ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

কারাবাসে কবি

সাযযাদ কাদির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২৪ মে ২০১৫   আপডেট: ১১:৫৮, ২৫ মে ২০২১
কারাবাসে কবি

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজের দমন-নির্যাতন তখন তুঙ্গে। মুক্তিকামী দ্রোহী নজরুলের পক্ষে তাই সম্ভব ছিল না নীরব থাকা। তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজার প্রাক্কালে লিখলেন :

    “আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল-
    স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল?
    দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
    ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,- আসবি কখন সর্বনাশী?
    দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে
    রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?”

এরপর ১৩ অক্টোবর লিখলেন, “ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনও বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি গুটিয়ে বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে।...পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে।”

নজরুলের প্রতি আগে থেকেই রুষ্ট ছিল রাজশক্তি। ‘ধূমকেতু’র দ্রোহাত্মক ভূমিকার কারণে সে রোষ তীব্র হয়ে ওঠে আরও। তারা দায়ের করে রাজদ্রোহ মামলা, জারি করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। নজরুল কলকাতায় ছিলেন না তখন। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি। কলকাতায় নেয়ার পর তাঁকে রাখা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। পরে দাঁড় করানো হয় আসামির কাঠগড়ায়। তাঁর বিচার হয় ১৯২৩ সালের ১৫ই জানুয়ারি। রায় হয় এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডের। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হো’ দেন এ রায়। তিনি নিজেও ছিলেন কবি। তাঁর নামে এখনো একটি সড়ক (‘সুইন হো লেন’) রয়েছে কলকাতায়। এর আগে ‘অনল-প্রবাহ’  কাব্যগ্রন্থ রচনার দায়ে রাজদ্রোহের মামলা হয় ইসমাইল হোসেন শিরাজীর বিরুদ্ধে। তাঁকে দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন এই সুইন হো। একই মামলায় ‘অনল-প্রবাহ’ প্রকাশের দায়ে জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাস কারাদণ্ড হয় (৮ সেপ্টেম্বর, ১৯১০) নব্য ভারত প্রেসের মালিক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী (১৮৫৫-১৯২০)-র।

ওই সুইন হো লেনে আছে কলকাতার কয়েকটি খ্যাতনামা পুস্তক প্রকাশকের দোকান। মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে নজরুল যে লিখিত জবানবন্দি দেন তা স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। তিনি লেখেন :

“আমার উপর অভিযোগ আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে রাজার মুকুট; আর একধারে ‘ধূমকেতু’র শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর একজন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে- রাজার নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে- সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্তকাল ধরে সত্য জাগ্রত ভগবান।... সত্য স্বয়ং প্রকাশ। তাকে কোনও রক্তআঁখি-রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না। আমি সেই চিরন্তন স্বয়ংপ্রকাশের বীণা, যে বীণায় চিরসত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। আমি ভগবানের হাতের বীণা। বীণা ভাঙলেও ভাঙতে পারে, কিন্তু ভগবানকে ভাঙবে কে?...আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হলো রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে অন্যায়, দিনকে রাত বলানো- এ কি সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুস্মান জাগ্রত আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসন-ক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী?” (রচনা : ৭ জানুয়ারি, ১৯২৩; রবিবার - দুপুর)

১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল কবি ছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে রাজনৈতিক বন্দির প্রাপ্য মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে ব্রিটিশ রাজ। সাধারণ কয়েদির পোশাক, বিছানাপত্র ও মানুষের খাওয়ার অযোগ্য খাবার দেওয়া হয় কবিকে। নজরুলের কারাদণ্ডের খবর পেয়ে ব্যথিত হন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নামে উৎসর্গ করেন নতুন গীতিনাট্য ‘বসন্ত’। উৎসর্গপত্রে লেখেন ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম, স্নেহভাজনেষু’। অনুবাদ-সাহিত্যিক ও ‘কল্লোল’-যুগের অগ্রদূত পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৯৩-১৯৭৪) বইটি রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে নজরুলের কাছে পৌঁছে দেন রক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে কারাগারের পাঁচিল ডিঙিয়ে।

চার মাস পর নজরুলকে স্থানান্তর করা হয় হুগলি জেলে। সেখানে সাধারণ কয়েদির মতো কোমরে দড়ি বেঁধে নেওয়া হয় তাঁকে। এর জবাব ভালোভাবেই দেন তিনি। আলিপুর জেলে থাকতে যেসব গান ও কবিতা লিখেছিলেন তা উজাড় করে দেন সেখানে। প্রথমেই জেলে ঢোকেন ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ হাঁক দিয়ে। এ গান গাওয়া ও কবিতা আবৃত্তি চরম ধৃষ্টতা মনে করত জেলের সুপার মাসচিন। রাজনৈতিক বন্দিদের নানাভাবে উৎপীড়ন করায় বিশেষ উৎসাহী ছিল সে। নজরুল তার নাম দেন ‘হার্স টোন’। কারণ অত্যন্ত কর্কশ ছিল মাসচিনের কণ্ঠস্বর। তাকে উদ্দেশ্য করেই তিনি রবীন্দ্রনাথের গান প্যারোডি করে লেখেন :

“তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে
আমারই গান তোমারই ধ্যান তুমি ধন্য ধন্য হে...”

এ গান শুনে খেপে যেত সুপার। কিন্তু গানের ব্যঙ্গ তো আইনের আওতায় পড়ে না, তাই নিষ্ফল আক্রোশে তার ক্ষোভ-আক্রোশই হতো সার। নজরুলের গানে সাড়া দিয়ে সুর মেলাত কয়েদিরা, তাদের উদ্দীপ্ত করতে তিনি তাই লেখেন সেই বিখ্যাত গান ও কবিতা :
    
    “কারার ওই লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত জমাট
    শিকলপূজার পাষাণ-বেদি
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি”
    
এরপর  বন্দিদের পত্রিকা পড়া, আঙিনায় বেড়ানো  বন্ধ করে দেয় মাসচিন। নজরুলকে রাখা হয়  ৬ ফুট বাই ৪ ফুট এক অন্ধকার সেলে। তাই বলে বন্ধ হয়নি তাঁর গান গাওয়া। হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় তিনি গাইতেন,

    “(এই) শিকলপরা ছল মোদের এ শিকলপরা ছল,
    (এই) শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল
    তোমার বন্দী কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়,
    ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন ভয়!
    এই বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে করবো মোরা জয়,
    এই শিকল বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল।...”
    
কয়েদিদের প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়ে তখন পালন করানো হতো ‘সরকার সেলাম’ নামের এক অপমানজনক নিষ্ঠুর প্রথা। এর প্রতিবাদ করেন নজরুল ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দি। কারাগারের জমাদার ‘সরকার সেলাম’ ঘোষণা করতেই তাঁরা ঘৃণা জানাতেন সামনের দিকে পা তুলে। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে মারামারি বেঁধে যেত রক্ষীদের। অত্যাচার চরমে উঠলে নজরুল ও রাজনৈতিক বন্দিরা শুরু করেন অনশন ধর্মঘট। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সারা দেশ। রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠান দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে, ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস্ ইউ।’

সরকারের কারসাজিতে সে টেলিগ্রাম ‘ঠিকানা ভুল’ ছাপ নিয়ে ফিরে যায় তাঁর কাছে। অনশনের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েন নজরুল, সারা দেশ থেকে দাবি ওঠে প্রতিকারের। শেষে রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে সরকার বাধ্য হয় বন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণের প্রতিশ্রুতি দিতে। কিন্তু কেবল প্রতিশ্রুতিতে ভোলেন না বন্দিরা, অনশন অব্যাহত রাখেন তাঁরা। দিন ছাড়িয়ে সপ্তাহ ছাড়িয়ে মাস ছাড়িয়ে যায় ধর্মঘট। কর্তৃপক্ষের হুমকি, জোরজুলুম কোনো কিছুই টলাতে পারে না নজরুলকে। চুরুলিয়া থেকে ছুটে আসেন কবি’র মা জাহেদা খাতুন। কিন্তু তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয় না পুত্রের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি নজরুলের।

শিবপুর থেকে অনশন ভাঙাতে হুগলি জেলের গেটে ছুটে যান শরৎচন্দ্র। তাঁকেও ফিরিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। ২১ মে কলকাতার গোলদিঘিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায়  দেখানো হয় বিক্ষোভ। সেখানে বক্তব্য রাখেন হেমন্ত সরকার, অতুল সেন, মৃণালকান্তি বসু, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ রাজনৈতিক নেতা ও শিল্পী-সাহিত্যিক। সভায় প্রস্তাব নেওয়া হয়- ‘কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবে নজরুল যাতে অনশন ভঙ্গ করেন।’

শেষ পর্যন্ত টনক নড়ে সরকারের। ৩৯ দিন অনশনের পর কারা-ব্যবস্থা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তখন বিরজাসুন্দরী দেবী (নজরুল মা বলে ডাকতেন তাঁকে), হুগলির রাজনৈতিক কর্মী সিরাজুল হক, হামিদুল হক, বিজয় মোদক, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে নিয়ে জেলগেটে যান অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানাতে। সরকারি প্রতিশ্রুতি, রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ এবং সঙ্গী বন্দিদের অনুমোদন নিয়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাত থেকে ফলের রস পান করে অনশন প্রত্যাহার করেন নজরুল।

জুন মাসে নজরুলকে পাঠানো হয় বহরমপুর জেলে। সেখানে তাঁকে বিশেষ শ্রেণির বন্দি হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ থাকলেও পালন করা হয়নি তা। সেখানে সাধারণ কয়েদির পোশাকই পরতে হয় তাঁকে। তবে জেলের সুপার বসন্ত ভৌমিক সহানুভূতিশীল থাকায় প্রথম দিকে তেমন অসুবিধা হয়নি নজরুলের। তাঁর জন্য একটি হারমোনিয়ামের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। কারাগারে থাকতে লেখা নজরুলের সকল গান ও কবিতা বাইরে পাচার হয়ে যেত গোপন পথে। সেগুলি পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। বহরমপুরে নজরুলের সহবন্দিদের মধ্যে ছিলেন পূর্ণ দাস, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখ। সে কারাবাসের বিশদ বিবরণ আছে এঁদের স্মৃতিকথায়। ১৫ ডিসেম্বর ওই জেল থেকেই নজরুল মুক্তি পান কারাদণ্ড শেষে।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়