ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শব্দ ও কাঁচি || সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ১ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শব্দ ও কাঁচি || সেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন

মনতাজের এখন ভীষণ কষ্ট। নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যে যন্ত্রণা, তেমন অবস্থা এখন ওর। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে টিনের চালে সে শব্দ শুনেছে ও। কিন্তু বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে অন্য একটা শব্দও ও পেয়েছে- কারো বুক থেকে গোঙানির শব্দ উঠে আসার মতো সে শব্দ। ওর বুক তোলপাড় করে- এই শব্দের অনুধাবন ও মেনে নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে নাকি ওর মগজ কাটছে ইঁদুর? নাকি কলজের ভেতর বিষ ঢেলে দিল কেউটে। ও বুঝতে পারে না। বিছানায় উঠে বসে। শব্দটি যে চেনা এই অস্বস্তি ও তাড়াতে চায়। ওর পূর্বপুরুষেরা সবাই এই শব্দটি চিনত। ও জানে না তখন ওরা এমন বিছানায় উঠে বসে থাকত কি না? গভীর রাতে শব্দ হলে ওর পিতৃপুরুষরা কী করত তা জানে না মনতাজ। দিনের বেলা এ শব্দ হলে ওর দাদা বাবা কী করেছে, তা দেখেছে ও। ছেলেবেলার কথা পরিষ্কার মনে পড়ে। একবার খাড়া দুপুরে এই শব্দ শুনে বলদের লেজ চেপে ধরে মাঠজুড়ে দৌড়েছিল ওর দাদা। ওরা, বালকেরা হাততালি দিয়ে মজা করছিল দাদার সঙ্গে। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে গেলে দাদা বলদটাকে ছেড়ে আলের ওপর চিৎপাত শুয়ে চিৎকার করছিল, আসুক বান, আসুক মহামারি, ধুয়েমুছে সাফ করে নিয়ে যাক আমার এই শরীর। একটা ভূমিকম্পও উঠুক। তলিয়ে যাক আমার এই শরীর।

ওরা, বালকেরা, দাদার এই বিলাপ শুনতে চায়নি। ওরা নিজেরা বলদটার লেজ ধরে মাঠে ছোটাছুটি করছিল। কী ভীষণ মজার খেলা। যেন এই খেলা জীবনে একবারই খেলা যায়। ওদের শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছিল। মাথার ওপর আষাঢ়ের সূর্য ঝলসায়। দূরে দিল্লির আখড়ার লাল দালানগুলো থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসে। ওরা তখন বলদটিকে ছেড়ে দিয়ে আখড়ার দিকে চলে যায়। ওখানে ওরা বৈষ্ণবদের গান শুনবে। এমনই ছিল ওর ছেলেবেলা। মাঠের ওপর পড়ে থাকা দাদার শরীর ওদের একটুও ভাবায়নি। এমনকি ঐ শব্দ নিয়েও ওদের কোনো চিন্তা ছিল না। কৈশোরে বাবাকে দেখেছে বুক চাপড়াতে, আর্তনাদ করতে, ছোটাছুটি করতে- তখন ও বুঝতে শিখেছে যে ঐ শব্দ বুকের ভেতর শূন্য থালা ঠনঠনিয়ে বাজায়। এখন এই মুহূর্তে শূন্য কাঁসার থালার ঝনঝন শব্দ ওর চারপাশ মাতিয়ে তুলেছে। সেই শব্দে ও বিমূঢ় হয়ে যাচ্ছে, ওর কষ্ট বাড়ছে।

পাশে ভাদুলি নিঃসাড় ঘুমুচ্ছে। ওকে ডেকে তোলা দরকার কি না, মনতাজ বুঝতে পারে না। ও ভাদুলির পিঠে হাত রাখে। ঘামে ভিজে চ্যাটচ্যাট করছে পিঠ। তারওপর ঘামাচি-ভরা খসখসে চামড়া। মনতাজ বিরক্ত হয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ও পা গুটিয়ে বসে। মনে হয় কাঁথা বালিশ থেকে দুর্গন্ধ আসছে। ভাদুলি ঠিকমতো কাচে না। নোংরা অলস স্ত্রীলোক। অভ্যেস পাড়া বেড়ানো আর যত দুনিয়ার গালগল্প। কথা বলতে শুরু করলে গলগলিয়ে বলতে থাকে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে তেড়ে ওঠে মনতাজ। ভাদুলি তখন ড্যাবড্যাবে চোখে তাকায়। বোকার মতো বলে, আমি কী করেছি? কথা বলা কি দোষ?

শুধু দোষ নয়, কথা বলা যে কখনো অপরাধ হয়ে যায় সেটা মনতাজ ভাদুলিকে বোঝাতে পারে না। এই না-বোঝাটুকু পর মুহূর্তে ভালো লাগে মনতাজের। ভাদুলির ওপর থেকে সব রাগ পড়ে যায় ওর। ও আবার ভাদুলির গায়ে হাত রাখে, ও এই মুহূর্তে কিছু স্বস্তি এবং উত্তাপ চায়। ওর নিজের ওপর যে রাগ বাড়ছে সেটা থেকে ও মুক্তি চায়। ভাদুলির পিঠের খসখসে চামড়া নরম হয়ে আসে ওর হাতের তালুর নিচে। চামড়ার স্পর্শে ঐ শব্দ ওর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। একটা দূরাগত ধ্বনি হলে ওর কিছুটা স্বস্তি বাড়ে। ও আরো স্বস্তি বাড়ানোর জন্য ভাদুলির কথা ভাবতে চায়। ভাদুলি বোকা ও সরল মেয়ে। বিয়ের ছয় বছরের মধ্যে ওদের কোনো সন্তান হয়নি। ভাদুলি ধরে নিয়েছে ও নিজে বাঁজা। সেই অপরাধের গ্লানি ওকে মাঝে মাঝে মরমে মারে। কখনো ও একলা ঘরে শুনশুনিয়ে কাঁদে।
ডাক্তারসাব গ্রামের সবাইরে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য পিল দেন। আমাদের তো কিছু লাগে না। তাও বাচ্চা হয় না কেন?
তোদের দুজনকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
দুজনের কেন? দোষ তো মেয়েমানুষের থাকে ডাক্তার সাব।
কে বলেছে? সব বাজে কথা। দুজনকেই দেখতে হবে।
দুজনের কথা শুনে মনতাজের বুকের ভেতর ভয় ঢোকে। প্রবল, ভয়াবহ শব্দটা ওর মাথা আচ্ছন্ন করে ফেলে। ও ভাদুলিকে কিছু বলতে পারে না। যদি অপরাধটা ওর হয়? তাহলে পৌরুষের লজ্জা ও লুকাবে কী করে? ও প্রচণ্ড মমতায় ভাদুলির পিঠে হাত বুলোতে থাকে। ভাদুলির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
কিছু না।
জেগে আছো কেন?
এমনি। তুমি ঘুমাও।
রাত কত?
জানি না।
মোরগে বাঁক দিয়েছে?
জানি না।
মনে হয় বৃষ্টি পড়ে?
হ্যাঁ।
টাপুরটুপুর বৃষ্টি। নদে এলো বান।

বলতে বলতে ভাদুলি আবার ঘুমিয়ে যায়। মনতাজের কষ্ট বাড়ে- বানের তোড়ের মতো কষ্ট। ও ভাদুলির পিঠ থেকে হাত সরাতে পারে না। মনে হয় পিঠটা একটা আশ্রয়, এই মুহূর্তে ওর একটা আশ্রয় দরকার, আশ্রয় ভেঙে গেলে ও একদম তলিয়ে যাবে। কোন অতল গহ্বরে তলাবে তা ও জানে না। ও বুঝতে পারে না যে ও কেন ভাদুলিকে বলতে পারছে না দুজনের ডাক্তারি পরীক্ষার কথা? কেন চায় যে ভাদুলি বোকা এবং সরলই থাকে। যদি অপরাধ ওর হয়? উহ্ না। মনতাজ ভাদুলির গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। শুনতে পায় সেই শব্দটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এগিয়ে আসছে, কাছে, আরো কাছে। ও ভাদুলির পিঠে নিজেকে চেপে ধরে। ভাদুলির পিঠটা বিশাল হাওর এলাকা হয়ে যায়- ওর মনে কৈশোরের কীর্তনের সুর ভেসে ওঠে, যে সুর শুনতে শুনতে ও যুবক হয়েছিল। ভালোবাসা বুঝতে শিখেছিল, নারীর শরীর চিনেছিল। যে সুর হাওরের ফাঁকা মাঠের ওপর দিয়ে বাতাসের সঙ্গে বয়ে আসত।

দিল্লির আখড়ার চারদিকে ঘন হিজল বন ছিল। বর্ষায় হাওর ডুবে গেলে গাছগুলো চুপচাপ, দাঁড়িয়ে থাকত। জলে ভিজে থেকেও ওগুলোর ক্ষতি হতো না। চিকন সবুজ সাপ পেঁচিয়ে থাকত হিজলের ডালে ডালে। গাছের ডালে সাপ দেখতে ভালো লাগত মনতাজের। মাঠে গরু ছেড়ে দিয়ে এই বনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত সাপ দেখার জন্য। পাতার সঙ্গে মিশে গাছের পাতা হয় যেত সাপগুলো। রঙের এই মেশামেশি ওর কাছে ভয়ংকর মনে হতো। ছোটবেলা ও লুকিয়ে লুকিয়ে মিশে থাকাটাকে ঘৃণা করতে শিখেছিল। এখন ও ভাদুলির পিঠের সঙ্গে মিশে আছে। এই মিশে থাকার মধ্যে রঙের বৈপরীত্য আছে। ইচ্ছে করলেও রং এক হয় না। এই নিবিড় হয়ে মিশে থাকতে পারল কৈ? এত শুধু দিনযাপন। সুখেদুঃখে সময় কাটানো- বয়স বাড়ানো। না এটা শুধু মিশে থাকা নয়। মনতাজ ভাদুলিকে ছেড়ে পাশ ফিরে শোয়।
ভাদুলি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে বলে, কী হলো ঘুম আসে না কেন তোমার?
মনতাজের রাগ হয়। জবাব দেয় না।
ভাদুলি ওর গায়ে ঠেলা দেয়, খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?
হ্যাঁ।
কী স্বপ্ন?
সাপ।
তোমাকে কামড়াতে আসছে?
না, কামড়াতে আসেনি। কামড় দিয়ে বিষ ফেলেছে আমার শরীরে। শরীর আমার নীল হয়ে গেছে।
উহ কী যে বলো। উঠে বসে ভাদুলি। শুনেছি সাপ স্বপ্ন দেখলে শত্রুতা বাড়ে। মাগো শত্রুতা বাড়লে আমাদের কী হবে?
চুপ কর।
মনতাজ ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।
রাগ কেন?
না রাগবে না। রাত দুপুরে প্যানপ্যানানি শুনতে হবে।

ভাদুলি কথা না বলে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। মনতাজের মনে হয় এ জন্য ও ডাক্তারি পরীক্ষায় যেতে পারে না। যদি প্রমাণ হয় যে অপরাধ ওর, তাহলে ভাদুলির ওপর কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে যাবে। ভাদুলি বাঁকা চোখে তাকাবে। বলবে, তুমি পুরুষ না ছাতু? অসহ্য। আর তার চেয়ে সাপের মতো রং মিলিয়ে এই মেশামেশিটুকুই থাক। কৈশোরে যে ঘৃণা জন্মেছিল, সেটা এখন এই মধ্য বয়সে ঝরে পড়ে। কবেই যে ঝরে গেছে ও টেরই পায় না। এর নামই কি বাঁচা? হয়তো তাই। এভাবেই বাঁচতে হয়। কিন্তু বাঁচতে পারছে কৈ? ঐ যে প্রবল শব্দ আসছে। ধুয়েমুছে নিয়ে যাবে বাঁচার উপাদান। সাপের মতো রং মিলিয়েও তো বেঁচে থাকা যায় না। মনতাজ চৌকি থেকে নিচে নামে। দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেয়। বৃষ্টি ছেড়ে গেছে। কিন্তু জোর বাতাস বইছে। বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে ওর নাকেমুখে। ওকে ফেলে দিতে চায়। সেই শব্দটা যেন ওর কানের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ও দরজা ছেড়ে দিয়ে দুহাতে কান চেপে ধরে।
প্রবল বাতাস ঘরে ঢুকে পড়ে। এলোমেলো হয়ে যায় ঘরের জিনিসপত্র। টিনের থালা-গ্লাস ঝনঝন শব্দে উল্টে পড়ে। উড়ে যায় মশারি। ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নামে ভাদুলি।
কী হয়েছে? ওগো কী হয়েছে?
পরক্ষণে শব্দটা শুনে চিৎকার করে ওঠে ও, আল্লাহ কী হবে গো? পাহাড়ি ঢল নেমেছে যে। ভেসে গেল ধান। হায় আল্লারে।
ভাদুলির তীব্র আর্তনাদ মনতাজের কলজে ফুটো করে ঢুকে যায়।

এতক্ষণ ধরে এই আর্তনাদ বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ও নিজেকে পেষণ করছিল। থেঁতলে আছে ওর শরীর। ও ভাদুলির মতো চিৎকার করতে পারছে না। স্থবির হয়ে আছে। ভাদুলি দুহাতে দরজা বন্ধ করতে চায়। মনতাজ শক্ত হাতে বাধা দেয়। ভাদুলি চেঁচিয়ে বলে, ঘরের জিনিসগুলো যে উড়েপুড়ে গেল?
যাক। সব ভেঙেচুরে যাক। কিইবা আছে আর কিইবা থাকবে। ভাদুলি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে, পাগল হলে কি চলে?
আকস্মিক ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মনতাজ। ভাদুলি ঘরের দরজা বন্ধ করে। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। মনতাজ মাটির উপর হতবাক বসে আছে। একটু পর ভাদুলি কাছে এসে বসে। দুজনে পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে, বিয়ের পরপর দুজনে যেমন খুব কাছাকাছি থাকতে আনন্দ পেত, তেমন কাছাকাছি হতে চায় দুজনে। কেননা, এখন একটা গভীর আর্তনাদের সময় দুজনের। এত কাছে যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, কিন্তু মনে হয় ইচ্ছে করলেই সবকিছু হয় না, সব আকাক্সক্ষা পূরণ হয় না। ভাদুলির হাত কুঁকড়ে থাকে, তা মনতাজের গলা জড়িয়ে ধরতে পারে না। মনতাজের হাত স্থবির, দুহাত ইচ্ছে করলেই ভাদুলিকে বুকে টেনে নিতে পারে না।
ওরা কিছুতেই আর্তনাদের সময়টা পার হতে পারে না। মনে হয় আনন্দের সময়টা ওদের জীবনে থেকে ঝোড়ো বাতাসে উড়ে গেছে। দুজনের গভীর ইচ্ছে আজ দুজনের মধ্যে নেই। কতক্ষণ এভাবে কেটে যায় ওরা জানে না।
একসময়ে ভাদুলি আস্তে আস্তে বিড়বিড়িয়ে বলে, ধান পাকার আর কত দিন বাকি ছিল?
মনতাজ কিছুই শুনতে পায়নি তবু উত্তর দেয়, আরো বিশ-বাইশ দিন।
সকালের মধ্যেই সব ধান পানির তলে তলিয়ে যাবে।
এ বছর একটা চালও ঘরে উঠবে না।
সারা বছর কষ্ট করতে হবে।
দিনমজুরির জন্য যেতে হবে শহরে।
হাওর এমন বিশ্বাসঘাতক।
কত কাল পর এমন পাহাড়ি ঢল আবার নামল?
বছর পাঁচেক।
হাওর এমন বিশ্বাসঘাতক।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ভাদুলি। বলে, মানুষের চাইতে বেশি কী?
চুপ কর।

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার


মনতাজ ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। ভাদুলি হাসতে হাসতে মনতাজের গলা জড়িয়ে ধরে। মনতাজ দুহাতে ভাদুলির হাত ঠেলে ফেলে দেয়। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। চারদিকের ঘর থেকে লোকজন সব বেরিয়ে এসেছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক। কাঁচি নিয়ে ছুটছে খেতের দিকে। কাঁচা ধান কেটে আনতে হবে। মানুষের খাবার না হোক ওগুলো শুকনো বিচালি হবে। বিচালি গাই-বলদের খাবার হবে। হাওর সমুদ্র হয়ে গেলে পুরো বর্ষা ছাগল-মোষ-গরু-ভেড়ার কষ্ট হবে। ওদের চরে বেড়ানোর কোনো মাঠ থাকবে না, কোনো ঘাস থাকবে না পেট ভরে খেয়ে জাবর কাটার জন্য। মাঠে কোনো জায়গা থাকবে না ঘরবসতির জন্য। টিলাগুলো সব ঘরবাড়ি গাছ-পালা নিয়ে দ্বীপের মতো হয়ে যাবে। লঞ্চে কুলিয়ারচর বা চিমটা বন্দর যাবার সময়ে দূরের গ্রামগুলোকে সবুজের সীমানার মতো মনে হবে।

নারী-পুরুষ আর্তনাদ করছে, ছোটাছুটি করছে। মনতাজ কেমন নির্বিকার হয়ে যায়। ধান কাটার আগেই আগাম বর্ষায় হাওর ভেসে গেলে কী করতে হবে তা মনতাজের জানা আছে, কিন্তু এখন এই মুহূর্তে এই জানাটা ওকে তেমন সহায়তা করছে না। ও অন্যদের মতো কাঁচি হাতে ছুটতে পারছে না। মানুষের আর্তনাদ ওকে বিহ্বল করছে। ও বুকের ভেতর প্রবল ব্যাকুলতা অনুভব করে। বুকের মধ্যে ভেসে ওঠে সমুদ্রের মতো হাওরের জলে ভরা পূর্ণিমার জ্যোস্না। টলটলে জলে টলটল করে চাঁদনি রাতের আলো। ও নৌকা বেয়ে চলে যায় দূরে কোথাও- বানিয়াচং, বিথঙ্গল কিংবা সোজা হবিগঞ্জে। ছাড়িয়ে যায় দিল্লির আখড়ার হিজল বন, বৈষ্ণবদের আখড়া, ঘাগড়ার শানবাঁধানো ঘাট, যে ঘাট পানির ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। চাঁদনি রাতে ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে। এ বছরই ফসল পাকার আগে বর্ষার পানি এসে ভরে গেল হাওর। যে বছর পাকা ফসল ঘরে ওঠে তখন সমুদ্র হয়ে যাওয়া হাওরের মৃদু স্রোতের কলকল ধ্বনি প্রবাহিত হয় বুকের ভেতরে- সে বছর রাত জেগে পালাগান শুনতে কোনো ক্লান্তি লাগে না। এইসব ভাবনার মাঝে গফুর এসে ধাক্কা দেয় ওকে, কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে রইলি যে? নামবি না?
মনতাজ ওকে দেখে। স্থলিত কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ, নামা তো উচিত। এখন কাঁচা ধানগুলো উঠিয়ে আনা ছাড়া আমরা আর কীই-বা করতে পারি।
গফুর রেগে গিয়ে বলে, তুই এমন ম্যানম্যান করছিস কেন?
মনতাজ উত্তর দেয় না। ও বোকার মতো হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ও অনেক দূরে যেতে চায়। ওর পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে গফুর, হাবিব, দেলোয়ার, আরো অনেকে, গাঁয়ের সবাই। ওর সামনে ভেসে ওঠে শহরের রাস্তা, দিনমজুরি- স্টেশনে ঘুমানো কিংবা কারো সঙ্গে বস্তির ঘরে ভাগাভাগি এবং রাস্তার ধারে ইটের ওপর বসে ভাত খাওয়া। ওর গা গুলিয়ে ওঠে। অসহ্য লাগে ঐসব দিনগুলো। শুধু একটু পেট ভরানোর জন্য মানবেতর জীবনযাপন, সে জন্য ঐ শব্দ ওর অনুভবকে তছনছ করে দেয়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ভালো লাগা।

ও বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ পরিবেশ চায়- গ্রামে অভাব থাকলেও পরিবেশ এখনো নষ্ট হয়নি। এই পরিবেশে নিজের মতো করে জীবনযাপন করা যায়। শহরের পচাগলা-নোংরা ও সহ্য করতে পারে না। বস্তিগুলোতে নোংরার আধার-ডাস্টবিনের একটা আকার আছে, চরিত্র আছে- বস্তিগুলোর আকারও নেই, চরিত্রও নেই। ডাস্টবিনের ময়লাকে ময়লা বলা যায়, কিন্তু বস্তির মানুষগুলোকে কী বলা যায়, তা ও জানে না। শহরে কাজ করতে গেলে ঐ বস্তিতে ওকে থাকতে হয়। ও নিজেকে আর মানুষ ভাবতে পারে না। বলে, আমি এক জন্তু।
প্রথম যখন শহরে আসে তখন ওর প্রচণ্ড মন খারাপ থাকে। খেতে পারত না, ঘুমাতে পারত না। একবার একটা রিকশাওয়ালা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনের নাম কী ভাই?
ও মৃদু হেসে বলেছিল, ইঁদুর।
কী কইলেন?
বিশ্বাস যদি না হয় তাহলে খেঁকশিয়াল।
পাগল। মাথা ঠিক নাই।
রিকশাওয়ালা সহজ সিদ্ধান্তে চলে আসে। ওর সঙ্গে আর কথা বাড়ায় না।
ধান পাকার আগে বর্ষা এসে গেলে এবং পাহাড়ি ঢল নামলে ওকে জন্তু হয়ে যেতে হয়, এই আর্তনাদ ওর বুকের ভেতর।
হাঁটতে হাঁটতে ও শুনতে পায় পেছন থেকে ভাদুলি ওকে ডাকছে, একটু পর ভাদুলি খুব দ্রুত হেঁটে, একরকম দৌড়েই, হাঁফাতে হাঁফাতে ওর কাছে আসে। কাঁচি বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। বলে, কাঁচি নাও। খেতে নামবে না?
কাঁচি?

মনতাজ বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকে। যেন এই জিনিসটিকে ও কখনো দেখেনি।
ধান কাটবে না? গাই-বলদ-
ভাদুলি কথা শেষ করতে পারে না। মনতাজ নিজের বুকে হাত রেখে বলে, এই বলদের তো বিচালি লাগে না?
কথার কি ছিরি।
ভাদুলি মুখ ভেংচায়। ওর ভেংচি কাটা মুখটা মনতাজের চোখে জন্তুর মুখ হয়ে গেলে ও কোনো কথা না বলে হাঁটতে থাকে।
কী হলো? যাচ্ছ যে? ধান কি আমি কাটব?
ভাদুলি রাগে গজগজ করে। আশপাশের মানুষের কাছে উচ্চস্বরে ওর বিরুদ্ধে নালিশ করে। তার দু-একটা কথা ওর কানে আসে। মনতাজ ভ্রুক্ষেপ করে না। ওর কেবলই মনে হয় কাঁচি উপেক্ষা করে কি ও বাঁচতে পারবে? এটাই তো শেষ নয়, আবার ধান পাকবে, ধান উঠবে ঘরে। কাঁচি উপেক্ষা করে ও কোথায় যাবে? কত দূরে যাবে? টিলা বেয়ে নামতে থাকে। দেখতে পায় পানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষগুলো দ্রুত হাতে কাঁচি চালাচ্ছে। কাঁচা ধানের গুচ্ছ একদল মাথায় করে নিয়ে আসছে টিলার ওপর- ছবির মতো একটা দৃশ্য। টিলা বেয়ে ও সমতলে নেমেছে, এখন হাঁটুসমান পানি। পানি বাড়ছে। মনতাজ বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকে- ওর বুকের ভেতর পাহাড়ি ঢল গড়াচ্ছে- সেই শব্দে দশ দিক ঢাকা পড়ে যায়।
ও চারদিক তাকিয়ে ভাদুলিকে খুঁজতে থাকে। ভাদুলির হাতের কাঁচিটি ওর চাই। ও জানে কাঁচিটিই ওর জীবনে সত্য, প্রত্যাখ্যান নয়।



 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুলাই ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়