ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কীর্তিমান ম্যাক্সিম গোর্কি

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৪, ২৮ মার্চ ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কীর্তিমান ম্যাক্সিম গোর্কি

ম্যাক্সিম গোর্কি

ফেরদৌস জামান : একবার গোর্কিকে বলা হয়েছিল কেন লেখেন? জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে সহজ ভাষায় বলেছিলেন, মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে প্রবল করে তোলার জন্য।

 

আরও বলেছিলেন, কঠোর বাস্তবতা ও তার সকল প্রকার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলার সংগ্রামে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে লিপ্ত করার জন্য হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। এ্যালেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ্ পেশকভ যে ম্যাক্সিম গোর্কি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার পেছনে প্রধান কারণ হলো, বাল্যকাল থেকেই তাকে অন্যায় অত্যাচারের বিভৎসতা এবং ব্যাভিচারের আগুনে দাউ দাউ করে দগ্ধ হতে হয়েছে। দগ্ধ হতে হতেই তিনি অর্জন করেন শিল্পী হবার মৌলিক অধিকার ও যোগ্যতা।

 

মধ্য রাশিয়ার ভোলগা নদীর তীরবর্তী শহরে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ (সেকালে রাশিয়ার জুলিয়ান পঞ্জিকা মোতাবেক ১৬ মার্চ, কারণ তা ছিল বিশ্বব্যাপী প্রচলিত গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা থেকে ১২ দিন পেছানো) জন্ম হয় ম্যাক্সিম গোর্কির। শিশু কালেই গোর্কি পিতাকে হারান, যখন তার বয়স মাত্র চার বছর। এমন পরিস্থিতিতে ভার্ভারা দুই সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে স্টিমারে চেপে বসেন। পথিমধ্যে গোর্কির ছোট্ট ভাইটিরও মৃত্যু হয়। নানা-নানীর আশ্রয়ে পিতৃহীন বালকটিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে আর বেশিদূর এগোয়নি। এরই মধ্যে মায়ের বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। নানী তাকে প্রায়ই মারধর করতো। এমন পরিস্থিতিতে এগারো বছর বয়সে মাকেও হারান। কার্যত পৃথিবীতে তার আপন বলতে আর কেউ রইল না। মা চোখ বোজা মাত্রই কঠিনপ্রাণ মাতামহ সাফ বলে দেন বসে বসে খাওয়ানোর পয়সা তার নেই। তখন থেকেই গোর্কির বাস্তব দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়া। হাঁটতে থাকলেন পৃথিবীর পথে পথে। মুচির দোকানে, রুটির দোকানে, বিস্কুট কারখানায়, বাগানের মালী, স্টিমারের হেঁসেলে বয়-বেয়ারাগিরি, মাছের আড়তে চাকরি, রেলস্টেশনের দারোয়ানী- কি করেননি?

 

১৬ বছর বয়সে চলে যান কাজান শহরে। চার বছর সেখানেই অবস্থান করেন। পেয়ে যান কিছু বন্ধুবান্ধব, যাদের সংস্পর্শে তার স্বপ্রণোদিত শিক্ষা অর্জন উৎসাহিত হতে থাকে। পড়তে থাকেন রুশ সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের রচনা। বাদ যায়নি সৃজনশীল সাহিত্য, দর্শন ও বিশ্ব সাহিত্য। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এ পর্বেই পরিচিত হন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও মার্ক্স-এ্যাঙ্গেলস্ এর রচনাবলীর সাথে। ১৮৮৮ থেকে ৯২ পর্যন্ত তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালেন রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কাজ করলেন আর ঘুরতে থাকলেন। এমনি করে ভোলগা নদীর অববাহিকাজুড়ে বিশাল এলাকার মানুষ এবং তাদের সমাজ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, আচরণ, অভ্যাস ইত্যাদি ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এর আগে ১৯ বছর বয়সে দুই-দুইবার আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টাও চালান। সে অপরাধে তাকে অবশ্য শাস্তিও পেতে হয়েছিল।

 

তিফ্লিস্ শহর থেকে প্রকাশিত ‘কাফকাজ’ নামের দৈনিক সংবাদপত্রে ১৮৯২ এর ১২ সেপ্টেম্বর একটি গল্প ছাপা হয়। গল্পটির নাম ‘মার্কা চুদ্রা’, লেখকের নাম ম্যাক্সিম গোর্কি।  বিদায় হল এ্যালেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ্ পেশকভের; তার স্থলে আবির্ভূত হল ম্যাক্সিম গোর্কির। এ সময় এক নারীর প্রেমে পড়লেন গোর্কি। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র আট বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের, টিকে ছিল ১৯০৪ পর্যন্ত। আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ না হলেও তারা আর একত্রে জীবনযাপন করেননি। এরই মাঝে নতুন করে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন বহুভাষাবিদ ও মস্কো আর্ট থিয়েটারের অভিনেত্রী, একইসাথে বলশেভিক পার্টির সদস্য মারিয়া ফিওদরনা আন্দ্রেইয়েভার সাথে। পরোবর্তীতে অবশ্য তার সাথেও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দেখা গেছে বিচ্ছেদ হলেও স্ত্রী একাতেরিনা ও প্রেমিকা মারিয়া উভয়েই গোর্কির খোঁজ খবর রেখেছেন।

 

১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে  পিটাসবুর্গ থেকে তার প্রথম গ্রন্থ ‘ওচের্কি  ই রাস্কাজি’ (নকশা ও গল্পাবলী) দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এর আগেই পত্র-পত্রিকায় অনেক গল্প প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ‘পেসনিয়া আ সোকলে’ ও ‘পেসনিয়া আ বুরেভিয়েনিকে’ (যথাক্রমে বাজপাখির গান ও ঝড়ো পাখির গান) নামে দুটি কবিতা তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। ১৮৯৫-এ তার বিখ্যাত ‘চেলকাশ’ গল্পটি এক দৈনিকে প্রকাশ হবার পর আলোড়ন পড়ে যায়। সেই সুবাদে সামারার এক বড় পত্রিকায় চাকরির সুযোগ পেয়ে যান। তখন তিনি ঠিক করেন, চাকরি করবেন এবং পাশাপাশি লেখা চালিয়ে যাবেন। ম্যাক্সিম গোর্কি অবশ্য পরোবর্তীতে ১৯১৫-এ ‘লিয়েতপিস্’ (কড়চা) পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং তার ছয় বছর পর ১৯২১ থেকে তার সম্পাদনায় সোভিয়েত সাহিত্য পত্রিকা ‘ক্রাস্নায়া নোফ্’ (রক্তিম জমি) প্রকাশিত হতে থাকে।

 

অন্যায় অত্যাচারের আগুনে দগ্ধ হওয়া গোর্কি রাজনীতির সাথে যোগাযোগ সবসময়ই রেখেছেন। যার ফলোশ্রুতিতে জার শাসিত রাশিয়াতে যেমন তাকে নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে, তেমনি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লব পরোবর্তী সোভিয়েত যুগেও সহ্য করতে হয়েছে। ১৯০৫-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন বলশেভিক পার্টিতে। সে বছরই জারের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় প্রথম বিপ্লব, যা ইতিহাসে ‘রক্তাক্ত রবিবার’ বলে পরিচিত। এর পরের বছরই গোর্কিকে দেশ ছাড়তে হয়। এরপর প্রায় সাত বছর তিনি নানান জায়গায় অন্তরীণ হন। এ দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় অবস্থান করেন ইতালির কাপ্রি দ্বীপে। অন্যায় অত্যাচারের চির বিদ্রোহী গোর্কি সেখানেও পরিচালনা করেছেন রাজনৈতিক পঠন-পাঠনের বিদ্যালয়। দেশে ফেরেন ১৯১৩ সালে। এর মাত্র চার বছর পর ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়াতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের সর্ব প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। পতন হয় জারতন্ত্রের, প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক-কৃষকের শাসন। বিপ্লব পরোবর্তী সোভিয়েত রাশিয়াতে তিনি দেশ গড়ার কাজে লেগে পড়েন। কিন্তু নতুন দেশে নতুনভাবে আর পার্টি সদস্য হননি। শতভাগ মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। জীবদ্দশায় সোভিয়েত রাশিয়ায় তিনি ছিলেন সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট। ‘মা’ উপন্যাস তাকে সোভিয়েত রাশিয়ার গন্ডি ছাপিয়ে পৃথিবীতে এক অভূতপূর্ব মর্যাদার আসনে নিয়ে যায়। কারও কারও মতে অদ্যাবধি এটি পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত এবং সর্বাধিক সংখ্যক ভাষায় অনুদিত একটি গ্রন্থ।

 

১৯২১ সালে শরীরে যক্ষা ধরা পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য লেনিন তাকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় জার্মানিতে প্রেরণ করেন। বছর দুই চিকিৎসা পর সেখান থেকে ফিরে আসেন তার প্রিয় ইতালি কাপ্রিতে। সেখানে আরও চার বছর অবস্থান করে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখেন। অতঃপর ১৯২৮-এ দেশে ফেরেন। ব্যাধি যে ঠিক মত সারলো তা নয়। চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন ৬৮ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ম্যাক্সিম গোর্কি।

 

তখন সোভিয়েত সরকারের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিন। তার সরকার বিষ প্রয়োগের অভিযোগে গোর্কির চিকিৎসকদের বিচারের মুখোমুখি করে এবং শাস্তি দেয়। একইসাথে একই অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়, যা অবিলম্বে কার্যকরও করা হয়। গোর্কির আকস্মিক মৃত্যু রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেছে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তির বদ্ধমূল ধারণা, কাজটি আসলে স্তালিনেরই ছিল। কারণ গোর্কি বহু বিষয়ে পার্টির সঙ্গে একমত হতে পারতেন না, সমালোচনা করতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে বা তুলে ধরতে অকুণ্ঠ সাহসী ছিলেন। ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা হোতা যিনিই হোন না কেন, গোর্কির মৃত্যু যে স্বাভাবিক ছিল না, এ বিষয়ে সকলেই সংশয়হীন। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের শবযাত্রায় জোসেফ স্তালিন অংশ নেন কফিন বাহকদের একজন হিসেবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়