ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

‘বাঙালি বীরের জাতি প্রমাণ করতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম’

সমীর চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বাঙালি বীরের জাতি প্রমাণ করতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম’

রবিন সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সমীর চক্রবর্তী

সাংবাদিক রবিন সেনগুপ্ত। একটি নাম, একটি ইতিহাস। ভারতের এই নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্যামেরা হাতে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার তোলা ছবি ছাপা হয়েছে ভারতে ও বিভিন্ন দেশে পত্র-পত্রিকায়। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু সম্মাননা’ পদকে ভূষিত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি পদক গ্রহণ করেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় তার বাসভবনে রাইজিংবিডির ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি সমীর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেন অসিম সাহসী এই চিত্র সাংবাদিক। একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে নানা বিষয়। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো :

 

রাইজিংবিডি : আপনি কীভাবে চিত্র সাংবাদিকতায় এলেন?

রবিন সেনগুপ্ত : আমার বাবা ছিলেন বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী। বাবার কাছ থেকেই আমার ফটোগ্রাফি শেখা। তখন ছিলো তিন পা ওয়ালা ক্যামেরা। মাথায় কাপড় দিয়ে ছবি উঠানো হতো। রুলেফেক্স, রুলেকড, ক্যানন, নিক্কন এসব ক্যামেরা দিয়ে ছবি উঠাতাম। ভারতের আনন্দবাজার, যুগান্তর, ব্রিক্স কাগজে ফ্রিল্যান্স হিসেবে কাজ করেছি।

 

রাইজিংবিডি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপনি কী ভাবে অংশ নিলেন?

রবিন সেনগুপ্ত : ৭১’এর যুদ্ধ আমাকে ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং অনুপ্রাণিত করে। তাছাড়া বাঙালি হিসেবে আমাদের অনেক বদনাম ছিল। বলা হতো বাঙালি ভাত খায়, তারা ভীতু। তাদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বাঙালি ভীতু কিংবা কাপুরুষ নয়। সৌর্যে বীর্যে তারা কারো থেকে কম নয়। পৃথিবী দেখে যাও, বাঙালিও বীরের জাত। হিন্দু কি মুসলমান এটা আমাদের কাছে বিষয় না। বাঙালি, ব্যাস, এটাই বড় পরিচয়। এই বাঙালি যুদ্ধ করতে পারে। আমাদের অসীম সাহস জানান দেয়ার জন্যই আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। তখন পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়াবহ গণহত্যার বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানাতে ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলাম।

 

রাইজিংবিডি : সে সময় কাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল ?

রবিন সেনগুপ্ত : প্রধানত মুক্তিবাহিনী বা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রক্ষা করি। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে যেতাম। কখনো ছবি তুলেছি, পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে দিয়েছি। আবার কখনো অস্ত্র হাতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। তা ছাড়া ব্যাক্তিগতভাবে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তারা সকলেই আমাকে নামে চিনত। সুরঙ্গ ব্রীজ অপারেশন কভার করার জন্য জিয়াউর রহমান আমাকে অনুরোধ করেছিল।

 

রাইজিংবিডি : আপনার ছবির প্রতিপাদ্য কী ছিল এবং ছবি তোলায় কী ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করতেন?

রবিন সেনগুপ্ত : ৬০ মিলিমিটার রোলেক্স ক্যামেরা দিয়ে একই সঙ্গে স্টিল এবং মুভি ছবি তুলেছিলাম আমি। তখন রঙিন ছবিও তুলেছিলাম। আমার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের প্লাবন। শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে তাদের জীবন চিত্র তুলে ধরতাম। ইন্দিরা গান্ধী, এডওয়ার্ড কেনেডিসহ গুরুত্বপূর্ণ যে সব মানুষ পরিদর্শনে আসত তাদের ছবি তুলতাম। তাছাড়া বুলেট আক্রান্ত হয়ে, শেল বিদ্ধ হয়ে জিবি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ নাগরিকদের অনেক ছবি তুলেছি আমি।

 

 

রাইজিংবিডি : আপনার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি পরিবার কী ভাবে দেখেছে?

রবিন সেনগুপ্ত : আমার বাবা বলতেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য যদি আমার একটি ছেলের প্রাণও যায় তাহলে তিনি গর্ব বোধ করবেন। মজার ব্যাপার হলো বিয়ের মাত্র ৮ মাসের মাথায় মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। বউকে বলেছিলাম বেঁচে থাকলে দেখা হবে। অন্যদিকে ফিল্ম শেষ হলেই আমি আগরতলায় চলে আসতাম। সেন এন্ড সেন নামে আমাদের স্টুডিও ছিল। সেখানে আমার ছোট দুই ভাই বিশু সেন গুপ্ত আর শম্ভু সেন গুপ্ত কাজ করতো। সেখানে সবগুলো ফিল্ম ডেভেলপ করে ইংরেজি ও বাংলায় ক্যাপশন লিখে বলে দিতাম সংবাদপত্রের যে কোন রিপোর্টার এলে তাদের বিনামূল্যে যেন ছবি দিয়ে দেওয়া হয়। আমি চাইছিলাম সবাই জানুক বাংলাদেশে নিরস্ত্র জনসাধারণকে পাকিস্তানিরা কী ভাবে মারছে।

 

রাইজিংবিডি : মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর নির্মমতার কথা কী ভাবে বর্ণনা করবেন আপনি?

রবিন সেনগুপ্ত : ৪ ডিসেম্বর আমাদের আর্মি (ভারতীয়) যখন জলে, স্থলে এবং আকাশে একযোগে আক্রমন শুরু করে, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কুড়িলা ও তিতাস নদীর তীর ঘেসে দুই থেকে আড়াইশ বাঙালির লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। বিকৃত এসব লাশ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। লাশের চারদিকে মাইন পাতা ছিল। আর্মিদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ অনুযায়ী শক্ত স্থানে পা দিতে দিতে কৌশলে ছবি তুলেছিলাম। ভৈরব, নোয়াখালী, চট্টগ্রামে একইভাবে শুধু লাশ আর লাশ চোখে পড়ে। ১৭ ডিসেম্বর আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলাম। ইন্ডিয়ান আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসে বললেন, we are setting here & gossiping. Go to the Rayerbazar, what happening to see. হলিডে কাগজের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান (রাশেদ খান মেননের ভাই) আমাদের পথ নির্দেশ করে। সেখানে গিয়ে দেখলাম লাশ আর লাশ। হাত পা বাঁধা, কারো চোখ বাঁধা। আমি তাদের লাশগুলো উল্টিয়ে উল্টিয়ে ছবি তুলছিলাম। এনায়েতুল্লাহ আন্দাজ করে বলছিল সাংবাদিক মুনির, শিলালিপির সম্পাদক পারভিন সুলতানাসহ অনেকে রয়েছেন। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তারা নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে। ৩ ডিসেম্বর আখাউড়ার কাছে একটি জায়গায় শতাধিক নারীকে গোপনাঙ্গে বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি নরপশুরা। তাদের স্তনের বোটা কেটে ফেলা হয়েছিল। রক্তে সব লাল হয়ে ছিল। কিন্তু আমি সেই বিভৎস ছবি তুলতে পারি নাই। কারণ, এরা তো আমার বোন, এই দৃশ্য আমি কি করে তুলবো!

 

রাইজিংবিডি : কোন অপারেশনের কথা মনে আছে কি ?

রবিন সেনগুপ্ত : মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একটা অপারেশন করেছিলাম কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জে। সে সময় সালদানদী (কসবা উপজেলা) নামক স্থানে পাকবাহিনীর একটি কনভয় রেশনের জন্য আখাউড়ায় যাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম ওটাকে উড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের ট্রেনিং ছিল গ্রেনেড চার্জ করতে সবুজ রঙের তার ব্যবহার করতে হবে। যাতে সবুজ ধানের সাথে সেটা মিশে যায়। সে ভাবে আমরা কাজটিতে সফল হয়েছিলাম। সালদানদী যুদ্ধের সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে, একটা থালায় আমরা পাঁচ-ছয় জন এক মুঠো এক মুঠো করে খাবার খেয়েছি। সিলেট জেলায় একটি চা বাগানে সফিউল্লার সঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে পাকবাহিনী এমন গুলিবর্ষণ শুরু করেছিল যে চার-পাঁচ দিন আমরা বাংকারে ছিলাম। পর্যাপ্ত পানিও সে সময় পাইনি। তবে সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করতো।

 

রাইজিংবিডি : বেগম মুজিবকে আপনি কী ভাবে দেখেছেন ?

রবিন সেনগুপ্ত : বেগম মুজিবকে মুক্ত করবেন মেজর তারা। সেই খবর শুনে ১৭ ডিসেম্বরই আমরা সেখানে যাই। ছবি তোলার পর বেগম মুজিবকে বললাম, আচ্ছা ম্যাডাম, ২৬ মার্চ রাতের বেলা কী ঘটনা হয়েছিল বলেন তো। তিনি তখন ফরিদপুরের ভাষায় বললেন, ‘তখন রাত ১২ টা। হঠাৎ আমি যেন শুনলাম জওয়ান পজিশন লও। আমি শেখ সাহেবকে কইলাম, বোজ্জ আমাদের বাড়ি দেহি মেলিটারি ঘিরা রাখছে। শেখ সাহেব কইলো আরি আমি বঙ্গবন্ধু ... কি কউ।”

 

রাইজিংবিডি : সে সময় বাংলাদেশের কোন প্রচার মাধ্যমে আপনি জড়িত ছিলেন কিনা ?

রবিন সেনগুপ্ত : বাংলাদেশ রেডিও’র সঙ্গে ছিল আমার আত্মিক সম্পর্ক। যুদ্ধের সময় কণ্ঠশিল্পী জব্বার, আপেল এরা সব আমার ত্রিপুরার বাড়িতে ছিল। তখন আমাদের টিনের ঘর ছিল। আমার বড় একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটাতে প্রথমে কোরআন পাঠ, ত্রিপিঠক পাঠ, আমাদের গীতা থেকে পাঠ, জয় বাংলা গান রেকর্ড করে রাখতাম। ভোর চারটার সময় বিএসএফ এসে আমার কাছ থেকে টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে যেত। শালবাগান এলাকায় কিলো হার্জের একটা রেকর্ডার নিয়ে ছিল বেতার কেন্দ্রটি। আর বাংলাদেশ থেকে আসার সময় তারা (আপেলরা) বালিশের মধ্যে কিছু টেপ নিয়ে এসেছিলো।

 

 

রাইজিংবিডি : পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনি কোন লেখালেখি করেছেন কিনা ?

রবিন সেনগুপ্ত : ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ সহ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখা একাধিক বই রয়েছে। ঢাকায় সাহিত্য প্রকাশ আমার তোলা ছবি নিয়ে ‘চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ’ নামে বই প্রকাশ করে। সেখানে ৯০টির মতো ছবি রয়েছে। তাছাড়া আমার তোলা ছবি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রকাশ করেছে একাধিক বই।

 

রাইজিংবিডি : বর্তমান বাংলাদেশকে আপনি কী ভাবে মূল্যায়ন করবেন ?

রবিন সেনগুপ্ত : বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। প্রাণের এই দেশটিতে আমরা এখন যেতে ভয় পাই। যেখানে প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে হুমকির মধ্যে থাকতে হয়। সেখানে আমরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করবো কী ভাবে। আমরা দেখতে চাই ৭১ এর চেতনার বাংলাদেশ।

 

রাইজিংবিডি : আপনাকে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে অনেক কৃতজ্ঞতা। আর এই সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রবিন সেনগুপ্ত : আপনাকে এবং রাইজিংবিডিকেও ধন্যবাদ।






রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/শাহনেওয়াজ 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়