ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া খুশবু লুটাদে || মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৯ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া খুশবু লুটাদে || মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

পাঠক, আপনারা গল্পের শুরুতেই দেখতে পাবেন, রঞ্জু নামের একটি ছেলে ভিড়ের ভেতরে বিভ্রান্ত। আমি জানি, এমন মানুষ প্রায় দেখে থাকেন সবাই। কখনো হয়তো পাত্তা দিতে চান না অথবা সে সময় আপনাদের থাকে না। আবার যখন নিজেরা হারিয়ে ফেলেন চেনা পথের চিহ্ন তখন একটু বিভ্রান্ত হয়ে ভাবেন বৈকি, এ আমি কোথায় এলাম! রঞ্জু আপনাদের চাইতে ভিন্ন কেউ নয়। এমন হতে পারে, আপনিই রঞ্জু কিংবা গল্পের কথক হিসেবে আমি নিজেই রঞ্জু নামের আড়াল নিয়েছি।

তো অসহায় চোখে মানুষের ভিড় দেখে আমাদের আলোচ্য রঞ্জু। এত মানুষ অথচ একজনও আপন নেই। একচুল আগাতে পারে না, মানুষের ধাক্কাই তাকে ঠেলে সামনে নিয়ে যায়। এই যে সবাই হেঁটে যাচ্ছে উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসে তারা কি আসলেই জীবিত কিনা সন্দেহ হয় তার।

সে নিজেই কি মৃত? এমন ভাবনাও মাথায় আসতে পারত। রঞ্জুর এমন মনে হতে পারত, হয়তো কিছুক্ষণ আগে কবরস্থানে নিজেকে কবর দিয়ে এসেছে। কিন্তু এমন মনে হবার আগেই তার কানে গান ভেসে আসে।

ধূপখোলার মাঠে মেলা জমে উঠছে। বৈশাখের মেলা। মানুষের মনের রং বৈশাখের উজ্জ্বলতায় ফুটে উঠছে কৃষ্ণচূড়ার মতো। মাঠের চারপাশে যে দোকানগুলোতে চা, বিরিয়ানি, মোটর পার্টস বিক্রি হতো, সেখানেও বাচ্চাদের নানা ধরনের খেলনা বিক্রি হচ্ছে। বাঁশির আওয়াজ কান ছাপিয়ে মাঠের চারধারে লাগানো বাঁশের মাথায় তিনকোণা, হালকা সবুজ রঙের মাইক থেকে কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে ‘হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া খুশবু লুটাদে'- গানটা ভেসে আসতে থাকে।

রঞ্জু ভাবে, সবাই তাকে উপহাস করছে। না হয় আজকের দিনে যখন সে মাত্র কবরস্থানে শ্যামাকে দাফন করে আসবে তখন কেন মহল্লায় উৎসব হবে? ওদিকে জমজ মেয়ে জন্মের সময় মা'কে হারালো, তারা কোথায় বড় হবে, কীভাবে বড় হবে এসব দুশিন্তায় আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে ভিড় জমালেও রঞ্জুর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না।

পাঠক, আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এমন একটা মর্মান্তিক সময়ে রঞ্জুর মনের অবস্থা কেমন থাকতে পারে। এই যে সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাদের ছেড়ে সে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে না, নিশ্চয় আপনারা সহৃদয়; রঞ্জুকে পাষাণ ভেবে ফেলবেন না। অথবা ফেলতেই পারেন। লেখক কিংবা কথক হিসেবে আপনাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া এক ধরনের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু বলেন তো আমি শুদ্ধ মানুষ কিংবা লেখক এ দাবি কি কোথাও করেছি? সুতরাং, আমি যে মাঝে মাঝে গল্পের ভেতর আমার চ্যাপ্টা নাক গলাবো সে বিষয়ে ছোটখাট মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন। এই যে দেখেন, অযথা বাক্যলাপ করছি, ওদিকে আমাদের রঞ্জু আজিমপুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধূপখোলার ভিড়ে আটকে আছে। আসার সময় শাহবাগ বাইপাস করে এসেছে। তাও, মেলা কিংবা বৈশাখের মূল ঝাপটা গায়ে লাগেনি তার। এরপর বকশীবাজার, নাজিরাবাজার, বংশাল পার হয়ে কখন যে বাড়ির কাছে এসে পড়েছে টের পায়নি। অথচ দাফন করতে যাওয়া দলটি থেকে স্বেচ্ছায় দলছুট হয়েছিল বাড়ি যাবে না বলে।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে হাওয়া হাওয়া গানের সম্পর্ক কোথায় মাথাটা একটু স্থির হলে হয়তো ভাবত রঞ্জু। বস্তুত, একটি মানবিক বিপর্যয়ের পর এসব সাংস্কৃতিক অসামঞ্জস্যতা নিয়ে ভাবাটা কোনোভাবেই যৌক্তিকতার আবরণে ফেলাও যায় না। কিন্তু রঞ্জু মাথা থেকে গানটি তাড়াতে পারে না। চারপাশে মানুষের অনেক হৈ হৈ শব্দ থাকলেও তার কানে কেবল গানটি চলতে থাকে যেন একটি সিডিতে অথবা ক্যাসেটে শুধু এই গানটি আছে। মাথা চেপে ধরে বসে পড়তে চাইলে পারে না। এখান থেকে ডানদিকে গেলে রঞ্জুর বাসা। সাধারণ সময়ে হেঁটে গেলে দশমিনিট। বাড়ি ফিরবে না তাই সে বামে মোড় নেয়। দয়াগঞ্জ মোড়ের দিকে রওনা দেয়। রঞ্জু ভাবে, যে কোনো একটা বাসে উঠে পড়বে, শেষ স্টপেজে নেমে যাবে।

ঠিক যেখানে মোড় থাকার কথা, সেখানে এসে দ্বিধায় পড়ে যায় রঞ্জু। চার-রাস্তার মোড়। ল্যাব এইডের বিল্ডিং উঠছে, পাশে বিশাল বড় ডাস্টবিন, যেখানে অধিকাংশ ময়লা বাইরে ফেলানো, কাক এসে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, রাস্তার কুকুরগুলোও সুবোধ বালকের মতো তাদের পাশেই ঘুরঘুর করছে। মানুষের চলাফেরায় তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। এই রাস্তার একটি গন্তব্য চলে গেছে মীর-হাজারিবাগের দিকে, একটু সামনে বাঁয়ে চাপলেই সায়েদাবাদের রাস্তা, যদিও রাস্তা না বলে ট্রাক-স্ট্যান্ড বলা ভালো, পুরো রাস্তা দখল করে রাখা সারি সারি ট্রাক। আরেকটি পথ চলে গেছে গুলিস্তানের দিকে। রঞ্জু কোনদিকে বাসে উঠবে তা ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়, রিকশা করে রেল-স্টেশনে চলে যাবে, তারপর কোনো একটা ট্রেনে উঠে পড়বে। ট্রেন না বাস এই মধ্যবর্তী চিন্তায় দাঁড়িয়ে থাকে রঞ্জু। তাকে পাশ কাটিয়ে কয়েকটি বাস চলে যায়। ধূপখোলা মাঠ থেকে বেশদূরে চলে এলেও  তার কানের ভেতরে আবার হাওয়া হাওয়া গানটি বেজে ওঠে। শব্দ উৎস করে তাকালে দেখতে পায়, সোনালি ডানার চিল ঠোঁটে ছোট্ট একটা টেপ-রেকর্ডার নিয়ে মাথার উপর গোলগোল ঘুরছে। সে একবার চোখ বন্ধ করে, আবার চোখ খোলে। একই দৃশ্য দেখতে পায় আবার। জীবনানন্দের চিল? ভাবনাটি মস্তিষ্কের প্রবাহে ঢেউ তোলা মাত্র বেরসিকভাবে টেপ-রেকর্ডার থেকে গান ভেসে আসে- হাওয়া, হাওয়া ও হাওয়া।

ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রঞ্জু। যেন, যাবার কোনো জায়গা নেই। বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার বুঝেও না বোঝার ভান করে। বাচ্চাদুটো জন্মেই একা হয়ে গেল আর সে কিনা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দংশন হয় রঞ্জুর। ভয় হয়। কীভাবে সে দাঁড়াবে, তাদের সামনে? এমন অবান্তর প্রশ্নে কাবু হতে থাকে সে। শ্যামা যে এভাবে মরে যাবে, তা কি আর কেউ জানত? মানুষ মরে গেলে কে বা আগে থেকে বুঝতে পারে?

পাঠক, আপনারা বুঝতে পারছেন রঞ্জুর মনে খুব স্টেরিওটাইপ চিন্তাভাবনা চলছে। কিছুটা বিক্ষিপ্তও বটে। গান তার পিছু পিছু আসছে। অপরাধবোধে ভুগছে। আবার স্মৃতিকাতরতাও ছাড় দিচ্ছে না। এই জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন? হয়তো বাড়ি ফিরে যেতেন। মেয়ে দুটোকে দেখে হুহু করে কাঁদতেন। আত্মীয়-স্বজন আপনাকে সান্ত্বনা দিত। তৎক্ষণাৎ স্মৃতিগুলো কি অমন ভিড়ে নাড়া দিতে পারত আপনাদের? এ কথা কী মানবেন, নিজের একান্ত অনুভব পেতে হলে নির্জনে যেতে হয়? প্রকৃতির কাছে যেতে হয়? ঢাকা শহরে আমি, আপনি কিংবা রঞ্জু প্রকৃতি পাব কোথায়?

শ্যামা খুব বলত, আমি একদিন হুট করে মরে যাব, বুঝলে। অমন যন্ত্রণা  সহ্য করে মরার চাইতে হুট করে মরে যাওয়াই ভালো। তাই না?

রঞ্জু কিছু বলত না উত্তরে। চুপ থেকে শুনত। তার মনে হতো, শ্যামার হুট করে মরে যাওয়া মানে, তার নিজেরও মরে যাওয়া। ব্যাপারটা মন্দ কি ভালো, অত চিন্তাও করেনি।

শ্যামা এটাও বলেছিল, জীবন তো বিশাল একটা জার্নি। এই যে তুমি, আমি একসাথে আছি, আমাদের জীবন যদি খুব বেশি বড় হয়, তবে মাঝে কতকিছুই ঘটতে পারে, তাই না?

তা, তো পারেই। আমরা আলাদা হয়ে যেতে পারি।

ধরো, আমাদের ভেতর সব ভালো থাকতে থাকতেই, একেবারে পৃথিবী থেকে চলে গেলে, দারুণ হবে না?

হু। মৃত্যু পর্যন্ত একসঙ্গে থাকব আমরা।

আজ সত্যি সত্যি শ্যামার বিদায়ের পর হাওয়া হাওয়া গানের ভেতর পুরোনো কথাগুলো ভেসে আসে অথবা বলা যায় সোনালী ডানার চিলের উপর ভর করে রঞ্জু সেখানে ফিরে যায় যখন সবেমাত্র তাদের প্রেম  হয়েছিল।

শোন, এসব প্রেম-ভালোবাসা আমার অসহ্য লাগে।

রঞ্জু হেসে বলেছিল, আমি কি তোকে বলেছি ভালোবাসতে?

নাহ, কেউই বলেনি তাদের ভালোবাসতে। সচরাচর যা হয়, যেভাবে হয়, তাদের বন্ধুত্বও প্রেমের দরজায় নীরবে পা ফেলেছিল। এরপর সেই প্রেমের দরজা পার হয়ে কখনো ভেতরে প্রবেশ, কখনো বাইরে প্রস্থান। চলাফেরাটা একসাথেই ছিল। রঞ্জুকে এখন পুরো যাতায়াত একা একাই করতে হবে, এ কারণেই কিনা মধ্যপথে সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় সে দাঁড়িয়ে আছে।

চিলটিকে আর দেখতে পায় না। সেও বোধহয় শ্যামার কবরে চলে গেছে, গান শোনাতে। ব্যাপারটা নিষ্ঠুর। একজনের মৃত্যুদিন, আর পুরো দেশের উৎসবের সাজ। রঞ্জুর মনে হয়, যদি কোনোদিন ক্ষমতা পায়, যদি সম্ভব হয় আইন করে এমন দিনে মৃত্যুঘোষণা বন্ধ করে দিতে হবে। এইসব দিনগুলোতে হাসপাতালে কেউ শেষ বিদায় জানাবে না। কোনো চিকিৎসককে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হবে না। বাস্তবে অসম্ভব কিন্তু এ দেশে চাইলে তো সব সম্ভব করা যায়। নতুবা সে উৎসব বলে কিছু রাখতে দিবে না দেশে।

শ্যামা প্রায় বলত, তুই ভাবতে পারিস, দিনের পর দিন কীভাবে দুজন মানুষ একজন আরেকজনের সঙ্গে দিন কাটায়?

অভ্যাসে পড়ে যায়।

নখ খুঁটাতে খুঁটাতে আনমনা হয়ে যেত শ্যামা। এজন্য তো তোকে বলি, ওসব প্রেম-ভালোবাসায় কাজ নেই। প্রেম একটা উত্তাল ব্যাপার, ওর ভেতরে অভ্যাস আসবে কেন, বল?

পড়াশোনার পাঠ শেষ হলে, অবধারিতভাবেই ওদের ভেতরে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। চাকরির সন্ধানে পাগল-প্রায় রঞ্জু। শ্যামার বাসা থেকেও চাপ দিচ্ছিল বিয়ের। সুতরাং, রঞ্জুকে সিরিয়াসলি বিয়ের কথা ভাবতে হয়েছিল। বাংলা সিনেমার মতো পারিবারিক ঝামেলা এসেও বাগড়া বাধিয়েছিল। রঞ্জুর বাবা প্রেমের বিয়ে মানতে রাজি নন। মেয়ে পর্দা করে না, অভিযোগে ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। রাগে-ক্ষোভে রঞ্জু ভেবেছিল, সে পালিয়ে বিয়ে করবে। শ্যামাকে ফিরিয়ে দেয়ার চাইতেও তার মন খারাপ হয়েছিল মূলত বাবার দেখানো যুক্তিতে। চির আধুনিক মন নিয়ে চলাফেরা তার, আর তাকেই পরিবার থেকে শুনতে হচ্ছে এমন বৈষম্যমূলক কথা! শ্যামাকে সব বলত রঞ্জু, কিন্তু সে ভেবে দেখল, কেবল এই কথাটি গোপন রেখেছিল সে। যদিও কিছুক্ষণ পর তার মনে পড়বে, বেশকিছু কথাই বলা হয়নি শ্যামাকে।

গোপন মানে পুরোপুরি গোপন। আজ পর্যন্ত সে বলেনি। বলবেও না কখনো। আর বলবেই বা কীভাবে? বলার মানুষটা তো আর নেই। তবে, রঞ্জু জানে এই যে বাড়ির পর্দা বিষয়ক জটিলতা, মেয়েকে কাজ করতে না দেয়া- এসব ব্যাপারে যে একটা অসন্তোষ শ্বশুরের ছিল, তা নিশ্চয় বুদ্ধিমান শ্যামার বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

পাঠক, আপনারা বিরক্ত হচ্ছেন? শ্যামা-রঞ্জুর কথোপথকন এড়িয়ে যাচ্ছি দেখে? একটু ভেবে দেখেন তো, কথোপকথনের শেষ আছে? শ্যামা যে ভাবত, প্রেমের ভেতরে অভ্যাস আসতে নেই, সে শ্যামার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রঞ্জুর, রঞ্জুর বাসার পরিস্থিতিও ঠিক শ্যামার জন্য অনুকূল ছিল না। তাই, সহজেই ভাবতে পারি, শ্যামার দাম্পত্য জীবন ঠিক সুখের ছিল না। আচ্ছা, আমরা রঞ্জুকে রাস্তার মাঝে রেখে এসেছি। সে নির্জনতা প্রত্যাশী। কিন্তু কোথায় যাবে সে?

বিস্মিত হয়ে রঞ্জু দেখে এই উৎসবের শহরে তার যাওয়ার জায়গা নেই। একটা পুকুরের কথা ভাবতে চায় সে। পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে থাকবে। আশেপাশে মানুষ থাকবে না। হ্যাঁ, শ্যামার কথা ভাববে সে। ভাববে, শ্যামা কি তার সঙ্গে সুখী ছিল?

বিড়বিড় করে রঞ্জু নিজেকে বলে, পুকুর আছে ময়মনসিংহে। তার নানুবাড়ির পাশে। হাজী বাড়ি। পুকুর পাড়। ময়মনসিংহ যেতে হলে বাসে উঠতে হয় মহাখালী থেকে। তারপর যে চিল খানিক আগে টেপ রেকর্ডার নিয়ে গান শোনাচ্ছিল, সেই চিল এসে তাকে জানায় যে, পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। পদ্মার পাড়ে যাবার কথাও ভাবে রঞ্জু। মৈনট ঘাট। বৈশাখের ভিড় তাকে আটকে দেয়। শ্যামার সঙ্গে ভুটান যাবে বলে ঠিক করেছিল। ল্যান্ড অফ থান্ডার ড্রাগন। টাকা জমাচ্ছিল। কত টাকা জমেছে, মনে করতে চায় কিন্তু পারে না। খুব বেশি জমলে কি একাই চলে যাবে ভুটান? অথবা ভুটান গেলে কি শ্যামার চলে যাওয়া সে ভুলে যেতে পারবে? নাকি আরও বেশি করে মনে পড়বে?

রঞ্জু সিগারেট ধরায়। তারপর সে খেয়াল করে, সিগারেটের কথাটিও সে গোপন রেখেছিল শ্যামার কাছে। পছন্দ করত না সে। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার। মরে গেলে, মানুষ সব দেখতে পায়? দেখতে পায়, তার আপনজনেরা কী করছে? দাদা বলত, মৃত মানুষের রূহু ঘুরে বেড়ায়। তাই দোয়া পড়তে হয়, কাঁদতে হয়, অজ্ঞান হয়ে যেতে হয়।

খারাপ লাগে রঞ্জুর। হাওয়া আর খুশবুর কথা ভাবে। মাত্র সে ঠিক করেছে দুই মেয়ের নাম হাওয়া আর খুশবু রাখবে। তাদের দুজনকে মায়ের আদরের কমতি হতে দিবে না। নিশ্চিত, বিয়ের কথা আসবে। কিন্তু এখনই বিয়ে করবে না।

পাঠক, রঞ্জুর আচমকা এই চিন্তার পেছনে কারণ খুঁজতে যাবেন না যেন। যে মাত্র পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল, সে কিনা ভাবছে এমন কথা? ভাবতেই পারে। মানুষের চিন্তা যে কত বিচিত্র হতে পারে, তা তো আমরা সকলেই জানি।

সুতরাং, রঞ্জু ফিরতি পথে পা বাড়ায়। এবার আর টেপ রেকর্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো চিল নয়, মাঠের মাইক থেকে আবার ভেসে আসে তার দুই মেয়ের জন্য গান। অতটা খারাপ লাগে না রঞ্জুর। বাড়ি ফিরে কখন মেয়ে দুটোর মুখ প্রথমবার দেখবে, বুকে জড়িয়ে নেবে এই চিন্তায় অস্থির চিত্তে পা বাড়ায়। না, পাঠক, মেলোড্রামাটিক কিছু ঘটবে না। কোনো গাড়ি এসে চাপা দিয়ে যাবে না, আমাদের রঞ্জুকে। সে পুনরায় একটি সিগারেট ধরাবে এবং মনে পড়বে শ্যামার কাছে সে আরও দুটো কথা গোপন করেছিল। শ্যামাকে সে জানায়নি, আফরিনের কথা। আফরিন যার সঙ্গে মনোদৈহিক আকর্ষণে সে জড়িয়ে আছে। জানায়নি যে, চিকিৎসক রঞ্জুকে বলেছিল, রঞ্জুর এজোস্পার্মিয়া আছে; রঞ্জু কখনো বাবা হতে পারবে না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়