ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কোরবানি

হেমন্ত সাদীক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোরবানি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| হেমন্ত সাদীক ||

অবাক ব্যপার! স্কুল খোলা থাকলে ছুটির জন্য মন কাঁদে, আর এখন ছুটি পেয়ে এমন লাগছে কেন? একটা শুক্রবারের জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকি, অথচ এখন সারা সপ্তাহই ছুটি! ব্যপারটা ভাবতেই ভালো লাগে, কিন্তু পেয়ে গিয়ে ভালোলাগাটা হারিয়ে গেল। অদ্ভুত!

অবশ্য আরো একটা বিষয় হতে পারে, এই বছর কোরবানি ঈদে প্রথমবারের মতো দাদুবাড়ি যাওয়ার কথা আমাদের। দিন গুণছি বসে বসে। সেই কারণেই হয়তো দিন কাটতে চাচ্ছে না-বেড়ে গেছে দিনের আয়ু!
ব্যপারটি তো সত্যিই অভাবনীয়! আমি একটা বিরাট মেলায় সারিবদ্ধ লোকের সাথে বসে আছি। আমার পাশ দিয়ে বিভিন্ন ফেরিওয়ালা যাচ্ছে। বাদাম, চানাচুর, বই, ছোলা, মানিব্যাগ, কলা- কীসের ফেরিওয়ালা নেই এ মেলায়! এ ছাড়া রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, বাথরুম তো সংযুক্ত আছেই। মজার বিষয়টি হলো পুরো মেলাটি অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে! এই কয়টা দিন ফুরোচ্ছিলই না। স্থির হয়ে গিয়েছিলো সময়। এঘর থেকে ওঘর করে এই সাতটা দিন কাটিয়ে এখন এই গতি পেয়ে কী যে ভালো লাগছে! কী উথাল-পাথাল বাতাস চারপাশে! মনে হল জীবনে এই প্রথমবার সত্যিকারের ছুটি পেলাম।

দাদু ছাড়া অন্য প্রায় সবাইকেই আমাদের বাসায় দেখেছি। তাই শুধু একজনই অপরিচিত। কিন্তু ছবি দেখে দাদুকে যেমন মনে হয় ইনি মোটেও তেমন মানুষ নন। আমাকে আর সুমুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। দাদুর কাঁদতে দেখে সুমুও কেঁদে ফেললো। আর শহর থেকে এতদূরে, এই পাড়া-গাঁয়ে একটা মানুষ আমাদের জন্য বুকে এত ভালোবাসা পুষে রেখেছেন- ভেবে আমার, কী অদ্ভূত; আমারও কান্না পেয়ে গেল! এই এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাপ্তাহিক বাজার বসে। আমি সপ্তাহে একদিন বাজার বন্ধ থাকতে দেখে বড় হয়েছি-এবার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। এখানে সপ্তাহে দুদিন বাজার বসে! দাদুদের এদিকে যে হাট বসে, কোনো এক বিচিত্র কারণে তার নাম টুপিরহাট।

সোম আর বৃহঃস্পতিবারে হাট বসে। ঈদ কালকে হবার কথা, যেহেতু আজ শুক্রবার, ঈদের পর আর দুদিন থাকা হলে টুপিরহাট দেখার সুযোগ হবে। বাবা থাকবে কী না কে জানে। বিকেলে বড়চাচার ছেলে শাকিল ভাইয়ার সাথে মাদ্রাসা মাঠে এলাকার অনেক ছেলের সাথে আলাপ হল। অদ্ভূত ব্যপার হলো, এখানে কোনো হাইস্কুল নেই, শুধু একটা মাদ্রাসা আছে! ওদেরকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম, ওরা আসলে এটি নিয়ে ভাবেইনি কখনো।
এরই মধ্যে অনেকে মাঠে গরু আনতে শুরু করেছে। কেউ কেউ সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে নিজেদের গরু। ভেতরে ভেতরে আমি বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, এই প্রথম ঢাকার বাইরে ঈদ করছি। শাকিল ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আমাদের কোরবানির গরুটা নিয়ে বের হলাম আমরাও। মাঠে অনেকগুলো ছেলে, সামনে অনেকগুলো সাজানো গরু।

সবাই সবার সাজানো দেখলাম-আড্ডা দিলাম, অন্যরকম একটা বিকেল কাটলো। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি সবার মুখ থমথমে। গত বছর এমন সময়ে, ঠিক ঈদের আগের দিন সেজ চাচার মেয়ে নবনী আপু মারা গেছেন। আপু এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলেন। ঈদ নিয়ে আপুর কেমন উচ্ছ্বাস ছিল আর প্রত্যেক ঈদে আপু কী কী করতো দাদু সেসব বলছেন আর কাঁদছেন। সবাই শীতল পাটি বিছিয়ে মেঝেতে বসেছে আর দাদু চৌকিতে। নবনী আপুর বান্ধবীদের গাছ থেকে মেহেদি আনতো, নিজে পিষতো। তারপর সবার হাত মেহেদীতে রাঙিয়ে নিজের হাত রাঙাত। ও-ই বাড়িটাকে জাগিয়ে রাখতো, ওর সাথে সাথে পুরো বাড়িটাও ঘুমিয়ে গেছে। বলতে বলতে দাদু চোখ মোছেন।  

চোখ মুছে পুনরায় বলতে শুরু করেন, ঈদের দিন আমার কাপড়-চোপড়, আতর-সুরমা সব রেডি করে দিত। নিজ হাতে সুরমা লাগায়ে দিত চোখে। জায়নামাজ হাতে অনেকদূর আগায়ে দিত। এখন ঈদের দিনে আর বাড়ি থেকে বের হইতে পারিনা। বুক ভাইঙ্গা যায়..।
দাদুর কান্না দেখে আমি বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। যে মানুষগুলোকে কখনো কাঁদতে দেখিনি, তাঁদের এভাবে কাঁদতে দেখে সহ্য করতে পারলাম না।  

দাদুর সাথে গোসল করে, নতুন পাঞ্জাবি পরে ঈদের মাঠে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু দাদু বাড়ি থেকে বের হবার সময়ে যে দৃশ্যের অবতারণা হবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না বলে শাকিল ভাইয়ার সাথে আগেই বেরিয়ে পড়লাম। একেবারে ধানখেতের ভেতর খোলা জায়গায় ঈদের মাঠ। অনেকে লুঙ্গি পরে মাঠে এসেছেন। অধিকাংশ মানুষই পরেছেন পুরনো কাপড়- খারাপ লাগলো।
নামাজ শেষে সবার সাথে গরু নিয়ে বের হলাম। আমাদের বাসায় কোনো ঈদেই গরু নিয়ে যাওয়া হয়নি। আর কোরবানি তো দেখিইনি। তাই অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছিল ভেতরে। অন্যদের থেকে আমাদের গরুটা বেশ বড়। তিন-চারজন মিলে নিয়ে যাচ্ছে , আমি পেছনে হাঁটছি। একটা আমবাগানে গিয়ে থামলাম। অনেকগুলো গরু-ছাগল বেঁধে রাখা হয়েছে সেখানে। কেউ চাকুতে ধার দিচ্ছে, কেউ গরুকে পানি খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ কয়েকজন মিলে একটা গরুকে মাটিতে ফেলে, চেপে ধরতে দেখে দৌড়ে গেলাম। একজন মৌলভি বিশাল বড় ছুরি দিয়ে গলা কেটে ফেললো গরুটার! দ্রুত সরে এলাম আমি। এটাই কোরবানি!

আমার গরুটাকে এভাবে কষ্ট দিতে দেবো না- সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা-দাদুরা চলে এলেন এরই মধ্যে। আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা বললাম সবাইকে। কিন্তু কী অদ্ভূত, কেউ আমার কথা কানেই তুলল না। শাকিল ভাইয়া পর্যন্ত না। বাবা আমাকে বোঝাতে এলেন- শোন, এইভাবে প্রিয় পশুকে কোরবানি দিলে অনেক সওয়াব হয় বাবা।
-আমার সওয়াবের দরকার নাই। আমাকে আমার গরু দিয়ে দাও, ওটাকে মেরে ফেলতে দেবো না আমি।
কোনো কাজই হলো না আমার চিৎকারে। চারপাশে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে, গরু-ছাগল যন্ত্রণায় পা ছুড়ছে। কুকুর চেটেপুটে খাচ্ছে তাজা রক্ত। আমি যেন বাস্তবে না, স্বপ্নে দেখছি এসব।

ভয় লাগছিলো ভীষণ। ছুরি থেকে টপটপ করে পড়ছে তাজা রক্ত! একসময় এলো আমাদের গরুটার পালা। খুব অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো ও। ছুরি হাতে মৌলভি সাহেব এসে দাঁড়ালেন ওর কাছে। আমার ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাই। পারলাম না।

শাকিল ভাইয়া শক্ত করে ধরে রাখলো আমার হাত। এতক্ষণ আমি সহ্য করছিলাম সব; কিন্তু যখন আমারই বাবা গরুটাকে মাটিতে শুইয়ে চেপে ধরলেন, আর গলায় ছুরি বসালো মৌলভি সাহেব- আমি সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম। আমার চোখের সামনে আমাদের গরুটার ফিনকি দিয়ে উঠলো রক্ত, কেঁপে উঠলো ওর সারা শরীর, চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরলো অশ্রু। যন্ত্রণায় ও গোঙ্গাতে থাকলো। আর কোনোভাবেই যেন ও নড়াচড়া করতে না পারে, সেজন্য শক্ত করে চেপে ধরে রাখলেন আমার বাবা-চাচারা! আমি মেনে নিতে পারলাম না। এই গ্রামের সবটুকু সৌন্দর্য, আমার সমস্ত উত্তেজনা, ট্রেন নিয়ে আমার ভাবনা, ভালোলাগা-সবই এক মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল।

আমি আমার প্রিয় বাবাকে হারিয়ে ফেললাম এখানে এসে। কীভাবে আমি আর বাবার দিকে তাকাবো, বাবার কোলে বসবো! আমার ভয় করবে। ঈদ নিয়ে আমার যত উচ্ছ্বাস ছিলো- সব হারিয়ে গেল। একটি দুঃসহ স্মৃতি হয়ে গেল ঈদ। আমি আর অপেক্ষা করবো না ঈদের জন্য। জীবনে আর কোনো ঈদ চাই না আমি। কখনো না।




লেখক :  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত শর্টফিল্ম নির্মাতা।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়