না, তাতেও সন্দেহ আছে। তবে এ কথা ঠিক, সেই থেকে আমার গান লেখা শুরু।

 

১৯৬০ সাল। আমি আর মদন দুজনই পাকিস্তান এয়ারফোর্স থেকে ফিরে এসেছি। ফেরার কারণ বাংলায় কথা বলা। বাংলায় কথা বলেছিলাম বলে আমার কোয়ার্টার গার্ড হয়ে যায় অর্থাৎ শাস্তি হয়। এয়ারফোর্সে প্রকাশের মাধ্যম ছিল ইংরেজি। পাঞ্জাবি-সিন্ধি-বেলুচ-পাঠানেরা তাদের ভাষা ব্যবহার করলে কোনো দোষ নেই কিন্তু বাঙালিরা বাংলা বললে মহা অপরাধ। তাই ঠিক করি ওয়ারফোর্সে থাকব না। আমি থাকিনি বলে মদনও থাকল না।

১৯৬১ সালে ভিলেজ এইডে চাকরি নিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসি। এলিফ্যান্ট রোডে ছিল আমার বাসা। এই হাতিরপুলের চৌমাথায় সেন্ট্রাল রোডের শুরুতে ছিল আমাদের স্কুলবন্ধু সুলতান মাহমুদের দোকান। সুলতানের দোকান বললে ঐ অঞ্চলের সবাই চিনত। ম্যাট্রিকুলেট ছেলে চাকরি না খুঁজে দোকান চালাচ্ছে বলে বুদ্ধিজীবী মাত্রেই তার ওখানে আসত এবং কিছুক্ষণের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিত। এখানে আসতেন নাট্যকার ফররুখ শিয়র, কবি আবদুস সাত্তার, নাট্যশিল্পী ও বেতারের বুনিয়াদি গণতন্ত্র আসরের মাতবর ভাই নিজামতউল্লাহ, মজিদের মা আয়শা আখতার, কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, চারুশিল্পী বন্ধু গোলাম সারোয়ার, কৃষিবিদ বন্ধু আবদুল কুদ্দুস এবং আরো অনেকে।

 

এই আড্ডায় প্রায়ই গান ও শিল্পী নিয়ে কথা হতো। সংগীত নিয়ে সবারই প্রচুর আগ্রহ ছিল। যেদিনই মাতবর ভাই থাকতেন সেদিন অবশ্য অবশ্য গানের কথা উঠতই- কারণ তখনকার নতুন শিল্পীদের মধ্যে কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার হলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আর শিল্পী জব্বার মাতবর ভাইদের কুষ্টিয়ার ছেলে। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের শুরুতেই খুব নামকরা বেতারশিল্পী ছিলেন আবুবকর খান, তিনিও কুষ্টিয়ার। এ জন্যে মাতবর ভাইয়ের গর্বের শেষ ছিল না। জব্বারের কথা বলতে গিয়ে তিনি বিখ্যাত গীতিকার ও কবি আজিজুর রহমানের কথাও বলতেন। কবি আজিজুর রহমানের বাড়িও কুষ্টিয়ায়। অর্থাৎ কুষ্টিয়া হলো প্রতিভার খনি। মাতবর ভাই তার রসালো ভাষায় আমাদের শোনাতেন জব্বারের বেতার-শিল্পী হওয়ার কাহিনি। কবে, কেমন করে কবি সাহেব জব্বারকে ধরে এনে রেডিওতে অডিশন দেওয়ালেন এবং নিয়মিত গানের চর্চা করানোর জন্য নিজের কাছেই রেখে দিলেন। তখনকার জনপ্রিয় উচ্চাঙ্গসংগীত-শিল্পী ওস্তাদ মোহাম্মদ ফজলুল হকও কবির সঙ্গেই থাকতেন মালিবাগের আমবাগানে।

 

মাতবর ভাই গানের কথা বলতে গিয়ে কবি আজিজুর রহমানের দুটি গানের কথা বলতেন। গান দুটি হলো- ‘মন রে ভবের নাট্যশালায় মানুষ চেনা দায়’ আর ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে’। জব্বারের কণ্ঠে ভবের নাট্যশালায় গানটি তখন দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বলা যায়, গানটি শ্রোতাদের মুখে মুখে। হাটখোলা রোডের কমিউনিটি সেন্টারে ভিলেজ এইড আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জব্বারের কণ্ঠে ‘ভবের নাট্যশালায়’ গানটি সামনাসামনি শোনার সুযোগ হলো। গান শুনে মোহিত হয়ে গেলাম। খুব ইচ্ছে হলো জব্বারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। সরোকে [গোলাম সারোয়ার] মনের কথা বললাম। সরোও বলল- চল একদিন, জব্বারের সঙ্গে আলাপ করে আসি। কিন্তু জব্বারের ঠিকানাও জোগাড় হয় না, আলাপ করতেও যাওয়া হয় না।

 

এরই মধ্যে ভিলেজ এইড উঠে গেল। আমি চাকরি নিলাম হাতিরপুলের ধানমন্ডি উচ্চবিদ্যালয়ে। হাতিরপুল থেকে বাসা বদল করে আমি আর সারোয়ার তখনকার পাকমোটরে [এখনকার বাংলামোটর] চলে এলাম। এটাকে বাসা না বলে ছোট গুদামঘর বলা চলে। একটিমাত্র দরোজা। তাও নিচু হয়ে ঢুকতে হয়; কোনো জানালা নেই। সারোয়ার শিল্পী মানুষ, তারপর রসিকজন। আমাদের এই বাসার দেয়ালে শাদা রং দিয়ে লিখে দিল পূরবী হাউস। ব্যাস, ডাকপিয়নও চিনে ফেলল ‘পূরবী হাউস’ মানে পাকমোটরের এই বাসা। এই একতলা দালানের পাশে আর একটি ঘর ছিল, তাতে থাকতে এল জামালপুরের ভানু নামের একজন সংগীতশিল্পী। তিনি প্রায় রাতেই গানের আসর বসাতেন। একদিন এলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ ফজলুল হক। সারা রাত গান হলো। যত দিন বাঁচব কোনো দিন ভুলব না ওস্তাদের সেই গান ‘মাওলা ম্যায় তু যোগান বানি তেরে ইয়াদ মে’। উচ্চাঙ্গসংগীত যে এত শ্রুতিমধুর হয় তা ওস্তাদের কণ্ঠে যে শোনেনি তার পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নয়।

হঠাৎ সুযোগ পেলাম ‘কবরী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় কাজ করার। সারা দিন যা-ই করি না কেন রাত জেগে কবিতা লিখি, ছড়া লিখি, গান লিখি। তাই পত্রিকার কাজটি লুফে নিলাম। পত্রিকায় আমার পদবি হলো ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পদবির কারণেই সম্ভবত একদিন একটা সুন্দর ডায়েরি পেলাম। ডায়েরিটা আমার খুব পছন্দ হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ডায়েরিতে আমি শুধু গান লিখব আর কিছু নয়। ডায়েরি পাওয়ার প্রথম রাতেই সেখানে প্রথম যে গানটি লিখলাম সেটি হলো- এই আকাশের নিচে পৃথিবী কেন যে কাঁদে;/ কোন সে মিছে মায়ায় আমারে বাঁধিতে চায়? গানটি পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুরে শিল্পী ইসমত আরার কণ্ঠে বেতারে রেকর্ড করা হয়।

 

একদিন রাতে বাসায় ফিরে দেখি সারোয়ার আমাদের বয়সি একজনের সঙ্গে কথা বলছে। সরো বলল, এই যার কথা এতক্ষণ আপনাকে বলছিলাম। আর ইনি হলেন কামাল, কুষ্টিয়া বাড়ি, রেডিওতে চাকরি পেয়েছেন। থাকার জায়গা নেই। থাকার জায়গা প্রয়োজন। আমি বললাম- কিন্তু এখানে থাকবেন কোথায়? কামাল সাহেব বললেন, আপনারা যেভাবে আছেন আমিও সেভাবেই থাকতে পারব; কোনো অসুবিধা হবে না। সরো জানাল- আমরা তো পিঠে পিঠ লাগিয়ে থাকি, সেখানে ফাঁক পাবেন কোথায়? কামাল সাহেবের উত্তর, এই দেখুন না। বলেই কাজে লেগে গেলেন। আমাদের ঘরে দুটো চৌকি ছিল ঠিকই- একটিতে আমরা, আর একটিতে থাকত সারোয়ারের আঁকাআঁকির সরঞ্জাম ও আমাদের দুজনের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি। কামাল সাহেব সেগুলোকে ঘরের দু-কোণে রেখে চৌকিটা ফ্রি করে ফেললেন চোখের পলকে। এবং আমাদেরই রাখা পুরোনো দৈনিক কাগজ বিছিয়ে একদিকে তার কাপড়ের ব্যাগটি ফেলে চিৎ হয়ে টানটান শুয়ে পড়ে বললেন- কী, কোনো অসুবিধা আছে? কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের ভাষা ও উচ্চারণভঙ্গি দারুণ শ্রুতিমধুর। আমরা বাকহারা।

 

প্রতি রোববার সকালের দিকে আমরা তিনজন কেবল একসঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কথা বলার সুযোগ পাই। আমার মতো কোনো রবি-সোম নেই। প্রতিদিনই আমার অফিস। কেবল অফিসে হাজির হবার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। আর ওদের দুজনেরই রোববার ছুটি। সারোয়ারের ছুটি থাকলেও তার কমার্শিয়াল কাজগুলো সে এই রোববারেই করে। আর রাত্রিতেও আমার আর সারোয়ারের ফেরার কোনো সময় ঠিক নেই। কেননা, খাওয়া যার যেখানে সুবিধা সেখানে। এক রোববারে কামাল সাহেব আমাকে একটা টাইপ করা কাগজ ও সুতো বাঁধা ২৫ শিট কাগজের বান্ডিল দিয়ে বললেন, নিন। দরখাস্তটা সই করবেন এবং ২৫টি গান লিখে পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দেবেন। মশায় আপনি তো ভালো লেখেন। আমি আপনার ডায়েরির সব গান পড়ে ফেলেছি। দেখি আপনাকে রেডিওর গীতিকার বানানো যায় কি না? সরো বলল, নে তোর কাজ হয়ে গেল।

 

কামাল সাহেবের কাছে ঠিকানা পেয়ে আমি আর সারোয়ার এক রোববারে চললাম শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সঙ্গে দেখা করতে। জব্বারের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাতবর ভাই। তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, তুমি যখন গান-টান লেখ যাও না একবার জব্বারের কাছে। ও যদি তোমার একটি গান করে তাহলে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে। জব্বার আমার খাতা থেকে যে গানটি প্রথম পছন্দ করল সেই গানটিই হলো- ‘আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে নিজেরে বিলিয়ে দিলাম’। গানটি দেখেই জব্বার বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কবি তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ তার গানটি এতই পছন্দ হয়েছিল যে, আমার আর সারোয়ারের সামনে বসেই গানে সুর দিয়ে ফেলল। আমরা তো অবাক এত শিগগিরই এমন একটি সুন্দর গান তৈরি হয়? কবি আজিজুর রহমানও গানটি খুব পছন্দ করলেন; এমনকি ওস্তাদ মোহাম্মদ ফজলুল হকও। তার কদিন পরেই কবি আজিজুর রহমানের নামে গানটি জব্বার রেডিওতে প্রচার করল। আমি তো আর রেডিওর তালিকাভুক্ত গীতিকার নই। আমার রচিত গান রেডিওতে প্রচারিত হবে, এটা আমার ভাবনারও অগম্য ছিল তখন।

 

এ গানটি আমি লিখলাম কী করে? কোন বাস্তবতা থেকে লেখা হলো গানটি? আমরা যে পূরবী হাউসে থাকতাম সেই ঘরে বিজলিবাতি একটা ছিল। কিন্তু বাড়িভাড়া দিতে দেরি হলেই বাড়িওয়ালা বাল্বটা যথারীতি খুলে নিয়ে যেতেন। এবং ভাড়া দেওয়া হলেই আবার বাল্ব লাগিয়ে দিতেন। প্রায় মাসেই আমাদের বাড়িভাড়া দিতে দেরি হতো; এমনকি দু-এক মাস বাড়িভাড়া বাকিও পড়ত। তখন আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ চালিয়ে নিতাম। ঢাকাইয়া বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়ার জন্য প্রায় প্রতিদিনই তাগাদা দিতেন। কিন্তু বাড়ি ছাড়তে বলেননি কখনো। ব্যাচেলরদের জন্য বাড়ি পাওয়াই কঠিন; তাই শত অসুবিধা সত্ত্বেও আমরা এই বাড়ি ছাড়িনি। রাতে ফেরার পর প্রায়ই এমন হতো ম্যাচ আছে তো মোমবাতি নেই, মোমবাতি আছে তো ম্যাচ নেই। তখন বেশ দূরের দোকানে দৌড়াতে হতো ম্যাচ বা মোমবাতির জন্য। এটাই তখন আমাদের জন্য বড় কষ্টের ছিল। অনেক সময় মোমবাতি কেনার মতো পয়সাও থাকত না। আর এক অসহায় অবস্থা। তারপরও আমাদের কাছে ‘পূরবী হাউস’ জিন্দাবাদ ছিল। মন্দের ভালো, মানে অতি ভালো ছিল এই আশ্রয়।

 

একদিন কী হলো খাতা-কলম নিয়ে বসেছি- রাত তখন বারোটা-সাড়ে বারোটা হবে। কী একটা কথা মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে; কিন্তু ভাব আর ভাবনার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারছি না। এদিকে মোমবাতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে অবশেষে নিভে গেল। কিন্তু আমার লেখা তখনো শুরুই হয়নি। হঠাৎই মনে হলো মোমবাতিটার মতোই তো মানুষের জীবন। আলো দিতে দিতে একসময় নিঃশেষ হয়ে মোমবাতি যেমন আঁধারের শূন্যতা ছাড়া কিছুই পায় না তেমনি মানুষের জীবনও দিনে দিনে শেষ হয়ে যায়- বিনিময়ে কবরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু কি পায়? আর তখনই মনে হলো লেখার মশলা পেয়ে গেছি। ইউরেকা! এখন কিছুক্ষণের জন্য শুধু আলো চাই। পাশের ঘরে ভানুদার গলা শোনা যাচ্ছিল- তিনি কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। ভানুদা আমার আলোর প্রয়োজন জেনে বললেন- নো প্রবলেম, আমাদেরটাই নিয়ে যান, আমরা এখন শুয়ে পড়ব। ভানুদার মোমবাতিতেই আমার লেখা হয়ে গেল, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে নিজেরে বিলিয়ে দিলাম...।

 

এই গানটি নিয়ে আরো কিছু কথা আছে। এটি জব্বারের কণ্ঠে আমার প্রথম গান। এই গানের জন্যেই রেডিওতে গীতিকার হওয়ার সুযোগ হলো। একদিন রেডিওতে গেছি, সংগীত বিভাগের কামাল সাহেব একটি পোস্টকার্ড আমার হাতে দিয়ে বললেন, শ্রোতারা সাধারণত গানের এক লাইন-দু লাইন লিখে অনুরোধ করে। কিন্তু দেখুন মেয়েটি আপনার পুরো গানটিই লিখে পাঠিয়েছে। আমার মনে হয়, এই মেয়ে আপনার গানের খুব ভক্ত। মেয়েটি যে আমার কলমবন্ধু, তা আর তাকে বললাম না। পত্রমিতা মাহমুদা সুলতানা খুলনা থেকে রেডিও কর্তৃপক্ষকে লিখেছেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের ‘প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’ গানটি অনুরোধের আসরে প্রচার করতে। চমৎকার বলে গানটির দারুণ প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু গানটি রেকর্ডকৃত নয়। জব্বার দু-চারবার ইতিমধ্যে গানটি শুধু লাইভ প্রোগ্রামে গেয়েছে। সুতরাং এ গান অনুরোধের আসরে বাজানোর কোনো সুযোগ নেই। কথাটা আমি রেডিওর ওয়াদুদ ভাইকে একদিন কথায়-কথায় আফসোস করে বললাম। কাজী আবদুল ওয়াদুদ রেডিওর সিনিয়র স্টাফ আর্টিস্ট। তিনি আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তিনি শুনে বললেন, দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি। তারপর সম্ভবত দু-এক মাস পরেই ওয়াদুদ ভাই একদিন আমাকে রেডিওতে দেখেই বললেন- এই যে কবি, আমি তোমাকে খুঁজছি আর তোমার কোনো পাত্তা নেই। চলো, মিষ্টি খাওয়াও। আমাকে আবন মিয়ার দোকানে [রেডিওর ঐতিহাসিক ক্যান্টিন] টেনে নিয়ে গেলেন এবং পরাটা ও চায়ের অর্ডার দিলেন। সেদিন সকালে আমার তেমন কিছু খাওয়াও হয়নি। পকেটে তেমন পয়সাও নেই। আমি ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্তিবোধ করছি., কত যে বিল হয়, সত্যি খুব লজ্জায় পড়ে যাব। আমি খেতে ইতস্তত করছি। ওয়াদুদ ভাই বলেন, আরে তাড়াতাড়ি খাও, চলো তোমাকে একটা জিনিস শোনাব। খাওয়া শেষ হতেই ওয়াদুদ ভাই চিৎকার করে বললেন, আবনভাই খাতায় লিখে রাখেন; আমাদের একটু কাজ আছে, আমরা গেলাম। আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আমি আমতা-আমতা করে ভদ্রতার খাতিরে বললাম, ওয়াদুদ ভাই, বিলটা আমি দিতাম। ওয়াদুদ ভাইয়ের স্বভাবসুলভ উত্তর- বিল দেওয়ার যখন সময় হবে তখন দেবে। এখন ওসব ভাবার তোমার দরকার নেই।

 

ওয়াদুদ ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন টেপ লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে একটা টেপ ও স্পুল নিয়ে স্টুডিওর বুথে এলেন। তারপর টেপ চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শোনো’।  আশ্চর্য আমার গান ‘প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’! তিনি আরো যা বললেন তা হলো- স্পেশাল রেকর্ডিং করা অনেক ঝামেলা। তাই বড় জামান সাহেবকে বলে জব্বারের লাইভ প্রোগ্রাম থেকে অব দি রেকর্ড করেছি। তারপর আমি নিজেই এডিট করলাম। জব্বার গেয়েছিল সাত মিনিট আর আমি এডিট করে বানিয়েছি সোয়া চার মিনিট- সাড়ে তিন/পৌনে চার মিনিট করতে পারলে ভালো হতো। এর চেয়ে কিছুতেই কম করা গেল না। তাহলে আর গানটার প্রাণ থাকে না। ওয়াদুদ ভাই নাটক বিভাগে কাজ করতেন কিন্তু সংগীতের ওপরও তার বেশ জ্ঞান ছিল। ওয়াদুদ ভাই একটা তারিখ উল্লেখ করে বললেন, ঐ দিনের অনুরোধের আসরে গানটি বাজবে। তোমার পত্রমিতাকে জানিয়ে দিয়ো। তার নামও ঘোষণা করা হবে অনুরোধকারিনী হিসেবে। আমি ওয়াদুদ ভাইকে বললাম, ওয়াদুদ ভাই, আমি আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব...। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ধন্যবাদের দরকার নেই। তুমিও খুশি, আমিও খুশি। আর কী চাই? ওয়াদুদ ভাই তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

 

প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে গানটি নিয়ে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। সালটি ছিল ১৯৯১। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে প্রকাশিত ‘আজকের সংবাদ বিভাকর’ পত্রিকায় এই গানটি অগ্রন্থিত নজরুলসংগীত হিসেবে পত্রস্থ হয়। আমি জানতে পেরে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের কথা পত্রিকার সম্পাদককে লিখে জানাই। আমার পত্রের উত্তরে বঙ্গীয় সংগীত পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ সুবোধ গঙ্গোপাধ্যায় তাদের ভুল স্বীকার করে যে পত্রটি আমাকে পাঠান তা এখানে হুবহু উল্লেখ করছি :

 

১২ আগস্ট ১৯৯১

প্রিয়বরেষু

আপনার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমাদের পরিষদের পরীক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি আজকের সংবাদ বিভাকর প্রকাশিত হয়ে চলেছে। প্রচুর লেখা আমরা পেয়ে থাকি। ঠিক তেমনভাবেই পেয়েছি ‘প্রদীপের মতো রাত জেগে’ গানটি। সিদ্ধেশ্বর বাবুর সৌজন্য স্বীকৃত ছিল। আমরা কোনদিক দেখিনি। আপনি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে আমাদের তথ্যনিষ্ঠ হতে সাহায্য করলেন- এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় আপনার চিঠি প্রকাশ করতে চেষ্টা করব। সঙ্গে পুরো গান সমেত।

পরবর্তী সংখ্যা পাঠাব। রবীন্দ্র বা নজরুল সংগীত ঘিরে মূল্যবান লেখা পাওয়া আশা করি অসঙ্গত হবে না। আশা করি, আমাদের অনুভূতির বিনিময় সংস্কৃতির জগতকে আরও পল্লবিত করে তুলবে।

প্রীতির অমল আলো....

সুবোধ গঙ্গোপাধ্যায়

কর্মাধ্যক্ষ

বঙ্গীয় সংগীত পরিষদ

[ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট একাডেমি ও রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটি, কলকাতা কর্তৃক স্বীকৃত]

২/১, পঞ্চাননতলা রোড, হাওড়া, ৭১১১০১

 

‘আজকের সংবাদ বিভাকর’ পত্রিকায় গানটি নজরুলসংগীত হিসেবে ছাপা হওয়ায় রীতিমতো অবাকই হয়েছিলাম। আমার রচিত গান নজরুলের রচনা বলে সুধীজনের কাছে গৃহীত হতে পারে এ কি কল্পনা করা যায়? তাও আবার নজরুলসংগীত বিশেষজ্ঞ সিদ্ধেশ্বর বাবুর মতো গুণীজনের বিবেচনায়। নজরুল আমার মানস-কবি হিসেবে আমি সার্থক- এই ধারণাতে আমি আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হলাম। এবং নিশ্চিত হলাম কালের কষ্টিপাথরে আমার কবিতা না টিকলেও আমার গান বাঙালি মননে টিকেও যেতে পারে। কাব্য সাধনা ও অনুশীলন যে আমার বৃথা যায়নি, সেই কথা ভেবে আরো নতুন উদ্যম পেয়ে গেলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’ সেই ওয়াদুদ ভাই রেকর্ডকৃত গানটিই এখনো বেতারে প্রচারিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার বিশেষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিশেষ আয়োজনে গানটি এখনো রেকর্ড করতে পারেনি।

 

এই লেখাটি শেষ করতে গিয়ে আকস্মিক আরেকটি কথা মনে পড়ল। কথাটি না বললে এ গান সম্পর্কিত কথা একটু হলেও অসমাপ্ত থেকে যাবে। সম্ভবত ১৯৭৬ বা ৭৭ সাল হবে, হেনা ভাই [ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল] ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে এসেছিলেন। তার কথা শুনছিলাম আমরা। কথা তো নয় যেন হাস্যরসের মধ্যদিয়ে বাণী প্রদান করছিলেন। তিনি কারো প্রশংসা করলেও তার মধ্যে এমন একটা তির্যক প্রকাশ থাকত যে যার জন্যে করা হলো তিনি শোনার পর খুশি হবেন না দুঃখী হবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না। কিন্তু আমার ব্যাপারে ঘটল সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি বললেন, ফজল-এ-খোদা আপনার ‘সালাম সালাম’ গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে ঠিক কিন্তু ‘প্রদীপের মতো রাত জেগে’ গানটি ঈর্ষণীয়ভাবে আপনার একটি উৎকৃষ্ট রচনা, যা হাজার গান থেকে বেছে নেওয়া যায়। আমি তখন রাজশাহীতে। গানটির সুরও দারুণ মেলোডিয়াস। জব্বার সাহেবের সোনালি কণ্ঠের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেছে। গানটি আমারও মাঝে মাঝে গুনগুন করে গাইতে ভালো লাগে। আপনি আমাকে গানটি দেবেন তো। আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, হেনা ভাই, আপনার একটি গানও আমাকে দিতে হবে তাহলে। তিনি আমার গানের ডায়েরিটা টেনে নিয়ে একটা পুরো গান লিখে দিলেন। গানটির প্রথম কলি- ‘আমি যে তোমার কাছে চৈত্র শেষের ঝরাপাতা,/আমার এ দীর্ঘশ্বাসে হয় না কারো মালা গাঁথা’ আমি ধন্য হয়ে গেলাম।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়