ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বর্মা মুলুকে || দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ১১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্মা মুলুকে || দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

আবার পর বৎসরের, আশ্বিন মাসে শরতের শোভা প্রকাশ হইল, আমার মনে ভ্রমণের ইচ্ছা প্রদীপ্ত হইল। এবার কোথায় বেড়াইতে যাই, তাহার কিছুই নিশ্চয় করিতে পারিতেছি না। জলের পথেই বেড়াইতে বাহির হইব, এই মনে করিয়া গঙ্গাতীরে নৌকা দেখিতে গেলাম। দেখি যে বড় একটা স্টিমারে খালাসিরা তাহাদের কাজকর্মে বড়ই ব্যস্ত রহিয়াছে। মনে হইল এই স্টিমারটা শীঘ্রই বাহিরে যাইবে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই স্টিমার এলাহাবাদ কবে যাইবে?
তাহারা বলিল যে, এই স্টিমার দুই-তিন দিনের মধ্যে সমুদ্রে যাইবে।

জাহাজ সমুদ্রে যাইবে শুনিয়া আমার সমুদ্রে যাইবার ইচ্ছা পূর্ণ হইবার বড়ই সুবিধা মনে করিলাম। আমি অমনি কাপ্তেনের কাছে যাইয়া তাহার একটা ঘর ভাড়া করিলাম। এবং যথা সময়ে তাহাতে চড়িয়া সমুদ্রযাত্রায় বহিগৃত হইলাম। সমুদ্রের নীল জল ইহার পূর্বে আর আমি কখনো দেখি নাই। তরঙ্গায়িত অনন্ত নীলোজ্জ্বল সমুদ্রে দিনরাত্রীর বিভিন্ন বিচিত্র শোভা দেখিয়া অনন্ত পুরুষের মহীমায় নিমগ্ন হইলাম। সমুদ্রে প্রবেশ করিয়া তরঙ্গে দুলিতে দুলিতে এক রাত্রির পর বেলা ৩টার সময় একটা স্থানে জাহাজ নোঙর করিল। সম্মুখে দেখি, একটা শ্বেত বালুর চড়া, তাহার উপরে একটা বসতির মতো বোধ হইল। আমি একটা নৌকা করিয়া তাহা দেখিতে গেলাম। বেড়াইতে বেড়াইতে দেখি যে, কতকগুলা মাদুলি গলায় চট্টগ্রামবাসী বাঙালিরা আমার নিকট আসিতেছে। আমি তাহাদিগকে বলিলাম, ‘তোমরা যে এখানে? তোমরা এখানে কী করো?’
তাহারা বলিল, ‘আমরা এখানে ব্যবসাবাণিজ্য করি। আমরা এখানে এই আশ্বিন মাসে মার একখানি প্রতিমা আনিয়াছি’।

আমি এই ব্রহ্মরাজ্যের খাএকফু নগরে দুর্গোৎসবের কথা শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। আবার এখানেও সেই দুর্গোৎসব! সেখান হইতে জাহাজে ফিরিয়া আইলাম এবং মুলমীনের অভিমুখে চলিলাম। যখন জাহাজ সমুদ্র ছাড়িয়া মুলমীনের নদীতে গেল, তখন গঙ্গাসাগর ছাড়িয়া গঙ্গানদীতে প্রবেশের ন্যায় আমার বোধ হইল। কিন্তু এ নদীর তেমন কিছু শোভা নাই। জল পঙ্কিল, কুম্ভীরে পূর্ণ। সে নদীতে কেহ অবগাহন করে না। মুলমীনে আসিয়া জাহাজ নোঙর করিল। এখানে মাদ্রাজবাসী একজন মুদেলিয়ার আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি আপনি আসিয়া আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি একজন গভর্নমেন্টের উচ্চ কর্মচারী, অতি ভদ্রলোক। তিনি আমাকে তাহার বাড়িতে লইয়া গেলেন। যে কয়দিন আমি মুলমীনে ছিলাম, সেই কয়দিনের জন্য আমি তাঁহারই আতিথ্য স্বীকার করিলাম। আমি অতি সন্তোষে তাহার বাড়িতে এ কয়দিন কাটাইলাম।

মুলমীন নগরের পথসকল পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দুধারে দোকানে কেবল স্ত্রীলোকেরাই নানাপ্রকার পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করিতেছে। আমি পেটরা ও উৎকৃষ্ট রেশমের বস্ত্রাদি তাহাদের নিকট হইতে ক্রয় করিলাম। দেখি যে, বড় বড় টেবিলের উপরে বড় বড় মাছ সব বিক্রয়ের জন্য রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এসব অতি বড় বড় কী মাছ?’
তাহারা বলিল, ‘কুমির’।
বর্মারা কুমির খায়। অহিংসা-বৌদ্ধ ধর্ম কেবল ইহাদের মুখে, কিন্তু পেটে কুমির। এই মুলমীনের প্রশস্ত রাস্তা দিয়া একদিন সন্ধ্যার সময়ে বেড়াইতেছি- দেখি, একজন লোক আমার দিকে আসিতেছে। একটু নিকটে আসিলে বুঝিলাম, সে বাঙালি। সেখানে তখন বাঙালি দেখিয়া আমি আশ্চর্য হইলাম- এই সমুদ্রপারে বাঙালি কোথা হইতে আইল? বাঙালির অগম্য স্থান নাই। আমি বলিলাম, ‘কোথা হইতে তুমি এখানে?’
সে বলিল, ‘আমি একটা বিপদে পড়িয়া আসিয়াছি’।

আমি অমনি সে বিপদ বুঝিতে পারিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কত বৎসরের বিপদ?’
সে বলিল, ‘সাত বৎসরের’।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী করিয়াছিলে?’
সে বলিল, ‘আর কিছু নয়, একটা কোম্পানির কাগজ জাল করিয়াছিলাম। এখন আমার মেয়াদ ফুরাইয়া গিয়াছে কিন্তু অর্থাভাবে বাড়ি যাইতে পারিতেছি না’।
আমি তাহাকে পাথেয় দিতে চাহিলাম। কিন্তু সে কোথায় বাড়ি আসিবে! সে সেখানে ব্যবসাবাণিজ্য করিয়াছে, বিবাহ করিয়াছে এবং সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে রহিয়াছে। সে কি আর কালা মুখ দেখাইতে দেশে আসিবে।

মুদেলিয়ার আমাকে বলিলেন যে, এখানে একটি দর্শনীয় পর্বতগুহা আছে, অভিপ্রায় হইলে আপনাকে সঙ্গে লইয়া তাহা দেখাইতে পারি। আমি তাহাতে সম্মত হইলাম। তিনি সেই অমাবস্যার রাত্রির জোয়ারে একটা লম্বা ডিঙি আনিলেন, তাহার মাঝখানে একটা কাঠের কামরা। সেই রাত্রিতে মুদেলিয়ার এবং আমি, জাহাজের কাপ্তান প্রভৃতি ৭/৮ জনকে লইয়া তাহাতে বসিলাম এবং রাত্রি দুই প্রহরের সময় নৌকা ছাড়িলাম। আমরা সারারাত্রি সেই নৌকাতে বসিয়া জাগিয়া রহিলাম। সাহেবেরা তাঁহাদের ইংরাজি গান গাহিতে লাগিলেন। আমাকেও বাংলা গান গাহিতে অনুরোধ করিলেন। আমি মধ্যে মধ্যে ব্রহ্মসংগীত গাইতে লাগিলাম। তাহারা কেহই তাহার কিছুই বুঝিল না, তাহারা হাসিতে লাগিল, তাহাদের তাহা ভালোই লাগিল না। সেই রাত্রিতে ১২ ক্রোশ চলিয়া আমরা আমাদের গম্যস্থানে ভোর ৪টার সময়ে পহুঁছিলাম।

আমাদের নৌকা তীরে লাগিল। এখনও অন্ধকার। তীরের অদূরে দেখি যে, একটা তরু ও লতাবেষ্টিত বাড়ি হইতে কতকগুলো দীপের আলো বাহির হইতেছে। আমি কৌতূহলবিশিষ্ট হইয়া সেই অজ্ঞাত স্থানে, সেই অন্ধকারে অন্ধকারে একা দেখিতে গেলাম। গিয়া দেখি একটি ক্ষুদ্র কুটির, তাহার মধ্যে গেরুয়া বসন পরা মুণ্ডিতমস্তক কতকগুলি সন্ন্যাসী মোমবাতির আলো লইয়া তাহা একবার এখানে, একবার ওখানে রাখিতেছে। এখানেও কাশীর দণ্ডীর ন্যায় লোকদের দেখিয়া আমি আশ্চর্য হইলাম। এখানে দণ্ডীরা আইল কোথা হতে? তাহার পরে জানিলাম যে, ইহারা ফাঙ্গো, বৌদ্ধদিগের গুরু ও পুরোহিত। আমি আড়ালে থাকিয়া ইহাদের এই বাতির খেলা দেখিতেছি। হঠাৎ তাহাদের একজন আমাকে দেখিতে পাইয়া তাহাদের ঘরের ভিতর আমাকে লইয়া গেল। বসিতে আসন দিল এবং পা ধুইবার জল দিল। আমি তাহাদের ঘরে গিয়াছি, তাহারা এইরূপে আমার অতিথিসৎকার করিল। বৌদ্ধদিগের অতিথিসেবা পরম ধর্ম। প্রাতঃকাল হইল, আমি নৌকাতে ফিরিয়া আসিলাম।

সূর্য উদয় হইল। মুদেলিয়ারের আর-আর নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা আসিয়া সেখানে যোগ দিলেন। ইহাতে আমরা পঞ্চাশ জন হইলাম। মুদেলিয়ার সেখানে আমাদের সকলকে আহার করাইলেন। তিনি অনেকগুলি হস্তী সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন, আমরা দুই-চারি জন করিয়া সেই হস্তীতে চড়িয়া সেখানকার মহাজঙ্গল দিয়া চলিলাম। এখানে মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট পাহাড় আর ঘন ঘন জঙ্গল। হাতি ভিন্ন এখানে চলিবার আর অন্য উপায় নাই। আমরা বেলা ৩টার সময়ে সেই পর্বতের গুহার সম্মুখে আসিয়া পহুঁছিলাম। আমরা হাতি হইতে নামিয়া এখান হইতে এক কোমর জঙ্গল ভাঙিয়া হাঁটিয়া চলিলাম। সেই পর্বতগুহার মুখ ছোট, আমরা সকলে গুঁড়ি মারিয়া তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দুই পা গুঁড়ি দিয়া গিয়া তবে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারিলাম। তাহার ভিতরে ভারি পিছল। পা পিছলে যাইতে লাগিল। সেখান হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া খানিক দূর গেলাম। ঘোর অন্ধকার, দিন ৩টার সময় বোধ হইতে লাগিল যেন রাত্রি ৩টা। ভয় হইতে লাগিল যে, যদি সুড়ঙ্গের পথ হারাইয়া ফেলি তবে আমরা বাহির হইব কী প্রকারে? সমস্ত দিন এই গুহার মধ্যে ঘুরিতে হইবে। এই ভাবিয়া আমি যেখানেই যাই, সেই সুড়ঙ্গের ক্ষুদ্র আলোটুকুর দিকে লক্ষ্য রাখিলাম।

সেই অন্ধকার গুহার মধ্যে আমরা পঞ্চাশ জন ছড়াইয়া পড়িলাম এবং দূরে দূরে দাঁড়াইলাম। আমাদের প্রতিজনের হাতে গন্ধক-চূর্ণ। যেখানে যিনি দাঁড়াইলেন তিনি সেখানকার পর্বতে খুপরির মধ্যে সেই গন্ধক-চূর্ণ রাখিয়া দিলেন। আমাদের দাঁড়ানো ঠিক হইলে কাপ্তান আপনার গন্ধকের গুঁড়া জ্বালাইয়া দিলেন। অমনি আমরা সকলেই দিয়াসলাই দিয়া আপন আপন গন্ধক-চূর্ণ জ্বালাইয়া দিলাম। একেবারে সেই গুহার পঞ্চাশ স্থানে পঞ্চাশটা রঙমশালের আলো জ্বলিয়া উঠিল, আমরা গুহার ভিতরটা সব দেখিতে পাইলাম। কী প্রকাণ্ড গুহা! উপরের দিকে তাকাইলাম, আমাদের দৃষ্টি তাহার উচ্চতার সীমা পাইল না। গুহার ভিতরে বৃষ্টির ধারার বেগে স্বাভাবিক বিচিত্র কারুকর্ম দেখিয়া আমরা আশ্চর্য হইলাম। পরে আমরা বাহিরে আসিয়া সেই পর্বতের বনে বনভোজন করিলাম এবং মুলমীনে ফিরিয়া আসিলাম। ফিরিয়া আসিতে আসিতে পথে নানা যন্ত্রমিশ্রিত একতানের একটা বাদ্য শুনিতে পাইলাম। আমরা সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া নিকটে গেলাম। দেখিলাম যে কতকগুলা বর্মা অঙ্গভঙ্গী করিয়া নৃত্য করিতেছে। সেই আমাদের কাপ্তান সাহেবরাও যোগ দিয়া তদনুরূপ নৃত্য করিতে লাগিলেন, তাঁহারা বড় আমোদ পাইলেন।

একটি বর্মার স্ত্রী ঘরের দ্বারে দাঁড়াইয়াছিল, সে সাহেবদের এই বিদ্রুপ দেখিয়া আমোদোন্মত্ত পুরুষদের কানে কানে কী বলিয়া গেল, অমনি তাহারা নৃত্য ও বাদ্য ভঙ্গ করিয়া কে কোথায় পালাইল। কাপ্তান সাহেবরা তাহাদের কত অনুনয়বিনয় করিয়া আবার নৃত্য করিতে বলিলেন। তাহারা শুনিল না, কে কোথায় চলিয়া গেল। ব্রহ্মরাজ্যে পুরুষদিগের উপরে স্ত্রীদিগের এত অধিকার। মুলমীনে ফিরিয়া আসিলাম। একটি উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত বর্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাঁহার বাড়িতে গেলাম। তিনি বিনয়ের সহিত আমাকে গ্রহণ করিলেন। ফরাসের উপরে তিনি এক চৌকিতে আর আমি এক চৌকিতে বসিলাম। সে একটা প্রশস্ত ঘর, তাহার চারিকোণে তাঁহার চারিটি যুবতী কন্যা বসিয়া কী সিলাই করিতেছে। আমি বসিলে তিনি বলিলেন, ‘আদা!’ অমনি তাহাদের মধ্যে একটি মেয়ে আসিয়া আমার হাতে একটি গোলাকৃতি পানের ডিবা দিল। আমি খুলে দেখি যে তাহাতে পানের মসলা।

বৌদ্ধ গৃহীদিগের এই অতিথি-সৎকার। তিনি তাঁহাদের দেশের উৎকৃষ্ট অশোকজাতীয় কতকগুলা ফুলের চারা আমাকে উপহার দিলেন। আমি তাহা বাড়ি আনিয়া রোপণ করিয়াছিলাম। কিন্তু এদেশে অনেক যত্নেও তাহা রক্ষা করিতে পারিলাম না। এই গাছের যে ফল হয়, বর্মাদিগের তাহা অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য! যদি ১৬ টাকা কাছে থাকে, তবে তাহা দিয়াও সেই ফল খরিদ করিবে। তাহাদের এই উপাদেয় খাদ্য কিন্তু আমাদের ঘ্রাণেরও অসহ্য।



লেখক : ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ও দার্শনিক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়