ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’

টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৭ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’

কবি হেলাল হাফিজ

শাহ মতিন টিপু : ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’- এই দুটো চরণই তাকে চিনিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। এমন আরো অনেক স্লোগানধর্মী চরণ রয়েছে তার অসংখ্য কবিতায়। আর এসব স্লোগানের জন্ম দিয়ে তিনিও ঢুকে পড়েছেন কবিতা পাঠকদের মনে। অচেনা অজানা অনেকের মনেই নোঙর ফেলেছেন। তিনি হেলাল হাফিজ। আজ এই আগুনে কবির ৬৮তম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এদিনে তিনি নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের আরেক আগুনে কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মও এই নেত্রকোনায়।

 

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিতার বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে কবি হেলাল হাফিজ এর নাম। বইটি সর্বত্র তুমুল আলোড়ন তোলে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য সংস্করণ হয়েছে। ওই গ্রন্থটির ১২টি সংস্করণ প্রকাশিত হলেও এরপর গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তার নিস্পৃহতা দেখা যায়। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’।

 

হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি যিনি স্বল্পপ্রজ হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত তার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি এখানে তুলে দেওয়া হলো-

 

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ মিছিলের সব হাত /কন্ঠ /পা এক নয়।/সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,/ কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।/ কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার/ শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে/ অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে/ অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,/ কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে/ কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।

 

যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান/ তাই হয়ে যান/ উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

 

হেলাল হাফিজ এর ‘রাডার’ শিরোনামের আরেকটি কবিতা এ রকম- ‘একটা কিছু করুন।/ এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে/ দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন/ একটা কিছু করুন।/ চতুর্দিকে ভালোবাসার দারুণ আকাল/ খেলছে সবাই বেসুর-বেতাল/ কালো-কঠিন-মর্মান্তিক নষ্ট খেলা,/ আত্মঘাতী অবহেলো নগর ও গ্রাম গেরস্থালি/ বনভূমি পাখপাখালি সব পোড়াবে,/সময় বড়ো দ্রুত যাচ্ছে/ ভাল্লাগে না ভাবটা ছেড়ে সত্যি এবার উঠুন/একটা কিছু করুন।/ দিন থাকে না দিন তো যাবেই/ প্রেমিক যারা পথ তো পাবেই/ একটা কিছু সন্নিকটে, হাত বাড়িয়ে ধরুন/ দোহাই লাগে একটা কিছু করুন।’

 

তার পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার আর মাতার নাম কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর কালে সামরিক পট পরিবর্তনের অস্থির সময়ে প্রতিবাদী লেখনী নিয়ে রুখে দাঁড়ানো কবিদের এক জন হেলাল হাফিজ। তার কাব্যের প্রধান উপকরণ যৌবন এবং বিদ্রোহ। কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। কবিতায় তিনি ২০১৪ সালের বাংলা একাডেমি পুরষ্কার লাভ করেন।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৫/টিপু/রণজিৎ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়