ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বই নিয়ে ছয়টি কথা

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৩ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই নিয়ে ছয়টি কথা

মুম রহমান : বিশ্বে বই নিয়ে কথাবার্তার কোন শেষ নেই। বই যে পড়ে না সে-ও বই নিয়ে দুইখান কথা বলে। বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জ্ঞানী ও মুর্খ সবারই ধারণা আছে। তবু কেউ বই পড়ে কেউ পড়ে না। বই আর বই পড়া নিয়ে ছয়জন মানুষের কথা শুনলেই আমরা বুঝতে পারবো বইয়ের বৈচিত্র কতো সুদুরপ্রসারী। আর কথাগুলো যারা বলেছেন তারা নিজেরাও বইয়ের চেয়ে কম বৈচিত্রপূর্ণ নন। আসুন হাফ ডজন বই উদ্ধৃতির সূত্র ধরে কিছু কথা জানি।

১. ‘একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তোমার বই পোড়ানো লাগবে নাস্রেফ মানুষকে বই পড়া বন্ধ করাতে পারলেই হলো।’ - রে ব্রাডবেরি

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : বই পোড়ানো নাৎসিদের অন্যতম একটি ঘৃণ্য কাজ ছিলো। হিটলার সাম্রাজ্য চেয়েছিলো তাদের অপছন্দের বইগুলো পুড়িয়ে বিলুপ্ত করে দিতে। বই যে একটা হাতিয়ার বই পোড়ানোর কার্যক্রম থেকে তা বোঝা গেছে নানা কালেই। আমাদের দেশেও ধর্ম, সংস্কৃতি, মতবাদ কিংবা যে কোন কিছুতে আঘাত লাগলেই আমরা বই পোড়াতে শুরু করে দেই। আমরা যারা এখনও হিটলারের বংশধর হয়ে বই পোড়াই তাদের জানা উচিত বই পুড়িয়ে সভ্যতাকে পোড়ানো যাবে না। শেষ বইটি রক্ষার জন্যও ডেনজেল ওয়াশিংটন তার ‘দ্য বুক অফ এলি’ চলচ্চিত্রে যুদ্ধ করে যায়।



লেখক
প্রসঙ্গে : রে ডগলাস ব্রাডবেরি (আগস্ট ২২, ১৯২০- জুন ৫, ২০১২) শুধু মার্কিন সাহিত্য জগতেই নয় আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী, ভৌতিক গল্প, রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের শেষ নবাব। কুড়ি আর একুশ শতক জুড়ে সাহিত্য জগতে একচ্ছত্র রাজত্ব করেছেন তিনি। বিশেষত যে সব নাক-উঁচা পুরানা ধাঁচের সমালোচকরা বৈজ্ঞানিক বা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পকে সাহিত্য মনে করতেন না তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে রে ব্রাডবেরি’র সেরা লেখাগুলি। তার মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল রে ব্রাডবেরি, ‘সাহিত্যের মূলধারা আধুনিক সায়েন্স ফিকশনকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বশীল  লেখক।’ এই দায়িত্বশীল কল্প বিজ্ঞানিক লেখক ভবিষ্যতকে দেখতে পান বলেই এমন কথা বলেছেন। আজকের দিনে আমরা সোস্যাল মিডিয়ার ভাইরাসে বইকে যেভাবে ভুলে যাচ্ছি হয়তো একদিন সভ্যতার সংজ্ঞাটাই পাল্টে যাবে।

২.‘আসুন আমরা মনে রাখি : একটি বই, একটি কলম, একজন শিশু একজন শিক্ষক পারে পৃথিবীটা বদলে দিতে পারে।’ - মালালা ইউসুফজাই

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে উত্তম, কলম তরবারি চেয়েও শক্তিশালী। কলম দিয়েই বই লেখা হয়। বই শিক্ষা, জ্ঞান আর প্রজ্ঞা ধারণ করে, বহন করে। শিক্ষকরা সেই ধারণ আর বহনের কাজটি প্রতিটি শিশুর অন্দর মহলে পৌঁছে দেয়। বই, কলম, শিশু, শিক্ষকের এই সুশীল চক্রটি নির্বিঘ্নে চালিত হলে পৃথিবীর চেহারাটিই হয়তো ভিন্ন হতো। পড়ার মৌলিক অধিকারে বাধাপ্রাপ্ত পাকিস্তানি শিশু মালালা ইউসুফজাই এই চক্রটির গুরুত্ব আমাদের বুঝিয়ে দিতে চান।



লেখক
প্রসঙ্গে : মালালা ইউসুফজাই (জুলাই ১৯৯৭) বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। নারী শিক্ষার জন্য শুধু পাকিস্তানে নয় সারা বিশ্বেই সে একজন আইকন। পাকিস্তানের পাহাড়ি উপত্যকায় তালিবান অধ্যুষিত প্রদেশে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সে। মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সে লড়াই করে বিবিসি উর্দূ ব্লগে লেখার মাধ্যমে। তাদের পরিবার ২০০৯ সালে ওই প্রদেশে একাধিক স্কুল চালাতো যা মৌলবাদী তালেবানরা বন্ধ করে দেয়। ১২ বছর বয়সী মালালা তালেবান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ও নারী শিক্ষার পক্ষে লিখতে থাকেন। তার লেখা দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া পড়ে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক এডাম বি এলিক তাকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মানবতাকর্মী ডেসমন্ড টুটু তাকে ইন্টারন্যাশনাল চিলডেন্স পিস প্রাইজের জন্য মনোনীত করেন। পরে মালালা শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পান। তবু মালালা এবং তার মতো সকল শিশুর জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার লেখা পড়ার স্বাধীনতা।

৩.‘আপনি একটি বই না-খুলে কিছু শিখতে পারবেন না।’ - কনফুসিয়াস  (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১- খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯)

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : বন্ধ হৃদয়, বন্ধ চিন্তা আসলেই অচলায়তন সৃষ্টি করে। সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ভয়ংকর উপায় হতে পারে বই থেকে দূরে থাকা। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতি যেই বিষয়ই হোক সে বিষয়ের বইটি না-খোলা পর্যন্ত আপনি আসলে শিক্ষা থেকে দূরেই থাকবেন। বই খুললেই শিক্ষার দুয়ার খুলে যাবে।



লেখক
প্রসঙ্গে : চীনা শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক কনফুসিয়াস মানবিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের নৈতিকতা, সমাজের দায়বদ্ধতা আর ন্যায় ও বিচার নিয়ে এমন সব কথা বলে গেছেন যা আজও স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রাখার যোগ্য। তিনি সব সময়ই বলতেন, অন্যের ক্ষেত্রে এমন কিছু করো না যা তোমার ক্ষেত্রে অন্য কেউ করলে মেনে নেবে না। মানবতাবাদী এই দার্শনিক, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধারক কনফুসিয়াস নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, বই না-খুলে শেখা যায় না, অন্তত সেই বইয়ে যে জ্ঞান আছে সেটুকু থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

৪.‘তোমার সন্তানের পৃথিবীকে বর্ধিত করার অনেক উপায়ই আছেতারমধ্যে বইয়ের প্রতি ভালবাসাই সর্বোত্তম পন্থা।’ - জ্যাকুলিন কেনেডি

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : ছোট্ট একেকটা বই তো আসলে বিরাট একেকটা জগত। এলিসের জগত, ওজের জগত, ঠাকুরমার জগত- কতোই না জগত শিশুদের সামনে তুলে দিতে পারে একেকটি বই। আমরা বাচ্চাদের জন্য যতো খেলনা কিনি তার অর্ধেক টাকারও যদি বই কিনতাম হয়তো আমাদের ভবিষ্যত সন্তানরা পৃথিবীটাকে অন্যভাবে দেখতো। সৈয়দ মুজতবা আলির বরাতে ফরাসি দার্শনিকের মতামত জানতে পেরেছিলাম যে, বই হলো চোখের মতো। আমাদের চোখ খুলে দেয়, চোখের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় বই। তারচেয়ে একধাপ এগিয়ে জ্যাকুলিন জানালেন, শিশুর জগতটিকেই বড় করে দেয় বই।



লেখক
প্রসঙ্গে : জন এফ কেনেডির স্ত্রী, ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডি ফরাসী সাহিত্যে পড়ালেখা করেছেন তারপর তিনি ওয়াশিংটন  টাইমস হেরাল্ডে ফটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে তিনিও  সচেতন রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করে গেছেন। জীবনের শেষ দুই বছর তিনি  বই সম্পাদনা ও প্রকাশনার সাথে জড়িত ছিলেন। শিল্প সাহিত্য ও আমেরিকার ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনসমূহ রক্ষা করার ক্ষেত্রেও কাজ করেছেন। আভিজাত্য, লাবণ্য ও ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি ফ্যাশন আইকন হিসাবেও সুপরিচিত। তাকে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফার্স্ট লেডি এবং বিশ শতকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নারী পুরুষের তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়।

৫.‘বই পোড়ানোর চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ আছেতারমধ্যে একটি হলো বই না পড়া।’ - জোসেফ ব্রডস্কি

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : রে ব্রাডবেরি’র অমূল্য কথারই বর্ধিত রূপ বলা যায় জোসেফ ব্রডস্কির এই উদ্ধতিকে। বই না পড়লে যেহেতু সভ্যতা এগোয় না সেহেতু বই সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু তাকের মধ্যে বই সাজিয়ে রেখে তাকে উপেক্ষা করা এরচেয়ে বড় অপরাধ আর বোধহয় নেই। এ যেন তোমার সামনে পুরো বিশ্ব আছে কিন্তু তুমি চোখ বন্ধ করে রাখলে। আমরা বিভিন্ন সময়ই পবিত্র গ্রন্থ নামিয়ে চুমু খাই আবার সাজিয়ে রাখি পরম যত্নে। কিন্তু তা খুলে দেখি না, বোঝার চেষ্টা করি না, পড়ি না। বই দেখতে হবে, পড়তে হবে, শুনতে হবে, বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে- নইলে বোকা-কালা-কানা হওয়ার অপরাধে আমাদের শাস্তি ভবিষ্যতের দরবারে পাওনা থাকবে।



লেখক
প্রসঙ্গে : কবি ও লেখক জোসেফ ব্রডস্কি আমাদের স্বপ্নের কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ইয়েল, কলম্বিয়া, কেম্ব্রিজ ও মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক জন্মেছিলেন কমিউনিস্ট রাশিয়ায়। যথাবিহিত মুক্ত চিন্তার অপরাধে তাকে দেশান্তরি হতে হয়। মার্কিন কবি ডব্লিউ এইচ অডেনের চেষ্টায় তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পান। পরিচ্ছন্ন চিন্তা এবং কাব্যিক গভীরতার জন্য ১৯৮৭ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

৬.‘একবার তুমি পড়তে শেখো, তুমি চিরকালের জন্য স্বাধীন।’ - ফ্রেডরিক ডগলাস

উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে : স্বাধীনতা কি এবং যথার্থ স্বাধীনতা কি- তা একমাত্র দাসরাই জানে। সুদুর আফ্রিকা থেকে একসময় পশুর মতো শিকলে বেঁধে যে সব কালো মানুষকে ইউরোপ আফ্রিকার বাজারে বিক্রি করা হয়েছিল পণ্য হিসাবে তাদেরই পূর্বসুরী ফ্রেডরিক ডগলাস। মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে ফ্রেডরিক ডগলাস পর্যন্ত বা তার আগে পরে যারাই নিজেদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন তারাই সবচেয়ে বেশি পড়ালেখাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের দেশেও তো টিপসইয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকেরই দাসোচিত জীবন পাল্টে গেছে। পরাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু পড়া লেখা- সেটা এ দেশেও প্রমাণিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যা কিংবা মুক্ত চিন্তার মানুষদের হত্যার মাধ্যমে।



লেখক
প্রসঙ্গে : লেখক, বক্তা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজ সংস্কারক ডগলাস ফ্রেডরিক দাস প্রথা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ম্যারিল্যান্ড থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি ম্যাসাচুট থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত দাস বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। পলাতক এই দাসের বক্তৃতা ও লেখালেখি অন্য দাসদের প্রবলভাবে আলোড়িত করে। মার্কিন শেতাঙ্গ সমাজের কাছে বিশ্বাসঘাতক, ঘৃণ্য পলাতক হিসাবে পরিচিত ডগলাস ১৮৪৫ সালে তার আত্মজীবনী ‘ন্যারেটিভ অফ দ্য লাইফ অফ ফ্রেডরিক ডগলাস’ লেখেন, যা বেস্টসেলার হয়। দাসদের বুদ্ধির স্তর নিয়ে শেতাঙ্গরা যে সব কথা প্রচার করেছিল ডগলাসের বুদ্ধিমত্তা, যৌক্তিক বিশ্লেষণ সেগুলো মিথ্যে প্রমাণ করে দেয়। তার দ্বিতীয় বই ‘মাই বন্ডেজ এ- মাই ফ্রিডম’ও দাসদেরকে অণুপ্রাণিত ও আলোড়িত করে। গৃহযুদ্ধের পর তিনি দাস প্রথা বিলোপের জন্য আন্দোলনে জড়িত হন। আমেরিকার ইতিহাসে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচন করার মনোনয়ন পেয়েছিল।


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়