ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বখাটে বকুল ও বঙ্গবন্ধু || মঞ্জু সরকার

মঞ্জু সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৩, ১০ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বখাটে বকুল ও বঙ্গবন্ধু || মঞ্জু সরকার

মঞ্জু সরকার

গোঁফ গজানোর আগেই বন্ধুদের সঙ্গে গোঁফে তা দিয়ে কথা বলে বকুল। পকেটে রাখা একটি চাকু বের করে নিজের দাঁত ঘষে। তুচ্ছ কারণে, কখনো-বা অকারণেও হঠাৎ বন্ধুদের পিঠে কিলঘুষি লাগিয়ে দেয়। গালে চটকানা দিয়ে আঙুলের ইশারায় আহ্বান জানায়, ‘লাগবি আমার সাথে?’
বড় হয়ে দুর্ধর্ষ গুন্ডা-মাস্তান হবে বকুল। বন্ধুদের কাছে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেই এ রকম কথা বলে। শুধু মুখের কথায় নয়, আচার-আচরণেও অ্যাম্বিশনটা বুঝিয়ে দেয়। মারদাঙ্গায় তার বাড়াবাড়ি রকম আগ্রহ। রোজ ঝগড়া কি মারামারি না করলে যেন  পেটের ভাত হজম হয় না তার।

বকুলকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য বাঘের মতো তার ওপর লাফিয়ে পড়েছিল কয়েকজন। দমাদম কিলঘুষিও মেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুস্তি লড়ে পরাস্ত হয় সবাই। কোথায় কার কাছে কেউ জানে না, বকুল কুংফু-কারাতে মারের দারুণ কিছু কায়দাও শিখে ফেলেছে।
একদিন স্কুলে ক্লাসের একটি ছেলেকে বিনা দোষে কারাতে  মেরে কুপোকাত করে ফেলে বকুল। ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করে ছেলেটি। কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারের কাছে গিয়ে বিচার দেয়।  হেডস্যার বিচার করতে ক্লাসে পাঠায় সবচেয়ে রাগী গেমস্যারকে।  গেমস্যার ক্লাসে ঢুকে দু’ইঞ্চি মোটা বেত প্রথমে টেবিলে মারলে টেবিল পর্যন্ত কঁকিয়ে ওঠে। এরপর বকুলের গুন্ডামি ছুটিয়ে দেয়ার জন্য ইচ্ছেমতো মেরে শাস্তি দেয়। কিন্তু  এত মার খেয়েও, বন্ধুদের কাছে হেসে বলেছে সে, একটুও লাগেনি তার। কারণ ভেতরে মোটা গেঞ্জি গায়ে বর্মের মতো ছিল। হাতে বেত পড়ার আগেই হাত সরিয়ে ফেলার কায়দা সে ভালোই জানে। আর পিঠ বেতের কাছে এগিয়ে দিয়েছে বলে বেতখানাও সুবিধা করতে পারেনি। তার ওপর  মুখে মিছেমিছি আহ্‌ উহ্ রব তুলে গেমস্যারের  রাগ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে।

হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ২-৩ বছরের মধ্যে ক্লাসের সেরা বখাটে ও বদ ছেলে হিসেবে বদনাম হয়েছে বকুলের।  ভাল ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলে। ঘনিষ্ঠ হয়েছে যারা, তারা বকুলের কিলচড়কে ঠাট্টা, কখনও-বা আদর ভেবেই  হজম করে নেয়। শুধু তো মার দেয় না, বন্ধুদের বিপদ-আপদে সে-ই এগিয়ে আসে প্রথম। ঝগড়া লাগলে বন্ধুদের পক্ষ নিয়ে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকি ছাড়াও মারামারি বাধাতেও দেরি করে না। বকুলকে নেতা হিসেবে মানতে শুরু করেছে অনেকেই। পকেটে পয়সা থাকলে বন্ধুদের খাওয়াতে সে কিপ্টেমি  করে না কখনও।
স্কুলে ক্যাপ্টেন হতে পারেনি, সেই রাগে মহল্লায় বন্ধুদের নিয়ে নিজেই একটা দল করেছে। ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতে নিজের টাকায় বল এবং স্ট্যাম্প, ব্যাটও কিনেছে। দলের ক্যাপ্টেন হয়েছে নিজে। নিজে ভাল খেলতে পারে না, কিন্তু ভাল খেলেও বকুলের উপর কেউ মাতবরি করতে পারে না।  ফাউল করলে রেফারির ভূমিকা নিয়ে শাস্তি দেয়। একজনকে মাঠ থেকে বের করেও দিয়েছে। দলের সবাই তাকে মানে এবং ভয়ও পায়।

ক্লাস এইটে উঠে বকুল তো লম্বায় কলেজে পড়া  ছেলেদের মতো বড় হয়ে গেছে প্রায়। ‘লম্বু’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল অনেকে। কিন্তু শুধু লম্বু হয়েও মন ভরেনি তার। সিনা আরো চওড়া এবং পেশিতে মাংস বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ব্যয়াম করে। প্রতিদিন পড়তে বসুক আর না বসুক, ব্যয়ামটা নিয়মিত করা চাই। ছোলা-গুড় ছাড়াও ডিম খায় রোজ। ডিমকে ওমলেট-মামলেট বানানো পর্যন্ত ত্বর সয় না, সরাসরি মুখে ঢেলে দেয়। একটুও মুখ বাঁকায় না। বন্ধুদের সামনেও আস্ত কাঁচা ডিম খেয়ে প্রমাণ দিয়েছে।
বকুলের বখাটেপনার কাণ্ডকীর্তি ক্লাসের এবং মহল্লার  খেলার সাথীরা তো রোজই দেখে। কিন্তু মহল্লার লোকজন এমনকি ঘরে বকুলের বাবা-মাও হয়তো ছেলের দুর্ধর্ষ মাস্তান হয়ে ওঠার খবর রাখে না।

সবাইকে জানিয়ে দেয়ার জন্য বকুল বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য একদিন খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী এক ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে গোটা শহরে হুলুস্থূল উত্তেজনা ছড়ায়।
খেলার মাঠে রক্ত ঝরানো ঘটনাটি রেলওয়ে জংশন শহরে সাড়া জাগানোর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমত ঘটনাটি ঘটেছে রেলওয়ের মাঠে। এ রেলের মাঠটি নিজেই একটি গোলমেলে এবং ভিড়বহুল জায়গা। আর মাথাটা ফেটেছে এই শহরের সেরা ধনি, পলিটিক্যাল নেতা ও ফার্স্টক্লাস কন্ট্রাকটার ওহাব খাঁর ছেলে রাজুর। রাজু বকুলের সমবয়সী ও সহপাঠী। তবে বকুলের মতো পচা স্কুলের ছাত্র সে নয়। সরকারি স্কুলে পড়ে, বাড়িতে এসেও প্রাইভেট পড়ায় চারজন টিচার।  বকুল ও তার দলের ছেলেদের সঙ্গে মেশে না পর্যন্ত। এমন একটি ভালো ছেলের মাথা ফাটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বকুল, রেলের মাঠ থেকে রাজুর বাবা ওহাব খাঁকেও উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছে। আর এ কাজে  নিজের মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও বঙ্গবন্ধুকেও মাঠে টেনে এনেছে বীরবিক্রমে।  

রেলের মাঠে মাথা ফাটানো যারা নিজের চোখে দেখেনি, বকুল কিংবা তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে যারা ভালো চেনেও না, তারাও লোকমুখে এ ঘটনা নিয়ে নানারকম কথা শোনে এবং নিজেরাও বলতে থাকে।  যেমন, বকুল আসলে শহরের সেরা মাস্তান কুলি সর্দারের চেলা। বকুলের বাবা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, লোকে ‘বিলাই মুক্তিযোদ্ধা’ নাম দিয়েছে। রেলে চাকরি করার সময়ে সে ঘুষ দিয়ে নিশ্চয়  রেলের মাঠটা নিজের নামে করে নিয়েছে। সেই জন্য মাঠের দখল নিতে ছেলেকে দলেবলে খেলতে পাঠায়। ওহাব খাঁকে ঠেকাতে ছেলেকেও মাস্তান বানিয়েছে। ওহাব খাঁও এবার বিলাই মুক্তিযোদ্ধাকে শহরছাড়া করবে। যত বড় মাস্তানই হোক,  ভ্যানিশ করে দেবে বকুলকে।

লোকমুখে নানা কথা ছাড়াও রেলমাঠের মারামারি নিয়ে পরদিন একটি খবরের কাগজেও দেড় ইঞ্চি খবর বেরুবে। ‘খেলার মাঠ নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ’ শিরোনামের খবরে কিশোর মাস্তান হিসেবে বকুলের নাম থাকবে।  প্রকৃতপক্ষে  রেলমাঠে যা যা  ঘটেছে, আর ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, তা জানার জন্য বকুল ও তার পরিবার সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলা দরকার।

২.
বকুলের বাবা  বিল্লাল মিয়া আসলেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সার্টিফিকেট আছে। মাসে এখন পাঁচ হাজার টাকা ভাতাও পান। তবে তার নাম শুনে বা চেহারা দেখে কেউ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় আন্দাজ করতে পারে না। ক্ষমতাবান লোকের নামের আগেপিছে পদবী থাকে সাধারণত। রিটেয়ার করেও আর্মি অফিসাররা নামের আগে মেজর, কর্নেল ইত্যাদি লেখে। কিন্তু বকুলের বাবা  লোকজনের কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ফলায় না কখনো।
বকুলই নিজের ক্ষমতা বাড়াতে বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গর্বের সঙ্গে বন্ধুদের জানায়। বিশ্বাস করেনি যারা, তারা আড়ালে বকুলের বাবাকে বিলাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে টিটকারি দিয়েছে। কারণ স্বভাবচরিত্রে বাবা ছেলের একদম বিপরীত, নিরীহ ভাল মানুষ।  অবশ্য ছোটবেলায় কেমন ছিল, সেটা কেউ জানে না। নিজেও  সে ভুলে গেছে বোধহয়।

বিল্লাল মিয়া এখন প্রায় বুড়ো মানুষ। রেলে ছোট চাকরি করেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে  বিভিন্ন স্টেশনে রেলের কলোনীতে থেকেছে দীর্ঘদিন।  ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য শেষ বয়সে রেলের  জংশন-স্টেশন ঘিরে গড়ে ওঠা শহরে দুই কাঁঠা জায়গা কিনে ছোট্ট একটি বাড়ি করেছে। মাথা গোঁজার এই জায়গাটুকু ছাড়া বিল্লাল মিয়ার আর কোনো সম্পদ নেই, আয়-উন্নতিও নেই।
বকুলের বড় ভাইদের একজন বাপের চাকরিটা পেয়েছে। বিয়েথা করে আলাদা হয়েছে সে। আর এক ভাই ঢাকায় সিএনজি চালায়। ভাইয়েরা নিজেরা তেমন মানুষ হয়নি। তবে রিটেয়ার করা বাপকে মাসে মাসে টাকা পাঠায় ছোট ভাইকে  মানুষ করার জন্য। ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আগাম প্রতিশ্রুতি দিয়ে,  স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য বকুল ভাইদের কাছে একটি ‘হিরো’ বাই-সাইকেলও কিনে নিয়েছে।

প্রাইমারিতে পড়ার সময় থেকেই বকুল তো বাড়ির বাইরে, রেললাইনে বা স্টেশনে ঘুরে সময় কাটাত বেশি। নিজের সাইকেল হওয়ার পর থেকে হয়েছে টো-টো কোম্পানির ম্যানেজার। সাইকেলে সামনে বা পেছনে বন্ধুকে বসিয়ে গোটা শহরে বানরের মতো দাপিয়ে বেড়ায়। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ওভারটেক করতে পারেনি। হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালানো এবং রেললাইনের উপর দিয়ে সাইকেল চালাতে গিয়ে দু’বার উল্টে পড়েছে বকুল। তারপরও বাহাদুরি দেখানোর স্বভাব কমেনি তার।
মহল্লায় নিজের স্পোর্টস টিম হওয়ার পর থেকে অবশ্য সাইকেল-রেস কমেছে তার। স্কুলে যাতায়াতের পর যেটুকু সময পায়, নিজের ক্লাবে কিংবা মাঠে বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটায়। রেললাইনের একটা ফাঁকা জায়গায় ক্লাব-অফিস বানিয়েছে বকুল। লাইনের উপরে বা স্লিপারে বসে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়। মাঠ ফাঁকা না পেলে লাইনের ধারে নানারকম খেলাধূলার চেষ্টা করে। পাথর ছুড়ে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা করে। খেলা ও ক্লাব ভেঙে দেয়ার জন্য ট্রেন ছুটে আসলে ট্রেনকেও ধমক দেয় বকুল, ‘এই বেটা খাড়া, আমরা অহন মিটিং করতাছি, দেহস না?’

রেললাইনের উপর খেলাধূলায় বাধা একমাত্র ট্রেন, কিন্তু রেলের মাঠটায় খেলার বাধা অনেক। রেলের ওই ফাঁকা জায়গাটুকু ছাড়া বকুলদের মহল্লায়  খেলার জন্য একটা ফাঁকা মাঠও নেই। বছর কয়েক আগেও মহল্লায় কিছু ধানক্ষেত ছিল। ধান হওয়ার আগে বা পরে ক্ষেতগুলিকেই মাঠ বানিয়ে খেলা যেত কিছুদিন। কিন্তু মহল্লাটিও পৌরসভায় ঢুকে যাওয়ায় ক্ষেতগুলিতেই হু হু করে পাকা বাড়ি গজিয়ে গেছে। গিজগিজে মানুষ আর ঘরবাড়ি। বকুলদের বাড়ির পাশে তিনতলা, চারতলা বাড়ি হয়েছে কয়েকটি। শহরে স্টেডিয়ামও হয়েছে একটা। কিন্তু রেললাইন ঘেঁষা বকুলদের মহল্লায় শত শত ছেলেদের জন্য একটাই মাত্র খেলার মাঠ।  ঠিক  খেলার মাঠও নয়, রেলের খানিকটা ফাকা জায়গা।
বিকেল হলে এলাকার পিচ্চি থেকে জোয়ান- সব বয়সী ছেলেরাই রেলের মাঠে ভিড় জমায়। বকুলও এই মাঠের উপর নির্ভর করেই তার দল গড়েছে। মাঠে যেদিন যুবকেরা ম্যাচ খেলে, সেদিন মাঠে খেলার জন্য তাদের খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।  এ সময়টায় খেলা দেখা কিংবা রেললাইনের ক্লাবে বসে আড্ডা দেয়া ছাড়া করার কিছু থাকে না। বকুল ইচ্ছে করলে অবশ্য বড়দের সঙ্গেও খেলতে পারে। লম্বু হওয়ায় সিনিয়রদের পাশে তাকেও বড় মনে হয়।  কিন্তু দলের বন্ধুদের ছেড়ে বকুল একা কোথাও খেলে না। ক্যাপ্টেন হিসেবে তাকে মাঠ দখলের জন্য আগেভাগে থাকতে হয়। পিচ্চিগুলিকে দাবড়ে ভাগানো ছাড়াও,  বড় ভাইদের সঙ্গে ঝগড়াও করতে হয় অনেক সময়।

একদিন ছুটির দিন দুপুরে  দলের ছেলেদের নিয়ে বকুল আগেভাগে মাঠে গিয়ে দেখে, মাঠটা আর আগের মতো নেই। বাঁশের বেড়া দিয়ে অনেকটা জায়গা ঘেরা হয়েছে। মাঠের কাছেই ওহাব কন্ট্রাকটারের চারতলা বাড়ি। বেড়া যে  ওহাব খাঁই  দিয়েছে, না দেখেও বুঝতে পারে লোকজন।
ওহাব কন্ট্রাকটার রেলের মাঠটাও কিনে নেবে, ভবিষ্যতে এ মাঠে আর খেলা যাবে না। এ রকম কথা অবশ্য অনেকদিন ধরেই বলাবলি করছিল লোকে। বকুলের বাবা রেলে চাকরি করেছে বলে রেল বিভাগের ভিতরের অনেক খবর জানে। বাবাকেও একদিন জিজ্ঞেস করেছিল বকুল, ‘ওহাব কন্ট্রাকটার কি রেলের মাঠটাও কিইনা নিতে পারব বাবা?’
বকুলের বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিয়েছে, ‘যুদ্ধ কইরা দেশটা স্বাধীন করলাম আমরা, কিন্তু দেশের সম্পদ লুইটাপুইটা খায় ওহাব কন্ট্রাকটারের মতো মানষে। কোটি কোটি টাকার মালিক হইছে।  টাকা আর পলিটিক্যাল ক্ষমতার জোরে এখন হ্যারা সবই করতে পারে। এইসব লোকের কারণে স্বাধীন দেশটায় শান্তি আসল না।’
শুধু বকুলের বাবা নয়, ওহাব খাঁর টাকা ও ক্ষমতার খবর শহরের সবাই জানে। মহল্লার সবচেয়ে বড় বাড়ি তার। গাড়িও কিনেছে। রাজনৈতিক দল করে। থানা-পুলিশও তাকে ভয় করে চলে। ওহাব খাঁর ছেলে রাজু মাস কয়েক আগেও বকুলের দলের সঙ্গে খেলেছে। বাপের বড়লোকি নিয়ে গর্ব করার কারণে বকুল তাকে টিমে রাখেনি। মাঠ থেকেও বের করে দিয়েছিল একদিন।


মাঠে বেড়া দেখে বকুলের দলের একজন রাজুকে বহিষ্কারের ঘটনা স্মরণ করে বেড়ার রহস্যটি খোলাসা করে, ‘বকুল মনে আছে, তুই যে রাজুকে  একদিন মাঠ থাইকা গেটআউট করলি? প্রতিশোধ নিতে রাজুই বাপকে দিয়ে এ  বেড়া দিছে। আমাদের হালা ছাগল ভাবছে।’
‘বেড়া দিছে বইলা কি মাঠখান হ্যার বাপের সম্পত্তি হইছে? বেড়া ভাইঙাই আজ খেলুম আমরা, চল।’
বাঁশের বেড়া ভেঙে ক্যাপ্টেন বকুলই সাথীদের মাঠে ঢোকার হুকুম দেয়। খেলাও জমে ওঠে যথারীতি।

৩.
বেড়া ভেঙে যেদিন মাঠে খেলা চলে, সেদিনও খেলা দেখার জন্য ছোট বড় অনেকেই মাঠে জড়ো হয়। মহল্লার অনেক ছেলে খেলার আনন্দ খেলা দেখেই পেতে চায়। মাঠের বাইরে বল গেলে নিজেও একজন খেলোয়াড়ের মতো বলে কিক দেয়ার সুযোগটি ছাড়ে না।  আবার কাজ নেই বলে বয়স্ক অনেকেই রেলমাঠে বসে থাকে।  একই সঙ্গে তাদের সময় কাটানো, খেলা দেখা এবং আরামও হয়।
মাঠের বাইরের সেদিন দর্শকদের মাঝে রাজু কখন দু’জন সঙ্গী নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, বকুলের দলের কেউ দেখেনি। বল একবার মাঠের বাইরে গেলে রাজু  প্রথম বলটিকে গ্রেফতার করে। চেঁচিয়ে সবার কাছে কৈফিয়ত চায়, ‘ওই বান্দররা, তোরা কার হুকুমে বেড়া ভাইঙা আমাদের মাঠে ঢুকছস? কার অনুমতি নিছস খেলার জন্য?’
ক্যাপ্টেন হিসেবে বকুলই রাজুর সামনে এগিয়ে যায়, নিজের বুক থাপড়ে বলে, ‘আমার হুকুম। আমার মাঠের বেড়া আমি ভাঙছি। তুই আমার বল ধরেছিস কেন?’
‘এইটা কি তোর বাপের জমি?’
‘হ্যাঁ, আমার বাপের জায়গা। আমার বাপ কে জানস?’

বকুলের বাপ যে রেলে সিগনালম্যানের চাকরি করত, সবাই জানে। কিন্তু রেল স্টেশন বা অফিসে পিয়ন-কুলিদের যে দাপট, বকুলের বাবার  সেটুকুও নেই। তার দৌড় এখন বড়জোর রেলওয়ের মসজিদ পর্যন্ত। কাজেই মাঠটাকে বাপের বলে দাবি করে বকুল কি ঠাট্টা করে, নাকি আর কোন বাপকে চেনাতে চায় সে? সবাই তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
‘তোর বাপ তো বিলাই, আমার বাপ দাবাড়ি দিলে টাউন ছাইড়া পালাইতে পথ পাইব না।’
‘জানস না, আমার বাপ একজন মুক্তিযোদ্ধা? বঙ্গবন্ধুর হুকুমে যুদ্ধ কইরা এ  দেশ স্বাধীন করছে।  বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী হইয়া দেশ চালায় এখন। আমার মুক্তিযোদ্ধা বাপ মাসে পাঁচ হাজার টাকা সরকারি  ভাতা পায়। সেই টাকায় আমি বল কিনছি। আর সরকারি মাঠে খেলতাছি। তুই বাধা দেয়ার কে?  হু আর য়ু হারামজাদা!’
‘এরকম চাপা মারলে আব্বাকে এখনই ডাইকা আনব কিন্তু। তখন সবাই ল্যাংটি তুইলা তো পালাবি, তোর মুক্তিযোদ্ধা বাপ আর বঙ্গবন্ধুও পালাইব।’
রাজুকে মারার জন্য বকুলের হাত নিশপিশ করছিল। জাতির পিতাকেও রাজু তুচ্ছ করায় সে আর এক সেকেণ্ডও দেরি করে না। প্রথমে রাজুর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে হুকুম দেয়, ‘যা ডাইকা আন তোর বাপকে, কুংফু মাইরা  তোর বাপেরও পা ভাইঙা দিমু।  তোর বাপ যে দুর্নীতি আর লুটপাট কইরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হইছে, মহল্লার হক্কলই জানে। আমাদের সরকারি খেলার মাঠ দখল করতে আসলে তোর বাপকেও আমি ছাড়ুম না। ’

চড় খেয়ে রাজু গাল চেপে বাপকে ডেকে আনার জন্য চুপচাপ চলে গেলে তার মাথাটা ফাটত না। চড় খেয়ে পাল্টা কিলচড় দিলেও হয়তো বকুলের মাথায় খুন চাপত না। কিন্তু ভয়ে চলে যাওয়ার বদলে রাজু বুকলের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তার গলা টিপে মারার তেজ দেখায়। তার সঙ্গী দু’জনকেও আহ্বান জানায়। তখন রাজুকে  মেরে কুপোকাত করে মাটিতে শুইয়ে দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না বকুলের।
পরাস্ত প্রতিদ্বন্দ্বিকে ছুটে পালাবার সময় দেয় বকুল। পরাজয় মেনে রাজুও উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করে, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই মাঠে পড়ে থাকা একটা ভাঙা ইট কুড়িয়ে নিয়ে আবার রুখে দাঁড়ায়। বকুলকে লক্ষ্য করে ছুড়ে  দেয় ইটটা। মাথাটা বিদ্যৎ বেগে সরিয়ে নিয়ে বকুল নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু তার পাশে দাঁড়ানো দলের লাইজুর মুখের উপর সশব্দে আঘাত করে ইটটি। মুখের রক্ত চেপে ধরে লাইজু মাটিতে বসে পড়ার আগে, হাত মেলে বকুলকে রক্ত দেখায়।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুর রক্ত দেখে স্থির থাকতে পারে কোনো ক্যাপ্টেন? ইটটা কুড়িয়ে নিয়ে সে প্রতিপক্ষের পিছু ধাওয়া করে। বকুলের পিছে তার দলের আরো কয়েকজন।
রাজুর সঙ্গী দু’জন জোরে ছুটে পালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজু তেজ দেখাতে, কিংবা খুব ভয় পাওয়ার কারণেও হতে পারে,  আবার মাথা ঘুরিয়ে রুখে দাঁড়ায়। ফলে বকুলের হাতের ইটের এক আঘাতেই মাথাটা ফেটে যায় তার এবং তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।

লড়াই দেখার জন্য বকুলের পক্ষে বা বিপক্ষে যারা ভিড় করেছে, তারা এক পক্ষের এমন পরাজয় আশা করেনি।  ততক্ষণে ধরাশায়ী অজ্ঞান রাজুর মাথার কালো চুল বেয়ে রক্ত চুয়ে পড়তে শুরু করেছে। ভিড়ের দর্শদের মাঝে আর্তচিৎকার ওঠে, ‘হায়, হায় ! কন্টাকদারের পোলাটা মইরা গেল নাকি? মাথা ফাইটা গেছে। গলগল কইরা রক্ত পড়তাছে। জলদি হাসপাতালে লইয়া যাও।’
শত্রুপক্ষ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় বকুলও স্তম্ভিত। দলের ছেলেরা করণীয় জানতে বকুলের দিকে তাকায়। বকুল নির্দেশ দিতে বিলম্ব করায় কয়েকজন ছুটে পালাতেও শুরু করে। মাঠের আতঙ্ক-উত্তেজনা সাময়িক আড়াল করতে এ সময়ে রেললাইনের উপর ঝমঝম করে একটি ট্রেন আসে। বকুলের দলের আহত লাইজু উঠে দাঁড়িয়ে নিজে পালানোর আগে বকুলকেও সতর্ক করে, ‘বকুল পালা, রাজুর বাপ ছুইটা আসলে আমাদের গুলি করব কিন্তু। তার পিস্তল বন্দুক আছে।’
মাঠে দলবল ছাড়া নিজেকে একা আবিষ্কার করে বকুলও  ধীরেসুস্থে মাঠ থেকে বেরিয়ে যায়।

৪.
রাজু মরে যায়নি এবং নিজেদের গাড়িতে করে ওহাব খাঁ ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। খবরটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফেরে বকুল।  বাসায় ফিরেই বাবাকে খোঁজে আজ।
বাবা সকালে গ্রামের বাড়িতে গেছে। ফেরেনি এখনো। বকুলের মা কানে কম শোনে। ফলে মাঠের মারদাঙ্গা ঘটনা এখনো টের পায়নি সম্ভবত। বকুল স্বস্তি বোধ করে। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। সাধারণত রাত আট-নয়টার আগে পড়তে বসার সময় হয় না তার। আর টিভিতে খেলা থাকলে সেদিন পড়া মাফ। কিন্তু আজ অবেলায় ছেলের পড়ার মন দেখে মা অবাক, আবার খুশিও হয়। গরম চিতই পিঠা ভাজতে বসে ছেলের জন্য।
পড়তে বসেও রেললাইনের ক্লাব কিংবা ট্রেনের আওয়াজ রোজই পড়ার মনকে টেনে নিয়ে যায় কয়েকবার। কিন্তু আজ পড়ায় একদম মন বসাতেই পারে না বকুল। মনে হয় ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়েও বাইরে বড় ধরনের হইচই গোলমাল হচ্ছে। হাসপাতালে গিয়ে রাজু কি তবে মরেই গেল? পুরো মহল্লার মানুষ ছুটে যাচ্ছে তাদের বাড়ির দিকে? নাকি ওহাব কন্ট্রাকটার থানার পুলিশ নিয়ে বকুলকে ধরার জন্য ছুটে আসছে? রাজু মরুক বা বাঁচুক, তার বাবা চুপচাপ বসে থাকবে না। তার মানে মরা-বাঁচা যুদ্ধের মুখে পড়েছে বকুল। এখন ভাল ছেলের মতো পড়ায় সে মন দেয় কী করে?

বাবার মুখের দিকে তাকালে প্রায়ই একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পায় বকুল। মুক্তিযুদ্ধের কথা ভাবলে বঙ্গবন্ধুর কথাও মনে পড়ে। আজ বাবা ঘরে নেই, তবু বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টাই ভাবে সে। ছোটবেলায় বকুল গল্প শুনতে চাইলে ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাত বাবা। পাকবাহিনী যখন তাদের শহরে হানা দিয়েছিল, তখন গ্রামের সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। বাবা ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিল অস্ত্র আর ট্রেনিং নেয়ার জন্য। তারপর মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে  নয় মাসে বাবা কত অপারেশন চালিয়েছে!
কিছুদিন আগেও জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের রেকর্ড ঘরে বসে শুনছিল বাবা। সেই ভাষণ শুনে বাবা বলেছে, ‘এই বজ্রকণ্ঠ শুইনাই আমরা নয়মাস জীবন হাতে নিয়া যুদ্ধ করার বল পাইছিলাম, আর অহন!’
বাবা গতবার বকুলকে নিয়ে ঢাকায় মেজ ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। বকুলকে বত্রিশ নাম্বারে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরও দেখিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ঘরদুয়ার, তার ব্যবহার করা জিনিসপত্র এবং সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে যেখানে গুলি করেছিল, সেইখানে গুলি আর রক্তের দাগ যেন এখনো লেগে আছে। বত্রিশ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর দেখার গল্প বকুল বন্ধুদের কাছেও করেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতার কথা তো সে বইয়েও পড়েছে।

সেইবার ঢাকা থেকে ফিরে নিজের ঘরেও বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি সেঁটে দিয়েছিল বকুল। বাবা দেখে খুশি হয়েছে। বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জাগাতে সেদিন  খোঁচা দিয়ে বলেছিল বকুল, ‘বঙ্গবন্ধু আর পরিবারের সবাইরে শয়তানরা গুলি কইরা খুন করল, আর তোমরা মুক্তিযোদ্ধারা কি খালি বইয়া বইয়া কাঁদছিলা বাবা?’
বাবাকে  আড়ালে অনেকে ‘বিলাই মুক্তিযোদ্ধা’ কয়। কথাটা নিজের কানেও শুনেছে বকুল। বিড়ালের মতো ম্যাঁওম্যাঁও কইরা জবাব দিয়েছে সে, ‘বঙ্গবন্ধু নাই শুইনা কাঁদা ছাড়া আর কী করতে পারতাম কও। আমাদের হাতে তো অস্ত্র ছিল না, ক্ষমতাও না।’
ক্ষমতা নেই বলে স্বাধীন দেশে ক্রমেই দুর্বল হয়ে গেছে। চাকরিতে ঢুকেও বাবা ঘুষ খেয়ে অনেক টাকার মালিক হতে পারেনি। বাবাকে  কেউ ভয় পায় না। বাবার বিলাই অপবাদ ঘোচাতেই তো বকুল তার মু্ক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের সঙ্গে  বঙ্গবন্ধুর নামও করেছে। মিথ্যে কিছু বলেছে কি সে? তারপরও বকুল শতভাগ নিশ্চিত, বাড়িতে ফিরেই বাবা আজকের মারামারির ঘটনা জানলে বকুলকেই বাঘের মতো দাঁত দেখাবে। সত্যি সত্যি মারতেও পারে আজ।
বাবা বাড়িতে ফেরার আগে জানালার বাইরে ভূতের মতো দুইটা ছায়ামূর্তি দেখে চমকে ওঠে বকুল। নিজের দলের লাইজু আর নূরুল এসেছে চোরের মতো। ইশারায় বকুলকে ডাকে তারা। পড়া ছেড়ে বকুলও চুপি চুপি বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

৫.
মহল্লার নির্জন জায়গা রেললাইনের উপরে বকুলদের ক্লাব। বন্ধুদের নিয়ে বকুল অন্ধকারে লাইনের উপরে বসে। ফিসফাস স্বরে কথা বলে তারা। লাইজু আর নুরুল সর্বশেষ খবর জানায়। রাজুর মাথা ফেটে দু’ফাঁক হওয়া দূরে থাক, এক ফোঁটা ব্রেণও আউলায় যায় নাই। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। রাজু বাপের কাছে সবার নাম বলে দিয়েছে। আর তার বাবা এতক্ষণে সব থানা পুলিশকে ফোন করার কাজ  শেষ করেছে। ঘুষ দেয়ার জন্য বস্তাভরা টাকাও রেডি করেছে।
এসব খবর শুনিয়ে লাইজু বকুলকে বলে, ‘রাইতেই পুলিশ আমাদের ধরতে আসব রে বকুল। বাড়িতে থাকা আমাদের ঠিক হবে না।’
‘চল, আমরা রাইতের মেল ট্রেনে ঢাকা পলায় যাই।’
‘তোরা পালাবি কেন? রাজুর মাথায় ইট তো আমি মারছি,  বেড়া ভাইঙা মাঠে খেলার হুকুমও আমি দিছিলাম। রাজুই তো পয়লা তোর মুখে ঢিল দিয়া রক্ত বাইর কইরা দিল। তুই পালাবি ক্যা?’
ঢিল লেগে লাইজুর গাল কেটে যাওয়ায় ওষুধের দোকানে মাগনা ওষুধসহ পট্টি লাগিয়ে দিয়েছে। সেই পট্টির উপর হাত রেখ লাইজু বলে, ‘রাজুর ইঁটা খাইয়া আমার দাঁতটা পইড়া গেলেই ভাল হইত রে। সেই দাঁতটারে সাক্ষী হিসাবে পুলিশরে দেখাইতে পারতাম। কিন্তু অহন তো আমার গালে পট্টি দেইখা পুলিশ আমারেও বড় আসামী বানাইব।’
‘পুলিশরে আমরা সব সত্যি কথা জানামু।’
‘পুলিশ ঘুষ খাইয়া মিথ্যারে সত্য কয়, সত্যরে মিথ্যা বানায়। ওহাব খাঁর মতো বস্তা ভরা টাকা ঘুষ দিতে পারবি পুলিশকে?’
‘পুলিশ যদি ধইরা নিয়া যায়, যাবে। জেলেই যাব। এ  দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধু জীবনে কত বছর জেলে ছিল, জানস?’
‘ধ্যাত! তুই বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযোদ্ধা বাপের কথা বইলা আরো ভেজাল  লাগাইছস।’
‘আমার আব্বায় কয়, ওহাব খাঁ তোর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে আসামী করছে। আমার আব্বারও নাম আছে, রাইতে সেও বাড়িতে থাকব না।’
‘পুলিশ মনে হয় এতক্ষণে আইয়া পড়ল রে! চল,  চল, আমরা তাড়াতাড়ি পালাই।’

বকুলের বাবার কথা মনে আবার। বাবা ফিরে বাড়িতে বকুলকে না দেখলে আরো চিন্তা করবে। আর বকুলকে না পেয়ে পুলিশ বিনাদোষে বাবাকে ধরে নিয়ে যাক, বকুল তা চায় না। উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের বলে সে, ‘তোরা আজকের রাইতটা কোনোহানে পলাইয়া থাক। আমার বাবা বাড়িতে নাই, দেহি সে ফিরল কি না।’
বকুল বাড়িতে ফিরতে দেরি করলে  বাবা-মা খুব টেনশন করে। আজ বাবা বাড়িতে নেই এবং এখনও ফিরছে না  বলে বকুলেরও খুব টেনশন হতে থাকে।

৬.
রাতে পুলিশ আসার আগেই বিল্লাল মিয়া বাড়িতে  ফেরে। মহল্লায় সাড়া জাগানো ছেলের কাণ্ডকীর্তির খবর বাড়িতে ঢোকার আগেই  জেনে গেছে সে। ঘরে এসেই আজ তাই বকুলের খোঁজ নেয়।
কানে খাটো হলেও ছেলের নামে কেউ বদনামি গাইলে বকুলের মা ঠিকই বুঝতে পারে। আজো যে তার ছেলের নামে মহল্লায় ঢিঢি পড়েছে, তাও বুঝতে পেরেছে সম্ভবত। স্বামীকে তাই আশ্বস্ত করে, ‘মানষে বকুলের নামে কতো আকথা-কুকথা কয়। আজ সাঁঝের আগে ঘরে পড়তে বসেছে বকুল। লেখাপড়া শিইখাই আমার পোলা প্রমাণ করব সে ভালা না খারাপ।’
‘তোমার পোলা যে আজ ওহাব খাঁর পোলার মাথা ফাটায় দিছে, জানো খবর? মহল্লার মানুষ তারে কুলি মাস্তানের চাইতেও ড্যাঞ্জারাস বলতেছে।’
‘সব মানষের মিছা কথা। পরের গিবদ গাওয়া তাগো জাতের খাচলত।’
বকুলের বাবা এবার বকুলকে ডেকে, তার কাছে আসল ঘটনা জানতে চায়।
‘রাজুর মাথায় কেন ইটা মারছি, সেইটা জানলে তোমারও মাথা গরম হইব বাবা।’
‘কী ক্ষতি করছে তোমার কন্ট্রাকটারের পোলায়?’
‘রাজু তোমারে বিলাই মুক্তিযোদ্ধা কইছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুরেও  অপমান করছে।’

বাবার মাথা কতটা গরম হয়, বকুল বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ম্যাঁওম্যাঁও কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘বিলাইই তো, ওহাব খাঁর মতো মানুষের কাছে আমি মশামাছিও না। কোনো দলেবলে নাই,  আল্লাবিল্লা কইরা একা কোনোরকমে টিইকা আছি। অহন ওহাব খাঁর মতো মানুষ যদি আমগো পিছু লাগে, পারমু তার সাথে?’
বকুল পিতাকে সাহস দেয়, ‘মারামারি লাগলে রাজুর বাপও পারব না আমার সাথে।’
‘চোপ। মারামারি শেখানোর জন্য কি তোমারে এত কষ্ট কইরা পড়াইতেছি? বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করছিল কি তোমার মতো গুণ্ডামাস্তান তৈরির জন্য? আসুক, পুলিশ যদি আসে, তোমাকে আমি পুলিশের হাতেই তুইলা দিমু। পুলিশ না আইলেও কাইল নিজে ওহাব খাঁর বাড়িতে ক্ষমা চাইতে যামু।’
বাবার ধমক খেয়ে বকুল আবার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে। পড়ায় মন দেয়ার জন্য নিজের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। আর বকুলের মা কী  বোঝে কে জানে, চোখের জল মুছে স্বামীকে বলে, ‘বকুলরে ঢাকায় কাজলের কাছে রাইখা আইস। বাড়িতে থাকলে এতো গ্যাঞ্জামে ওর  লেখাপড়া হইত না।’

এক সময় বকুল ও তার বাবা-মায়ের মনে কী হয়, কী হয় ভয়-ভাবনা কমতে শুরু করে। ভয় আরো কমানোর জন্য পড়া ছেড়ে বকুল টিভিও ছাড়ে। টিভির খবর চাপা দিয়ে দরজায় টোকার আওয়াজ বাড়িতে বোমা পড়ার মতো আতঙ্ক জাগায়।
বকুলদের বাড়িতে ঢোকার গলিতে চার চাকার গাড়ি ঢোকে না। ওহাব খাঁ তার গাড়ি বড় রাস্তায় রেখে, যুবক সঙ্গীদের নিয়ে চুপচাপ বাড়িতে এসেছে। দরজা খোলা উচিত কিনা, বোঝার জন্য বাবা-ছেলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। শেষে বিল্লাল মিয়া বকুলকে তার ঘরে লুকাতে বলে ঘরের দরজা খুলে দেয়। সালাম দিয়ে ঘরে স্বাগতম জানায়।
ওহাব খাঁর সঙ্গী দুই যুবককেও মোটরসাইকেলে শহরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছে বিল্লাল। কিন্তু তাদের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ওহাব খাঁর মতো মানুষ তার বাড়িতে আসবে, স্বপ্নেও ভাবেনি বিল্লাল। বুক দুরুদুরু করে তার।
‘বিলাই মিয়া, তোমার পোলা বকুল যে মহল্লায় এত বড় মাস্তান হইছে, জানতাম না। প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার মানুষের সামনে মাথায় বাড়ি দিয়া আমার রাজুকে খুন করতে চাইছিল। অল্পের জন্য আল্লাহ তারে প্রাণে বাঁচাইছে। তা ঘটনার সময় তুমিও তো ছিলা মাঠে, ছিলা না?’
‘জে না খাঁ সাব, আমি গ্রামের বাড়িতে গেছিলাম। একটু আগে ফিইরা খবরটা পাইছি। তারপর বাড়িতে আইসাই বকুলরে বহুত শাসন করতে আছিলাম। এমন সময় আপনি আইলেন।’
‘কী শাসন করবা তুমি! প্লান-প্রোগ্রাম কইরা আমার ছেলের উপর হামলা চালানো হয়েছে। আবার প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে রেলের মাঠে আমারে ঢুকতে দিব না। তা তুমি রেলের জায়গা দখলে ছেলের দলের সাথে ছিলে না দাবি করছো, ঠিক আছে। তা হলে তোমার ছেলের দলের পেছনে কারা ইন্ধন দিতাছে, সেই নামগুলি অন্তত আমার কাছে বলো।’
‘দেখেন খাঁ সাহেব, বকুল ছেলেমানুষ। ও কোনো রজনৈতিক দলাদলিতেও নাই।  মহল্লায় খেলার জায়গা নাই বইলা আপনার ফাঁকা জায়গায় খেলতে গেছিল। আমি তারে নিষেধ করছি, জীবনেও আর যাইব না। ছেলের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই খাঁ সাহেব।’
‘ক্ষমা করার জন্য আমি  তোমার ঘরে আসি নাই। তোমার ছেলেরে কে লিড দিতাছে, সেইটা জানতে আইছি।’

ওহাব খাঁর সঙ্গী যুবকদের একজন ধমকায়, ‘আপনার মাস্তান পোলা কই? কই লুকায় রাখছেন তারে?’
‘ডাক দেন বকুলরে। তার কাছেই  আমরা আসল খবর  জানতে পারব। ’
বিল্লাল মিয়া আমতা আমতা করে, ‘আমি তো দেখি নাই ...
পাশের ঘর থেকে বকুল সবই শুনছিল। বাবাকে আসল ঘটনা বলার পরও বাবা ভয়ে মিনমিন করছে দেখে সে নিজেই এবার শত্রুপক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘আপনার ছেলে রাজুই আমার মাথায় আগে ঢিল দিছিল আংকেল। লাগলে আমার মাথাটাই আগে ফাইটা যাইত। সত্যি কিনা, মাঠের মেলা মানুষ সাক্ষী দিব।’
‘আমার ছেলে দোষ করে থাকলে তার বিচার করার মালিক কি তুমি? এত বড় সাহস কোথায় পাইলা তুমি? কার কাছে?’
‘আপনার ছেলে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাপ আর বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার সাহস পাইল কই?’
ওহাব খাঁ এবার কয়েক মুহূর্ত বকুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঠাণ্ডা গলায় কথা বলে।
‘আচ্ছা, তোমার বাপও তাইলে মুক্তিযোদ্ধা! তা ছেলেকে ভালই পলিটিক্স শিখাইছো বিলাই মিয়া। বঙ্গবন্ধুর নামে সারা দেশে কতোজন কতোভাবে সুবিধা লইতাছে। তা বাপের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় লইয়া তুমিও যদি কিছু সুবিধা লইতে পারো, আমার আপত্তির কিছু নাই। আমি শুধু জানতে চাই তোমার পেছনে সরকারি দলের আর কোনো যুব নেতা, ছাত্র নেতা আছে?’

ওহাব খাঁর সঙ্গী ধমক দিয়ে বলে, ‘তুই  এই বয়সে কোন দলে ঢুইকা পলিটিক্স করস শুনি? তোর লিডারের নাম ক।’
‘বঙ্গবন্ধু আমার নেতা। আমি কোনো দল করি না।’
‘তার মানে, তুমি  রেলের মাঠরে যে খেলার মাঠ করার ডিক্লায়ার দিছো, তার পেছনে সরকারি দলের কোনো নেতা বা মুক্তিযোদ্ধা বাপ জড়িত নাই?
‘না, আমার বাবারে দোষ দেন কেন? সে আপনাগো কী ক্ষতি করছে?’
ওহাব খাঁর সঙ্গীদের একজন বকুলকে ধমক দেয়, ‘এ্যাই, তোর গলায় অহনো এতো ত্যাজ কেন? ফের যদি ওই রেলের মাঠে তোরে খেলতে দেখি, তা হইলে তোর বঙ্গবন্ধু বাপও কিন্তু তোরে বাঁচাইতে পারব না। কথাটা মনে রাখিস।’

চলে যাওয়ার আগে ওহাব খাঁ শেষ কথা জানায়, ‘ঠিক আছে বিলাই মিয়া, আমার রাজুর এ্যাটেম্ট টু মার্ডার কেসে তোমার ছেলের বিচার আইনে যা হবার হইব। আমার ছেলের সিটিস্ক্যানে যদি গুরুতর কিছু ধরা পড়ে, তোমাকে তার সব চিকিৎসা ব্যয় দিতে হবে কিন্তু।’

৭.
ওহাব খাঁর আগমন বাড়িতে বোমা পড়ার ভয় জাগিয়েছিল, আসলেও লোকটা যে বাড়িতে টাইমবোমা ফেলে দিয়ে গেছে, সেটা তারা চলে যাওয়ার পরই বকুলের মায়ের চোখে যেন প্রথম ধরা পড়ে। ছুটে এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, ‘কী হইছে? ওহাব খাঁ গাড়ি চইড়া গুন্ডা লইয়া আমাদের বাড়িতে আইল কেন?  মহল্লার  কতো লোক তার গাড়ির কাছে জড়ো হইছে। বকুলরে নিয়া  এতো কথা কইতাছে কেন!’
বিল্লাল মিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীর কান্নার সঙ্গে নিজের আতঙ্ক যোগ করে।
‘এখন তো ওহাব খাঁ জাইনা গেল, রেলের মাঠ দখল করায় তার বিরুদ্ধে সরকারি দলের নেতা-ক্যাডার কেউ নাই।  তোমারে এবারে সে উচিত শিক্ষা দিব, আমারেও  ছাড়ব না।’
‘আপনি অক্ষনই ওরে ভাইয়ের বাসায় পাঠায় দেন।’
‘তুমি আবারও ওহাব খাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর কথা কইতে গেলা কেন?  অহন পুলিশ আইলে কে বাঁচাইতে আইব তোমারে?’
বকুল বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পায় না।  ভিতরে বঙ্গবন্ধুর  বজ্রকণ্ঠ শুনতে পায়- রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।

বাবা-মাকে ধমক মেরে সান্ত্বনা দেয় বকুল, ‘আমারে নিয়া তোমরা চিন্তা কইরো না তো।’
অতপর এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বকুল। নিজের মুক্তি, নেতা কিংবা দলবল খুঁজতেই কি না কে জানে- অন্ধকারে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়  সে, তার বাবা-মাও জানতে পারে না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়