ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মেধা ও মগজের পচন যখন পাঠ্যক্রমে

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ৯ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেধা ও মগজের পচন যখন পাঠ্যক্রমে

|| অজয় দাশগুপ্ত ||

মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পর শিশুদের আমরা কী শেখাব বা কী তারা শিখবে এ নিয়ে এখন দেশ মাথায় তুলছি আমরা। পাঠ্যক্রমের নতুন সূচি প্রকাশিত হবার পর আমাদের কারো কারো টনক নড়েছে। দেশের সুশীল সমাজের মেজাজ হঠাৎ চড়ে গেছে। তারা যেন জানতেনই না এমনটা হতে পারে। সমাজ ও দেশের সবদিকে যখন আধা-ধর্ম আর আধা-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গোঁজামিলের কাজকারবার তখন আমরা কেন আশা করব শিশুদের বই বা পাঠ্যক্রম হবে সত্য সুন্দর আর প্রগতিময়?

যারা এগুলোর দায়িত্বে তারা কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চান? না চাইলেও, তারা কি তা করতে পারবে? দেশজুড়ে চলছে নিয়মহীনতার এক আদিপর্ব। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কার কথা কে শোনে? কে মানে কার আদেশ? আওয়ামী লীগের ভেতরেই পচন ধরে আছে। বিএনপি আর জামায়াত লড়াই করছে মরিয়া হয়ে। দেশের মানুষের মনে পাকিস্তানের জন্য প্রেম আর ভারত তথা হিন্দুবিদ্বেষ চরমে। সংখ্যাগুরুদের হারানোর এতো ভয় আর কোনো জাতিতে দেখিনি। যাদের দখলে সবকিছু, যারা জনঅনুপাতে ৯০ শতাংশ, তারা কেন এমন মরিয়া? কী তারা হারাতে পারে বা কোথায় তাদের ভয়? আজ এই ভয় এতটাই বিস্তৃত হয়ে জেঁকে বসেছে যে, অজান্তে শিশুদেরও অন্য পথে ঠেলে দেওয়ার কাজে তারা নেমে পড়েছে। সরকার জানুক, না জানুক যেসব অশুভ পরিবর্তন ঘটেছে তার পেছনে আছে সাম্প্রদায়িকতা। সেটা এমন এক জায়গায় এসে গেছে আপনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যাই করেন না কেন আগে আপনাকে এগুলো মানতে হবে। আর একবার তা করতে পারলে বা হয়ে গেলে, কারো সাধ্য নেই আবার তাকে অসাম্প্রদায়িকতায় ফিরিয়ে নিতে পারে। তার মানে একাজ হয়েছে বুঝে-শুনে পরিকল্পনামাফিক।

সামাজিক মিডিয়ায় পাঠ্যবই নিয়ে ভীষণ হৈ চৈ বেঁধে গেছে। ভাবখানা এই, আমরা মনে করেছিলাম লেখা থাকবে ‘ক’-তে কমিউনিস্ট ‘খ’-তে খন্দকার। এই পাঠ্যবই কবে কখন দেশ ও জাতির চাহিদা মিটিয়েছিল? কখন ছিল সবার বা সর্বজনীন? যখন বাঙালি হিন্দুর হাতে ছিল তখন ‘ঋ’-তে ঋষি, যখন ধর্মান্ধদের হাতে তখন ‘ও’-তে ওড়না। এই দুটোর কোনোটাই পরিত্যাজ্য বা খারাপ কিছু না। ঋষি যেমন পূজনীয়, ওড়নাও আদরণীয়। কিন্তু দুটোর ব্যবহার বা প্রয়োগ ছিল স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আজ এতদিন পর আমাদের দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দেশ শাসনে, তখন পাঠ্য বইয়ে কী যোগ হবে, কী হবে না সেটাই আসলে আমাদের ভাবনার বিষয়।

যে মন্ত্রী পাঠ্যবই বিতরণকালে হাসি হাসি মুখে ছবি তোলেন, মিডিয়ায় সেসব ছবি দেখে আমরা আশান্বিত হই, তিনি এখন কোথায়? আওয়ামী লীগের এই আমলে যে কজন মন্ত্রী লাইম লাইটে আছেন, তারা প্রায় সকলেই বাম ঘরানার। পর্যটন, তথ্য ঘিরে কত গুজব কত কত ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর বিমানে আগুন ধরে যায়। কোনোটা আবার কতদূর উড়ে আবার ফিরে আসে। এসব কিছুর পরও আমরা আসল তথ্য জানতে পারি না। শুধু দেখি কেউ রিমান্ডে যায় আর কারো চাকরি নট হয়। কিন্তু সেটা তো উত্তর হতে পারে না। এবার যখন পাঠ্যবই নিয়ে তুলকালাম, আমরা কি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে আদৌ কিছু শুনতে পাবো? তার কথা বলছি এই কারণে তিনি একদা বাম এখন আওয়ামী লীগার। তার যৌবন ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ছিল কাল মার্ক্স আর লেনিনের প্রভাব। সেই তিনি কীভাবে এগুলো হজম করছেন? আমরা কি বিশ্বাস করবো এই কাজ বিচ্ছিন্ন কিছু? না সেটা সম্ভব?

সামাজিক মিডিয়ায় যা দেখছি তাতে এটা স্পষ্ট, পুরো বিষয়টি এক ধরনের হটকারিতা। না ধর্ম না প্রগতি এই মাঝামাঝি জায়গাটা কারো জন্য সুখের হতে পারে না। সরকার যা বলে যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাসনে আছে তার সাথে এর মৌলিক তফাৎ আছে। আমাদের দেশে এখনো লড়াইটা সাতচল্লিশের ওধারে রয়ে গেছে। ধমর্প্রাণ নামে পরিচিত মানুষেরা আদৌ জানেনই না কে করছে, কী করছে বা কেন করছে! ও-তে ওড়না বা অ-তে অজু লিখলেই কি দেশের মানুষ ধার্মিক হয়ে যাবে? না তাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটবে? আসলে এর পেছনেও কাজ করছে এক ধরনের রাজনীতি। এবং সেটাই উদ্বেগের বিষয়। নিন্দুকেরা বলছে, এগুলোর পেছনে নাকি চট্টগ্রামের একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারার নির্দেশ কাজ করেছে। করুক বা না করুক, এটা বোঝা যায় সরকার এদের ভয় পায়। সমীহ করে চলে। খেয়াল করে দেখবেন, আসলে শাপলার ঘটনার পরপর এদেশের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তার মাশুল দিচ্ছে জাতি। বল প্রয়োগে তাদের হটানো গেলেও পরে রাজনৈতিক মোকাবেলার বিষয়টা একেবারেই করা হয়নি। বরং ক্রমে নতজানু হয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুখের কথায় যে তাকে বাঁচানো যাবে না সেটা আরো একবার স্পষ্ট হলো।

পাঠ্য বইয়ে কী যোগ হলো আর কী বাদ গেল তার হিসাব করলে বুঝতে কষ্ট হবে না মূলত সাম্প্রদায়িকতাই এখন চালিকা শক্তি। দেশ ও জাতির মগজে যে পচন তাকে লালন করে শরীর ঠিক রাখার ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর সেটাই প্রমাণ হলো আবার। সুশীল থেকে আমজনতা সবার ভেতর এখন দুটো বিষয় কাজ করে। একদিকে তার স্বর্গ নরকের ভয়, আরেকদিকে জীবন উপভোগের তাগিদ। না আমরা ইরানের মতো, সিরিয়ার মতো বা আফগানিস্তানের মতো একপেশে হতে পারব না, আমাদের এখনও সাহস আছে উদারতাকে আলিঙ্গন করার। এমন উভচর বা দু’মুখো চরিত্রের কারণেই পাঠ্যবইও আজ গোলমেলে। কুসুমকুমারী দাশের কবিতা পরির্বতন করার দূঃসাহস আর যা খুশি তা ঢোকানোর এই অপচেষ্টায় সবচেয়ে বাধাগ্রস্ত হবে শিশুরা। যারা এদেশের প্রাণ। এ জাতির ভবিষ্যৎ। মূলত তাদের প্রতি যে আমাদের আসলে কোনো টান নেই বা দায় দায়িত্ব নেই এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। যাদের আমরা বাংলাদেশকে ‘বাংলাস্তান’ বানাতে চেয়েছিল বলে গালমন্দ করি, রাজনীতিতে দূরে রাখতে চাই, ঘৃণা করি, তারাও এ কাজ করেনি। জানি না এর অবসান কোথায়? তবে আরো একবার প্রমাণ হলো, এখন আর কোনো সম্প্রদায় বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি কারো কোনো মমতা বা মাথাব্যথা নেই। যা আছে তার নাম জোড়াতালি। জগাখিচুড়ি। এর ভেতর দিয়ে যাওয়া শিশুরা কী শিখবে কীভাবে বড় হবে, সেটা ভাবতেই ভয় করে। আদৌ কি এর কোনো প্রতিকার বা বিহিত আছে কোথাও?

বাংলাদেশের এই পাঠ্যক্রম বা পাঠদানের বিষয়ে যে পরিবর্তন, আমার ধারণা এটাই আগামীর রূপরেখা। মুখে আমরা যতই বলি বা যাই বলি না কেন, আসলে আমাদের সামাজিকতা বা সোশ্যাল জগত এখন পুরোই সাম্প্রদায়িক। তার বাইরে যত জৌলুস কিংবা আধুনিকতা, ভেতরে ততটাই অন্ধকার। এই আঁধার দূর করার সংস্কৃতি বা শিল্প আজ ম্রিয়মান। মানুষের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে। ভয় ও অনিশ্চয়তার বেড়াজালে তাকে পঙ্গু ও দূর্বল করে এখন শিশু মনোজগতে হানা দিয়েছে অনিয়ম। আমরা কি এখান থেকে বেরুতে পারবো আদৌ? না এভাবেই আরেক ধরনের জাতি ও দেশের দিকে এগুতে থাকব? সময়ের কাছে এর জবাব আছে। আপাতত এর বাইরে বলারও নেই কিছু।

 

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়