ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একটি গল্প ও কবিতার খসড়া || পূরবী বসু

পূরবী বসু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি গল্প ও কবিতার খসড়া || পূরবী বসু

পূরবী বসু

গল্প

পাগলি, তোকে নিয়ে কোনো দিন লিখতে হবে ভাবিনি। ভাবিনি এ জন্যে যে তোকে আদর করে ‘পাগলি’ বলে ডাকলেও আমি জানতাম তোর মতো বুদ্ধি ও বিবেচনা সচরাচর তোর বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না। কিন্তু তা সত্বেও একটি ভুল পদক্ষেপের জন্যে, এক অপ্রত্যাশিত প্রতারণার শিকার হয়ে তোকে মস্ত বড় একটা অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে গতকাল।

 

যাকে আজ কয়েক বছর ধরে জানিস, যার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিলি তুই অহরহ, সলজ্জ হেসে হাতব্যাগ থেকে বের করে যার ছবি একাধিকবার আমায় দেখিয়েছিস, সে যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে, এমন পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে তোর ওপর প্রথম সুযোগেই, তুই কী করে বুঝবি তা? আমি ছাড়া শুধু তোর বিধবা মা, যে আমাকে মজা করে ‘সই’ বলে ডাকে, জানত, কাল প্রথমবারের মতো তুই তোর প্রেমিকের বাড়ি গিয়েছিলি বিকেলবেলা। একটু ভালো কাপড় পরে, সামান্য সেজেগুঁজে, আমার কাছ থেকে ধার করে গায়ে সামান্য সুগন্ধি মেখে। তোকে সেখানে যেতে বারণ করিনি আমি অথবা তোর মা কেউ-ই। তোর পছন্দের মানুষটি বলেছিল, তার মা তার মুখে তোর কথা শুনে শুনে তোকে একবার দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। সামান্য আলাপ করতে চান ভাবী পুত্রবধূর সঙ্গে একান্তে নির্জনে। এর মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি আমরা। শেষ পর্যন্ত ভেবেচিন্তে ঠিক করা হলো, তোর প্রেমিকের বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্যে তোর যাওয়াই ভালো হবে বিশেষত একান্ত নিভৃতির জন্যে, যেটা ভদ্রমহিলা চেয়েছিলেন।

কিন্তু কাল বিকেল বেলা অনেকটা দূর হেঁটে ঐ বাড়িতে গিয়ে দেখিস, ওদের ঘরের দরজা খোলা কিন্তু মনে হয় যেন সারা বাড়ি খালি। কেমন সুনসান। কোনো শব্দ নেই কোথাও। এক-ই উঠানে আরো যে দুখানি ঘর, পশ্চিমে আর দক্ষিণে, যেখানে ওদের স্বজনরা তাদের পরিবার নিয়ে স্বতন্ত্র বাস করে, তাদের দরজাতেও বড় তালা ঝুলছে। তুই এসেছিস দেখে তোর প্রেমিক ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অতি আগ্রহ সহকারে ঘরে তুলে নেয় তোকে। যদিও আশপাশে কাউকে না দেখে তোর কেমন অন্যরকম লাগে সবকিছু। গা ছম ছম করে ওঠে একবার। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি তিনি- মানে তার মা কোথায়, তুই জানতে চাইলে সে হেসে বলে, বাড়ির সকলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় গেছে পাশের গ্রামে। শিগগির চলে আসবে।

           

আর তারপর এ-কথা সে-কথার পর, যাকে একদিন সর্বস্ব দিবি বলে প্রস্তুত হয়েই দিন গুনছিলি তুই, সে হঠাৎ এক অচেনা মূর্তি ধারণ করে। বনের ক্ষুধার্ত বাঘ কিংবা সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তোর ওপর। শুধু তাই নয়, তার নিজের দুই হাত খানিক ক্ষণের জন্যে মুক্ত করে তোর মুখ চেপে ধরে জোরে তোর আর্তচিৎকার থামিয়ে দেবার জন্যে। পরে অবশ্য হাত সরিয়ে নিয়েছিল একটি কোল বালিশের ওয়ার দিয়ে তোর মুখটা বেঁধে নিয়ে। ওয়ারটার খানিকটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বাকিটা সমস্ত মাথা পেঁচিয়ে পেছনের দিকে চুলের ওপর গিঁট দিয়ে আঁটকিয়ে নিয়েছিল। 

তোর মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীটা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল তোর গায়ের ওপরে। যেন বিশাল ভারী প্রস্তর চাপা পড়ে তুই নিঃশ্বাস নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিস। কতক্ষণ এমন চলেছিল বলতে পারবি না। তোর কাছে তা অনন্তকাল মনে হয়েছিল। কিন্তু ঝড় থেমে যাবার পরেও টের পাস বাড়ি নিঃশব্দ।  কেউ তখনো ফিরে আসেনি। সে কোনো কথা না বলে একটা সিগারেট ধরায়। কোনো কথা না বলে কয়েক টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা হাতে নিয়েই হঠাৎ কী কারণে ঘরের বাইরে চলে যায়।

 

তুই বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্ত্রখণ্ডগুলো একত্র করে যত দ্রুত সম্ভব তা পরে নিস।

আলুথালু চুলে, থ্যাবড়ানো লাল টিপে তুই যখন বাড়ি ফিরিস, তোর দৃষ্টি, বেশ, চেহারা দেখে তোর মাকে কিছু মুখে বলে দিতে হয় না। তোকে ঘরে ঢুকতে না দিয়েই তোর ডান কবজিটা শক্ত করে চেপে ধরে তোর মা বলে, ‘চল। আমার সঙ্গে থানায় চল।’

            পথে থেমে আমাকে সব জানিয়ে যায় সই। আমি ওদের সঙ্গে থানায় যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করি। সই বলে, এখন ঘরেই থাক। তোর করার অনেক আছে। পরে। এখন অপেক্ষা কর।

ওরা থানায় যায়। দারোগা ছিলেন না তখন থানায়। ডিউটিরত কনস্টেবল লিখিত অভিযোগ নেন। পরে দারোগাকে ডেকে আনা হয়। দারোগাই নাকি ফোন করে ডাক্তার ডাকিয়ে আনেন থানায়। বাদীর পক্ষ থেকে কেইস হিস্ট্রি লেখার পরেও শেষ পর্যন্ত মামলা গ্রহণ করা হয় না। পরিচিত দারোগা মাকে বোঝায় এসব মামলা-মোকদ্দমা, জেলহাজত করে লোক হাসিয়ে লাভ আছে? এ তো প্রেমিক-প্রেমিকার একান্ত নিজস্ব নিভৃতিতে ঘটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা ছাড়া, মামলা কোর্টে গেলে মেয়েটি কখনো প্রমাণ করতে পারবে না ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর ওপর জুলুম করা হয়েছে। ফলে কেইস হিস্ট্রি ফাইল করা যখন হয়ে গেছে, বাদী নিজে তার কথা একটু ঘুরিয়ে সমঝোতায় মীমাংসায় পৌঁছার বিষয়টাতে একটা সই করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যাবে এখানেই। পুলিশ, থানা, খবরের কাগজ, টেলিভিশন করে জীবনটা বরবাদ হবে না। বিশেষ করে যেখানে মেয়ে স্বেচ্ছায় পুরুষের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে বাড়িতে অন্য সকলের অবর্তমানে, আর তাদের দুজনের মেলামেশা, অন্তরঙ্গতা, ও পারিবারিক স্বীকৃতির কথা এই অঞ্চলের সবার-ই জানা।  ফলে একে ধর্ষণ বলে পাবলিকও মেনে নেবে না। গলা খাটো করে বিধবা মায়ের প্রতি সহানুভূতির স্বরে দারোগা বলেন, ‘মেয়েটার বিয়েটিয়ের সম্ভাবনাও তো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে, যদি...।’  অতএব শুভাকাঙ্ক্ষী দারোগার আদেশে একে ধর্ষণের বদলে  ‘প্রেমিক-প্রেমিকার বিবাদ’ বলে উল্লেখ করা হলো থানার নথিপত্রে। সব দেখেশুনে এবং পরীক্ষা করে ডাক্তারও বললেন, ‘যৌনমিলনের সাক্ষ্য মিললেও ধর্ষণের কোনো আলামত তিনি পাননি। মেয়েটির শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই।  কামড়, আঁচড় বা চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো নমুনা দেখা যায়নি কোথাও। কোনো ক্ষত নেই ঠোঁটে, স্তনে, তলপেটে বা অন্য কোনোখানে। আর ভিকটিম নিজেই যখন আসামিকে শনাক্ত করেছেন তার পূর্বপরিচিত এবং প্রেমিক হিসেবে, তখন খরচসাপেক্ষ ডিএনএ পরীক্ষা করে নতুন করে আসামি খুঁজে বেড়াবার কোনো অবকাশ বা যৌতিকতাও নেই।’

  

অতএব খালি হাতে ওরা থানা থেকে ফিরে এল ঘরে। আমি বসেছিলাম ঘরের দোরে ওদের প্রতীক্ষায়। ওদের টলটলায়মান শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনকেই একসঙ্গে জড়িয়ে ধরি। আমার দুটি হাত ওদের দুজনের ঘাড়ে রেখে মা-মেয়েকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে বসাই চৌকিতে। এক গ্লাস করে ঠান্ডা জল এনে দিই দুজনের হাতে। নিজেও খাই ছোট এক গ্লাস।

রাত হয়ে গেছে। দরজার কাছে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। আর কোনো আলো নেই কোথাও। আমরা তিন নারী অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকি আবছা অন্ধকারে। কেউ কোনো কথা বলি না।  মনে হয়, সব কথা বুঝি ফুরিয়ে গেছে আমাদের।

একসময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পশ্চিম দিগন্তের ওপরে কাস্তের আকারের পরিচিত চাঁদটা উঠেছে। চারদিকে এত অন্ধকার বলেই বুঝি চাঁদটিকে অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আজ। বছরের শেষ চাঁদ। মনে হলো, এই গ্রহে সারা বছরে জমে ওঠা সকল কালিমা, সকল আবর্জনা, সকল নষ্টামি ঘোচাতেই যেন আকাশে উদিত হয়েছে এই উজ্জ্বল চাঁদ। আমি সেই কখন থেকে পাগলিটাকে নিয়ে মনে মনে একটি পদ্য রচনা করে চলেছিলাম।

 

 অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

 

খোলা দরজার কাছে মেঝেতে রাখা হ্যারিকেন নিয়ে এসে ঘরের ভেতর টেবিলটার ওপরে রাখি। তারপর মনে মনে গড়া পদ্যখানি একটি কাগজে লিখে ফেলি চটপট। এই মুহূর্তে, জীবনের এক গভীর কালবেলায়, তাৎক্ষণিক করণীয়ের কথা ওকে মুখে বুঝিয়ে বলার চেয়ে ছন্দবদ্ধ বা ছন্দমুক্ত লিখিত নির্দেশাবলিতে প্রকাশ করা আমার কাছে অনেক বেশি সহজ মনে হয়। পাগলি, আমি জানি, বুঝতে পারবে এই ভিন্ন প্রকাশভঙ্গির পেছনের আসল কারণ।  পাগলি বুঝতে পারবে কবিতার লাইনগুলোর মাঝখানে যে শূন্যতা, সেই না বলা কথাগুলোর অনুপস্থিতি, আমাকেও নৈঃশব্দে ঠেলে দিয়েছে, আমি বাঙ্ময় হতে প্রায় ভুলে গেছি। ফলে ভালো কাজের কথা যেমন আমি প্রায় বলি না আজকাল, খারাপ কাজের-ও সমালোচনা করি না।

 

কবিতা

পদ্মস্নান

 

কাঁদিস্ না আর, ওঠ্ এবারে, দূর করে দে ভয়,

এমনি করেই আমাদের যে বেঁচে থাকতে হয়।

 

পুলিশ-ডাক্তার সব করেছিস, সব বলেছিস, সঙ্গে ছিল মায়

কিন্তু তারা গা করে না,  রা’ করে না, রিপোর্ট লিখে যায়।

 

যা পাগলি, পুকুরঘাটে, গোসল সেরে আয়

ঘষে মেজে নাইবি যাতে নোংরা মুছে যায়।

 

কান্না কিসের? বলি মেয়ে, চোখে কেন জল?

এমন কী আর হয়নি আগে নিজের মুখেই বল!

 

গেল বছর চৈত্র মাসের কালবৈশাখীতে

জয়া গেল তুফান-ঝরা আম কুড়ায়ে আনতে।

 

কোথায় আম! কোথায় জয়া! সন্ধ্যা নামে ঘাটে

বেহুঁশ মেয়ে খুঁজে পেতে সারাটা রাত কাটে।

 

ভাগ্য তবু  ভালো জয়ার বেঁচে তো সে আছে!

মুখে রা’ নেই, যদি আরো ক্ষতি হয় তার পাছে।

 

আরো ক্ষতি? সে কী জিনিস জানতে যদি চাই

ওরা বলে, ‘হতে পারতো জীবনটাই আর নাই।’

 

তাইতো বলি, কান্না ভুলে ওঠ্ এবারে, স্নানটা সেরে আয়

জানিস্ না কি পদ্মপুকুরজলে সকল ময়লা ধুয়ে যায়!

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়