ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমি এক শূন্য || মনি হায়দার

মনি হায়দার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১২, ১০ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমি এক শূন্য || মনি হায়দার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

আপনে ডাক্তার?
সামনে তাকায় মুহিন। সদ্য গোঁফ ওঠা একটা ছেলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে গভীর আগ্রহের সঙ্গে। ছেলেটির গায়ে পুরনো জামা, ছেঁড়া এবং ময়লা। শরীরটা বেশ নাদুস নুদুস। মুখের দাঁতগুলো সাদা। গোটা মুখের উপর কমনীয় একটা রুপ আছে। এ্যাপ্রোনটা ভালো করে শরীরের সঙ্গে গুটিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মুহিন, ডাক্তার দিয়ে কী হবে?
খালার খুব জ্বর। বুবু আপনারে যাইতে কইছে।
মজা পাচ্ছে মুহিন। কে খালাম্মা, কে বুবু কিছুই জানে না ও। কিন্তু  ছেলেটির চোখের মিনতি মুহিনকে আগ্রহী করে তুলছে, কোথায় তোমার খালা?
ওইতো বাসায়- যাইবেন? একটা রিকশা ডাহি? মুহিনের আগেই একটা রিকশা ডাকে ছেলেটি, এই রিকশা যাইবা?
রিকশাঅলা রিকশা থামিয়ে দিলে মুহিন উঠে বসে, পাশে বসে ছেলেটি। এবং বসেই হাতের ব্যাগটা নিজের হাতে নেয়। মুহিন বুঝতে পারে ছেলেটির এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে। রিকশা ছুটে চলেছে। মুহিন চারপাশটা দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মফস্বল এলাকা-কিশোরগঞ্জ।

মুহিনের একটা রোগ আছে, রোগী, রোগীর ব্যবস্থাপত্র, পথ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে এ্যাপ্রোন গায়ে চড়িয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সোজা কমলাপুরে আসে। প্রথমেই যে ট্রেন পাবে, টিকিট কেটে উঠে বসবে। যেতে যেতে মফস্বল এলাকা দেখে নেমে পড়বে। মোবাইল বন্ধ রাখে। দুনিয়ার কারো সংগে যোগাযোগ থাকে না এ সময়। নিজের মতো থাকে এক, দুই, তিন দিন। অনেক অনেক মজার ঘটনাও ঘটে। ডাক্তার পরিচয়ের কারণে অনেক সুবিধাও পায়। সকালে অফিসে এসেই ডাক পেয়েছিল.. বাইরে চলো...বাইরে চলো। এগারোটা নাগাদ কোনো রকমে সময় পার করে এ্যাপ্রোন গায়ে চড়িয়ে, ব্যাগটা হাতে নিয়ে অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ায়। রিকশায় উঠে কমলাপুর। কমলাপুর  থেকে ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জ। কিশোরগঞ্জ নেমে এক কাপ চা খেয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করেছে মুহিন। শহরের প্রধান রাস্তা পার হয়ে মানুষের চলাচল দেখতে দেখতে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে শহর প্রায় ছেড়ে বাইরে এসে পড়েছে। ফুরফুরে বাতাস, স্নিগ্ধ আকাশ, খোলামেলা প্রকৃতি বেশ লাগছিল মুহিনের।  ছেলেটির কথায় সুন্দরের জগৎ থেকে বাস্তবে আসে সে।

রিকশা চলছে বেশ্র দ্রুত গতিতে। নিজের মনে ভাবে মুহিন- কোথায় কোন রোগীর বাড়ি যাচ্ছে সে? রোগী কি ভিজিট দিতে পারবে? না পারলে অসুবিধা নেই। বিনা ভিজিটেই রোগী দেখবে। কিন্তু বুবুটা কে? ছেলেটির দিকে তাকায় মুহিন- নির্বিকার সামনে তাকিয়ে আছে।
তোমার নাম কী?  
কালো মুখে হাসি ফোটে- আমার নাম সুবল।
কতদূর তোমাদের বাসা?
এইতো আইসা পড়ছি। রিকশাভাই, থামেন।
রিকশা থামলে মুহিন নেমে দাঁড়ায়। রাস্তাটা পাকা কিন্তু পুরোনো। এবরো থেবরো। গোটা এলাকাটা গ্রামীণ । রাস্তার পাশে আম জাম কাঁঠালের গাছ। আরও আছে প্রচুর কলাগাছ। পাখপাখালির ডাকও শুনতে পায় মুহিন। রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের পানি স্বচ্ছ। ছোট একটা ঘটলাও আছে। মুহিনের খুব ইচ্ছে হলো, পানিতে মুখ দেখতে। ঘাটলার পারে দাঁড়িয়ে পানির মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দেয়। পানির মধ্যে সুন্দর মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে কয়েক মুহূর্ত, দেখা শেষ হতেই দু’হাতে পানি নিয়ে মুখে দেয়।
তাড়াতাড়ি আহেন, খালার অবস্থা ভালো না- সুবল তাড়া দেয়।
চলো।

সুবল আগে আগে, পিছনে পিছনে হাঁটে মুহিন। ঢোকে একটা পুরোনো কিন্তু বনেদী বাড়ির ভেতরে। বাড়িটি ইটের তৈরি। যখন তৈরি হযেছিল, বোঝা যায়, বাড়ির মালিক যথেষ্ট সৌখিন ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দিনের অযত্ন অবহেলার কারণে বাড়িটির ক্ষয়িষ্ণু দশা চলছে। বাড়ির সামনে কয়েকটা লেবু, আমলকি, আমড়া, কলা গাছের ঝাড়। বাড়িটির সামনে মোটামুটি বড় বারান্দা। বারান্দায় মলিন রঙের দুটি বেতের চেয়ার। চেয়ারের সামনে একটি কাঠের টেবিল। টেবিলের উপর মলিন সাদা কাপড় রাখা। কাপড়ের  উপর কয়েকটি ফুলের হালকা আভাস দেখতে পাচ্ছে মুহিন।

ডাক্তার সাব, আহেন- সুবলের দিকে তাকায় মুহিন। সুবল ঘরের ভেতর থেকে প্রথম দরজায় দাঁড়িয়েছে। পেছনে একটি মুখ। সুন্দর, কমনীয়। চোখে রাজ্যির ক্লান্তি, কপাল চওড়া। মাথার দু’পাশে সিঁথি। শরীরে জড়ানো সালোয়ার কামিজ। সরু বিন্দাস হাত দু’টো একেবারে খালি। কপালে বড় একটা লাল টিপ।
সুবলের পেছনে ঘরের ভেতরে ঢোকে মুহিন। ভেতরের ঘরটা বেশ বড় এবং গোটা ঘরজুড়ে একটা পুরোনো দিনের খাট। খাটের উপর জীর্ণ কিন্তু বনেদী বিছানার উপর অস্থিচর্মের একজন নারী শুয়ে আছে- মুখ হা। বিস্ময়কর ঘটনা, মুখের সবগুলো দাঁত অটুট। চেহারা চিমসে গেছে কিন্তু আভিজাত্যের একটা নির্মোক এখনও জ্বলজ্বল করছে। চোখ দু’টি মুদ্রিত। কপালের উপর আধাপাকা কয়েক গাছি চুল বাতাসে নড়ছে। মুহিত অভ্যস্ত অভিজ্ঞতায় বিছানার পশে বসে রোগীর ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করছে। স্পন্দন আছে কিন্তু প্রবাহটা বড় ক্ষীণ। যে কেনো সময়ে এই ক্ষীন ধারা রহিত হয়ে যেতে পারে। মুহিত মাথা তুললে দেখে মেয়েটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিহ্বল চোখে। সুবল নেই।

উনি খাওয়া দাওয়া করেন না?
মাথা নাড়ায় মেয়েটি, না।
কেনো?
ইচ্ছে করে খায় না।
মুহিত ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে, ইচ্ছে করে খায় না।
মাথা ঝাঁকায় মেয়েটি, হ্যাঁ।
কিন্তু কেনো?
আমি জানি না।
উনি আপনার কী হয়?
খালা।
ওনার ছেলেমেয়ে আছে না?
একটা ছেলে আছে, ঢাকা থাকে।
মায়ের খবর নেয় না?
নাহ।
বুঝতে পেরেছি। গরম পানির ব্যবস্থা করা যাবে?
যাবে, মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মুহিন ব্যাগ খোলে, ব্যাগের ভেতরে বারো রকমের ওষুধ থাকে। বের করে প্রয়োজন মতো সাজায় সামনের টেবিলের উপর। মেয়েটি একটি বাটিতে গরম পানি এনে সামনে রাখে। মুহিন দ্রুত ইনজাকশনের সিরিঞ্জ গরম পানিতে ধুয়ে একটা শিশি ভেঙে ভেতরে ওষুধ নিয়ে মহিলার হাতে পুশ করে তাকায় মেয়েটির দিকে।

উনি কতোদিন ধরে এ রকম না খেয়ে আছে?
মাঝে মাঝে জোর করে খাওয়াই। খাওয়ালে বকাকবি করে। বকতে বকতে বমিও করে। এ বারের অবস্থা  আরও জটিল। গত দু’দিনে কিছুই খায়নি।
মহিলা হঠাৎ চোখ মেলে তাকায় কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পায় বলে মনে হলো না মুহিনের। ওর দিকে অপলক তাকিয়েই থাকলো কয়েক মুহূর্ত। তাকিয়ে থাকলেও ওকে দেখতে পায়নি। দৃষ্টি অন্য কিছু খুঁজছে। মাথা এপাশ ওপাশ করে আবার তাকায় মুহিনের দিকে।
মেয়েটি অনুরোধ করে, আপনি  একটু সরে দাঁড়াবেন? খালা আমাকে খুঁজছে।
মুহিন দ্রুত  সরে দাঁড়ালে মেয়েটি কাছে যায় মহিলার। হাত ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায়- খালা, কিছু বলবেন?
আলো, শিশির কি এসেছে?
না খালা, আসেনি।
ফোন করেছিলি?
করেছিলাম।
আমি অসুস্থ বলেছিস?
বলেছি।
কী বললো? আসবে?
মাথা ঝাঁকায় আলো, আসবে।

মহিলার মুখে ক্ষীণ হাসির  রেখা- আসবে? কবে আসবে? বলতে বলতে মহিলা আগের মতো নির্জীব পড়ে থাকে। গোটা ঘটনা যাদুর মতো লাগলো মুহিনের কাছে। গোটা বাড়িতে থৈ থৈ শোক ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে সিনেমায় দেখা আধিভৌতিক পরিস্থিতি। ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে মুহিন চলে যাওয়ার। মহিলা এ সময় পুনরায় চোখ মেলে তাকায়, আমি যে দেখলাম শিশির আমার পাশে বসা। আলো, তুই আমাকে মিথ্যা বললি কেনো?
আলো, আপনি সরুন। আমি দেখছি- আলো নেমে গেলে বিছনায় বসে মুহিন। হাত ধরে মহিলার, হ্যাঁ, আমি তো এসেছি মা। কিন্তু আপনি তো আমার সঙ্গে কথা বলছেন না।
কী বলবো?
খাচ্ছেন না কেনো?
আমাকে খেতে দেয় না আলো। সব খাবার আলো আর সুবল খেয়ে ফেলে। তুমি আসতে এতো দেরী করলে কেনো? আমার দাদাভাই কেমন আছে? ওকে আনলে না?
মুহূর্তে বুঝে নেয় মুহিন, নাতীর প্রসঙ্গে বলছে। এই প্রশ্নের জবাব কি দেবে?
বুঝে ওঠার আগেই মহিলা ডাকে আলোকে, আলো? শিশিরকে ভালো করে খেতে দে। এরপর মহিলা পাশ ফিরে শুয়ে থাকে।

সুবল ঢোকে। হাতে একটা ট্রে। আলো সুবলকে ট্রে সামনের রুমে নিয়ে যেতে বলে বিপন্ন চোখে মুহিনের দিকে তাকায়- আপনি আসুন।
মুহিন গিয়ে দেখে টেবিলের উপর ট্রে রাখা। সেখানে বিস্কিট করুণভাবে বসে আছে সুদৃশ্য পিরিচের উপর। দু’টি পাকা কলা। এক গ্লাস পানি। চেয়ারে বসে মুহিন।
নাস্তাটুকু নিন বলেই আলো  ভেতরে চলে যায়।
মুহিন ক্ষুধা অনুভব করে।  আলতো করে একটা বিস্কিট মুখে দেয়। এক চিরন্তন ভালো লাগায় মুহিনের অন্তরভূমি ভরে ওঠে। মনে হয়, এই ক্ষয়িষ্ণু জীর্ণ বাড়ি, বাড়ির মানুষ, বিছানায় শোয়া মহিলা, আলো, সুবল- সবাইকে সে চেনে। অনেক দিনের চেনা। ভাবতে ভাবতে, অনুভব করতে করতে বিস্কিট কলা খেয়ে গ্লাসের পুরো পানিটা খেয়ে নেয়। তীব্র পরিতৃপ্তিতে মন প্রাণ সতেজ হয়ে ওঠে।

আপনাকে ডাকছে, ভেতর থেকে আলো এসে সামনে দাঁড়ায়। খালার সঙ্গে কথা বলার আগে কয়েকটা কথা শোনা দরকার আপনার।
বলুন, বলতে বলতে সিগারেট ধরায় মুহিন। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্রশ্ন করে, সিগারেটের ধোঁয়া সমস্যা হবে না তো আপনার?
নাহ। খালা আপনাকে মনে করেছে ওনার ছেলে শিশির। আপনি অনেক দিন পর বাড়ি এসেছেন। আপনি ঢাকায় থাকেন। আপনর স্ত্রী এবং ছেলে আছে। ছেলের নাম সৌরভ। আপনি একটা ব্যাংকে চাকরি করেন। উনি, মানে খালা বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না। স্মৃতি মনে নেই। আবোল তাবোল অনেক কথা বলেন। জানি না, সুবল আপনাকে কোত্থেকে ধরে এনেছে, কিন্তু এ মিথ্যাটুকু একজন মায়ের জন্য- অভিনয় করতে পারবেন না?
এক মুহূর্ত ভাবে মুহিন, পারবো কি না, জানি না। চেষ্টা করবো।
থ্যাঙ্ক ইউ। আসুন।  

পাশের রুমে যেতে যেতে চ্যালেঞ্জটা নেয় মুহিন। একজন মাকে যদি মুমূর্ষু সময়ে একটু সুখ দেয়া যায়, দেখা যাক না। জীবন তো নাটকের সমষ্টি, আজকে না হয় বাস্তবে একটু অভিনয়ই করলাম একজন মায়ের জন্য! ভেতরে ঢুকেই দেখতে পায় শিশিরের মা হাত বাড়িয়ে ডাকছে, শিশির!
মুহিন দ্রুত কাছে যায়, হাত ধরে পাশে বসে- মা!
বাজান, সত্যি তুমি এসেছো? ছানি পড়া চোখে শিশিরের মা আছিয়া বানু দু’হাতে সারা শরীর মুছতে থাকে। এক অনাস্বাদিত সুখে বিভোর হয়ে পড়ে মুহিন। মায়েদের হাতের স্পর্শ প্রকৃত অর্থে মধুর চেয়েও মধুর। সেই কবে, দশ বারো বছর আগে মা মারা গেছেন। মনে পড়ছে মায়ের স্পর্শসুখ নতুন করে শিশিরের মায়ের কাছে। শিশির তুমি কোথায়? হায়, তুমি কতো অভাগা! কতো ক্ষুদ্র তুমি! মায়ের আশীষ নিতে আসছো না!
আলো?  আলো?
জ্বি খালা, আমি আপনার কাছেই আছি।
তুই কি শিশিরকে খেতে দিস না? ছেলেটা আমার কতো শুকিয়ে গেছে। তোর হাতে সংসার ছেড়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এখন দেখছি তুই আমার ছেলেকে না খাইয়ে মারবি। চল, রান্না ঘরে চল। আজ আমি নিজে রান্না করবো- বলতে বলতে মুহিনকে ছেড়ে বিছানা থেকে নামতে শুরু করে মা।

আলো দ্রুতপায়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে, খালা আপনি কেমনে রান্না করবেন। চোখে তো দেখেন না। আপনি বলুন, কী রান্না করতে হবে, আমি এখনই করে আনছি।
শোন মেয়ের কথা, শিশির কি খেতে পছন্দ করে তুই জানিস?
আপনি বিছানা থেকে নামবেন না খালা, হাঁটতে পারেননা, দাঁড়াতে পারেন না। পরে গেলে একেবারে সব শেষ হয়ে যাবে- আলোর মুখে হাহাকার, আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।
মা, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আলো খুব চমৎকার রান্না করেছে- আমি পেট ভরে খেয়েছি। আপনি কী খাবেন? আপনার জন্য আঙুর এনেছি?  খাবেন?
আঙুর ফল? আছিয়া বানুর মুখে এক ধরনের স্মৃতিকাতরতার আলো ফোটে, তোমার বাবা খুব আনতো। মনে নেই, সবাই মিলে খেতাম। তুমি খেতে পারতে না, রস চুইয়ে পড়ে যেতো গাল বেয়ে। তোমার বাবা গ্লাসে আঙুর নিয়ে রস করে তোমাকে খাইয়েছে। আলো? আমাকে আঙুর দে।
আলো হতভম্ব। কোথায় আঙুর পাবে? চোখ বড় বড় করে তাকায় মুহিনের দিকে। আছিয়া বানুকে শুইয়ে রেখে মুহিন দ্রুত নামে বিছানা থেকে। আমি আসতে আসতে পথের পাশে আঙুর বিক্রি করতে দেখেছি। সুবল কোথায়? ওকে ডাকুন। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দেয় আলোর হাতে।

আলো দ্রুত টাকাটা নিয়ে চলে যায়। মুহিন ফিরে এসে দেখতে পায়, আছিয়া বানু ঘুমিয়ে গেছেন। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, মুখের এই বলিরেখার মাঝে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ধারণ করে তিনি জীবনের শেষ লগ্নের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ফেলে আসা দিনের মধুর স্মৃতি এখনও হঠাৎ হঠাৎ জেগে  উঠে জীবনের সুখ পেয়ালায়। সুবল দ্রুত রিকশা নিয়ে চলে যায়, রান্না ঘরে রান্না চড়িয়েছে আলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সুবল আঙুর নিয়ে এলে আলো আর মুহিন মিলে আছিয়া বানুকে খাওয়াতে চেষ্টা করে। আছিয়া বানু প্রবল প্রতিবাদ করেন- আমি আঙুর খাই নারে... আঙুর খাই না...আমার শিশির কি আঙুর খেয়েছে?
এই তো আমি খাচ্ছি, মুখে আঙুর রেখে আছিয়া বানুর হাত দিয়ে স্পর্শ করায় মুহিন। আছিয়া বানু খিল খিল করে হাসতে থাকেন। অনেক মজার ঘটনা। আলো চমকে ওঠে, এমন করে কখনো আছিয়া বানুকে হাসতে দেখেনি। কি মিষ্টি  আর ধারালো হাসি! কোথায় ছিল এতোদিন?  
আমার ভয় লাগছে।
কেনো?
খালা তো এমন করে হাসে না।
কখনো হাসেনি, বলে আজকে হাসবে না কেনো? হাসি আসলে মানুষ হাসবে।
সুবল ঘরে ঢোকে, বুবু মাছ আনছি।
যা, আমি আসছি।
আলো রুম থেকে চলে যায়।

আছিয়া বানু ঘুমুচ্ছেন। মুহিন ঘরের বাইরে আসে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ছোট্ট একটা বাল্ব জ্বলছে বারান্দায়। সেই আলোয় রান্নাঘর, বারান্দা ম্লান আলোয় আলোকিত। দুয়ারে দাঁড়িয়ে মুহিন তাকায় রান্নাঘরের দিকে, রান্নাঘরটা বেশ বড়। মাছ কাটা শেষে আলো পানিতে ধুচ্ছে দ্রুত কিন্তু নিপুণ হাতে। সুবল আবার বাইরে থেকে এসে আলোর হাতে একটা ব্যাগ দেয়। আলো ব্যাগ থেকে কয়েকটা গোল আলু বের করে পাশে রাখে। সুবল দা দিয়ে আলুর ছোলা ছড়াতে থাকে। সন্ধ্যার বিষণ্ন আলোয় অজানা অচেনা জগতের দুয়ার নূপুর পায়ে নাচতে নাচতে খুলে যাচ্ছে মুহিনের সামনে। আর সেই দুয়ারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডা. মুহিন দেখছে মানুষ্য জীবনের সামান্য সুখ, বেদনা মাখা বসন্ত।
মৃদু আলোয় আলোকে মনে হচ্ছে সূদূরের ওপার থেকে নেমে আসা এক মানবী, যে মানবীর ছায়া আছে, বাটা ভরা চোখে কাজল কালো মায়ার অঞ্জন আছে, আর আছে  গভীর গোপন তিক্ত দীর্ঘশ্বাস।
মাছ চুলোয় চড়িয়ে উঠে আসে আলো, সারাদিন আপনাকে খেতে দিতে পারিনি। রান্না হয়ে গেছে একটু পরেই দিচ্ছি।
অসুবিধা নেই- আশ্বাস দেয় মুহিন। একটা কথা বলি, আমি যেটুকু বুঝেছি খালা স্মৃতি হারিয়েছেন। পুষ্টিরও অভাব প্রচণ্ড। আমি সুবলকে নিয়ে বাইরে যাই। ওষুধসহ আরো কিছু লাগবে, কিনে আনি।
কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই।
আমার কাছে আছে। সুবল?
জে।
চল আমার সঙ্গে।
চলেন।

সবুলের সঙ্গে বাইরে বের হয়ে মুহিন দেখতে পায়, ঘরের পেছনে একটা রিকশা। সুবল রিকশাটা দ্রুত কাছে এনে বলে- ওঠেন।
তুমি রিকশা চালাও।
হাসে সুবল, সংসার চালাইতে অইবে না? ওঠেন।
মুহিন রিকশায় বসে। সুবল দ্রুত গতিতে প্যাডেল ঘোড়ায়। বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তা পার হয়ে কয়েক মিনেটের মধ্যে কিশোরগঞ্জের প্রধান সড়কে উঠে পড়ে রিকশা। রাত আটটায় বাসায় ফেরে সুবল আর মুহিন। মাছ মাংস ডিম তরিতরকারী ওষুধ, হরলিক্সসহ অনেক ধরনের জিনিস এনেছে  মুহিন।
সুবল কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করে আলোর কাছে, আমি ওনারে এইসব কিনতে অনেক মানা করছি, উনি হোনে নাই।
হাসে মুহিন, আমি অপ্রয়োজনীয় একটা জিনিসও কিনি নাই।
বুঝেছি। সুবল তুলে রাখ, আমি পরে দেখবো বলে আলো তাকায় মুহিনের দিকে- আসুন। আপনার খাবার দেয়া হয়েছে। কথা বলতে বলতে আলো মুহিনকে নিয়ে পাশের রুমে ঢোকে। রুমটি ছোট। কিন্তু পরিপাটি। বোঝা যায় এই রুমে থাকে আলো। বিছানার উপর একটা প্লেটে ভাত, পাশে মাছ আলুর তরকারি, আলু ভর্তা, পাতলা ডাল, একটা ডিম ভাজা।

এতোসব কে খাবে?
আপনি খাবেন। কথা না বলে খেতে বসুন- আলোর কণ্ঠে আদেশের সুর। আদেশ মেনে নিয়ে খেতে বসে মুহিন। আহামরি কোনো আয়োজন নয়। খুব সাধারণ আয়োজন কিন্তু স্বাদ মুহিনকে  দারুণ তৃপ্তি দেয়। পেট ভরে খায়, অনেকদিন পর এমন স্বাদ আর সুখের খাবার খায়। খাবার খেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে চেয়ারে। আলো আর সুবল সংসারের কাজ  করছে। রাত দশটার দিকে ওর কাছে আসে। মুহিন প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখছে। ফিকে অন্ধকার , মাথার উপর অর্ধেক চাদ। হালকা বাতাস। বাড়ির গাছপালা বাতাসে দুলছে। এই বাড়িতে সুবল কী করে? বুঝতে পারছে না মুহিন। আবার বোঝে- সংসারটা বোধহয় সুবলই চালায়।
আসুন ঘুমাবেন আপনি- আলো সামনে আসে।
এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না। বসুন আপনি। সুবল কোথায়?
ও এখনই ঘুম দেবে, আলো বসে সামনের চেয়ারে।
শিশির আসে না কেনো? কেনো মায়ের খোঁজ নেয় না? প্রশ্ন করে মুহিন।
একটু সময় চুপ থেকে উত্তর দেয় আলো- কারণ আমি।
আপনি?
হ্যাঁ।
শৈশবে বাবা-মা মরে গেলে দূরে সর্ম্পকের এই খালা আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে মেয়ের মতো আদরে যত্নে বড় করে। শিশির আমার চেয়ে বছর তিনেক বড়। আমরা এক সঙ্গেই বড় হয়েছি, লেখাপড়া করেছি। শিশির স্থানীয় কলেজে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করতে থাকে।  সেই সময়ে পরিচয় হয় নিশির সঙ্গে। নিশির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পরে শিশির। বাড়িতে কিছু জানায় না। এদিকে খালুও মারা যান। খালা আশা করে আছেন, আমার সঙ্গে শিশিরের বিয়ে দেবেন।

আপনার ইচ্ছে কী ছিল?
সংসার করতে কে না চায়? বিশেষ করে আমার মতো সর্বহারা একটি মেয়ের পক্ষে এই সমাজ সংসারে না বলার কোনো সুযোগ আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে শিশির চাকরি নিয়ে বাড়ি আসে। খালা বলেন, আমাকে বিয়ে করতে। শিশির জানায়, ঢাকায় সে নিশিকে বিয়ে করেছে। খালা এমন আঘাত পান যে, কয়েক মাস বিছানায় পড়ে থাকেন। বা পাশটা প্রায় অবশ হয়ে গিয়েছিল। অনেক ডাক্তার দেখানোর পর খালার এখন এই অবস্থা।
আর সুবল?
সুবলও আমার মতো কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। খালু তখন বেঁচে ছিলেন। রেলস্টেশনে বছর চারেকের  ওকে ভিক্ষে করতে দেখে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই থেকে ও আছে। বলা যায় সুবলই এখন সংসার চালায়।
রিকশা চালিয়ে?
হ্যাঁ।
শিশির কোনো টাকায় পয়সা দেয় না।
আগে দিতো। কিন্তু বছর তিনেক ধরে কোনো খরচ তো দেয়ই না, বাড়ির কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করে না।
যোগযোগ না করার কারণ কী বলতে পারেন?
নিশি, ওর স্ত্রীই যোগাযোগ করতে দেয় না। বাড়িতে একবার এসেছিল, বিয়ের পর পর। আমাকে দেখার পর নিশির মনে হয়েছে, আমি ওর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। শিশির বাড়ি এলে ...।
বুঝতে পেরেছি।
আপনার জন্য চা করে আনি?
না। বরং আপনার কথা শুনি।
আমার তো তেমন কিছু বলার নেই। যা বলার ছিল, বলেছি। এখন কেবল শূন্য।

অনেক রাতে ঘুমুতে যায় মুহিন। আলোর বিছানায় ঘুমিয়ে আলোর সঙ্গেই ঘুমিয়েছে। আলো ঘুমিয়েছে আছিয়া বানুর সঙ্গে। সুবল ঘুমায় সামনের রুমের খোলা জায়গায় একটা বালিশ আর চাটাইয়ের উপর। সকালে উঠে হাত পা ধুয়ে নাস্তা খেয়ে আছিয়া বানুর রুমে যায় মুহিন। তিনি গভীর ঘুমে আছেন। ব্যাগটা কাধে নিয়ে সামনের ঘরে আসে মুহিন। রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আসে আলো- কোথায় যাচ্ছেন?
বাসায়। আমার মেয়ে, স্ত্রী পথ চেয়ে আছে- বলতে বলতে আলোর হাত থেকে চায়ের কাপটা নেয়, নিবিড় করে চায়ে চুমুক দেয়। আলো অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। সুবল অনেক সকালে উঠে রিকশা নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। বাড়ির চারদিকে পাখি ডাকছে।
আপনাকে, এই বাড়ির সবাইকে আমার মনে থাকবে চিরকাল। চা খেয়ে শূন্য কাপটা বাড়িয়ে ধরে আলোর দিকে- যাই।
কাপটা হাতে  নেয় আলো, আসুন।
লম্বা পা ফেলে বাড়ির বাইরে চলে যায় মুহিন। পেছনে ফিরে তাকায় না। কিন্তু কী এক হাহাকারে বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে পাথরের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত রাস্তায় উঠে একটা রিকশা নেয় রেলস্টেশনের দিকে। চোখ ভিজে যায়, ইচ্ছে করছে গলা ছেলে লালনের মতো কাঁদে- হাতের কাছে ভরা কলসি তৃষ্ণা মিটলো না...।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়


রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়