ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ডিলানের নোবেল ভাষণ

সুশীল সূত্রধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডিলানের নোবেল ভাষণ

সুশীল সূত্রধর : ১০ ডিসেম্বর এ বছরের নোবেলজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সাহিত্যে নোবেলজয়ী বব ডিলান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিজের ভাষণ লিখিত আকারে পাঠিয়েছেন সুইডিশ একাডেমিতে। ভাষণে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার জন্য ডিলান সুইডিশ একাডেমিকে ধন্যবাদ জানান। এই সম্মানকে তিনি ‘চাঁদে দাঁড়ানোর’ মতো অসাধারণ বলে মনে করেন। ডিলানের লিখিত ভাষণ পড়ে শুনিয়েছেন সুইডেনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত অজিতা রাজি। বব ডিলানের সেই ভাষণ-

 

‘শুভসন্ধ্যা; সুইডিশ একাডেমির সব সদস্য এবং আজকে রাতে উপস্থিত সম্মানিত অতিথিদের প্রতি আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা।

 

আমি সশরীরে আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে না পারার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার আত্মা আপনাদের সঙ্গেই আছে। এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে আমি সম্মানিত। সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার মতো কিছু আমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। এই সম্মান পেয়েছেন এমন অনেকের লেখা আমি অল্প বয়স থেকেই পড়েছি এবং সেসবে মগ্ন হয়েছি, যেমন- কিপলিং, শ, টমাস মান, পার্ল বাক, আলবেয়ার কামু, হেমিংওয়ে। সাহিত্যের এই মহারথীদের বই ক্লাসরুমে পড়ানো হয়, দুনিয়াজুড়ে লাইব্রেরিতে তাদের বই সংরক্ষিত থাকে, ভক্তিসহকারে তাদের নাম উচ্চারিত হয়। তারা আমার ওপর সবসময় গভীর প্রভাব রেখেছেন। আর আজ তাদের নামের তালিকায় যুক্ত হতে পারার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

 

আমি জানি না এই লেখক-লেখিকারা কখনো নোবেল পাওয়ার কথা ভেবেছিলেন কিনা। কিন্তু আমার ধারণা দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে কেউ যখন একটা বই বা কবিতা বা নাটক লেখেন, তখন তার মনের গহিনে নোবেলের আকাঙ্ক্ষা বাসা বাঁধে। এই স্বপ্নটা মনের এতটাই গভীরে থাকে যে, লেখক হয়তো নিজেও জানেন না সেটা তার হূদয়ে আছে।

 

কেউ যদি কখনো আমাকে বলতেন যে আমার নোবেল জয়ের সামান্যতম সুযোগ আছে, তাহলে আমি ভাবতাম সেটা আমার চাঁদে দাঁড়ানোর মতো ব্যাপার হবে। যে বছর আমি জন্মেছিলাম এবং তার পরবর্তী কয়েক বছর সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার মতো উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিক থেকে আমি প্রায় সঙ্গীহীন।

 

এই চমকে দেওয়া খবরটা যখন পাই, তখন আমি রাস্তায়। খবরটা হজম করতে আমার কয়েক মিনিট লেগেছিল। মহান সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয় তিনি নিজেকে নাট্যকার হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি যে সাহিত্য লিখছেন, এটা সম্ভবত তার মাথায় প্রবেশ করেনি। তার শব্দগুলো রচিত হয়েছিল মঞ্চের জন্য। আমি বলতে চাচ্ছি, তিনি তার লেখাগুলো পড়ার জন্য নয় বরং মঞ্চে অভিনয়শিল্পীদের মুখে উচ্চারিত হওয়ার জন্য লিখেছিলেন। তিনি যখন ‘হ্যামলেট’ লিখেছিলেন, আমি নিশ্চিত তখন তার মাথায় বিভিন্ন বিষয় ঘুরছিল- ‘এই সংলাপগুলোর জন্য উপযুক্ত অভিনেতা কে?’ ‘এগুলো কীভাবে মঞ্চস্থ হওয়া উচিত?’ কোনো সন্দেহ নেই সৃষ্টিশীল রূপকল্প এবং লক্ষ্য ছিল সবার আগে, কিন্তু আরো কিছু বৈষয়িক চিন্তাভাবনা তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে। ‘টাকা-পয়সা কী ঠিক জায়গায় খরচ হচ্ছে?’ ‘আমার পৃষ্ঠপোষকদের জন্য কী সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো আসনের ব্যবস্থা থাকবে?’ ‘মানুষের খুলি কোথায় পাব?’ আমি বাজি ধরে বলতে পারি শেক্সপিয়ারের মাথায় সবচেয়ে কম যে প্রশ্নটি এসেছে সেটা হলো, ‘এটা কি সাহিত্য?’

 

কিশোর বয়সে যখন আমি গান লেখা শুরু করেছিলাম, এমনকি যখন কিছুটা নাম হচ্ছিল, তখনো গানগুলো নিয়ে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল সামান্যই। কফি হাউজ বা বারে সেগুলো বাজবে; বড়জোড় কার্নেগী হল, লন্ডন প্যালাডিয়ামের মতো জায়গায় পৌঁছবে। আর আমি যদি বড় কোনো স্বপ্ন দেখে থাকি, তাহলে সেটা একটা রেকর্ড করা আর রেডিওতে আমার গান শুনতে পাওয়া। সত্যিই এটুকুই ছিল আমার মনে কল্পিত সবচেয়ে বড় পুরস্কার। রেকর্ড তৈরি ও রেডিওতে গান প্রচার হওয়া মানে আপনি অনেক শ্রোতার কাছে পৌঁছতে পারছেন।

আমি ডজনখানেক রেকর্ড এবং দুনিয়াজুড়ে হাজারখানেক কনসার্ট করেছি। তবে আমি যা-ই করি না কেন, তার কেন্দ্রে ছিল আমার গান। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মনে আমার গান জায়গা করে নিয়েছে, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

 

তবে একটা কথা বলার আছে। একজন পারফর্মার হিসেবে আমি ৫০ হাজার মানুষের সামনে গেয়েছি আবার ৫০ জনের সামনেও গেয়েছি। আমি বলতে পারি যে ৫০ জনের সামনে গাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন। ৫০ হাজার মানুষ একটা ব্যক্তিত্ব কিন্তু ৫০ জন মানুষ সেটা নয়, এখানে প্রত্যেকেই ভিন্ন পরিচয় নিয়ে বসে থাকে। তারা যেকোনো কিছু অনেক পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পারেন। আপনার সততা এবং সেটা কীভাবে আপনার প্রতিভার সঙ্গে সম্পর্কিত সেটার পরীক্ষা হয়ে যায়। আর নোবেল কমিটি একেবারেই ছোট, তাই আমার বিচার সেখানে খুব ভালোভাবেই করা হয়েছে।

 

কিন্তু শেক্সপিয়ারের মতো আমাকেও বৈষয়িক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয়েছে। ‘অমুক গানের জন্য সেরা মিউজিশিয়ান কে?’ ‘যেখানে রেকর্ড করছি, সেটা কি ঠিকঠাক?’ ৪০০ বছরেও কিছু বিষয় বদলায়নি।

নিজেকে কখনো প্রশ্ন করার সুযোগ হয়নি, ‘আমার গানগুলো কি সাহিত্য?’

তাই সুইডিশ একাডেমিকে ধন্যবাদ দিতে চাই যে তারা এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে এবং শেষমেশ আমাকে এমন অসাধারণ জবাব দিয়েছে।

 

সবাইকে শুভকামনা

বব ডিলান।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়