ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একটি রেশমি রুমাল || দিলওয়ার হাসান

দিলওয়ার হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৬, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি রেশমি রুমাল || দিলওয়ার হাসান

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

স্বাধীনতা যুদ্ধের ছ-সাত বছরের মাথায় আমরা কলেজের ছাত্র। সেই সময় ঢাকা থেকে সিনেমার ইউনিট এসে সেট ফেলত আমাদের স্বর্ণকমলপুর শহরে।

স্বর্ণকমলপুর তখন মহকুমা। ঢাকা থেকে মেরেকেটে আড়াই ঘণ্টার পথ। বিদ্যুতের সুবিধে আছে- গ্রাম ও শহরের লোকেশন একসঙ্গে পাওয়া যায়। এ কারণে তানভির রিজভির মতো পরিচালকও এ শহরে আসেন। আসেন আকমল হোসেন কিংবা খান সানোয়ার রহমান। আমরা কলেজ ফাঁকি দিয়ে শুটিং দেখতে যাই।

দিন-রাত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা শুটিং চলে কয়েক শিফটে। দিনের বেলায় ডেফর ডে আর রাতে ফ্লাড লাইটে নাইট ফর ডে। খান সানোয়ার তো তার একটা ছবির পুরো শুটিং করেন শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরের একটা গ্রামে। টানা তিনমাস ধরে চলে। মনে আছে সার্কাসের দৃশ্য ছিল ছবিটাতে। গোটা একটা সার্কাসের দল ভাড়া করে আনা হয়েছিল। দর্শক হিসেবে আমরাও সিনেমায় পার্ট নেই। ক্লোজ-আপে বেশ কবার আমাকে ও আমার বন্ধু আলাউদ্দিন সুজাতকে দেখিয়েছিল। সার্কাসে জোকারের বাদরামো দেখে হেসে কুটি-কুটি হচ্ছি দুজন। সুজাত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। এ শহরের ছেলে। বাবা নাম করা উকিল। সে সময় লংসট, মিড লংসট, ক্লোজআপ, ট্রলি, টিল্ট আপ, টিল্ট ডাউন, কাট, সাউন্ড, ক্যামেরা, প্যাক আপ এসব শব্দ আমাদের ঠোঁটের আগায়। সিনেমা বাবদে আমি আর সুজাত ইচঁড়ে পাকা ছিলাম খানিকটা। বইটই পড়েও কিছু জ্ঞানগম্যি হয়েছিল। তখন পেনিলোপ হাউসটোনের দ্য কনটেম্পরারি সিনেমা পড়ে ফেলেছি। বিটিভিতেও ভালো ভালো ছবি দেখাত তখন। নির্বাক যুগের ছবি দেখতাম চার্লি চ্যাপলিন শোতে। হলিউডের নামিদামি ছবিও দেখাত।

আমরা ঢাকায় গিয়ে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বিনে পয়সায় দেখেছিলাম আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ আর ‘অক্টোবর’। যদিও তখনো ফেলিনি কিংবা গদারের কোনো ছবি দেখা হয়নি। দেখা হয়নি ক্রুফো কিংবা পোলানস্কি। তবে রেনোয়ার ‘রিভার’ দেখা হয়েছিল। আমাদের শহরে সবেধননীলমণি যে সিনেমা হলটি ছিল তার নাম মাধবী টকিজ। পুরনো সিনেমা হাউস। বেশ বড়। ওখানে হারানো দিনের ছবি চলত- রাই কমল, রাজা এল শহরে, সাহেব বিবি গোলাম এই রকম আরকি। ইংরেজি ছবিও ছিল- ক্লিওপেট্রা, দ্য গানস অব নাভারন, দ্য টাইম মেশিন, দ্য টাওয়ার অব ইনফারনো, দ্য পসিডন অ্যাডভেঞ্চার কিংবা ডার্টি হ্যারি।

শুটিংয়ের কারণে নামকরা নায়ক-নায়িকাদের কাছে থেকে দেখবার সুযোগ হতো আমাদের। তাতে ছিল এক অন্য রকমের থ্রিল। আমাদের শহরে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের যে-ডাক বাংলা আছে ওখানে এসে উঠত চিত্র তারকারা। ওখানেই নায়িকা সুনন্দার সঙ্গে প্রেম হয় বিখ্যাত পরিচালক জাহিদুল রায়হানের। মিতালী দেবীকে ছেড়ে তাকেই বিয়ে করেছিলেন শেষে। এসব খবর আমরা সে সময়কার সিনে পত্রিকাগুলোতে পড়তাম। আমি তখন শহীদ তজু রোডের একটা চিলেকোঠায় ভাড়া থাকি। বাবা-মা, ভাই-বোনেরা থাকত গ্রামে। মাসে-মাসে টাকা পাঠাত। সিনেমা আর সিগারেটের খরচ জোগাতে বিকেলে একটা টিউশনি করতাম রিভার রোডে। তারপরও মাঝে মধ্যেই অর্থ সংকটে পড়তাম। তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। সেদিনও মনটা খারাপ ছিল। নিঃসঙ্গতা এসে চারপাশে থেকে ঘিরে ধরেছিল। তখন জনারণ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

সে-সময় শুটিং চলছিল শহরতলীর একটা মাঠে। শীতের বিকেল। গায়ে একটা গরম কোট চাপালাম। একদা জিপিওর সামনে থেকে কিনেছিলাম। গলায় বেঁধে নিয়েছিলাম মাফলার। স্পোর্টস ক্যাপটা সঙ্গে নিয়েছিলাম কুয়াশা থেকে বাঁচার জন্যে। জুতোজোড়া ছিড়ে গেছে। ডান পায়ের সামনের দিক দিয়ে বাতাস ঢুকে। জল কাদায় পা পড়লে ভিজে ওঠে। টাকার অভাবে নতুন একজোড়া কিনতে পারছি না। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে সন্ধ্যাপ্রদীপ আর আগরবাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। ঝাড়ু দিচ্ছে কেউ কেউ। বাকিতে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনে হাঁটা দিলাম। রিকশা ভাড়া নেই। আলাউদ্দিন সুজাতকে সঙ্গে নেব কি? না থাক, অভিযানটা একলারই হোক। ফেরার পথে ওর বাড়ি থেকে রাতের খাবার সেরে নেওয়া যাবে।

বিশাল মাঠের এক কোণায় মস্তো একটা বটগাছ। তার নিচে সেট পড়েছে। বিরাট একটা সার্কেল। চারদিকে মানুষ। মাঝখানে ক্যামেরা, লাইট আর যন্ত্রপাতি নিয়ে নেপথ্যের কলাকুশলীরা। ক্যামেরার সামনে চিত্রনায়িকা রুচিতা। আগেও দেখেছি-আমার শরীরে অজানা শিহরণ, নাচের বেশে কড়া মেকাপে ছিল সে। একেবারে ঝলমল করছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক পরিচালকের ছবিতে, তাকে গ্রামের গৃহবধূর ভূমিকায় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম একদা। আজ এরকম মুগ্ধতা নেই।

টেপ রেকর্ডারে গান ভেসে এল- ও আমি মন চেয়ে কি করেছি ভুল। রিহার্সাল শটের জন্যে নায়িকা মুদ্রা তোলে। পরিচালক নাচ শুরুর নির্দেশ দেন। রুচিতা নাচতে থাকে। দর্শক হৈ চৈ করে ওঠে। পরিচালক চিৎকার করে ওঠেন- সাইলেন্ট, সাইলেন্ট। নাচ থামে। প্রচণ্ড শীতেও নায়িকা ঘেমে ওঠে। বগলের কাছে ব্লাউজে ঘামের দাগ বসে যায়। মেকাপের লোক এসে মুখের ঘাম মুছে। রুচিতা বিশ্রাম চায়। চা খায় এক কাপ। পরিচালক সিগারেট ধরান। এখানে এন্তার চা-সিগারেট চলে। আমারও নেশা ধরে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দীর্ঘ টান দেই। বেশ জোরে-জোরে বাতাস বইছে।

এক কাপ চা হলে বেশ হতো। আবার গান। এবার শুট  হবে। পরিচালক চিৎকার করে ওঠেন- সাইলেন্ট, সাইলেন্ট, লাইট, ক্যামেরা, রোল অন-ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ, অ্যাকশন। কিরকির করে ক্যামেরার রিল ঘোরে। নাচ জমে ওঠে। গানটা সম্ভবত দ্রুত লয়ের ঝুমুর। শট ওকে হয় না। পরিচালক বিড় বিড় করতে থাকেন- ওহ নট গুড, নট গুড। দ্রুত কাটের নির্দেশ দেন। গান থেমে যায়, থেমে যায় নাচ। রুচিতা ঘেমে ওঠে। শাড়ির তলা থেকে একটা রেশমি রুমাল বের করে মুখ মুছে। কী চমৎকার রুমালটা- বিস্তৃত সাদা জমিনের ওপর ডেইজি ফুলের ডিজাইন। চারপাশে ঝালর দেওয়া। কোন ব্র্যান্ডের রুমাল এটি? রিমেমবারেন্স, মাদমোয়াজেল কিংবা ফ্লাওয়ার দ্য আমুর? শুইতজার কোম্পানির তৈরি হয়ত বা। রুমালট খুব ভালো লেগে যায়। খুব দামি নিশ্চয়ই, পারী কিংবা লন্ডনের কোনো রয়াল স্টোর থেকে কেনা হয়ত। রুমালে ঢালা হয়েছে পৃথিবীর কোন নামকরা সুরভি, শ্যানেল নাম্বার ফাইভ কি, নাকি ভায়োলেটা, ক্রিস্টাল কিংবা লিলি অব দ্য ভ্যালি?

রুচিতাকে দেখার বদলে রুমালটা দেখতে থাকি। এত সুন্দর রুমাল জীবনেও দেখিনি। রুমাল আমার পছন্দের জিনিস নয়, নিজে ব্যবহার করিনে; তবে কাউকে ব্যবহার করতে দেখলে খরাপ লাগে না। একবার আলাউদ্দিন সুজাত একটা রুমাল আমাকে উপহার দিয়েছিল। কলকাতা থেকে তার এক খালাত বোন তাকে এনে দিয়েছিল। সে আমাকে দিয়ে দেয়। রাখতে পারিনি। কদিনের মধ্যেই হারিয়ে ফেলি। ওই রুমালটা বেশ ভাল ছিল- মোলায়েম সুতি কাপড়ের ওপর হালকা প্রিন্ট। আমি তাতে ক’ফোটা ওল্ড স্পাইস ঢেলে ব্যবহার করতাম। সুরভি খুব দামি জিনিস। কেনার সামর্থ আমার ছিল না। তবে একজন জোগানদার ছিল- মৃদুলা, যে-বাসায় টিউশনি করতাম সে-বাসার মেয়ে। পারী থেকে তার পেন-ফ্রেন্ড পাঠাত, সে দিত আমাকে।

আশ্চর্য, সেই কখন থেকে হা করে রুচিতার রুমালটার দিকে তাকিয়ে আছি। পরিচালক বলছিলেন, ‘আজ কি টায়ার্ড রুচিতা, নাচে মন দিতে পারছ না যে?’

‘কই না তো হাসিব ভাই।’

‘তাহলে কনসেনট্রেশন আসছে না কেন?’

‘কোনো কারণ নেই, আবার শুট করুন না। ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ওকে, তার আগে একপ্রস্ত চা হয়ে যাক, প্রোডাকশন?’

চা খেতে-খেতে রুমালটা দলাই মলাই করছিল রুচিতা। কী এক আকর্ষণে আমি তখনও রুমালটার দিকে তাকিয়ে আছি। এরকম একটা তুচ্ছ জিনিস আমাকে প্রবলভাবে টানছে বলে অবাক হলাম। আচ্ছা, একবার যদি হাতে পেতাম রুমালটা তাহলে শুঁকে দেখতাম। না জানি কোন অজানা সুরভির মিষ্টি ঘ্রাণ সেখানে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ও রুমাল আমি পাব কী করে? ব্রা, প্যান্টি কিংবা ব্লাউজের মতো রুমালও মেয়েদের একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস! খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। ভাবলাম চলে যাই। আলাউদ্দিন সুজাতের বাড়ি থেকে ভাত-টাত খেয়ে চিলেকোঠায় ঢুকে পড়ি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ অর্ধেকটা পড়ে ফেলে রেখেছি, আজ শেষ করব। কিন্তু রুমালটার কথা মনে পড়ে গেল বলে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিলাম।

অদূরে চা খাচ্ছিল রুচিতা। মুখে এখন ঘামটাম নেই। কী একটা কথায় খিল খিল করে হাসছিল। পরিচালক শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিলেন। বললেন, ‘এবার যেন টেক ওকে হয়। আর ভালো লাগছে না। এ শটটা হয়ে গেলে প্যাকআপ করব। আবার গানের সঙ্গে নাচ- ও আমি মন দিয়ে কি করেছি ভুল..., ‘ও নো, ও নো, অল এনজি।’ পরিচালকের চোখে মুখে হতাশা। রুচিতা অবাক। রুমালের ভাঁজ খুলে পুরো মুখটা মুছে বলল, ‘এরকম হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না হাসিব ভাই। আজ না হয় প্যাক আপ করুন।’

‘ঠিক আছে।’ হাজার ওয়াটের লাইটগুলো নিভে যায়। শুধু কম আলোর কিছু বাতি জ্বলে জিনিসপত্র গোছানোর জন্যে। অদূরে দাঁড় করানো গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে রুচিতা, তখনও হাতে রেশমি রুমাল। আহা এই চমৎকার রুমালটা আর দেখব না। অবাক হয়ে ভাবি অভিনেত্রীর সামান্য এই রুমাল আমাকে আবিষ্ট করল কী করে? মানুষের মনে কত বিচিত্র অনুভূতিরই না জন্ম হতে পারে!

রাত তখন দশটার ওপরে, রিকশা টিকশা কিছুই পাব না। হেঁটে ফিরতে হবে আমাকে। আকাশে তখন পূর্ণিমার এক ফালি চাঁদ। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে। মেলা ভেঙে যাওয়ার মতো একটুখানি বিষণ্ণতা। হঠাৎ পায়ের নিচে ছোট্ট এক টুকরো কাপড়ের মতো কী যেন একটা চোখে পড়ে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি রুচিতার হাতের সেই রুমাল। বুকটা আমার ধক করে ওঠে। মাঠ তখন প্রায় জনশূন্য। শুধু ইউনিটের কজন লোক তাদের জিনিসপত্র গাড়িতে তুলছে। দুরু-দুরু বুকে রুমালটা হাতে তুলে নেই। ধীরে ধীরে নাকের কাছে নেই। তীব্র উৎকট একটা দুর্গন্ধ আমাকে ব্যাকভলি খাওয়া ফুটবলের মতো দশ হাত দূরে নিয়ে ফেলে যেন। দেশের সবচেয়ে সুন্দরী অভিনেত্রীর রুমালে এমন দুর্গন্ধ! দ্রুত হাত থেকে ফেলে দেই, যেন রুমালটা একটা বিষাক্ত সাপ। পা চালিয়ে হাঁটতে থাকি। চাঁদের আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। কী সুন্দর আজকের চাঁদটা। সেই বিরল সুন্দর চাঁদটাকে মাথায় নিয়ে জনশূন্য হিম  ছড়ান রাতে হরহর করে বমি করে ফেলি। পেটে দানা পানি তেমন একটা ছিল না বলে দারুণ তিতে খানিকটা পানি বেরিয়ে আসে। বমনের যন্ত্রণা নিয়ে জ্যোৎস্নার ভেতর হাঁটতে থাকি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জানুয়ারি ২০১৭/দিলওয়ার হাসান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়