ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রক্তাক্ত বাংলাকে বাঁচাতে লড়াই চলছে, চলবে || মোস্তাফা জব্বার

মোস্তাফা জব্বার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রক্তাক্ত বাংলাকে বাঁচাতে লড়াই চলছে, চলবে || মোস্তাফা জব্বার

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। মাত্র ২৮/২৯  দিনে পারও হয়ে যায়। আমরা এখন ফেব্রুয়ারি পার হবার দিন গুনছি। এরই মাঝে পত্র-পত্রিকা-টিভি ও অন্যান্য মিডিয়াতে ভাষা শহীদদের নিয়ে মাতম শুরু হয়েছে। প্রায় সবাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় ব্যস্ত। অথচ ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষা ও হরফ যে বিপন্ন সেটি কাউকে বলতে শোনা যায় না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তেমন কোন আলোচনাও হচ্ছে না।

প্রতিবরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার শহীদ মিনারে রাজনীতিবিদদের ঢল নেমেছে। দেশের অন্য শহীদ মিনারে প্রধানত ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রভাত ফেরি করে বেদীতে ফুল দিয়েছে। ঢাকায় বইমেলা শেষ হবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন এবং তার পরের দিন ১ মার্চ থেকে ফাঁকা হয়ে যাবে। বাংলা ভাষা নিয়ে মাতমের ছিটেফোঁটাও আমরা কোথাও পাব না। কাগজের পাতা বা টিভির পর্দা অন্য কিছুতে ভরে যাবে।

খোলামেলাভাবে বলতে গেলে বাঙালিদের একাংশ তাদের বাংলা ভাষা বর্জনের স্থানটিকে খুব স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত করে ফেলেছে। এক কথায় যদি বলা হয় তবে এখন শহুরে বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরোয়া মুখের ভাষা বাংলা হলেও ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কল কারখানা বা দৈনন্দিন জীবনের আনুষ্ঠানিকতা এমনকি লেখাপড়ার ভাষাও বাংলা নয়। ভাষার জন্য রক্ত দানকারী জাতির এমন ভিমরতি কেন হয়েছে তা গবেষকরা খুঁজে দেখবেন। তবে আমি খুব সহজেই অনুভব করতে পারি যে, পুঁজির বিকাশের ফলে একশ্রেণির বাঙালির কাক হয়ে ময়ুরের পুচ্ছ ধারন করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তারা ইংরেজ হতে চাচ্ছে এবং তাতেই তাদের জীবনের মুক্তি বলে মনে করছে। অন্যদিকে অক্ষম বা ক্ষমতাহীন বাঙালির ভাষার নাম বাংলা। এই জনগোষ্ঠী বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানেনা। ভুল ইংরেজিও বলতে বা লিখতে পরেনা। বাংলা ছাড়া তার কোন গতি নেই। সাংবিধানিকভাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হলেও এই রাষ্ট্রযন্ত্র, বিশেষত আমলাতন্ত্র নানা কৌশলে বাংলা বর্জনের চরম পথে পা বাড়িয়েছে। এর মাঝে ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বাংলা ভাষার অস্তিত্ত্ব বিপন্ন করাটাই আমার নিজের কাছে চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আমার বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার চ্যালেঞ্জের জন্য কি এই ভাষাটির ব্যবহার হ্রাস পাবার কোন যৌক্তিক কারণ আছে!

এখন আমার মনে হচ্ছে যে, একটি সময় আসবে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তির নামে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ৩৫ কোটি লোকের ভাষা বা তার চাইতেও বেশি মানুষের হরফ হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ তবুও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে কমছে। বিশেষ করে ডিজিটাল যুগের আগে আমরা বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতোটা সচেতন ছিলাম এখন সেটি নেই।

আমি তাই মনে করি বাঙালি জাতির মাতৃভাষার সহ¯্রাধিক বছরের ইতিহাসে এর উৎপত্তি, বিকাশ, রূপান্তর ও সমৃদ্ধির পথচলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এর ডিজিটাল যাত্রা। সেই ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফের মুদ্রণ বা ৭২ সালে বাংলাদেশের বাংলা টাইপ রাইটারে এর যাত্রা, আশির দশকে ফটোসেটারের উদ্ভব, ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ থেকে এই সময়ে ডিজিটাল উপায়ে বাংলার ব্যবহারের মাঝে রয়েছে প্রযুক্তিগত বিবর্তনের-উদ্ভাবনের অসম সাহসী ইতিহাস। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলা ভাষা ও তার লিপি ডিজিটাল যাত্রার এক অসাধারণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথমবার বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার পথে সবচেয়ে বড় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার লগ্ন উপস্থিত হয়েছে। সরকার ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে তার সহায়তায় বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার সহায়ক ১৬টি টুল উন্নয়নের কাজ করার পরিকল্পনা করছে। কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের তিরিশ বছর পূর্তির সময়ে আমরা বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার ডিজিটাল যাত্রাকে একটু ভালো করে ব্যাখ্যা করে দেখতে চাই। আমার তিরিশ বছরের লড়াই-এ এমন একটি সময় এর আগে আর কখনও আসেনি বলেই আমি মনে করছি। এখনই সময় পুরো প্রেক্ষিতটি পর্যালোচনা করার।

গত শতাব্দীতে বাংলাদেশের বাংলা ভাষার জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিলো কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন। যদিও আশির দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের নাগরিকদের দ্বারাই এই কাজটি শুরু হয়, তথাপি এটি কার্যত এক নতুন মাইলফলক হিসেবে আবির্ভুত হয়, ১৯৮৭ সালের ১৬ মে, আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কম্পিউটার প্রয়োগের সূচনা হয়। এরপর কম্পিউটারে বাংলা ভাষার বড় ঘটনাটি হচ্ছে ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কীবোর্ড-এর আত্মপ্রকাশ। এই শতকে এসে এটি আরও সম্প্রসারিত হয় এবং সকল প্রকারের ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলার প্রয়োগ ঘটতে থাকে।

বস্তুত ১৯৮৭ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তেই বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রায় কোন না কোন উন্নয়ন হয়েছে। একটি নতুন ফন্টের ডিজাইন, মাউস দিয়ে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি, বাংলায় ই-মেইল প্রচলন, বাংলা অভিধান, ইউনিকোডে বাংলা, নতুন নতুন কীবোর্ড-এর জন্ম, কীবোর্ড প্রমিতকরণ, বিডিএস ১৫২০: ২০১১ প্রণয়ন বা বিডিএস ১৮৩৪:২০১১ প্রণয়ন, মোবাইলের জন্য বাংলা বাধ্যতামূলক করা বা একটি নতুন সফটওয়্যারে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি হওয়া-এসব চলেই আসছে।  এরই মাঝে আমরা ডট বাংলা ডমেইন চালু করেছি। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৭ সালে সরকার ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলা ভাষার জন্য ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কর্মকা- প্রমাণ করে যে বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা এবং বাংলা ভাষাভাষীরা অসাধারণ মেধাসম্পন্ন জাতি। এটিও এতে প্রমাণিত হয় যে, বাঙালী জাতি বাংলা ভাষা ও হরফকে পুরোই ভুলে যায়নি। এতে এটিও প্রমাণিত হয় যে, কিছু লোক বাংলাবিদ্বেষী হলেও আমরা এখন নিজেদেরকে ততোটা অসহায় বিবেচনা করতে পারিনা।

তবে এই বিষয়টিও আমরা এখন অনুভব করছি যে, স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষার যতোটা উন্নয়ন হতে পারতো তা আমরা করতে পারিনি। বিশ্বের উন্নত ভাষাসমূহের সাথে তুলনা করার মতো সমন্বিত উদ্যোগ আমাদের এর আগে ছিলো না। এবার সম্ভবত সেই দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করার সময় হয়েছে।

আমি ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করা থেকে এই লেখা সম্পাদনার মুহূর্ত পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলার ¯্রােতধারায় একীভূত হয়ে মিশে আছি। আমার রক্তের প্রতি ফোটায় বাংলা ভাষা ও তার হরফ বিরাজ করে। ফলে আমার সাথে যেমনি আছে ডিজিটাল বাংলার ইতিহাস, তেমনি আছে এর সমস্যা, সংকট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। বিভিন্ন সময়ে আমি এসব বিষয় নিয়ে লিখেছি। যেমনি করে নিজের সকল শক্তি দিয়ে ডিজিটাল বাংলার যাত্রাপথ সুগম করেছি তেমনি এই যাত্রা পথে যখনি কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তখনি তাকে সরানোর জন্য প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি। জাতিগতভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে নীরব থাকার মানুষ নই আমরা। সেই ৪৭ সালে যখন পাকিস্তানের মোহ এই জনপদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, তখনও আমরা বাংলার সামান্য অবমূল্যায়ণ সহ্য করিনি। এর আগেও যখন বাংলা ভাষা রক্তচক্ষুর চাপে পড়েছে তখনও বাঙালি প্রাণের ভয় করেনি।

কিন্তু একটি চরম সত্য কথা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষার যে সব চ্যালেঞ্জ ছিলো এখন তেমনটি আর নেই। পাকিস্তান আমলে আমাদের লড়াই ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। রক্ত দিয়ে সেই লড়াইটা আমরা করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রথম লড়াইটা ছিলো অফিস আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন করার। অতীতে কোনদিন যে ভাষা অফিস বা আদালতের ভাষা হতে পারেনি সেই ভাষাকে বঙ্গবন্ধু সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করেন। তিনি যান্ত্রিক সংকটও দূর করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারিভাবে বাংলাকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়। সামরিক শাসকরা মজ্জাগতভাবে ইংরেজির দাস হওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু সরকারি অফিসে বাংলা ব্যবহারের যে বাধ্যবাধকতা চালু করেছিলেন তাকে শিথিল করা হয়। স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের জন্য আইন করলেও পরবর্তী সময়ে সেটি তামাশায় পরিণত হয়। এখন সরকারি অফিসে গ্রামের রস্তার উন্নয়নের প্রকল্প ইংরেজিতে প্রণীত হয়। সরকারি অফিসের সেমিনারের ভাষা হয় ইংরেজি। তারা কথা বলেন ইংরেজিতে, প্রবন্ধ লিখেন ইংরেজিতে। বেসরকারি অফিসে বাংলা একেবারেই নেই। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা নেই। উচ্চ আদালতেও বাংলা নেই। এমনকি প্রাথমিক  শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার ইংরেজিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সনের বদৌলতে শিশুদেরকে মাতৃভাষা বর্জন করতে হচ্ছে।

কেউ কেউ এই কথাটি বলতে পারেন যে, বাংলাকে তো ইংরেজির মতো ব্যবহার করা যায় না। এর ব্যাকরণ ও বানান শুদ্ধিকরণ সফটওয়্যার নেই। এর জন্য প্রণীত অপটিক্যল ক্যারেক্টর রিডার সফটওয়্যার কজ করেনা। এর অনুবাদক সফটওয়্যার নেই বা খুব ভালো করপাস গড়ে ওঠেনি।

এসব সত্য কথা। কিন্তু আমরা ২০১৭ সালে এসে সেই সত্যকে অতিক্রম করার পথে পা দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ৩ জানুয়ারি ২০১৭ অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তার মাধ্যমে ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বাংলা ভাষার ডিজিটাল টুলের ঘাটতিটা কেটে যাবে।

তবে বাংলা ভাষার বর্তমান সংকট কেবল টুলসের অপ্রাপ্যতা নয়। সংকট মানসিকতার। আমরা আমাদের জীবনধারায় বাংলাভাষাকে ঠাঁই দিচ্ছি না। বাড়িতে নিজেরা বাংলায় কথা বললেও বিয়ের দাওয়াতের কার্ডটাও ইংরেজিতে করি। এমনকি আমাদের নতুন প্রজন্মের কিছু লোক রোমান হরফে বাংলা বা রোমান হরফ দিয়ে লিখে বাংলায় রূপান্তর করার কুচর্চা করছে। এর ফলে বাংলা ভাষার বানান চর্চায় কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি বরং দিনে দিনে একটি প্রজন্ম বাংলা হরফ বা যুক্তাক্ষর চিনতে ভুলে যাচ্ছে। এই চরম অরাজক অবস্থা আমরা মানতে পারি না। কিছু বিভ্রান্ত মানুষের জন্য বাংলা ভাষা ও বর্ণমালাকে আমরা বিপন্ন হতে দিতে পারি না। এখনো আমরা আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের পথ ছাড়িনি। রক্তাক্ত বাংলার জন্য তাই আমাদের লড়াইটা চালু আছে, থাকবে।
 

 

ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়