ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পর্দা নামলো ক্যান্টন ফেয়ারের

বাংলাদেশিরা আবেগাপ্লুত, বিদেশিরা বিস্মিত

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২১, ১৯ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশিরা আবেগাপ্লুত, বিদেশিরা বিস্মিত

ক্যান্টন ফেয়ারে ওয়ালটন প্যাভিলিয়ন

উদয় হাকিম, গুয়াংজু (চীন) থেকে :  শেষ হলো ক্যান্টন ফেয়ার। চীনের গুয়াংজু শহরের এই মেলার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য মেলা। কেন একে বৃহত্তম মেলা বলা হয়? ভাবতে গেলে হয়তো একটু সময় লাগবে। কিন্তু সহজ করে বললে, সবচেয়ে বেশি ক্রেতা আসেন বলেই এর এতো নাম।

 

আর কাঙ্ক্ষিত সেই ক্রেতাদের আনাগোনায় শেষ দিনে পরিপূর্ণ ছিল ওয়ালটনের মেগা প্যাভিলিয়ন। আন্তর্জাতিক হলে যতগুলো দেশের স্টল বা প্যাভিলিয়ন ছিল, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রেতার আনাগোনা ছিল ওয়ালটন প্যাভিলিয়নে। বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের ডিজাইন, অভিজাত কালার এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে ওয়ালটনের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। বাংলাদেশে তৈরি সাশ্রয়ী মূল্যে এতো ভালো মানের পণ্য দেখে তারা বিস্মিত।

 

এদিকে ক্যান্টন ফেয়ারের শেষ দিন মঙ্গলবারও প্রচুর বাংলাদেশি ওয়ালটন প্যাভিলিয়নে এসেছেন। তাদের কথা- শেষ বেলায় একবার ওয়ালটনকে না দেখলে মন ভরবে না। তাই এলাম। এদের মধ্যে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা প্যাভিলিয়নের ছবি তুলেছেন। সেলফি নিয়েছেন। এমনকি ওয়ালটনের কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভদের জড়িয়ে ধরেছেন।

 

চীনের গুয়াংজু শহরে বিখ্যাত এই মেলাকে বলা হয় চায়না এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ফেয়ার। তবে বিশ্বজোড়া এর পরিচিতি ক্যান্টন ফেয়ার নামেই। এর বিশেষত্ব হচ্ছে এক ছাদের নিচে সারা বিশ্বের পণ্য। সমসাময়িক বিশ্বকে বুঝতে হলেও এই মেলায় আসতে হয়। কারণ পৃথিবীর অগ্রগতির ধারায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন যেসব পণ্য আবিষ্কার বা তৈরি হচ্ছে- এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে তার প্রায় সবই। কে কতটা আধুনিক, কতটা উন্নত, কতটা সময়োপযোগী সেটা প্রমাণের মেলা এটি।

 

প্রমাণের ব্যাপার ছিল বাংলাদেশের জন্যও। এতদিন জাহাজ বোঝাই করে যেসব পণ্য যেতো বাংলাদেশে; এখন সেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে অন্যান্য দেশে। দেশের কোটি কোটি টাকা চলে যেতো এসব পণ্যমূল্য পরিশোধে। এখন উল্টো আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

 

সত্যি বলতে কি, এখনো অনেক বাংলাদেশির মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে। তারা মনে করেন একটা সুই বানানোর ক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। ক্ষমতা নেই সাধারণ নাট-বল্টু বানানোর। বাংলাদেশ যে কতটা এগিয়েছে ওয়ালটনকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। হাইটেক প্রোডাক্ট তৈরিতে ওয়ালটনকে এখন বলা চলে এশিয়ার জায়ান্ট।

 

 

আরেকটা কথা বলে রাখি। বাংলাদেশি পণ্যের ইমেজ কিন্তু বিদেশি ক্রেতাদের কাছে অনেক উঁচুতে। ‘মেইড ইন চায়না’- বলে আমরা যেমন অবজ্ঞা করি, তেমনটা বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে নেই। ওয়ালটনের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশি গার্মেন্টস বিশ্বে এক নম্বর। আমাদের ওষুধ, সিরামিকস ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বিশ্বজোড়া।

 

এতদিন পিছিয়ে থাকলেও এখন উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যেও বাংলাদেশ সুনামের আসনে প্রতিষ্ঠিত। ক্যান্টন ফেয়ারে এসে তার প্রমাণ মিলেছে। বিশ্বের নামি-দামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওয়ালটন বলতে গেলে বিজয়ী হয়েছে। ওয়ালটন প্যাভিলিয়নে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের ব্যাপক সমাগমই তার প্রমাণ। বলা চলে এবারের মেলার চমক ছিল ওয়ালটন। ইলেকট্রনিক্স খাতের জায়ান্টরা নড়েচড়ে বসেছে ওয়ালটনকে দেখে। আগে তাদের ধারণা ছিল না ওয়ালটন সম্পর্কে। ওয়ালটনের উত্থান সবাইকে কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তুলেছে। তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে, এতো অল্প সময়ে এতো বিশাল বাজার কীভাবে তারা দখল করছে।

 

ক্যান্টন ফেয়ারের শেষ দিনে যারা প্রকৃত ক্রেতা তারাই এসেছেন ডিল এবং নেগোসিয়েশন ফাইনাল করতে। তারা হয়তো দেশে গিয়ে সময় নিয়ে ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শন করবেন। উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখবেন। তারপর বড় মাপের অর্ডার দেবেন। তেমনি একজন অস্ট্রেলিয়ার ওমেগা প্রাইভেট লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার জেড এইচ। তিনি আগেও একবার এসেছিলেন। মেলার শেষদিনে আবার এসেছেন। জানালেন, খুব শিগগিরই ওয়ালটন কারখানা পরিদর্শন করতে আগ্রহী। কারখানা পরিদর্শন করে পণ্যের অর্ডার দেবেন।

 

মঙ্গলবার ওয়ালটন পণ্য আমদানির বিশেষ আগ্রহ দেখান অনেকেই। তাদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার মিচা লুইচ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মিচা, জার্মানির ভিজিজি কোম্পানির এ্যান্ড্রিয়াস রুডিজেন, পোল্যান্ডের ডিএফ ইলেকট্রো’র ইওজেন ইয়াসোনভ, জাপানের নিওয়াকা কোম্পানির এস ঝাং, ইউরোপের দেশ মাল্টা’র কেএইচএস ট্রেডিংয়ের কিন্নেথ পুল্লিসিনু, দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টগেট সোর্সিং লিমিটেডের জনি জোসন, আর্জেন্টিনার গারবার্টনো কোম্পানির রাফায়েল গোয়াস্টাভেনু, তুরষ্কের এইচওয়াইজেড ম্যাডডাসলার কোম্পানির ওভিজোভ ম্যারেটগেকি, জর্জিয়ার ওকে ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি সোতা গেভেনতাজ, সিঙ্গাপুরের ওসানিয়া কোম্পানির মাহাল্লিল পি, চিলির এলিনক ট্রেড এর ডিয়েগো টায়েরা প্রমুখ।

 

এর বাইরেও ওয়ালটন পণ্য নিজ দেশে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের নিক ওয়েন্নি, ফ্রান্সের বার্নার্ড মরভান, রোমানিয়ার কাস সার্ভিস কোম্পানির ক্রিস পেট্রাস, মরক্কোর মুরাড ক্যাপ, বলিভিয়ার ডোনাল্ড মারকো, তুরস্কের সুকরু, কাজাখস্তানের আলিসান আস্কারভ, আর্জেন্টিনার সেবাস্টিয়ান, ফিজি’র নরহারি ইলেকট্রনিক্স এর চেতন কুমার, ডমিনিকার মিনায়া ইউনিট্রেড লিমিটেডের পুরি উইভ, জিম্বাবুয়ের ব্রেট হবসন প্রমুখ।

 

এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মরিসাস ইত্যাদি নানা দেশের ব্যবসায়ীরা ওয়ালটন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন, খুব শিগগিরই যোগাযোগ করবেন।

 

 

বিদেশ থেকে ফিরে আসি আবার বাংলাদেশিদের কথায়। ক্যান্টন ফেয়ারের ৫৯ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম অংশ নিল বাংলাদেশি কোনো ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ড। বুকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’- লেখা নিয়ে সগৌরবে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে ওয়ালটন। আর তাই বাংলাদেশ থেকে আসা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা মেলায় ওয়ালটন প্যাভিলিয়নে এসেছেন। তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করছেন। প্রথমত দেশপ্রেম, দ্বিতীয়ত বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের দ্রুত উত্থান তাদের আবেগ তাড়িত করেছে।

 

যেমন মেলার শেষদিনে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সুপার স্টার গ্রুপ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ ইবরাহিম। তিনি বললেন, শেষ বেলায় আবার এলাম। শুভকামনা থাকল আপনাদের জন্য। তিনি ওয়ালটনের ইনভার্টার প্রযুক্তির ফ্রিজ ভালো করে দেখেন। তার সঙ্গে ছিলেন, উগান্ডার অনারারি কনসাল আবুল হোসেইন। ঢাকা চেম্বারের সাবেক পরিচালক সৈয়দ হাবিব, মনিরুজজ্জামান লিটনসহ অসংখ্য বাংলাদেশি শেষ দিনে ওয়ালটন প্যাভিলিয়নে এসেছেন। তাদের কথা একটাই- এগিয়ে যাও ওয়ালটন। 

 

১১৯তম আন্তর্জাতিক ক্যান্টন ফেয়ার শুরু হয়েছিল শুক্রবার। পাঁচদিনের এই মেলা শেষ হয় মঙ্গলবার। মেলায় প্রদর্শিত হয় ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এলইডি টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, রিচার্জেবল ফ্যান, ইলেকট্রিক সুইস, সকেট, বাল্ব, ইন্ডাকশন কুকার, ব্লেন্ডার, এসিড লেড রিচার্জেবল ব্যাটারি ইত্যাদি।

 

তবে মেলা শেষ হলেও উদ্যোক্তারা আজও সঠিক হিসেব দিতে পারেনি- কতগুলো প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছিল। কতজন বায়ার এসেছিলেন। এটাকে উদ্যোক্তাদের একটি বড় দুর্বলতা বলা চলে। ঢাকা বাণিজ্য মেলাতেও হালনাগাদ তথ্য থাকে। এখানে সেটা নেই। অথচ সবকিছুই হচ্ছে ডিজিটালি। চার-পাঁচটা ইনফো সেন্টারে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে পারছে না। অনুমানে বলছে, ৩ লাখ ক্রেতা। সেটা হলেও অবশ্য কম কিসে। আগেই বলেছি, এতা বেশি ক্রেতা বিশ্বের আর কোনো মেলায় পাওয়া যায় না।

 

মেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না সমাপনী কোনো আয়োজন। সবাই নীরবে এসেছেন। নীরবে চলে গেছেন। নিয়ে গেছেন বুক ভরা আশা। ব্যবসা আরও ভালো হবে। ব্র্যান্ড আরো বড় হবে- এটাই তাদের স্বপ্ন।  

 

ছবি : উদয় হাকিম

 

 

রাইজিংবিডি/গুয়াংজু (চীন)/১৯ এপ্রিল ২০১৬/উদয় হাকিম/সাইফ/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়