ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুক্তির দিশারী হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু ।। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তির দিশারী হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু ।। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের মিছিলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি আমার। পরবর্তী সময়ে ৬৫ থেকে ৬৭ এই তিন বছরে পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। এরপর একাত্তর সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকি। এ সময় আমি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা কমিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই। তার আগে আমি সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। এরই মধ্যে ফরিদপুর মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনও করেছি। কলেজ সংসদের নির্বাচিত সম্পাদকও ছিলাম। তার মানে আমরা যে সময়টাতে বড় হয়েছি সে সময়টা ছিল উত্তাল সময়। পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ছয় দফা আন্দোলন-পরবর্তীকালে ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গেছি।

 

’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে ফরিদপুরের সর্বত্র আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকি। আর এর মধ্য দিয়ে আমরা তখন বুঝে যাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব থাকবে আমাদের হাতেই। তথা বাঙালিদের হাতেই থাকতে হবে। আর একমাত্র নেতা হিসেবে থাকবেন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হলোও তাই। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির দিশারী হয়ে উঠলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণের দিন। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন সবার মতো আমিও ছিলাম। ভাষণে উজ্জীবিত হওয়ার পর আমরা ৩২ নম্বরে যাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তার কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য। কিন্তু তাকে সে সময় পাইনি। এরই মধ্যে রাত নামে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর সংগঠনের নেতাদের নিয়ে সেখান থেকে হেঁটে সদরঘাট আসি ফরিদপুরে যাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য, এলাকায় গিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করা। সবাইকে মোটিভেট করি।

 

এর মধ্য দিয়ে চলে আসে একাত্তরের ২৫ মার্চ। কাল রাত। ঢাকায় নিরীহ মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয় পাকিস্তানি বর্বর আর্মি। ওদিকে আমরাও নিতে থাকি যুদ্ধের প্রস্তুতি। আমরা পরিকল্পনা করি পাকিস্তানি আর্মিদের ফরিদপুরে প্রবেশ করতে দেব না। কিন্তু সে সময় সেই অর্থে কোনো প্রশিক্ষণ আমাদের ছিলো না। আমাদের একমাত্র অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধ।

 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভোর রাত ২১ এপ্রিল ’৭১। পাকিস্তানি মিলিটারি ফরিদপুরে প্রবেশের অপেক্ষায়। এ সময় পাক আর্মিদের প্রতিহত করতে আমরা সচেষ্ট। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে ফেরিঘাট ধ্বংস করে দেই। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে অবস্থান নেই অনেকে। কিন্তু তারপরও বর্বর পাক আর্মি মানুষ হত্যা করতে করতে ফরিদপুরে প্রবেশ করে। আমরা পিছু হটি। গ্রামের ভেতরে বলতে গেলে গভীরে চলে যাই। সে সময় পরিকল্পনা করি ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করার। এভাবে কেটে যায় আরো এক মাস। আমি বুঝে ফেলি এভাবে হবে না। এরই মধ্যে আমাদের জেলার অনেকেই তাদের মত পরিবর্তন করে পাক আর্মিদের দলে ভেড়ে। আমাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করে। মে মাসের শেষের দিকে আমরা মুজিবনগরে যাই। ৭ জুন করিমনগর বর্ডার দিয়ে কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতা যাই। যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হয়। একদিন মাগুরা দিয়ে যাওয়ার সময় প্যারামিলিশিয়ার হাতেও ধরা পড়ি। কিন্তু বুদ্ধি খাটিয়ে সেখান থেকে বেঁচে ফিরি।

 

মুজিবনগরে গিয়ে দেখি ট্রেনিং চলছে। জাতীয় পর্যায়ের নেতারাও আছেন। শেখ কামাল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও সেখানে। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে খুব ভালো করেই চিনতেন। কেননা, তিনি ফরিদপুর দিয়ে মুজিবনগরে যাওয়ার সময় আমরাই পার করে দেই তাকে। সেখানে আমি ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়ার অনুমতি পাই। কিন্তু ভয়াবহ টাইফয়েডের কারণে ট্রেনিং নিতে পারিনি সে সময়। দেড় মাস টাইফয়েডের সঙ্গে লড়াই করে সেরে উঠি। তখন সিদ্ধান্ত হয় মুজিববাহিনীর সঙ্গে যাওয়ার। কিন্তু এ সময়ও চর্মরোগ ও রক্ত আমাশয়ের কারণে যেতে পারিনি। পরে শরণার্থী ক্যাম্পেই রয়ে যাই। আমার ওপর দায়িত্ব আসে শরণার্থী শিবিরের প্রত্যেককে মোটিভেট করার জন্য। যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করি তখন। এছাড়া শরণার্থীদের রসদ, পোশাক ও সেবা করেই কাটিয়ে দেই যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত। এর মাঝে শরণার্থী শিবির থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগও রক্ষা করতে হতো তখন।

 

এদের মধ্যে রাজশাহীর কামরুজ্জামান, মালেক উকিল বেঁচে থাকার জন্য আমাকে টাকা দিয়েও সাহায্য করেছেন যুদ্ধের সময়। সেপ্টেম্বরের পর থেকেই আমরা বুঝেছি যুদ্ধ শেষ হতে বেশি দিন বাকি নেই। আসে ডিসেম্বর মাস। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়ে ঘোষিত হয় বিজয়।



লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়