ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘...রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি’

রিজভী জয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘...রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি’

রিজভী জয় : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’র শেষ দুই পঙ্‌ক্তিতে লিখেছেন : সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,

রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘বাঙালি চিরদিন দালালী করতে পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না।’

ছেলেবেলায় কবির এসব উক্তির জন্য কিছুটা বিরক্তই হতাম। নিজ জাতিসত্তা নিয়ে এহেন অসম্মানসূচক মন্তব্যে আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগতো বৈকি। ভাবতাম কবিগুরু নিজে বাঙালি হয়েও কি করে পারলেন এ মন্তব্য করতে!

 

সে প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হয় নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘কবিগুরু দেখে যাও বাঙালি মানুষ হয়েছে...

মনে মনে ভাবলাম, যাক বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু কিছুদিন পরই এই বাঙালিরাই যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলো তখন কবিগুরুর উক্তির যথার্থতা আবার প্রমাণিত হয়ে গেল।

 

নিজেদের অমানবিক, স্বার্থপর আচরণ দ্বারা আমরা কবিগুরুর বক্তব্য প্রমাণ করেছি বার বার। অমানুষ সন্তানদের কার্যকলাপ বাঙলা মায়ের গর্বিত মুখে কালি লেপন করেছে, কত না রজনী তাকে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়েছে। বাঙালির সে অমানবিকতার সর্বশেষ উদাহরণ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে হামলা।

 

গত ৬ নভেম্বর রবিবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে তীরবিদ্ধ হয়েছেন ৯ জন পুলিশ সদস্য এবং গুলিবিদ্ধ হন চার জন সাঁওতাল। এদের মধ্যে তিন জন সাঁওতাল নিহত হন। পরবর্তীতে পুলিশ ওইদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে। এসময় তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া সহ লুটপাট চালায় স্থানীয় দুর্বৃত্তরা।

 

কেন সাঁওতালরা এমন আচরণ করল? প্রশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সাহস তারা পেল কোত্থেকে? এ সব প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এক সহজ সমীকরণে। নিজ স্বার্থে সাঁওতালদের ব্যবহার করে তাদের গাছে তুলে দিয়ে সটকে পড়েন গাইবান্ধা সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদেরেএক সদস্য। জমি অধিগ্রহণের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে এমন খবর প্রচার করে, রংপুর চিনিকলের জমি দখল করতে সহজ সরল সাঁওতালদের ভুল বুঝিয়ে পূর্বপুরুষের জমি উদ্ধার আন্দোলনে নামতে উস্কানি দেন তিনি। সাঁওতালদের অধিকার আদায়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে সচেষ্ট হন সাবেক ছাত্রলীগের এই  নেতা। সহজ সরল অসহায় সাঁওতালরাও তাকে বসায় দেবতার আসনে।

 

ক্ষতিগ্রস্থ সাঁওতালদের অভিযোগ, রংপুর চিনিকলের জমি দখল করে নিতে তাদের উসকে দিয়েছিলেন এই নেতা। আবার গত ৬ নভেম্বর এই চেয়ারম্যানের নির্দেশেই তাদের বসতবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এর পেছনে কে বা কারা ছিল তাদের নাম বেরিয়ে আসে। সর্বশেষ এ হামলার নেপথ্যে সাঁওতালরা স্থানীয় এমপি, কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ইন্ধনদাতার অভিযোগ তোলেন।  এ লজ্জা কোথায় রাখবে বীরের জাতি বাঙালি?

ঘটনার পর থেকে এ নিয়ে চলছে রাজনীতি। অভিযুক্তরা অভিযোগ অস্বীকার করে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাহ! এই তো বাঙালির চরিত্র। তারা ভুলেই যাচ্ছেন, তারা সবাই জনপ্রতিনিধি। সুতরাং দোষত্রুটি যাই হোক, দায় এড়ানোর সুযোগ এখানে নেই।

 

অধিপতি শ্রেণির বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন, নিপীড়ণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর যুদ্ধের এন নদী রক্ত পেরিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এসেছে। কথা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অথচ জন্মলগ্ন থেকেই আমরা তা ভুলে বসে আছি।  

 

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জন্য প্রণীত সংবিধানে এ দেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোন জাতিসত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় নি। অথচ, এ উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদ আর অধিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন করেছিল সাঁওতালরাই। একটু পেছন ফিরে তাকালে তা স্পষ্ট দেখা যাবে। যদিও বাঙালির গৌরবের ইতিহাসের মহাকাব্যে এ গৌরবগাঁথা অগ্রন্থিত থেকে গেছে।

নিষাদ জাতির অন্তর্ভুক্ত সাঁওতালরাই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা। মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, পাকুর, পূর্ণিয়া অঞ্চলে অবস্থান করলেও, সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বাস করে ভাগলপুরের দামিন-ই-কোতে। বহু কষ্ট করে বন সাফ করে শ্বাপদ-সংকুল দামিন-ই-কোতে তারা জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে মানব বিচরণই ছিল না, সে মাটিতে ফলিয়েছিল সোনালী ফসল।

দামিন-ই-কো’র সমৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে সেখানে আগমন ঘটে ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণির। তারা ব্যবসার নামে বিনিময়ের সময় সহজ সরল সাঁওতালদের চরমভাবে ঠকানো শুরু করে। কিছু চাল, কিছু অর্থ বা অন্য দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবনের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্যবিধাতা ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসল মহাজনরা।

 

ঋণ দেওয়ার সময় মহাজনরা যত টাকা দিত, লিখিয়ে নিত তার চেয়ে অনেক বেশি। এবং ঋণ শোধের সময় সুদসমেত আসল টাকা আলাদা আলাদা দিতে হতো। ফলে সব দিয়েও অনেক সময় শোধ হতো না মহাজনের ঋণ। তখন সাঁওতাল চাষি বাধ্য হতো নিজেকে বন্ধক দিতে এবং মহাজনের ক্রীতদাসে পরিণত হতে। বিনা পারিশ্রমিকে খাটতে খাটতে তার জীবন শেষ হয়ে  যেত। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বংশধরের জন্য সে একটা জিনিসই রেখে যেতে পারত, তা হলো মহাজনের ঋণ। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইংরেজদের খাজনা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো স্থানীয় জমিদারদের লোলুপ দৃষ্টি। সাঁওতালদের জমি গ্রাস করার বিভিন্ন উপায় খুঁজত তারা। এই উদ্দেশে তারা তাদের গরু, ছাগল, মহিষ, টাট্টু ঘোড়া এমনকি হাতির বাঁধন খুলে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে দরিদ্র সাঁওতালদের ক্ষেতের পাকা ফসল নষ্ট করে ফেলত।

এই অমানবিকতার প্রতিকার সাঁওতালদের হাতে ছিল না। ইংরেজদের বিচারালয় তাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাবার কোন নিশ্চয়তাও ছিল না। কাজেই আদালতে সুবিচার লাভ সাঁওতালদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। নিপীড়ণ নিষ্পেষণের জালে আটকে যাওয়া এই সহজ সরল মানুষগুলোর আদতে মুক্তির কোনো পথ খোলা ছিল না। ফলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাস্বরূপ তারা বিদ্রোহে অংশ নেয়। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন প্রায় ৫০ হাজার সাঁওতালের এক বিশাল মিছিল বড়লাটের কাছে অভিযোগ পেশ করার উদ্দেশ্যে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য ধর্মের শোষিত, নিপীড়িত মানুষ।

 

অসম বিদ্রোহের ফলাফলে এ বিদ্রোহে সাঁওতালদের সেদিন পরাজয় হয়েছিল সত্য কিন্তু প্রেরণা যুগিয়েছিল পরবর্তীকালের সকল স্বাধীকার আন্দোলনে। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগের দেখানো পথেই এসেছে সিপাহী বিদ্রোহ, ভারত ছাড় আন্দোলন, বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। অথচ কতই না অকৃতজ্ঞ আমরা! আমাদের অধিপতিশীল জ্ঞান কাঠামো স্বীকার করে নি সাঁওতাল বিদ্রোহের অবদান। আর একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে এখানে ওখানে খড়কুটোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে তারা।

 

মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়ালেও বদলায়নি সাঁওতালদের ভাগ্য। আজীবন তারা থেকে গেছে শোষিতের কাতারে। কালে কালে শুধু বদলেছে শোষকের পরিচয়। আজও অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, জাতিগত বৈষম্য, হয়রানি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। তাদের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটাপন্ন, ভাষা বিপন্ন। তাদের উন্নয়নের জন্য অদ্যাবধি তেমন আন্তরিক ও জোরালো কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা কী ধরনের উন্নয়ন চায় সে ব্যাপারে তাদের অভিমত শোনার প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি কেউ। নিজের দেশে, এই স্বাধীন মাটিতেই তারা চরম অবহেলার শিকার হয়ে আজও তারা প্রহর গুনছেন আমরা অর্থাৎ বাঙালিদের মানুষ হবার অপেক্ষায়।

 

যতদিন না ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বাঙালি মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন গোবিন্দগঞ্জের মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে তাতে সন্দেহ নেই। শুরু করেছিলাম কবিগুরুর কথা দিয়ে, শেষে করছি তাঁর কথা দিয়েই। বাঙালি চরিত্রের টলটলায়মান বা অস্থির অবস্থা দেখে তিনি বারবার হতাশ হয়েছেন। আবার বাঙালির বীরত্বে তিনি গর্বিত হয়েছেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘বাঙালির প্রধান রিপু হচ্ছে আত্মভিমান তাহাকে অহরহই স্তুতির সুদ ঢোঁকে ঢোঁকে গেলাতে হয়, তার কমতি হলেই তার অসুখ বোধ হয়’ (সাহিত্যের পথে)।

কবিগুরু যতই অভিমান করে বাঙালিকে গাল-মন্দ করুন না কেন, তিনিই বাঙালিকে উচ্চ আসনে উঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : ‘বাঙালির প্রাণ বাঙালির আশা/ বাঙালির কাজ বাঙালির ভাইবোন/এক হউক সত্য হউক, সত্য হোক হে ভগবান।’

 

কিন্তু আমরা তো এক হতে পারছি না। শয়তানের প্ররোচনায় আমরা হানাহানি বিভেদে নিজেরা কলুষিত হচ্ছি। ধর্মীয় সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে আমরা এখনও বের হয়ে আসতে পারছি না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং সাঁওতাল, ওরাও, মোরাং, গারো, চাকমা সকলে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধ করলাম। অথচ এখনও মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জায় হামলা হচ্ছে। লুটপাট, খুন, নির্যতন চালানো হচ্ছে হিন্দু, খ্রিস্টান,বৌদ্ধ, সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে!

 

বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে আমরা বাঙালিরা হত্যা করেছি। যিনি প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন-আমরা কতটা অকৃতজ্ঞ। বাঙালি তাঁর ডাকে একতাবদ্ধ হয়ে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করলো। তারপর আবার এই স্বাধীন দেশেই বাঙালি জাতিসত্তাকে কৌশলে কবর দেওয়া হলো। এখনও তারই ধারাবাহিকতা চলছে। দুষ্টুচক্র এখনও সক্রিয়। তারা আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করছে। মনে রাখতে হবে, রবি ঠাকুরের কথাটি : ‘বাঙালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ, শাশ্বত যা সর্বমানের বেদীমূলে উৎসর্গ করবার উপযুক্ত, তাই আমাদের বর্তমানে কাল রেখে দিয়ে যাবে ভাবি কালের উত্তরাধিকাররূপে। সাহিত্যের মধ্যে বাঙালির যে পরিচয় সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ব সভায় আপন আত্মসম্মান সে রাখবে, কলুষতা আবর্জনা বর্জন করবে, বিশ্ব দেবতার কাছে বাংলাদেশের অর্থরূপেই সে আপন সমাদর লাভ করবে।’

 

লেখক : সাংবাদিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়