ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ক্যাম্পাসের সুলতান

মাহমুদুল হাসান আসিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্যাম্পাসের সুলতান

মাহমুদুল হাসান আসিফ: ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’ কিন্তু কখনো কখনো কেউ তার স্বপ্নের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। জীবনের এমনই গল্প বুকের গহীনে লালন করে চলেছেন রাজশাহীর সুলতান কবীর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুলতান কবীর জন্মগতভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তিনি একচোখে দেখতে পান না। অপর চোখে দেখেন খুব সামান্য। সুলতানের জন্ম চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা মো. শাহীন উদ্দিন দিনমজুর, ঠিকঠাক তিনবেলা খাবার জোগাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলের জীবন জয়ের অদম্য ইচ্ছা যেন কোনো প্রতিবন্ধকতাতেই হার মানতে চায় না। সকল বাঁধা উপেক্ষা করে সুলতান পৌঁছাতে চায় অভীষ্ট লক্ষ্যে। তিনি ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। এখন এই বিভাগের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে সে আইডল। কেননা বিভাগের সর্বোচ্চ রেজাল্ট তার দখলে।

ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল সুলতানের। ফলশ্রুতিতে মাধ্যমিক পর্যন্ত কখনো দ্বিতীয় হননি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেন, দৃষ্টিশক্তির চেয়ে ইচ্ছেশক্তির জোর কত বেশি। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে শুধু মেধা আর ইচ্ছাশক্তিই শেষ কথা নয়। এসএসসি পরীক্ষার আগে তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।  চিকিৎসক জানিয়ে দেন, তিনি আর ভারি কোনো কাজ করতে পারবেন না। এদিকে বাবার চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে তার চোখের চিকিৎসা। কোনোটাই ভালোভাবে হয় না। ফলে বাকি চোখটাও আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে সুলতানের। এমন পরিস্থিতিতে পড়ালেখা নয়, পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব নেয়াই প্রধান হয়ে ওঠে সুলতানের কাছে। রাইজিংবিডির কাছে সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে গলা ভারি হয়ে এলো তার।

সেই দুঃসময়ে উপায় না পেয়ে টিউশনি বাড়িয়ে দিতে হলো, সকাল-সন্ধ্যা টিউশনি। সেখান থেকে করা আয় দিয়েই অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর পরিবারের বেঁচে থাকা। এসএসসি পরীক্ষায় তাকে বসতে হলো প্রস্তুতি ছাড়াই। ফলশ্রুতিতে মাধ্যমিকে ফল আশানুরূপ হলো না। এরপর সুলতান উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলো গ্রামের উথলি কলেজে। সকল বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েই এইসএসসি পাশ করলো। এরপর ভর্তি হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্ত এরপর আবারো নেমে আসে আঁধার। পড়ালেখার অর্থ আসবে কোত্থেকে? বাবা-মাকে খাওয়াবে কে? এসব ভাবনায় জর্জরিত হতে থাকে সুলতান। উত্তর খুঁজে না পেয়ে স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সবকিছু গুছিয়ে সে ফিরে আসে বাড়িতে। কিন্ত যে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়, তার স্বপ্ন এত সহজে মরবার নয়। আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সুলতান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলে আসা শিক্ষক আর সহপাঠীদের দেয়া সাহস আর অনুপ্রেরণায় আবারো ফিরে আসে সে ক্যাম্পাসে। পড়াশোনা শুরু হয় নতুন করে। এরপর প্রথম বর্ষে শুধু বিভাগে নয়, পুরো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে সর্বোচ্চ সিজিপিএ অর্জন করে সে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি করে এক বিস্ময়ের। সুলতান এখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, সর্বোচ্চ সিজিপিএ এখন তারই দখলে।

শুধু বইয়ের পড়া কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শক্ত থিওরি পড়া নয়, সুলতানের মেধার প্রমাণ মেলে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। সুলতানের মুঠোফোনে কোনো নম্বর সংরক্ষণ করা নেই। যে কারো নম্বর এমনকি কয়েক বছর আগে কথা হয়েছে এমন ব্যক্তির ফোন নম্বরও সুলতানের মুখস্থ। দুই, তিন কিংবা চার অঙ্কের যোগ, বিয়োগ, গুণ নিমিষের মধ্যেই করতে পারে সে মুখে মুখে। বলা চলে, খাওয়া-গোসলের মতো মৌলিক কাজগুলো বাদ দিয়ে দিনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে মেধা ঝালাইয়ের মধ্য দিয়ে।

পড়ালেখার প্রতি এমন ভালোবাসার কারণ জানতে চাইলে সুলতান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি একমাত্র পড়ালেখার মাধ্যমেই সবকিছু জয় করা সম্ভব।’ ভবিষ্যৎ ভাবনা জানতে চাইলে সুলতান জানায়, রাবি থেকে মাস্টার্স করার পর ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করা এবং নিজেকে একাডেমিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলাই এখন তার সংগ্রাম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়