ব্লাস্ট রোগে ২০ হাজার বিঘা জমির ধান নষ্ট
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা : আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ব্রি-২৮ ধান কাটা শুরু হবে। কৃষকদের প্রত্যাশা ছিল ধান বিক্রি করে মেটাবেন মহাজনের ঋণ। মোট উৎপাদন থেকে নিজেদের সারা বছরের খোরাক হিসেবে রেখে দেবেন কিছু অংশ। কিন্তু এবার মহামারী ব্লাস্ট রোগ কৃষকদের সব আশা ভঙ্গ করে দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার মাঠের প্রায় ২০ হাজার বিঘা জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। তবে কৃষি বিভাগের হিসাবে ৫০০ বিঘা । কৃষকরা তাদের অন্যান্য মাঠের জমির ধান নিয়ে এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, দূর থেকে মনে হয় ধান পেকে গেছে। কিন্তু কাছে যেয়ে দেখা যায় ধানের প্রতিটি শীষ শুকিয়ে গেছে এবং ধানে দানা নেই। সব চিটা ।
দোস্ত গ্রামের মাঠে যেয়ে কথা হয় কৃষক আবু ছালেহ’র সঙ্গে। তিনি জানান, তার তিন বিঘার ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি এবার তার জমি থেকে খরচের টাকাটাও উঠাতে পারবেন না।
কৃষ্টপুর গ্রামের মাঠে যেয়ে কথা হয় জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার সাত বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে। অনুরুপভাবে নুর ইসলামের চার বিঘা, হালিমের তিন বিঘা, কুন্দিপুর গ্রামের নাসিরের সাড়ে চার বিঘা, ইব্রাহিমের তিন বিঘা জমির ধান ব্লাস্ট রোগে চিটা হয়ে গেছে।
এসব ক্ষতিগস্ত কৃষকরা জানান, ধার দেনা করে ধানের আবাদ করে আজ তারা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তারা এবার মোটা অংকের দেনায় জড়িয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে ঘরে খাবারের ধানও উঠবে না।
কৃষকরা বিঘা প্রতি ফলনের আশা করেছিল ২০ থেকে ২২ মণ ধান। কিন্তু ব্লাস্ট রোগের কারণে সেখানে উৎপাদন হবে মাত্র চার থেকে পাঁচ মণ। ফলে এ বছর কৃষকদের খরচের টাকাটাও ঘরে আসবে না। তারা জড়িয়ে যাবে ঋণের জালে। তবে, কৃষিবিদরা কৃষকদের সান্ত্বনা ও বাকি ধান রক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কৃষকরা সে পরামর্শে ভরসা পাচ্ছেন না ।
গত বছর চুয়াডাঙ্গায় ব্লাস্ট রোগে গম নষ্ট হবার পর এ বছর চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা ও জীবননগর উপজেলার মাঠে ব্রি-২৮ ধান ব্লাস্ট রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্লাস্টের কারণে ধানের শীষে একটিও দানা নেই । সবই চিটা হয়ে গেছে।
আর যে সব জমির ধানে এখনো ব্লাস্ট আক্রান্ত হয়নি সে ধানগুলিও ব্লাস্ট রোগ থেকে রক্ষা করতে পারবেন কি না কৃষকরা শঙ্কায় আছেন । তারা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শতেও ভরসা পাচ্ছে না । কৃষকদের অভিযোগ, কৃষি উপ-সহকারীরা আগাম জানালে হইতো এই ব্লাস্ট রোগের হাত থেকে ধান রক্ষা করা যেত।
তবে কৃষিবিদরা জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। এদিকে ধান নষ্ট হওয়ায় চলতি বছরে কৃষকদেরকে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হবে। বাধ্য হয়েই জড়িয়ে পড়বে ঋণের জালে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নির্মল কুমার দে জানান, মহামারী ব্লাস্ট রোগের কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ৩০০’ বিঘা, আলমডাঙ্গায় ১০৫, দামুড়হুদায় ৭৫ বিঘা ও জীবননগরে ৩০ বিঘাসহ প্রায় ৫১০ বিঘা জমির ধানের ক্ষতির হয়েছে।
কিন্তু সরজমিনে সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়ন, জীবননগর, দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার মাঠ এবং একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ব্লাস্টে প্রায় ২০ হাজার বিঘা জমির ধান ক্ষতি হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছর জেলায় ব্রি-২৮ ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রায় ৩৪ হাজার হেষ্টর। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রতি হেক্টরে সাড়ে ৩ মেট্রিক টনের বেশী । কিন্তু নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০০ হেক্টর বেশি জমিতে ধান আবাদ হয়েছে।
ব্লাস্টের বিষয়ে কৃষিবিদদের দাবি, আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এই রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ। যেকোনো ফসলে এই রোগ তখনি হয় যখন রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম এবং সকালে শিশির পড়ে। শিশির পড়াতে তা বাতাসের অধিক আর্দ্রতায় এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়।
কৃষিবিদরা এ সময় কৃষকদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন, যে সব মাঠের জমির ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে সব জমিতে পুনরাই পানি ধরে রেখে পাঁচ কেজি এমওপি সার ছিটাতে হবে। সেই সঙ্গে টেবুকোনাজল + টাইফুক্সিট্রোবিন ৬ গ্রাম অথবা ট্রাইসাই ক্লাজল + প্রপিকোনাজল ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি পাঁচ শতক জমিতে ৭-১০ দিন পর পর বিকেল বেলায় স্প্রে করতে বলা হয়েছে ।
অপর দিকে ব্লাস্টের আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে আক্রান্ত ও অনাক্রান্ত সব খেতে ( ট্রাইসাইক্লাজল + প্রপিকোনাজল ) ২ মি. লি. প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি পাঁচ শতক জমিতে ৭-১০ দিন পর পর বিকেল বেলায় দুই বার স্প্রে করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরে গমে ব্লাস্ট রোগ হওয়ায় কৃষিবিদরা চলতি মৌসুমে কৃষকদেরকে গম আবাদে নিরুৎসাহিত করে এবং ধানসহ অন্যান্য ফসলের আবাদে উৎসাহ দেখায়। এর ফলে কৃষকরা কৃষি বিভাগের কথা মত গম আবাদ না করে ধানের চাষ বৃদ্ধি করে । কিন্তু সেই ধানও যখন ব্লাস্ট রোগে নষ্ট হচ্ছে তখন কৃষকরা চরম শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন।
রাইজিংবিডি/ চুয়াডাঙ্গা / ১১ এপ্রিল ২০১৭/এম এ মামুন/রুহুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন