ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

কাঁটামুকুট: মনের মুকুট

খান মো. শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৮, ১২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঁটামুকুট: মনের মুকুট

রাজধানীর মতিঝিলে রাজউক এভিনিউয়ে ৫ নম্বর ভবন প্রিন্টার্স বিল্ডিংয়ের সামনে কাঁটামুকুট (ছবি: খান মো. শাহনেওয়াজ)

খান মো. শাহনেওয়াজ : বাসগৃহই হোক আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভবনই হোক সবুজসজ্জায় উদ্ভিদের সমাহারে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে স্থান করে নিচ্ছে কাঁটামুকুট।

সারা গায়ে কাঁটা ভরা এই গাছটি ধীরে ধীরে বৃক্ষপ্রেমীদের মন কেড়ে নিচ্ছে। বাসগৃহের সামনে, ঘরের বাড়ান্দায়, ভবনের ছাদে কেউ গাছ লাগালে কাঁটামুকুট লাগাতে ভোলেন না। গাঢ় সবুজপত্রী গাছটি চোখ জুড়ানো ফুল দিয়ে থাকে। ফুল ধরে সারাবছর।

কাঁটামুকুট গাছের ইংরেজী নাম ক্রাউন অফ থোর্নস (crown of thorns)। এটা ইউফোরবিয়া (Euphorbia) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একে বলা হয় ইউফোরবিয়া মিলি (Euphorbia milii)। অনেকে একে ক্রাইস্ট থোর্ন (Christ thorn) এমনকি ক্রাইস্ট প্ল্যান্টও (Christ plant)  বলেন। এটা মূলত আমেরিকা, আফ্রিকা ও মাদাগাস্কার অঞ্চলের উদ্ভিদ হলেও বর্তমানে বিশ্বের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কাঁটামুকুট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একে কণ্টমুকুটও বলা হয়। দেশের প্রায় সব নার্সারিতেই পাওয়া যায় এই গাছ।

স্থপতিরা ভবনের সন্মুখ প্রাঙ্গনে বাগানের যে নকশা করেন (Front yard plantation design) তাতে কাঁটামুকুটকে অগ্রাধিকার দেন। ঢাকা নগরীতে অনেক আধুনিক ভবনের সামনে শোভা পায় এই কাঁটামুকুট। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় রাজউক এভিনিউয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছে ৫ নম্বর ভবন প্রিন্টার্স বিল্ডিংয়ের ইয়ার্ড প্ল্যান্টেশন প্লেসে রয়েছে কাঁটামুকুট। ভবনের সামনে সিড়ির পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেসে বেশ কিছু গাঢ় সবুজ কাঁটামুকুট গাছ আর তার ফুল সহজেই নজর কেড়ে নেয়।

মিসৌরি বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্যানতত্ত্ববিদদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইতিহাসে যে তথ্য মেলে তাতে প্রতীয়মান হয়, যীশু খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে এই গাছ মাদাগাস্কার থেকে আরব ভুখণ্ডে এসেছে। গ্রিক চিকিৎসক ইউফোরবাসের প্রতি সম্মান স্বরূপ এই উদ্ভিদ গণের নাম রাখা হয়েছে ইউফোরবিয়া। মাদাগাস্কারের পূর্ব দিকে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত ফরাসি দ্বীপ লা রিইউনিয়নের (প্রাক্তন বোরবন দ্বীপ) গভর্নর ব্যারোঁ মিলিয়ঁস ১৮২১ সালে এই গাছ নিয়ে আসেন ফ্রান্সে মূল ভুখণ্ডে। পরে তার নাম অনুসারে এর নাম রাখা হয় ইউফোরবিয়া মিলি। নেপালে এবং ভারতের কেরালা রাজ্যে এই গাছ পাওয়া যায়। কথিত আছে, কেরালায় যে ইহুদিরা বাস করেন তারা ইসরায়েল থেকে কাঁটামুকুট ভারতে এনেছেন।

আমাদের দেশে অনেকেই কাঁটামুকুটকে ক্যাকটাস বলে ভুল করেন। অনেক নার্সারি একে ক্যাকটাস (Cactus) এমনকি সাকিউলনট উদ্ভিদ (Succulent plant)  বলেও চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওয়াইল্ডস্ক্রিন আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, কাঁটামুকুটের বাহ্যিক রূপ ক্যাকটাসের মত হলেও এটা ক্যাকটাস নয়, এমনকি সাকিউলনটও নয়। 

কাঁটামুকুট বিরূপ পরিবেশে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সক্ষম। বলতে গেলে যত্নআত্তি ছাড়াই ঘরে ও আঙিনায় বেড়ে ওঠে বিধায় শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে এর কদর রয়েছে। এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও প্রচুর। নার্সারিতে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার একটি চারা দুশ থেকে আড়াইশ টাকায় বিক্রি হয়। বেশি উচ্চতার চারার দাম আরও বেশি। এর কাণ্ড বা ডাল ভাঙলে অথবা কেটে ফেললে কিংবা ফুল ছিঁড়লে যে কষ বের হয় তা দুধের মত ধবধবে সাদা। কষ দীর্ঘক্ষণ ধরে ঝরতে থাকে। এই কষ বিষাক্ত এবং ত্বকের সংস্পর্শে এলে জ্বলুনি ও অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। কাঁটামুকুটের কাঁটাও বিষাক্ত। কাঁটা শরীরে ফুটলে বা কাঁটার খোঁচা লাগলে ত্বকে ও মাংসে যন্ত্রণা হয়।

বৃক্ষপ্রেমী, শখের বাগানী ও কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার বায়েজিদ উল্লাহ বলেন, ‘ইউফোরবিয়া মূলত একটি গণ, যার প্রায় সাড়ে ৭ হাজার প্রজাতি আছে। কাঁটামুকুটের বৈচিত্র্য বা প্রকারভেদ (Variety) আছে। এটি বেশ কয়েক রঙের হয়। এর মধ্যে লাল, গোলাপী ও সবুজ  রঙের ফুল বেশি দেখা যায়। কমলা ও হলুদ রঙের কাঁটামুকুটও দেখা যায় তবে তা বিরল।’

বায়েজিদ উল্লাহ বলেন, ‘বীজ থেকে কাঁটামুকুট জন্মানো কঠিন। কারণ, এর বীজ অল্প সময় বাঁচে বা কার্যকর থাকে। বাণিজ্যিকভাবে এর বীজ পাওয়া যায় না। তবে এর কাটিং থেকে বংশবৃদ্ধি (Propagation) করা সহজ ও সুবিধাজনক। যেহেতু এর সারা গায়ে কাঁটা থাকে তাই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ধারালো ছুরি বা সিকেচার (গাছের ডাল কাটার বিশেষ কাচি) দিয়ে এর বাড়তি ডাল কেটে নিতে হয়। নতুন ডাল গজাতে থাকলে বা ডাল বেশি লম্বা হয়ে গেলে এর উপরের দিকে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি কেটে নিতে হয় পাতাসহ। এই কাটিং কেউ কেউ ছত্রাকনাশকে ডুবিয়ে রাখেন ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য। তবে সেটা জরুরী নয় যদি বাগানে ছত্রাক সংক্রমনের ঝুঁকি কম থাকে। কাটিং শুষ্ক হলে মাটিতে রোপন করতে হয়। কাঁটামুকুটের জন্য ৬ ইঞ্চি ও এর ঊর্ধ্বে যে কোন মাপের টব ব্যবহার করা যায়।

পানি সহজেই সরে যায় এমন ঝুরঝুরে মাটিতে কাঁটামুকুট ভালো হয়। গাছের বৃদ্ধির জন্য উজ্জ্বল আলো প্রয়োজন। গাছ লাগানোর পর শুষ্ক মৌসুমে সপ্তাহে একবার পানি দিলেই হয়। বেশি পানি পেলে এর শিকড় পঁচে যেতে পারে। পরিমান মতো নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সার প্রয়োগে বৃদ্ধি ভালো হয়। তবে খুব বেশি মাত্রায় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই গাছে পোকার আক্রমণ খুব বেশি হয় না। তবুও খেয়াল রাখতে হয় মিলিবাগ, মাকড় আর সাদা মাছির ব্যাপারে। এসবের আক্রমন হলে প্রয়োজন অনুসারে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এ জাতীয় গাছের প্রধান শত্রু মূলত ছত্রাক। পর্যাপ্ত আলো বাতাস না পেলে মিলডিউ জাতীয় ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। সেক্ষেত্রে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

গৃহবধু হ্লা মা চিং ও তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ইউ কান থেইনের খুব পছন্দের ফুল কাঁটামুকুট। তারা রাজধানীর মিরপুরে ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটিতে (ডিওএইচএস) নিজেদের বাসভবনের ছাদে লাগিয়েছেন এই গাছ। হ্লা মা চিং জানান, তিনি এক বছর আগে এই ফুলগাছ সংগ্রহ করেছেন। তার ছাদে রয়েছে সাদা, হলুদ এবং গোলাপী-সাদা পাপড়ির কাঁটামুকুট ফুল। এই ফুলে তেমন যত্ন নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শীত মৌসুমে মাসে একবার পানি দিলেই হয়ে যায়। গরমের সময় ৫/৭ দিন পর পর পানি দিয়েছেন। এই ফুলের বাহারি আর উজ্জ্বল রঙ ছাদবাগানে বাড়তি সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।

সরকারি চাকরিজীবী পলি জাহান তার শখের বাগানে রেখেছেন কাঁটামুকুট। তিনি বলেন, ‘কাঁটামুকুট মনকে চাঙা করে তোলে। অবশ্য ফুল আমাকে টানে না যতটা কাঁটায় আকৃষ্ট হই। এর কাঁটাই বেশি ভালো লাগে, আর ফুলটা বাড়তি পাওনা। কাঁটামুকুট আমার এক চিলতে বাগানে শোভা বাড়িয়েছে, এ আমার মনের মুকুট।’

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জানুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়