ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মসলা বাণিজ্য থেকে রাজ্য দখল || ইবনুল কাইয়ুম

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৮, ১০ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মসলা বাণিজ্য থেকে রাজ্য দখল || ইবনুল কাইয়ুম

শিল্পীর তুলিতে আঁকা ভারত মহাসাগরে মসলার জন্য যুদ্ধ

যুদ্ধের অনেক রকম ইতিহাসের কথা আমরা শুনেছি, জেনেছি। তবে মসলা নিয়েও যে যুদ্ধ হতে পারে সে সম্পর্কে আমরা কতটুকু ধারণা রাখি তা বলা মুশকিল। এ যুগে এ কথা শুনলে অনেকেই হেসে উঠবেন। হয়ত ভ্রু কুঁচকে বলতেও পারেন, ‘সত্যি হয়েছে নাকি?’
হ্যাঁ, এক সময় বিশ্বে এই মসলা নিয়েই তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। এই ভারতবর্ষকে এ জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে অনেক। ভারতবর্ষে দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন সেই ঘটনার সূত্র ধরেই এসেছিল। সে অবশ্য আরেক ইতিহাস।

পনেরোশ শতকের কথাই বলি। সে সময় মসলার বাণিজ্য করে ভারতবর্ষের কালিকট রাজ্য এক সময় সমৃদ্ধি লাভ করে। কালিকট সমুদ্র বন্দর হিসেবে এ কারণেই বিশ্বে পরিচিতি পায়। ভারতবর্ষের এবং ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে যত মসলা উৎপন্ন হতো তা এই বন্দরের মাধ্যমেই পৃথিবীর সকল বণিকদের হাতে যেতো। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কালিকট সে সময় সমৃদ্ধির মুখ দেখে। সমৃদ্ধির পথ বেয়েই আসে সুখ্যাতি। ইউরোপের দেশগুলোতেও তখন এর সমৃদ্ধির কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশগুলোর মধ্যে পর্তুগালের প্রখর দৃষ্টি ছিল এ দিকে। কালিকট সমুদ্র বন্দরে আরব, মিশরিয়, ইউরোপীয়সহ নানা দেশের বণিকরা বাণিজ্য করতেন। তবে মসলার বাজারে ফ্রান্সের আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। সে সময় ক্রুসেড তথা ধর্ম যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম শাসিত হওয়ায় ফ্রান্সের সঙ্গে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী দেশ হিসেবে পর্তুগালের চরম শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল। সমুদ্র পথে সে সময় ফ্রান্সের জলপথ না মাড়িয়ে ভারতে আসার কোনো উপায় ছিল না। এ কারণে তারা ভাবনায় পড়ে যায়।

তবে পর্তুগালের রাজা ডোম হেনরী ম্যানুয়েলের সুদূর প্রসারী ভাবনা এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্তের জন্ম দেয়।  রাজা হেনরী সিদ্ধান্ত নেন তিনি মসলার উৎসভূমি ভারতবর্ষে লোক পাঠাবেন। তবে সে ক্ষেত্রে তাকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ঘুরে তবে যেতে হবে। অজানা অচেনা সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে সে এক ভয়ংকর অভিযান! তবে সেই অভিযানের ফলে যদি মসলার বাণিজ্য করায়ত্ব করা সম্ভব হয় তাহলে পর্তুগালের মতো ছোট একটি দেশই সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভেনিসসহ অন্যান্য দেশের জৌলুস তখন তার পায়ে এসে লুটাবে। শুধু তাই নয়, সমস্ত পৃথিবী একদিন খ্রিস্টান পৃথিবীতে পরিণত হবে, যার পুরোভাগে নেতৃত্ব দেবে পর্তুগাল। এই স্বপ্নই তাকে অনুপ্রেরণা যোগায়।

দুঃসাহসী হেনরী তখন শুরু করলেন এক এলাহী কাণ্ড। দেশের তাবড় তাবড় গাণিতজ্ঞ, মানচিত্রকর, জ্যোতির্বেত্তা ও সুদক্ষ নাবিক এনে জড়ো করলেন। তাদের সাহায্যে আফ্রিকা ঘুরে ভারতবর্ষে যাওয়ার একটানা জলপথের খোঁজে চলল অনুসন্ধান। সে সময় পর্তুগীজদের দুই ধরনের জাহাজ ছিল। হালকা ও দ্রুতগতির জাহাজের নাম ছিল ‘ক্যারাভেল’। আর ভারি ধীরগতির যে জাহাজ ছিল তার নাম হলো ‘গ্যালিওন’। এই গ্যালিওনে করেই তারা কামান বয়ে নিয়ে এসেছিল এই সুদূর ভারতবর্ষে। সে সময় পর্তুগীজরা জাহাজ শিল্পেও অবিশ্বাস্য উন্নতি লাভ করে।

মজার ব্যাপার হলো, পর্তুগীজদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা সম্পর্কে অন্যদের মতো খ্রিস্টান জগতের ধর্মীয় নেতা রোমের পোপ সবই জানতেন। পোপ পঞ্চম নিকোলাস ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ পর্যন্ত পর্তুগীজরা যা কিছু আবিষ্কার করবে তার উপর রাজা হেনরীর একমাত্র অধিকার দান করে একটি ঘোষণাও দেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তার সেই ঘোষণা অনুমোদন করে তৃতীয় ক্যালিকেটাস অনুরূপ একটি ঘোষণা দেন। পোপের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সমগ্র প্রাচ্য অঞ্চলকে জয় ও ভোগ করার একচ্ছত্র অধিকার পর্তুগালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।


নানা হীণ ষড়যন্ত্র করে তারা মুসলমান-হিন্দু বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। তা সফল হয়নি কেবল কালিকটে। স্থানীয়রা হিন্দু-মুসলিম ধর্মের বিভেদ ভুলে দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তাদের দেশপ্রেমের কাছে পর্তুগীজদের আক্রমণ বার বার ভেস্তে গেছে। কামানের বিপরীতে সামান্য বল্লম, সড়কি আর তলোয়ার দিয়েই তারা যুদ্ধ করেছে।
বহু পরে অবশ্য মিশরের কাছ থেকে কামানসহ সৈন্য সাহায্য পায় কালিকট। সে যাত্রাও কালিকট ছাড়তে বাধ্য হয় পর্তুগীজরা। তবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তারা ঘাঁটি গেড়ে বসে। এবং মসলার বাণিজ্যে ভাগ বসায়। সেই সঙ্গে জলদস্যুতাও চালায় তারা। কিন্তু কালিকট দখল করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। ১৫০৯ থেকে ১৫৯৯ এই ৯০ বছরের ইতিহাস দুর্দম প্রতিরোধের ইতিহাস। কালিকটের জলে, স্থলে বহুবার দুই পক্ষের শক্তি পরীক্ষা হয়েছে। তবে সেখানকার হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও প্রতিরোধের মুখে কিছুতেই কালিকট দখল করা সম্ভব হয়নি পর্তুগীজদের। অবশেষে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়ে যায়।

যদিও এরপর এক সময় মসলার একচেটিয়া বাণিজ্য পর্তুগীজদের হাতে চলে আসে। দেড়শ বছর পর্যন্ত মসলার বাণিজ্য তাদের হাতেই ছিল। এ সময় তারা ইউরোপে একচেটিয়া মসলার ব্যবসা করে। একচেটিয়া বাণিজ্যের কারণে পর্তুগাল মসলার দাম তখন এতো চড়িয়েছিল যে ডাচ বণিকদের মনে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রোটেস্টান্টপন্থি হলান্ড মসলার জন্য ভারতবর্ষে যাত্রা করে।

তারা মসলার বাণিজ্যের উদ্দেশে একটি কোম্পানি গঠন করে। নাম দেয় ‘ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৬০২ সালে এই কোম্পানি পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্য করার জন্য সরকার থেকে একচেটিয়া সমর্থন লাভ করে। শুধু তাই নয়, এই কোম্পানিকে সন্ধি ও মৈত্রি স্থাপন করা, নতুন এলাকা জয় করা, দূর্গ গড়ে তোলা এবং আরো কিছু কিছু বিষয়ে সর্বময় কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে তারা পর্তুগীজদের হাত থেকে এমবয়না দ্বীপ দখল করে নেয়। এটাই ছিল উপনিবেশ স্থাপনের পথে তাদের প্রথম পদক্ষেপ।

এর ১৪ বছর পর কোম্পানির পক্ষে জান পিয়েটার্জ কোয়েন জাকার্তা অধিকার করে বসে। সেই দিন থেকেই ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তবে সেখানে পর্তুগীজরা যা কখনোই করেনি ডাচরা সেই কাজটিই মনোযোগ দিয়ে করতে থাকে। তারা মসলা উৎপাদনের চিন্তা করে। চাষিদের নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়। এক সময় দেখা যায় চাষিদের নিজেদের জমি বলতে আর কিছু নেই। তারা কোম্পানির কাছ থেকে দাদন নিয়ে মসলা চাষ করছে। আরো পরে নিজ ভূমেই পরবাসী হয়ে পড়ে তারা। সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন খড়গ নেমে আসে যুগ যুগ ধরে মসলার এই নিপুণ কারিগরদের ওপর।

প্রথমে পর্তুগীজ, তারপর ডাচ এবং সর্বশেষ ইংরেজরা মসলার খোঁজে মসলার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় প্রবেশ করে। ইংল্যান্ডে সে সময় মসলার প্রচুর চাহিদা ছিল। পর্তুগীজদের সরিয়ে ডাচরা মসলার বাজার দখল করার পর তারা দাম বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নেয় তারাও প্রাচ্যের মসলার বাজারে ঢুকবে। ইংরেজদের সেই বিখ্যাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবার মসলার বাণিজ্যে নেমে পড়ে। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি কোম্পানির প্রথম জাহাজ এই উদ্দেশে প্রাচ্যের দিকে যাত্রা করে।

১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা ভারতের সুরাটে বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে। কীভাবে তারা সুরাটে ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মোগল সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে নিয়েছিল তা কারো অজানা নয়। তারা ঠিক করেছিল ভারতবর্ষে থেকে বস্ত্রের ব্যবসা করে তা দিয়ে যা মুনাফা হবে তাই দিয়ে মসলার ব্যবসা করবে। কৈ এর তেলে কৈ ভাজা কাকে বলে তা তারা ভালই জানত!

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৪ বছর ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মসলার বাণিজ্য করেছিল। কিন্তু ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ডাচদের চাপে তাদের ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়। তারপর তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের মসলার বাণিজ্য এখানেই শেষ হয়। তবে ধীরে ধীরে তারা এক সময় ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। শুরুতেই যেমন বলেছিলাম। মসলার বাণিজ্য থেকে রাজ্য প্রতিষ্ঠা মন্দ কি?


লেখক : সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী
তথ্যসূত্র : মসলার যুদ্ধ, সত্যেন সেন

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/সনি/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়