ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ভুবন মাঝি : মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের ব্যক্তিগত অন্তর্দ্বন্দ্ব

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫২, ১৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভুবন মাঝি : মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের ব্যক্তিগত অন্তর্দ্বন্দ্ব

ভুবন মাঝি সিনেমার দৃশ্য

রুহুল আমিন : ‘মরতে খুব ভয় করে ফরিদা। যেখানে কিচ্ছু নেই, সেখানে যেতে আমার ইচ্ছে করে না’- সরকারি অনুদানে নির্মিত ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র নহিরের (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সংলাপ এটি। ঠিক নায়ক সুলভ নয়, অথচ ভুবন মাঝি চলচ্চিত্রের নায়ক নহির। নায়কের কণ্ঠে এমন নিরুত্তাপ সংলাপ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায়।

নহির মানুষের প্রাণ নিতে ভয় পায়। লালন সাঁইয়ের কুষ্টিয়ার গড়াই পাড়ের মানুষ বলেই বোধহয় নহিরের গড়ন কোমল। নির্মাতা সচেতনভাবেই বোধহয় নহির চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত নহির মানুষ খুন করে। মানব কল্যাণের বৃহৎ স্বার্থে, মাতৃভূমিকে রক্ষার্থে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।|

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ভুবন মাঝি । তিনটি সময় সমান্তরালে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। ১৯৭০, ২০০৪ ও ২০১৩ সাল। পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য সিনেমার মতো এই সিনেমাতেও কেন্দ্রীয় চরিত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে তুলে এনেছেন। যে মানুষটি অতি সাধারণ থেকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধে যায়। তবে যুদ্ধ জয় শেষে সে বাউল জীবনযাপন করে। অথচ নহির ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাককালে গ্রাম থেকে কুষ্টিয়া শহরে আসে পড়াশোনা করতে। বাবার চিঠি হাতে নিয়ে ওঠে কুষ্টিয়া শহরে চাচার বাসায়। দেশের রাজনীতিতে তখন স্বাধীনতার বাতাস ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। ৭০-এর নির্বাচন আসন্ন। বিদেশি শাসকের রাহুগ্রাস থেকে ‍মুক্তির আন্দোলন যখন দানা বাধছে তখন নহির বিন্দুমাত্র বিলচিত না। ‘রাজনীতি আমার পছন্দ না’ টাইপের শিক্ষার্থী নহির। পড়াশুনার পাশাপাশি থিয়েটার করত। আর যা ছিল তা হলো চাচাত বোনের বান্ধবী ফরিদা বেগম। 

ভেবেছিলো পড়াশোনা আর থিয়েটার করবে, কিন্তু মুক্তি আন্দোলনের আঁচে ঠিক থাকতে পারেনি নহির। ফরিদার প্ররোচনা তো ছিলই। ফরিদা ছিল রাজনীতি সচেতন তরুণী। তাই তো বাঙালির স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার, ছয় দফা দাবির বুকলেট নহিরকে ধরিয়ে দেয় ফরিদা। তারপরও নহির মানুষ হত্যার মতো কাজ করতে পারছিল না। তাই তো রাজাকারের ঘরে গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে নিজেই আহত হয়ে শরণার্থী শিবিরে ফিরে আসে। তারপরও যুদ্ধ চলে, ফরিদাকে চিঠি লেখা হয়। ফরিদা রাজাকার দ্বারা ধর্ষিতা হয়। আওয়ামী পরিবারে নির্যাতন হয়। মানুষ ভিটেমাটি ছাড়ে। 

সিনেমাটিতে সমান্তরালে তিনটি সময় তুলে ধরা হয়েছে। এর একটি নির্মাতা সোহেলের গল্প। যে ২০০৪ সালে কুষ্টিয়ায় গিয়ে বাউল আনন্দ সাঁইয়ের ওপর নির্মাণ করে তথ্যচিত্র। কিন্তু ২০১৩ সালে যখন পুরোনো শকুন আবার সরব হয়। বাউলদের চুল দাড়ি কেটে দেয়, মুক্তমনাদের ওপর হামলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল হয় শাহবাগ তখন আনন্দ সাঁইয়ের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর জানাজা নিয়ে মৌলবাদিরা শুরু করে পাঁয়তারা। তখন সোহেল তার তথ্যচিত্রকে সামনে এনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো করে।

সিনেমায় নন লিনিয়ার স্টোরি টেলিং খানিকটা কঠিনই বটে। সাসপেন্স, সিনেমাটিক অ্যাপ্রোচ, মেক বিলিভ এসব বিষয় ধরে রাখা কঠিন। সে কঠিন কাজটা নির্মাতা অনেকটাই পেরেছেন। হয়তো আরো ভালো করতে পারতেন। রানা দাশগুপ্তের ক্যামেরার কাজ বেশ ভালো লেগেছে। গড়াই নদীর তীর, পাকশী বিজ্রের ওপর নহির-ফরিদার বসে থাকা, কলকাতার অলিগলির দৃশ্য ভালো লেগেছে। তবে দু’এক জায়গায় আলোর ব্যবহার কিছুটা চোখের আরামে ব্যঘাত ঘটিয়েছে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে পরমব্রতকে যতদূর জানি তেমনটা পেয়েছি। কারণ কলকাতার সিনেমার মাধ্যমে পরমব্রতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল। তবে অপর্ণা ঘোষের কথা বলতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রাককালের কলেজ পড়ুয়া জেলা শহরের মেয়ে হিসেবে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। অভিনয়ে পরিমিতি বোধও ছিল। এ ছাড়া বড় হুজুর চরিত্রে মামুনুর রশীদ, মিজান চরিত্রে মাজনুন মিজান, রাজাকার চরিত্রে শুভাশিস প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় সেরাটা দিয়েছেন। সংলাপের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ভিন্নতা দেখা গেছে ভুবন মাঝি সিনেমাটিতে। প্রতীকী কিছু সংলাপ ছিল যা অসাধারণভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। 

সংগীত পরিচালক হিসেবে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। সিনেমায় এটি কালিকাপ্রসাদের প্রথম সংগীত পরিচালনা। ছয়টি গান ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমাটিতে। গানগুলো লিখেছেন কালিকাপ্রসাদ ও আকাশ চক্রবর্তী। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সপ্তর্ষি, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শিমুল ইউসুফ, বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়ুয়া, বুশরা শাহরিয়ার, কোনাল, সালমা ও সাব্বির। এ ছাড়া দিজেন্দ্রনাথের  ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটিও ছিল। সপ্তর্ষির গাওয়া ‘আমি তোমারই নাম গাই’ গানটির অসাধারণ সুর করেছেন কালিকাপ্রসাদ। ইউটিউবে এর প্রমাণও পাওয়া যায়।  এ ছাড়া ‘বোতলে পুরেছি কান্না’র  মতো পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজের গানও ছিল।

কস্টিউম ও সেট ডিজাইন নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। এই একটা জায়গা আমার ভালো লাগেনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দেয়াল লিখন থেকে শুরু করে মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ, শরণার্থী শিবিরের সেট নির্মাণে আরো বেশি যত্নশীল হওয়া দরকার ছিল। মনে হয়েছে দায়সারা গোছের কাজ হয়েছে। 

আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে। তবে এই ‘অনেক’ সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের গ্রাউন্ড ন্যারেটিভ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভুবন মাঝি সিনেমাটিও এর ব্যতিক্রম নয় বলেই মনে হয়েছে। আবার ইতিহাস নির্ভর হলেও ভুবন মাঝি যে কেবল মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা তাও বলা যাবে না। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার মতো এখানে অস্ত্রের খুব বেশি ঝনঝনানি ছিল না। ছিল না পাকিস্তানি সৈন্যদের প্যারেড। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের বাঙালি নির্যাতন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথাও তেমন ছিল না। লালন সাঁইয়ের মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের ব্যক্তিগত অন্তর্দ্বন্দ্বই যেন এই সিনেমার বিশেষত্ব। সে হিসেবে ভুবন মাঝি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হয়েও যেন ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নয়। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য যে কেবল যুদ্ধ বিজয়ের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায়নি, তা যে একটি চলমান প্রক্রিয়া তাই যেন বলতে চেয়েছেন পরিচালক।

ফরিদাকে লেখা চিঠিতে নহিরের, ‘এই প্রথম মনে হলো বাংলা আমার দেশ। এই পতাকা আমার। যেমনটা তুমিও’ বাংলা সিনেমার দর্শকরা অনেকদিন মনে রাখবে এই সংলাপ। ছোটখাটো দুয়েকটি অসামঞ্জস্য ছিল, তবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে সফলভাবে নন লিনিয়ার গল্প বলার যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন পরিচালক তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মার্চ ২০১৭/মারুফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়