ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কেমন বইমেলা চাই?

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেমন বইমেলা চাই?

|| শিহাব শাহরিয়ার ||

বইমেলা কেন? উত্তর খোঁজার দরকার নেই, আবার দরকার আছেও। কেননা মানুষ যখন জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করল, তখন বইলেখা ও বই পড়া- দুই শুরু হলো। কবে, কখন বইলেখা, বইপড়া, বইবিক্রি আর বইমেলার শুরু হলো, তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বইমেলার শুরু হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর পরই। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা কিছু বই নিয়ে একাডেমির মূল ফটকের কাছে বসেছিলেন। এই সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পল্লীকবি জসীমউদদীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখকরা।

বলা হয়, প্রতীক অর্থে সেটিই বাংলাদেশের বইমেলার শুরু। মহান ভাষা আন্দোলন-স্নাত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি সত্তরের দশক থেকেই বইমেলার আয়োজন করে আসছে। ধীরে ধীরে এটি বৃহত্তর রূপ পেয়ে এখন বাঙালি লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের ‘প্রাণের মেলা’ হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর বাড়ছে প্রকাশকের সংখ্যা, বইয়ের সংখ্যা, পাঠক সংখ্যা; ফলে বেড়ে গেছে বইমেলার পরিসর। গত কয়েক বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে বইমেলার অর্ধেক অংশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাস্তার অপর পাড়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। এতে ভাগ হয়ে গেছে লেখক, প্রকাশক ও পাঠক। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বলছে, তাদের প্রাঙ্গণে আর জায়গা হচ্ছে না, কারণ প্রাঙ্গণে আরো ভবন তৈরি হয়েছে, প্রকাশক বেড়েছে, দর্শক বেড়েছে আর বেড়েছে লেখক। এখন সৃজনশীল সকল প্রকাশককে নেয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দি অংশে আর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও, অনলাইন, মিডিয়া প্রচার, লিটলম্যাগ, মূল অনুষ্ঠান মঞ্চসহ অন্যান্য বিষয়গুলো রাখা হয়েছে একাডেমির ভেতর।

প্রতি বছর মেলা নিয়ে অনেক বিষয়-আশয় ঘটে। মেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমির সঙ্গে সহযোগিতায় থাকে জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা ও মালিক সমিতি। প্রতি বছরই মেলা শুরুর আগে একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের ডাকে, তাদের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়, মেলা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে। এবারও সেভাবেই হয়েছে। তবে এবার একাডেমির সঙ্গে একটি প্রকাশনীর অনাকাঙ্ক্ষিত মতভেদ হলো। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছিল সরব। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের লেখালেখি, এমনকি গালাগালি পর্যন্ত হয়েছে। অবশেষে একাডেমি শর্তসাপেক্ষে সেই সৃজনশীল প্রকাশককে বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এ কারণে দেখা গেল, লেখকদের মধ্যেও তৈরি হলো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কথার চালাচালি, গালি-মন্দ, কাদা ছোড়াছুড়ি, মন কষাকষি, দলাদলি, ঠোকাঠুকি, ব্যক্তি আক্রমণ ইত্যাদি। কেউ দোষ দিলেন তরুণ প্রকাশককে, কেউ দোষ দিলেন একাডেমি প্রধান প্রবীণকে। বিশেষ করে বার বার নিয়োগ পাওয়া বর্ষীয়াণ একাডেমিক প্রধানের সম্মান নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছিল এ কথা বলা যায়। 

এই অনাকাঙ্ক্ষিত তর্ক-বিতর্ক এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা কেন্দ্র করে। এই গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের এখন সর্ব বৃহৎ বইমেলা। এছাড়া রয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত ঢাকা বইমেলাসহ বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা ধরনের বইমেলা। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় বইমেলাতেও বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশক-পাঠকরা অংশ নিয়ে থাকে। যেমন কলকাতা বইমেলা, টোকিও বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, নিউইয়র্ক বইমেলা, লন্ডন বইমেলা। এসব বইমেলা থেকে আমাদের বইমেলার চরিত্র আলাদা। ভাষাস্নাত একুশের বইমেলার আকর্ষণ অন্যরকম। শুধু বই বেচাকেনা এই মেলার চরিত্র নয়, এটি বাঙালির একটি উৎসবও। সারাদেশ তো বটেই, বিদেশ থেকেও অনেক লেখক এ উপলক্ষে দেশে আসেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই নতুন বই বের হয়।

এই মেলার আরো অনেক বড় বড় দিক রয়েছে। যেমন তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ একটি উল্লেখযোগ্য দিক। মেলায় আসে ছোট বড় অসংখ্য দর্শক, ক্রেতা, আর বইপ্রেমী মানুষ। যারা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলো বছরে একবার নিজের জন্য এবং সন্তানদের জন্য বই কিনতে আসেন। লেখকদের জন্য এই মেলা সত্যিকার অর্থেই প্রাণের মেলা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে এই মেলার জন্য প্রতিবছরই অপেক্ষা করি। যদি এই মেলা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা তুলে ধরি তাহলে সেটি হবে এরকম:

আমি একুশের বইমেলায় প্রথম প্রবেশ করি ১৯৮৪ সালে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। পড়ি আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। লিখি কবিতা ও গল্প। ব্যক্তিগত আবেগ মনজুড়ে। লেখক, পাঠক ও প্রকাশক সীমিতভাবে মিলিত হয়েছে। ফাল্গুন মাস। বিকেলের নরম রোদ। সড়ক পেরিয়ে বাংলা একাডেমির গেট। সবাই ঢুকছে নতুন বইয়ের গন্ধ নেশায়। প্রথম প্রবেশকালে আমার মনও বেশ পুলকিত। শীতের হালকা আমেজ গায়ে মেখে ঢুকলাম। বইয়ের স্টলগুলো সারি সারি সাজানো। পুকুর পাড়ের চারিধার, বয়রাতলাসহ পুরো প্রাঙ্গণ লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের নান্দনিক সমাবেশ বেশ আকৃষ্ট করলো আমাকে। দুই একজন লেখক ছাড়া সবই নতুন মুখ, অচেনা মানুষের মুখ। কেউ কেউ ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিয়ে মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখছেন। দেখছি লেখকদের কোথাও কোথাও জটলা ও আড্ডা হচ্ছে। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে আর লোক সমাগম বাড়ছে। আমি তখনো মফস্বলের গন্ধভরা মানুষ- চলাফেরা, কথাবার্তায় চাল-চলনে। কারণ সদ্য রাজধানীর আগন্তুক কিশোর-উত্তীর্ণ যুবক আমি। আমাকে কে চেনে? লিখতেও শুরু করেছি মাত্র। এবছরেই প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘সচিত্র বাংলাদেশ’ পত্রিকায়, যার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন কবি কেজি মুস্তফা। তবে বলে রাখি ইতোমধ্যে কবি ও সম্পাদক ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের জনক আহসান হাবীব, কবি সুফিয়া কামাল ও শামসুর রাহমানসহ অনেক বর্ষীয়াণ লেখক-কবিদের সঙ্গে দেখা। মেলায় এরকম বিশিষ্ট কবি-লেখককে দেখে বেশ রোমাঞ্চিতও হচ্ছি। প্রথম দিন বলে কথা, বই নেড়েচেড়ে দেখার চেয়ে মেলার মানুষদেরকে দেখতেই বেশি কৌতূহলী আমি। বেশ কয়েকবার চক্কর দিলাম বইমেলার পুরো এলাকা। আস্তে আস্তে বিদ্যুৎ বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। তখনও মানুষের পায়ে পায়ে উড়ছে ধূলো। একাডেমি কর্তৃপক্ষের নজরও আছে বেশ। এখানে বলতেই হবে এই সময়কার বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা এবং একইসঙ্গে সাহিত্যেরও বাঘা বাঘা ব্যক্তিদের কথা। শামসুজ্জামান খান, রশীদ হায়দার, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, বশীর আল হেলাল, মমীন চৌধুরী প্রমুখের কথা। এরা বাংলা একাডেমির অলঙ্কার যেন। কথাশিল্পী রশীদ হায়দার কর্মকর্তা হিসেবে তথ্যকেন্দ্রে বসে মাইকে প্রতিদিন প্রকাশিত নতুন বইয়ের খবর জানাচ্ছেন ভরাট কণ্ঠে। দেখলাম সন্ধ্যারাত ঘন হওয়ার সাথে সাথে মেলার দর্শকরাও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আমিও একরাশ আনন্দানুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

এই এলাম, এই আসাই বার বার প্রতিবার আমার আমাকে নিয়ে যায় একুশের বইমেলায়। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এরপর থেকে একবারও মিস করিনি বইমেলা। ফেব্রুয়ারি মানেই বইমেলা, বইমেলা মানেই প্রতিদিন বিকেল আর সন্ধ্যা আমাকে টেনে নতুন বইয়ের কাছে, মেলার মানুষদের কাছে। কি যেন মাতাল করা নেশা। মেলায় না গেলে মন যেন কেমন করে। কেমন করার সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তিগত নতুন মাত্রা। ১৯৯৭ সালে আমার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে। এরপর ২০০৩ সালে প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এরপর প্রায় প্রতি বছরই বের হচ্ছে আমার এক একটি নতুন বই। আমি আসলে এখন নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছি একজন লেখক হিসেবেও। এ যেন এক নতুন আকর্ষণ- মেলায় বই আসছে। বই আসা মানে, মেলায় প্রতিদিন উপস্থিত থাকা। এর সাথে আরো যুক্ত হয়েছে আমার সম্পাদিত লোক নন্দন বিষয়ক পত্রিকা ‘বৈঠা’। ২০০৫ সালে প্রকশিত হয় বৈঠা’র প্রথম জ্যোস্না বিষয়ক সংখ্যা। ছোটকাগজের আলাদা আবেগ ও নেশা। এখন ছোট কাগজ ও নতুন বই নিয়ে মেলায় হাজির হওয়া যেন প্রতি বছরের প্রাণের কাজ।

এই যে ব্যক্তিগত আনন্দের কথা বললাম, তা বোধহয় বাংলাদেশের প্রত্যেকটি লেখকেরই একই রকম আনন্দ, একই রকমন অনুভূতি, একই রকম প্রাণের টান বা নেশা। সুতরাং বাংলা ভাষার প্রত্যেক লেখক, পাঠক, প্রকাশকের জন্যই এই মেলা একটি আনন্দের উৎস। সুতরাং এই বইমেলা নিয়ে কোনো বৈরি পরিবেশ তৈরি করা যাবে না, কোনো ষড়যন্ত্র করা যাবে না। কারণ সকলের মনে রাখতে হবে, প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতাবিরোধী, ভাষা আন্দোলনবিরোধী চক্র এই বইমেলা নিয়ে বহুবার ষড়যন্ত্র করেছে, বন্ধের পায়তারা করেছে এবং করছেও। সুতরাং জ্ঞানের যে প্লাটফর্ম বই, যে বই মানুষকে আলোকিত করে, যে বই মানুষের নিত্য দিনের প্রিয় বন্ধু, সেই বইয়ের প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

বাঙালির এই প্রাণের বইমেলা হবে, আনন্দের, উৎসবের ও জ্ঞানের। শুরুতেই যেমনটা বললাম, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার অবতারণা করা যাবে না, মনে রাখতে হবে এইট কোনো ব্যক্তিগত বিষয় চরিতার্থ বা বাস্তবায়ন নয়। এখানে সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দেয়া যাবে না। এটি সমস্ত বাঙালির মনন ও চেতনার ফসল। বইমেলা নিয়ে নানান প্রশ্নও আছে। যেমন জায়গার সংকুলান হচ্ছে না বলে, একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নেয়া হয়েছে, এতে পরিসর বাড়লেও অসুবিধা হয়েছে লেখক-পাঠক ও ক্রেতাদের। কারণ রাস্তার এপার ওপার করা কষ্টকর। তবু মানুষ ছুটে যায় বইমেলায়, তবু মানুষ মিলিত হয় প্রাণের টানে। আমি চাই অমর একুশের বইমেলা হোক সুন্দর,  বইমেলা হোক লেখকের, পাঠকের, প্রকাশকের ও সকল বাঙালির।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়