ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফিল্ম রিভিউ

সবকিছুই আসলে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’

মোহাম্মদ নূরউল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ৩০ জানুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সবকিছুই আসলে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে সাহানা গোস্বামী

মোহাম্মদ নূরউল্লাহ : ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ রুবাইয়াত হোসেনের দ্বিতীয় সিনেমা। তার প্রথম সিনেমা এ দেশের বিজ্ঞ শ্রেণীর দর্শক গ্রহণ করেনি। রিলিজের তিনদিনের মধ্যে প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নির্মাণের দিক থেকে উতরে গেলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল এর বিষয়বস্তু; আপত্তি ছিল রাজনৈতিক। দ্বিতীয় সিনেমার দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যেই বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে; এবার আপত্তি নৈতিক।

 

যে কোনো সিনেমা, শুধু সিনেমা কেন, যে কোনো শিল্পের দুটি প্রধান দিক থাকে। বিষয় বস্তু ও উপস্থাপনা। শিল্পের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু উপস্থাপনার জন্য অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠিত উপায় রয়েছে। যে কোনো উপায়েই বিষয়বস্তু বা বক্তব্য উপস্থাপন করা যায়। এমনকি নিজে নতুন ধরনের উপায়ও বানিয়ে নেয়া যায়। নতুন ধরনের উপস্থাপনার উপায় সবসময়ই প্রশংসনীয়। ইতিহাসে অনেক উদাহারণ আছে যে, নতুন ধরনের উপায় নিয়ে যিনি হাজির হয়েছেন, শিল্পমানের ক্ষেত্রে তিনি হয়তো ব্যর্থ, কিন্তু তার অনুসারীরা উপায়টিকে শিল্পমান দিয়েছে। যে কোনো পুরনো ঢংয়ে শিল্পী তার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে পারেন। তাতে শিল্প অবমূল্যায়িত হয় না। আর বিষয়বস্তুর ব্যাপারে মূল কথা যে বিষয়বস্তু নীতি-নৈতিকতা বা মানবিকতা বিরোধী হবে না। এই হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে শিল্পকর্ম মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি যা সর্বত্র বিবেচিত।

 

স্থানীয়ভাবে কোনো শিল্পকর্ম বিচারের সময় বিষয়বস্তু মূল্যায়নে রাজনীতি সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। রাজনৈতিকভাবে একটা শিল্প সঠিক হওয়া জরুরি। একটি ভূখণ্ডে একাধিক রাজনীতি থাকে। সেই বিচারে একেক গোষ্ঠী একেক রকম মূল্যায়ন করে একই শিল্পকর্মের। অন্যান্য শিল্পকর্মের চেয়ে সিনেমার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। কারণ সাধারণ জনগণের উপর এর প্রভাব ব্যপক। যে দেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে, তারা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই পৃথিবীর অন্যান্য সিনেমা বিচার করেন। ইঙ্গ-মার্কিন স্বার্থবিরোধী কোনো সিনেমাকে কখনো অস্কার পেতে দেখা যায় নি। ফ্রান্সবিরোধী কোনো সিনেমা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখায় না। তাই একেক প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্য সিনেমা একেক রকম। 

 

রুবাইয়াতের প্রথম সিনেমা ‘মেহেরজান’ রাজনৈতিকভাবে সঠিক না হওয়ায় অভিযোগে বর্জন করা হয়েছে; যদিও তার নির্মাণ সমসাময়ীক অনেক সিনেমার থেকে ভালো ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের, অহংকারের। মুক্তিযুদ্ধের গল্প যখন আমরা বলবো, আমরা আমাদের বীরত্বের, অহংকারের গল্পই বলবো। যেমন ভারত প্রচার করে যে মুক্তিযুদ্ধ ওরাই করে দিয়েছে, এমনকি ইসরায়েলও মনে করে তাদের ইহুদি জেনারেল জ্যাকবের নেতৃতের কারণেই ভারতীয় সেনাবাহিনী জয়লাভ করেছে। আমাদের গল্পে ভারত আমাদের সহযোগী, পাকিস্তানীরা আমাদের শত্রু। এটাই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজনীতি ছিলো। যুদ্ধে তো পাকিস্তানী সৈন্যদেরও বীরত্ব ছিলো কিন্তু তা আমাদের বলবার গল্প নয়। এটাই জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। এই রাজনীতির বাইরে সকল শিল্পই পরিত্যাজ্য। এসব নিয়ে প্রচুর আলোচনা সমালোচনা হয়েছে।

 

‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ক্যারিয়ারিস্টিক নারীর সাফল্য লাভের জন্য সংগ্রামের গল্প। মূল চরিত্র রয়াকে তার সাফল্য লাভের জন্য অনৈতিক এবং স্বার্থপর মনে হয়। রুবাইয়াত বলেছেন ‘এটি একটি নারীবাদী সিনেমা’। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রুবাইয়াত পুরুষবাদীদের নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নারীদের সংগ্রামকেই সিনেমায় ফোকাস করার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীকর্মী প্রধান শিল্প গার্মেন্টসের ব্যবহারও প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা আছে। এমনকি কাল্পনিক চরিত্র নন্দিনীকেও রুবাইয়াত নিয়ে এসেছেন বিপ্লবী চরিত্র প্রমাণের জন্য। রুবাইয়াত চান নারীরা বিপ্লবী হয়ে উঠুক যার যার জায়গা থেকে। এ সবই খুব ভালো উদ্দেশ্য। কিন্তু সবাই যদি রয়ার অনুসারী হয়ে ওঠে তাহলে নারীবাদী-পুরুষবাদী সকলেরই বিপদ আছে।

 

আন্ডার কনস্ট্রাকশনের গল্পটা এ রকম যে,  সিনেমাটা মূলত শুরু হয় মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটা দৃশ্য থেকে। পরের দৃশ্যেই জানা যায় সাহানা গোস্বামী অভিনীত রয়ার এটি শেষ নাটক। কারণ তার বয়স হয়ে যাচ্ছে। অথচ রয়া রক্তকরবীর নন্দিনী চরিত্রটি করছে বারো বছর ধরে। একটা বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে তার রিপ্লেস হচ্ছে। তাহলে কী করবে এবার রয়া? আর্কিটেক্ট ব্যবসায়ী স্বামী সামিরের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না সে। থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে সন্তান নেবে কি না সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে? তার বাসায় কাজ করে ময়না। তাদের এপার্টমেন্টের লিফটম্যান সবুজের সাথে তার প্রেম। যে এক সময় রয়াকে ছেড়ে সবুজের সাথে পালিয়ে যায় তার চোখের সামনে দিয়ে কিন্তু রয়া তাকে আটকাতে পারে না। রয়ার মা আলাদা বাসায় একা থাকেন। তার স্বামী কোনো এক অভিনেত্রীর জন্য তাকে পরিত্যাগ করেছেন। মায়ের সাথে রয়ার পার্থক্য   মৌলিক চিন্তা ধারায়। এমন সময় সিনেমায় রাহুল বোস আসেন ইমতিয়াজ নাম নিয়ে। আর্ট কিউরেটর তিনি। ‘রক্তকরবী’ নাটকটি ইউরোপের মার্কেটে নিয়ে যেতে চান তিনি। রয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং সর্বশেষ সুযোগ। ‘রক্তকরবী’ নির্দেশক রাসেল ভাই, যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন ইমন, এবং ইমতিয়াজকে রক্তকরবীর নতুন প্রেক্ষাপটে বিনির্মাণ করার প্রস্তাব দেয় রয়া। রাসেল ভাই রাজী না থাকলেও ইমতিয়াজের ভালো লাগে। রয়া নাটকটির নির্দেশনা দেয়ার জন্য চারপাশের ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। রানা প্লাজা ভেঙ্গে গার্মেন্টস কর্মীদের অসহায়ত্ব খুঁজে পায় রক্তকরবীর খনি শ্রমিকদের অসহায়ত্বে। ময়নার সন্তানকে জন্ম দেয়ার সংগ্রামের সাথে মিল খুঁজে পায় নন্দিনীর বিপ্লবের। নিজের সাফল্যের জন্য রয়া ইমতিয়াজের সাথে এক ধরনের সম্পর্কে জড়ায়, স্বামীকে উপেক্ষা করে। এমনকি সে নিজের মায়ের চিকিৎসার জন্যে সময়ও দেয় না।

 

নারীদের এই সংগ্রামী চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশেরই লোকজন। সব চরিত্রই আমাদের চেনা, নানান দোষগুণে মিশ্রিত ওরা। এটা সত্য যে রয়ার মতো সুবিধাবাদি চরিত্রও আমাদের নারীবাদীদের কয়েকজনের মধ্যে রয়েছে। একজন নারী নির্মাতা হিসাবে রুবাইয়াত রয়ার চরিত্র নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে শেষ করেছেন। নৈতিকভাবে রয়া সমর্থন করা যায় না। টেকনিক্যালি মূল চরিত্রের মাধ্যমেই পরিচালক তার তর্কটা চালিয়ে যান এবং মূল চরিত্রের তর্কই পরিচালকের তর্ক হিসাবে গ্রহণ করা হয়। সেদিক থেকে আন্ডার কনস্ট্রাকশন নেতিবাচক সিনেমা।

 

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে সাহানা গোস্বামী

 

রয়া ছাড়া অন্য দুই নারী চরিত্র ময়না ও রয়ার মা, তারা কিন্তু সমাজের নারীবাদী সার্কেলের লোক নন, এবং তাদের মাঝে অসততা কিংবা বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার লক্ষণ দেখা যায় না। রয়ার মা এখনো বিশ্বাস করেন যে তার স্বামী একদিন ভুল বুঝবেন এবং সেই অভিনেত্রীকে ছেড়ে তার কাছে ফিরে আসবেন। আর ময়না তো সাধারণ বাঙালি নারীর মতো সংসার করা সন্তান উৎপাদন করা এবং সন্তানকে মানুষ করার সংগ্রাম করাই জীবনের সার্থকতা মনে করে। এখানেই এই পূর্ব প্রজন্ম এবং কাছাকাছি পরের প্রজন্মের সাথে রয়ার মতপার্থক্য। ব্যাতিক্রম চিন্তা করতে চায় সে। বিপ্লব করতে চায়, নিজের সাফল্য চায়।

 

আন্ডার কনস্ট্রাকশন উপস্থাপনার ধরনে যদিও বিশেষ নতুনত্ব কিছু নেই। সাম্প্রতিক কলকাতার সিনেমার ধরনটাই অনুসরণ করেছেন। তবুও বাংলাদেশী সমসাময়ীক অন্যান্য অনেক সিনেমার থেকে ভালো। নির্মাতা হিসেবে তার অনভিজ্ঞতা, চিত্রনাট্যে দূর্বলতা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে। কোথাও ঠিক পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স চোখে পড়ে না। অসমাপ্ত অনেকগুলো সিকোয়েন্স দিয়ে গল্পটা বলার চেষ্টা করেছেন। যদিও রুবাইয়াত দাবি করেছেন যে, শেষটা তিনি অসমাপ্তই রাখতে চেয়েছেন। তবে অসমাপ্ত গল্পেরও একটা শেষ থাকে।

 

সংলাপের সহযোগী কিছু জায়গায় সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা আছে তার। যেমন সামির যখন কুয়ালালামপুর যায়, তখন নাটকটার ইউরোপিয়ান মার্কেটে যাবার সুযোগ পাওয়ার কথা জানায় রয়া। কিন্তু সামির ফোনে ব্যাস্ত।  এ ধরনের সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট বেশ ভালো। বিশেষ করে সামীর চলে যাওয়ার পর রিহার্সেলের জন্য পরা শাড়ি যেভাবে খুলে ফেলে দেয়, তাতে বোঝা যায় যে সংসার তার কাছে বাহুল্য। সুন্দর দৃশ্যায়ন।

 

কোথাও বলে দেয়া না থাকলেও সিনেমাজুড়ে মন্তাজ শটের ব্যবহারের মাধ্যমে এবং স্বপ্নদৃশ্যগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় সংসার করাটা রয়ার কাছে কেবল সাফল্য অর্জনের জন্য কম্পোম্রাইজ। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে নারীর সংগ্রামের এই গল্পটা কি সিনেমায় বলার মতো গল্প? স্বার্থপরতা এই সমাজে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে বলেই কি লোকজনকে ঠকিয়ে হলেও নিজের সাফল্য অর্জনের গল্পই বলতে চাই?

 

এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শক ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কয়েক ভাগে ভাগে হয়ে যাবে। সকল সিনেমার দর্শক সকলে নয়। নারীদের একটা বড় অংশ হয়তো সিনেমার কন্টেন্টের বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করবেন। অনেকেই হয়তো সিনেমাটি গ্রহণও করবেন না। সেটা প্রত্যেকের অবস্থান থেকে নিজস্ব বা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত। যারা সিনেমায় বাস্তবতার গল্প দেখতে চান, শুধু তাদের জন্য এই সিনেমা। এতে জনপ্রিয় বিনোদনের অভাব আছে, সাসপেন্স নেই, এমনকি গল্প ক্লাইমেক্সেও পৌঁছায় না। তবে বড় পর্দায় দেখতে ভালো। সুন্দর চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ এমনকি সাহানা গোস্বামীর অভিনয়ও। নামকরণে সবচে বেশি স্বার্থক মনে হয়েছে। সবকিছুই আসলে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’।

 

রুবাইয়াতের সফলতা ব্যর্থতা, অনভিজ্ঞতা, দূর্বলতা থাকার পড়ও বাংলাদেশে সুস্থ ধারার অন্যান্য ছবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সিনেমা প্রশংসারই দাবিদার। আরো সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে অবশ্যই তার দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন এবং বিশেষ করে বিষয়বস্তু নির্বাচনে তার শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ নেবেন। সাফল্য পাওয়ার চেয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম করতে থাকা বেশি জরুরি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জানুয়ারি ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়