ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কবি দলের হয় না, সে সব অবস্থায়ই কবি : আল মাহমুদ

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবি দলের হয় না, সে সব অবস্থায়ই কবি : আল মাহমুদ

কবি আল মাহমুদের সঙ্গে জব্বার আল নাঈম

আল মাহমুদ কবি ও কথাসাহিত্যিক। ত্রিশের কবিদের হাতে বাংলা কবিতার আধুনিকতার উন্মেষ। কবি আল মাহমুদ সেই সাফল্য মৌলিক শৈলীতে ধরে রেখেছেন গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে অদ্যাবধি। নাগরিক চেতনায় আল মাহমুদ মাটিজ অনুভূতিতে গ্রামীণ শব্দপুঞ্জ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্প সংশ্লেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছেন। কবির সঙ্গে আমার কথা হয় এই গ্রীষ্মের এক উজ্জ্বল সন্ধ্যায়, তারই মগবাজারের বাসায়।

শুরুটা আমিই করেছিলাম। অর্থাৎ যেহেতু আমি কবির সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি সুতরাং সালাম বিনিময়ের পর আমাকেই কথা বলতে হলো। আমি যা শুনেছিলাম, আলোচনার শুরুটা সেখান থেকেই হওয়া উচিত বলে যুক্তিসংগত মনে হলো। আমি বললাম, ‘গত বছর আপনি ঘোষণা দিয়ে মহাকাব্য শুরু করেছিলেন এবং কিছু অংশ প্রকাশও করতে দিয়েছেন। বাকি অংশটুকুর কী অবস্থা?’

আল মাহমুদ বললেন, ‘হ্যাঁ, লিখতে তো শুরু করেছিলাম। কতটুকু শেষ করতে পারি বলা যাচ্ছে না।’ বলেই কবি পাশে বসা জামিল আরাফাতের কাছে জানতে চাইলেন, ‘কত লাইন শেষ হয়েছে?’ জামিল জানাল, ৯২৭ লাইন লেখা সম্পূর্ণ হয়েছে। কবি এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘শুনলেই তো, কতটুকু পারি বা কোথায় গিয়ে শেষ করতে পারব, বলতে পারছি না।’

আল মাহমুদ এখন আর নিজে লিখতে পারেন না। জামিল আরাফাত কবির কাছ থেকে শুনে শুনে লিখে নেন। আমি বললাম, ‘এই বয়সে এসে আপনার ভেতরে কোনো রকম আত্মতৃপ্তি কাজ করে কি?’
কবি বললেন, ‘না। প্রতিভাবানদের আত্মতৃপ্ত হতে নেই। প্রতিনিয়ত তাদের ক্ষুধার্ত থাকা ভালো। এখন তো ভালো করে লিখতে পারছি না। আমার ইচ্ছা আছে কাব্যনাট্য লেখার। আমার খুব ইচ্ছা ছিল কাব্যনাট্য করা। কিন্তু সেটা আমি পারি না। অনেক সময় মনে হয় করতে পারলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করত।’

আমি বললাম, ‘সবাই রবীন্দ্রনাথ দিয়ে বাংলা সাহিত্য শুরু করে। অথচ তারও আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা অন্যান্য অনেকে সেখানে বাদ পড়ে যান; এটাকে কী বলা যায়?’
‘এর কারণ আমার যেটা মনে হয়...।’ কবি কিছুক্ষণ থেমে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে আমাকেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা মাইকেল নিজে কখনো ‘মাইকেল’ বলতেন? অথচ তোমরা তাকে ‘মাইকেল’ বলো। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার! কিন্তু সে কি কখনো বলেছে? নেভার। সে বলেছে: 

‘পিতা রাজ নারায়ণ
জননী জাহ্নবী
দত্তকূল কবি। আমি শ্রী মধুসূদন।’’
কবি প্রসঙ্গে ফিরে আসেন। বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে তো অনেকের নামই আলোচনায় আসে না। যেমন, অসাধারণ গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ লিখে বিশ্বমানের কাতারে পৌঁছে গেছেন। অথচ কত কম আলোচিত!’

‘মাহমুদ ভাই, দার্শনিকভাবে বিশ্লেষণ করলে মানুষ হারায় না অর্জন করে?’
‘প্রশ্নটা বেশ জটিল। কে এর সমাধান দেবে? তবে আমার কথাটা বলতে পারি, মানুষ মনে হয় কিছুই হারায় না। হারানোর কী আছে? কিছুই নেই। আমার জীবনে জেল-জুলুম হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছি। অযথা আমাকে কষ্ট করতে হয়েছে। আমি কিন্তু কখনোই বলিনি, আমি হারিয়েছি। তার পরও আমি আমার কাজ করছি। এই বৃদ্ধ বয়সে আমি বসে থাকিনি। যখন যেটা পেরেছি, করেছি এবং করছি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখে যাচ্ছি। হয়তো ভালোভাবে সম্পূর্ণ করতে পারি না। তার পরও অলস বসে থাকি না।’

‘আপনি কবি, গদ্যও লিখেছেন। আপনার কাছে কবিতার সংজ্ঞা জানতে চাই?’
‘কবিতার সংজ্ঞা বলা তো খুব কঠিন! কবিতা হলো, কবির বাস্তব এবং জীবনের বাস্তবতা-স্বপ্নের মধ্যে পা ফেলে হেঁটে যাওয়া। সেই অভিজ্ঞতা কলমে বর্ণনা করাকে আমি মনে করি কবিতা।
আমি বলি, কালিদাস পণ্ডিত অনেক ধাঁধা লিখে গেছেন। সেগুলোকে আমরা কবিতা বলব?’

কবি নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন। পরক্ষণেই আপনমনে দিলেন তার উত্তর- ‘‘ধাঁধা কবিতাই। আর কালীদাস পণ্ডিত অনেক বড় মানের কবি। কারণ, তিনি ‘মেঘদূত’ রচনা করেছেন। তার দূত যেসব দেশের ওপর দিয়ে যেত, সে দেশের বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি। তুমি শুনলে অবাক হবে এত অ্যাকুরেট বর্ণনা! কোন দেশের মেঘের চুল কেমন? ভারতের মেঘের কেশ কেমন- সেসবের বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি। গাঁয়ের বর্ণনা দিচ্ছেন। এ কি খুব সহজ? এ কি গভীর জ্ঞান ছাড়া সম্ভব? তিনি তার কালের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সব বিষয়ে জানতেন। এ ছাড়া ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান যেভাবে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন, এখনো অবাক হয়ে যাই। খুব সহজ কথা নয়! কালিদাস একজন কবি এবং জেনুইন কবি। কবিতা হলো একজন কবির স্বপ্ন, জীবনের বাস্তবতা- এখানে সবকিছু এসে যায়।’’

‘তাহলে কবি ও গল্পকারের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?’
‘‘গল্পকার যখন সৃজন করেন তখন তিনি কবিই। সৃজনের কম্পন কবির মতো। কিন্তু তার জ্ঞানবুদ্ধি পড়াশোনা তাকে গদ্য প্রস্তুতে প্ররোচনা দিচ্ছে। আবার কবিতাও সে লেখে। কখনো কখনো প্রবন্ধও। কথা হলো, রচনার মুহূর্তে তার মধ্যে যে সৃজন কম্পন হয়, শরীর শিরশির করতে থাকে এবং শুধু লিখতে বা বলতে ইচ্ছে করে। এটা তো কবির কাজ। কবির আরেকটা কাজ পরিবর্তন। এটা সব কবিই চায়। সমসাময়িক কালের যে গণ্ডি আছে, এটা সবাই ভেঙে বের হয়ে যেতে চায়। আমার একটা ছড়া আছে :

‘সবাই বলে ভাঙব ভাঙব
কেউ কি কিছু ভাঙে?
ষাটের দশক বগল বাজায়
বউ কেড়ে নেয় লাঙে।’’

কবি হেসে ওঠেন। বলেন, ‘কথাটা কিন্তু ঠাট্টা নয়। ঠাট্টা হলেও বাস্তবতা আছে। ষাট দশকের কিছু কবির বউ ঘরে ছিল না। তবে, এটা কাউকে আহত করার জন্য বলি না। কথা হলো, সমসাময়িক সময় ধরে ভেঙে বের হতে হবে, আমাদের দেশে যেহেতু আমরা কাব্যে অনেক এগিয়ে, তাই এটা নিয়ে অনেক কথা হয়। হবে। আর হলেই ভালো। কবিতা আধুনিক সাহিত্য এবং এটাই একমাত্র আধুনিক প্যাটার্ন।’

‘কবিতার প্রসঙ্গে আসি। আপনি বলেছেন, কবিতা তুলনামূলক কমপ্লেক্স। তাহলে কি ধরে নেব-
কবিতা কৈশোরের স্মৃতি
সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি...’
কবি শেষ করতে দেন না। কবিতার সুর কেড়ে নেন নিজ কণ্ঠে:
‘পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি
রাবেয়া রাবেয়া-
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের
ভেজানো কপাট!
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী।’

আল মাহমুদ পুরো কবিতা গড়গড় করে বলে যান। তারপর বলেন, ‘ভাই, কবিতা এ রকম হতে হবে- এমন নয়। এগুলো তো আমি বলেছি। স্রেফ আমার কল্পনামাত্র। আমার মনে হয়েছে। তবে, এটা যে সার্থক সংজ্ঞা এমনটা আমি বলতে পারব না।’

আমি প্রশ্ন করি, ‘‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে আপনি লিখেছেন ‘ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি’- আসলেই কি তাই?’’
‘হ্যাঁ, ঠিক কথা। আসলেই আমি কিছু পারতাম না। পারলে তো করতাম। দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন। যা-ই হোক, এখানে একজন কবির বক্তব্য খুব ওপেন বলেছি। আমি বলতে পেরেছি- প্রেমের সংজ্ঞা তো সবাই দেয়। কথাটা আশা করি বুঝতে পারছ।’

অন্য আরেকটি লাইনে আপনি বলেছেন, ‘পরাজিত নয় নারী; পরাজিত নয় কবিরা।’
‘এটাও সত্য। কবিরা তো পরাজিত নয়। কবিরা পরাজয় মানতে চায় না। এটা হলো কবি স্বভাব। সেই কালিদাস থেকে শুরু করে আজ অবধি কোনো কবি পরাজয় মানতে চায় না। কারণ একজন প্রকৃত কবির তো হারানোর ভয় নেই। কবি জানে সামনের দিকে তাকাতে। কবির উচিত সামনের দিকে তাকানো।’

‘আপনার কবিতায় ইমাজিনেশন দেখা যায়। কবিতায় চিত্রকল্পের ওপর অধিক হারে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?’
‘আমি আমার দেশ ভালো করে জানি। আমি আমার দেশের অলিগলি ঘুরে বেড়িয়েছি। কথায় আছে না, এমন নদী কই, যে নদীতে আমি সাঁতার কাটিনি। আমার অভিজ্ঞতাই আমার সম্বল। আমার শব্দরাজি তুমি দেখো, বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার হয়নি এমন প্রচুর শব্দ আমি ব্যবহার করেছি। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক ডিকশনারি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আমার ব্যবহৃত অনেক শব্দ আছে।’

‘কবি কি অভিধানের ওপর নির্ভরশীল?’
‘প্রত্যেক কবিরই একটা প্রস্তুতি থাকে। থাকে আয়োজন। থাকে ইমাজিনেশন। আর এগুলো তখন তার মস্তিষ্কে খেলা করতে থাকে। কোনটার সাথে কোনটার মিল হবে, অন্ত্যমিল কীভাবে দেওয়া হবে। উপমা, উৎপ্রেক্ষা কাকে বলে? এগুলো জানতে হয়। কারণ, কবি যখন কবিতা ভাবনায় বসে, তখন ইমাজিনেশন, শব্দ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সব একসঙ্গে কাজ করতে থাকে। কবিতা কি এতই সহজ ব্যাপার! যে-কেউ ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখতে পারে না। লিখলেও হয় না। কারণ, প্রকৃত কবি ভিতরের জিনিসটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। জালালউদ্দিন রুমির কথাই বলি, কত বড় আধ্যাত্মিক মানুষ। কত বড় কবি। জালালউদ্দিন রুমির একটা দল ছিল- মৌলানা দল। তারা নাচত। ড্যান্সিং মৌলানা দল। যে অবস্থায় পড়লে অনেকেই বলে দিত ‘আমিই খোদা’। তখন তার কাছে মনে হয় আমিই সব। তার ধ্যান এতটা উচ্চ পর্যায়ের, চিন্তা করা যাবে না। তখন তার সবগুলো শরীরের অংশ কাজ করে। কবিতা লিখতে গেলেও একজন কবির কবিতাবিষয়ক সব মেকানিজম কাজ করে। এ জন্য বলা- কবিতা সবাই লিখতে পারে না।’


‘কবিতা কলা না বিজ্ঞান?’
‘কবিতা মানুষের হৃদয়ের রসায়ন। যেখান থেকে রসবৃত্তি ভেসে ওঠে তাকে ভাষায় রূপ দেয় কবিতা। কবিতার সংজ্ঞা তো একেকজন একেকভাবে দিয়েছেন। আর সর্বশেষ কবিতা প্রমাণ করার কিছুই নেই। কবিতা হলে নিজে থেকে বোঝা যায়। কবিতা লেখার পর তোমার চোখ মুখে এক ধরনের উজ্জ্বলতা ছড়াবে, ঘরময় পায়চারি শুরু হবে। এবং তোমার লিখিত কবিতা বারবার পড়তে থাকবে। তখন বুঝবে কাজ হয়ে গেছে।’


আমি পুনরায় জানতে চাই, ‘তাহলে কবিতা কলা কিংবা বিজ্ঞান নয়?’
তিনি বলেন, ‘না, কবিতা কলাও না, কবিতা বিজ্ঞানও না। আবার কখনো কখনো কবিতা কলা এবং বিজ্ঞান। আবার কখনো কখনো এদের ঊর্ধ্বে কবিতার অবস্থান। তবে, সর্বশেষ কবিতা কবিতাই। কবিতাকে কবিতার কাছেই রাখা ভালো।’

‘মাহমুদ ভাই, কবিতায় আধুনিকতা সম্পর্কে জানতে চাইব। সাহিত্যসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন,  আধুনিকতা অতিক্রম করে আমরা উত্তরাধুনিকতায় আমাদের অবস্থান?’
‘আধুনিক, উত্তরাধুনিক এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। যারা এসব বলে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- আধুনিকতার বয়স কত? আধুনিকতার বয়স বড়জোড় ১০০ বছর। আধুনিকতার সীমা তো নির্ধারণ করা আছে। তার পরে উত্তরাধুনিকের কথা বলা কী দরকার! আর কবিতার বেলায় যেহেতু আধুনিক-উত্তরাধুনিক প্রসঙ্গ বারবার আসে, তাহলে কবিতার আরেক নাম ‘উত্তরাধুনিক’ হওয়া উচিত। তাহলেই তো মনে হয় সকল সমস্যার সমাধান।’

‘কবিতা লিখতে হলে তথ্য ও জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। কবিতার বেলায় তথ্য এবং জ্ঞান এক করে দেখা যাবে?’
‘না। কখনো না। সেটা কীভাবে এক করবে? দুটোই আলাদা। এগুলো যে কবিতায় থাকবে তার কোনো গ্যারান্টি নাই। আমি যখন লিখি তখন আমার লেখাটা লিখি। যা আমি ভাবি। আমি চিত্রকল্প তৈরি করি, আমি স্বপ্ন তৈরি করি। আমি লিখি। আমি একটা জিনিস তৈরি করি। এই যে তৈরি করাটাকে বলে সৃজন বা ক্রিয়েশন। এই ক্রিয়েশন শুধু একজনই করতে পারে, তিনি কবি। তিনি সৃষ্টি করেন। সৃষ্টির একটা কম্পন আছে। এই কম্পনে শরীর থেকে ঘাম ছেড়ে দেয়। এবং তিনি তখন বুঝতে পারেন তিনি কোথাও-না-কোথাও পৌঁছে যাচ্ছেন।’

‘বায়ান্নতে ভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তাদের আমরা ‘ভাষাসংগ্রামী’ বলি, আবার একাত্তরে যারা লড়াই করেছেন তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলি। কিন্তু একজন কবি বা কথাসাহিত্যিককে ‘ভাষাসংগ্রামী’ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত ‘
প্রশ্নটা শুনে কবি কিছুক্ষণ ভাবেন । তারপর বলেন, ‘আসল কথা কি, ‘কবি’ শব্দটার মধ্যেই ভাষা শব্দটা লুকিয়ে আছে। তাকে আলাদা করে ভাষাসংগ্রামী বলার কী আছে? কমিট শব্দ থেকে কবি শব্দটা এসেছে। কবি কিছু বলেন আর অন্যরা সেসব শোনেন। কবি শব্দটা খুব নরমাল নয়। এটার অনেক ওজন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারের বড় বড় আমলা-কামলাও কবি হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে। আবার কেউ যদি কবি হয়ও তারা তাদের অন্য পরিচয় লুকিয়ে নামের আগে কবি শব্দটাই ব্যবহার করে। রবীন্দ্রনাথ তো জমিদার ছিলেন। তার নামের আগে পরে কেউ জমিদার শব্দ ব্যবহার করে? করে না। শিল্পসাহিত্যের সবচেয়ে এলিট ক্লাস হয় কবি। কবি সবাই হতে পারে না।’

আমি বলি, ‘ঠিক বলেছেন। কিন্তু কবি ও কবিতা একে অপরের পরিপূরক। কবি যখন কোনো দলের, জাতির বা সম্প্রদায়ের হয়ে যায় তখন?’
‘বুঝেছি। এটারও জবাব আছে। জবাব থাকবে না কেন? কোনো কবিই কোনো দলের হয়ে যায় না। সব অবস্থায়ই সে কবি থাকে। আর এই কবিতা সব অসুবিধা বা বিষণ্ণতা থেকে রক্ষা করে থাকে। সাময়িক দৃষ্টিতে কবি কোনো দলের ছত্রে আশ্রয় নেন। কিন্তু কবি কি আসলে কোনো দলের হয়? কবি যখন তার লেখা লেখে, সেখানে দল আসে না। লেখাটা হয়ে ওঠে সর্বজনীন।’


‘তা ঠিক, তবে আপনি কোন দলের লোক আপনার নিজের মুখেই শুনতে চাই।’
‘শোনো বলি, আল মাহমুদ কোনো দলের লোক না। আল মাহমুদ একজন কবি। আবার, একজন কবির কাছে সবাই আসবে। সেটা গ্রহণ করা-না-করার দায়িত্ব কবির। আমি তো কোনো দলের সাপোর্ট করে কবিতা লিখি না। যারা লিখে তাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য।’

‘‘প্রশ্নটা হলো আপনার বেলায়ও প্রযোজ্য কি না, আমি বলি। কারণ শিল্পসাহিত্যের অনেকেই আপনাকে ‘মৌলবাদী’ কবি বলে!’’
তিনি কথাটায় বিস্মিত হন না। একটু থেমে বলেন, ‘যারা আমাকে এসব কথা বলে আমি কি তার প্রতিবাদ করতে যাই?’
‘তা তো জানি না।’
‘নাহ্, যাই না। যখনই সময় আসে তখনই দেখা যায়, তাদের অনেকেই আমার আশপাশে ঘুরঘুর করে। আমি বিশ্বাসী মানুষ। আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে কাজ করি এবং প্রার্থনা করি। এটা তো আমার বৈশিষ্ট্য। যারা আমার নিন্দা করে, আমি তাদের প্রতিবাদ করি না। হয়তো তারা একদিন বুঝবে। পৃথিবীতে অনেক বড় কবি জন্মেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাদের মধ্যে একজন। তিনি কিন্তু বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তার বেলায় তো এত কথা ওঠে না। আমি এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বাড়াতে চাই না।’

আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই। বলি, ‘‘একবার কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আপনার নাম চলে এসেছিল। তিনি আপনাকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস পোষণ করে বলেছিলেন, ‘যদি সুযোগ পাই মাহমুদ ভাইকে কদমবুসি করে আসব।’’
এ কথা শুনে আল মাহমুদ হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘সমরেশ ভালো লিখে। শোনো, একবার আমি বসে আছি, হঠাৎ একজন লোক আমার কাছে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। কোনো কথা নেই বার্তা নেই! আমি অবাক হতেই সে বলল, মাহমুদ ভাই আমি জয় গোস্বামী। তারপর কথাবার্তা হলো। আসল কথা হলো, কবিতার ব্যাপারে তাদের মধ্যে ইন্টালেকচুয়্যালিটি, সরলতা আছে। এ জন্যই এরা কবি। কবিকে কবিতা দিয়ে বিচার করতে হয়। আবার বিচার ছাড়াও হয় না। আরেকটা কথা, কাদের সমালোচনা করে? যাদের প্রোডাক্ট আছে তাদের সমালোচনা হয়। আর যাদের নাই তারাই সমালোচনা করে। তাই, এ ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের সময়ের থেকেই এই সমালোচনা শুরু হয়েছে, এখনো আছে, আগামী দিনেও থাকবে।’

‘আপনাদের সময়ের কথা উঠলেই তো পঞ্চাশের পঞ্চপাণ্ডবের কথা মনে পড়ে। প্রত্যেকের সঙ্গে আপনার কেমন বন্ধুত্ব বা আন্তরিকতা ছিল?’
‘পঞ্চাশের শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, ফজল এরা আমার বন্ধু। শামসুর রাহমান ও আমার সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। তারা মনে করে, আমার সঙ্গে তার খারাপ সম্পর্ক ছিল। অথচ শামসুর রাহমান কি কোথাও এসব বলে গেছেন? তার সঙ্গে আমার খুবই প্রীতির সম্পর্ক ছিল। মাঝে মাঝে আমার বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকতেন। জানতে চাইতাম কী ব্যাপার? বলতেন আমার ভালো লাগে না তাই চলে এসেছি। এই কথাগুলো কি মানুষ জানে? এগুলো তো জানে না। জানলেও বলবে না কেন? শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। যা বলতে গেলে দিনকে দিন সময় অতিক্রান্ত হবে। আর ফজলের চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। তার স্বাস্থ্য খারাপ ছিল না। দিব্যি হেঁটে বেড়াত। খুব খারাপ লাগে। শহীদ কাদরী আমার প্রাণের মানুষ, প্রায় প্রতি সপ্তাহে ফোন করে। আমি তাকে বলি- শালা কী খবর? হা হা হা। তার সাথে আমার সম্পর্ক শালা ভাই।’

‘মাহমুদ ভাই, আপনার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই। আপনি ফেরারি আসামি হয়েছেন, কখনো জাহাজে পানি তোলার কাজ করেছেন। কখনো কখনো খাবারের জন্য পুরান ঢাকার বুড়ির হোটেলে গিয়েছেন, এই কষ্টের জীবনে কখনো কি মনে হয়েছে কবিতা লিখবেন না?’
‘‘কবিতা লেখা ছেড়ে দেব- এ কথা কখনোই ভাবিনি। কষ্ট ছাড়া কারো জীবনে তো পরিপূর্ণতা আসে না। আর কবিতা লেখা ছাড়ব কীভাবে? লোকে তো আমাকে ‘কবি’ বলে। (হাসি) কোথাও গেলে মানুষ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত- ঐ তো কবি। ব্যস। সেই আমি কবিতা ছেড়ে দিলে হয়? হয় না।’

‘আজ দশ বছর আপনি অন্যের সহায়তায় লেখালেখি করছেন...।’
‘হ্যাঁ। আমি বলি, অন্য কেউ লিখে নেয়। অনেকেই এ কাজে সহযোগিতা করে। এ ভাবেই চলছে আমার প্রতিদিনের জীবন। বিশেষ করে, আমার নাতিরা আছে। এরা খুবই উচ্চশিক্ষিত। বেশিরভাগ সময় ওরা এই কাজে সহযোগিতা করে। তারা ভালো লেখাপড়া জানে। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। এরাই মূলত আমাকে সহযোগিতা করে।’

‘এই বয়সে ক্লান্তিহীন লিখছেন- কার উৎসাহে?’
‘কারো নাম বলতে পারব না। অনেকের উৎসাহ আছে। আর আমাকে উৎসাহ দেওয়ার কী আছে? আমাকে দেখে অনেকেই উৎসাহী হয়- এটাই আমার উৎসাহ। তবে যে আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করায় (শিল্পসাহিত্য) সে জাকির আবু জাফর। আমি তার জন্য দোয়া করি।’

অনেকটা সময় কেটে গেছে। ফিরতে হবে। আমি টুকটাক আরো কিছু বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। বলি, ‘এখন কী পড়ছেন বা ভাবছেন?’
তিনি না ভেবেই বলেন, ‘এখন পড়ছি (অন্যের সহযোগিতায়) আর্কিওলজি। এ সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ আমার। লেখারও আগ্রহ আছে। একটা উপন্যাস লিখতে চাই। যেমন হরপ্পা, যেগুলো লস্টসিটি। যেগুলো ওয়ান্স আপন এ টাইম ছিল, কিন্তু এখন নাই। সেগুলো নিয়েই একটা উপন্যাস লিখব।’


‘এগুলো জানার জন্য একজন লেখককে কতই না ঘুরতে হয়! তাই না?’
‘তোমরা তো জানো না, একটা সময় পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ শহরগুলোতে আমি ঘুরেছি, দেখেছি, হেঁটেছি। আমরা বলি ‘প্যারিস’ ওরা বলে ‘পারি’। সেই শহরের ফুটপাত ধরে হেঁটেছি। লন্ডনে খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। আমার মনে হয়েছে, এই তো সেই বিলেত। যাকে আগে আমরা বিলেত বলে জানতাম।’

প্রসঙ্গটা চলে এলো, বিদায় নিয়ে চলে আসার আগে আমি শেষ প্রশ্ন করলাম, ‘আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে সুযোগসুবিধামতো বিদেশে পাড়ি দিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছেন...’
আমার প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, ‘আমি সেসব করিনি কেন তাই তো জানতে চাও? সুযোগ আমিও পেয়েছি। কিন্তু সবার আগ্রহ সবকিছুতে থাকে না। আমার প্রয়োজন হয় না। আমি কিছুটা গ্রাম্য লোক ছিলাম। গ্রাম্যপ্রীতি আমার ভেতরে এখনো রয়েছে। সেই বন্ধন ছিন্ন করতে পারি না। আর আমি পরের দেশে পরের জমিতে থাকব কেন?’



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়