ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৩তম পর্ব

দিলরুবা আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫০, ৩০ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেক্সাসান জীবন থেকে : ১৩তম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দিলরুবা আহমেদ : মানুষের সঙ্গে মানুষের চেহারার মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। চোখ-নাক-মুখ একই ব্যাপার সবার। তারপরও একেকজনের চেহারা একেক ধরনের। এতো মানুষ। কোটি কোটি। অথচ একই ছকের ভেতর কতো শত রকমের তারা। হঠাৎ করে মিল হওয়া কিছুটা অংশ বা সাদৃশ্য আমাদের চমকায়- আরে এ তো দেখতে অমুকের মতো, কি আশ্চর্য? এ রকম একটা ভাব জাগে।

ঘটনাটা ঘটল আমার ক্ষেত্রেও। হঠাৎ করেই একদিন আলাপ হলো এক আমেরিকান বৃদ্ধার সঙ্গে। আমার অফিসেই কাজ করেন তিনি। আশ্চর্য্যরকম মিল তার আমার শাশুড়ির সঙ্গে। তার ওপর চোখ পড়া মাত্রই থমকে গিয়েছিল দুচোখ- এতো মিল হয় কেমন করে! আমার শাশুড়িও ছিলেন অসম্ভব রূপবতী এক মহিলা। এখন রয়েছেন পরলোকে, মনোলোকে। ইহলোকে থাকা আমার এই বৃদ্ধা সহকর্মীর নাম রেবেকা হাইঞ্জ। নামটাও প্রায় আমার দেশীয়। স্বদেশি ভাব আছে একটা। প্রথমদিনে তাকে বললামও তা। তুমি দেখতে আমার মাদার-ইন-ল (শাশুড়ি)-র মতো। তোমার নামটাও কিন্তু এশিয়ান। প্রচুর রেবেকা তুমি খুজে পাবে উপমহাদেশে।

ভদ্রমহিলা এতেই যেন খুব অবাক হলেন। তার ইনোসেন্ট চেহারায় আরো এক ধাপ অপার বিস্ময় যোগ করে বললেন, তাই? জানতাম না তো, কেউ বলেনি কখনো। এতটা বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে এটা জানতে! মহিলার বয়স ৫০।  অবশ্য দেখতে মনে হয় ৬০। আমার শাশুড়ির বয়স ছিল ৬৩। ওইটুকুন বয়স পর্যন্তই উনি যেতে পেরেছিলেন। কেন যে রেবেকাকে বয়সের চেয়ে বেশি বড় দেখায়, জানি না। এদের অবশ্য বয়স লুকানোর অভ্যাস নেই, যা আমাদের রয়েছে। দেখতে লুকায়, বলতে না। দেখতে মনে হয় ছুড়ির দল ঘুরছে, বয়স জানতে গেলে দেখা যাবে ডাবল বয়সের অধিকারী। শুধু আমার এই সদাসর্বদা বিস্মৃত রমণীকে দেখাচ্ছে বয়সের চেয়ে অনেক বড়। বার্ধক্য তাকে ছুয়ে দিয়েছে পুরোপুরি।

গোলাপি রঙের সোনালি চুলের এই কোমল স্বভাবের বৃদ্ধার সঙ্গে প্রায়ই আমার গল্প হয়। তার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে, তাই অযথাই গল্প করি। ভেবেছিলাম অকারণেই তাকে আমার ভালো লাগে। সে-ই একদিন বলল, তোমার মাকে খোঁজো আমার মাঝে তাই ভালো লাগে। আমি আর বলি না মাদার-কে না, মাদার-ইন-ল-কে খুঁজি। তাকে বলা হয় না ভেঙে। কেউ কখনো শাশুড়িকে খুঁজবে না- এটাই চিরাচরিত, স্বতঃসিদ্ধ প্রথা যেন, এর ব্যতিক্রম কিছু নেই। কারণও সম্ভবত একটাই-  এ পৃথিবীতে লায়লা নামের একটি মা-ই এসেছিলেন আমার শাশুড়ি হতে। আমাদের অফিস হচ্ছে গ্রেপভাইন-এ।

রেবেকা থাকে প্রায় ওকলাহোমার কাছাকাছি এক শহরতলিতে। অনেক দূর। ৬০ মাইল স্পিডে গাড়ি চালিয়েও এখানে এসে পৌঁছাতে লাগে সোয়া ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা। প্রথম প্রথম আমি খুব অবাক হতাম। সে মোটেও না। তার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা হচ্ছে, আমেরিকায় কাজ করতে এ রকম বহু জনকে বহু দূরে বহু জায়গায় দুই-তিন ঘণ্টাও ড্রাইভ করে যেতে হয়। প্রমাণও মিলল অনেক। আমাদের অফিসেই আবিষ্কৃত হলো বহু জন, বহু দূর থেকে যাদের আগমন। অবশ্যই নিজেকে আমার অপার সৌভাগ্যের অধিকারী মনে হতে লাগল। আমাকে ড্রাইভ করতে হয় মাত্র ২০ মিনিট। পুরোপুরি ২০ মিনিটও না, আসলে ১৭ মিনিট। আমার স্বদেশি সুগৃহিণী ভাবীসকল করিত রব এতো দূরে যান চাকরি করতে! রেবেকাকে তাদের সবাইকে দেখাতে ইচ্ছা করে। মুখে বললে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, তাই দেখানোর ইচ্ছা। এতো বুড়ো একটা মানুষ প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা করে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ করে আসা-যাওয়া করে। সে তুলনায় আমার দৌড় তো খুবই কম।

যখন রেবেকা বাসায় ফেরে প্রতিদিনই রাত হয়ে যায়। রেবেকা বলে, ওই জায়গাটা একটা প্রায় গ্রামই, গভীর রাতে মনে হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার এক মহাদেশে আছি বুঝি। হাইওয়ে ছেড়ে ভেতরে মেঠোপথে বহু দূর যেতে হয়। জানতে চেয়েছিলাম, কাছে বাসা নাও না কেন? উত্তরে প্রথমে হাসল বিশ্বসুন্দরী। তারপর জানলো, ওটা হচ্ছে তাদের ফার্ম হাউস জাতীয় আবাসস্থল। দীর্ঘদিনের বসতি। ফেলে আসা যায় না। ভেড়া আছে, গরু আছে, শুয়োর আছে। দুধ তোলে, দুধ বেচে। সবজি বোনে।

উইন্ডমিল আছে। পানি তোলে। গ্যাস ভরে রাখে হিটিং এবং কুকিংয়ের জন্য। সেখানকার বিষয়াবলী তদারক করেন তার স্বামী। তিনি একজন সুদক্ষ ফার্মার। সহজ বাংলায় চাষী। তাদের বাসাটাও হচ্ছে প্রাচীন আমলের। কাঠের তৈরি। নিচে চাকাও আছে। তবে সেগুলো এখন আর চলে না। For show only-র জন্য। পুরোপুরিই গ্রামীণ ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু আমার মনে হতে থাকে বড়ই সুখময় আবাস, আরো ভালো লাগে যখন দেখি রেবেকাও ভারি তৃপ্ত তার এ জীবনযাপনে। পাচ একর জায়গা জুড়ে অবাধ বিচরণ। কৃষি জমি তাই ট্যাক্সও কম। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ল্যান্ড বা মেট্রোপলিটান এলাকা হলে খাজনা দিয়েই কুলাতে পারতো না।

আমাকে অবাক করে একদিন আমার দেশের মেয়ের মতোন করে বলে উঠল, খুব সকালে পাখির কিচিরমিচির শুনি। কি যে ভালো লাগে তখন! এই মানুষটাকে আমার তখন ভালো লাগে আরো বেশি। কারণ আমার শাশুড়িও ছিলেন এ রকমই। সকালে উঠে ঘুরতেন তার গোলাপ বাগানে। মাঝে মধ্যে বাগান থেকে তুলে আনতেন ফুল। অতো ভোরে আমার ওঠা হতো না ঘুম থেকে। আজ মনে হয়, আহারে যদি উঠতাম! আমার রুমের সামনের টেবিলে রেখে যেতেন একটা গোলাপ। আমি উঠে যাতে ওটা মাথায় গুজি। দুঃখ করে বলতেন, আজকালকার মেয়েরা খোপা কেন বাঁধে না। আমার হচ্ছে বদঅভ্যাস, সবসময় চুল ছেড়ে রাখার। খোপা করে তাতে ফুল গুজেছি বলে তো কই মনে পড়ে না। বরঞ্চ তার দেওয়া ফুল কানের ওপর গুজে দিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াতাম। উনি মাথা চাপড়ে ফুলের দুর্গতি দেখতেন। আমি জানি মনে মনে উনি এতেও খুশি। আমি বলতাম This is fashion, mother. কেন যেন তাকে আমি প্রায়ই আদর করে mother ডাকতাম। একসময় সত্যিই পরদেশি হয়ে যাবো বলেই হয়তোবা।

পায়ে নুপূর থাকবে, আলতা থাকবে, আর খোপাভরা ফুল- এই ছিল আমার শাশুড়ির চাহিদা। ভাববার প্রয়োজন নেই যে সে একজন গায়ের বধূ। আমার শ্বশুর একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। আমার শাশুড়িও সেই রকম উচুমার্গের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন। বাসায় কাজের লোক ছিল নয়জন। কিন্তু সবকিছুই করতেন নিজের হাতে। নিজের মতো করে। আমি ছিলাম তার সোনার সংসারে অতি আদরে সাজিয়ে রাখা পুতুল। আদরের খেলনা। হয়তোবা তাই আজো রেবেকাকে দেখলে আমি তাকে খুঁজি এই পরবাসে, অন্য সময়ে, ভিন্ন গোত্রে, অচেনা পরিবেশে, অজানা কল্পলোকে।

আমাকে অবাক করে রেবেকা হাইঞ্জ একদিন জানাল, সে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করা মেয়ে। শুনে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। আমি খুব অবাক হই। এই প্রায় থুত্থুরি বুড়ো মানুষটা কমপিউটার সায়েন্সও জানে! ওয়াও! পরে ভাবলাম আমাদের দেশের জন্য নতুন হতে পারে বিষয়টা, কিন্তু এ দেশে তো তা না। যে কেউ যে কোনো সময় পড়া শুরু করতে পারে। শেখার আগ্রহ থাকলে উপায় অজস্র। এই দেশে, দেবী দুর্গার অনেক হাতের মতো শতধারায় বিকশিত হও- এ রকম যেন আশীর্বাদ বইছে। এই যুগের হয়েও তার ছেলে-মেয়েরা কেউ যে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে না বা পড়ল না এ নিয়ে তার অবশ্য কোনো মন খারাপ নেই। যার যা ভালো লাগবে, তাই পড়বে। যেটুকু মেধায় কুলায়, সাধ্যের মাঝে হয়, সেটুকুই সই। ভালোই জীবন দর্শন রেবেকার। পাঁচজন ছেলে-মেয়ে তার।

আমাকে জানাল তাদের মধ্যে দুজন তার বায়োলজিক্যাল, দুইজন Step, একজন adopted child। ভালোই সংসার সাজিয়ে বসে আছে। গল্পে গল্পে বুঝি সে কোনো বিভেদ করে না তার তিন ধরনের ছেলেমেয়ের মধ্যে। আমি তাকে এ কারণে আরো পছন্দ করতে শুরু করি। তাদের পাঁচ একর কৃষিজমি। পাঁচ ছেলে-মেয়ে এক একর করে পেয়ে যাবে তাদের মৃত্যুর পর। তারা স্বামী-স্ত্রীতে ছেলে বা মেয়ে, আপন বা সৎ- এর বিভেদ করছে না সম্পত্তি ভাগাভাগিতেও। পালক সন্তানটিও একই পরিমাণ সম্পদ পাবে। রেবেকার সঙ্গে তার মা-ও থাকেন। মায়ের বয়স বললো ৮০ বছর। সে বলল  কথাটা এভাবে- আমি খুব সৌভাগ্যবতী, আমার মা আমার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন। একটাই শুধু ভাই, আমার বড়, আমাকেই মা পছন্দ করলেন বসবাসের জন্য। আমার ভাবীর আচরণ Bossy (কর্তৃত্বমূলক) ধরনের। মা পছন্দ করেন না। আমি শুনে হেসে উঠি। বিশ্বময় শাশুড়ি-বৌয়ের একই যাতনা। মনে মনে অবশ্যই বলি, আহারে আমার কি ভাগ্য আমার শাশুড়ি তো এ রকম ছিলেন না। রেবেকার সঙ্গে তার ছেলে-মেয়েরা কেউ থাকে না। এ দেশে এ রকমই চলে। এটাই স্বাভাবিক।

তার এক ছেলেকে আমি দেখেছি। সেও এই অফিসে কাজ করে। তার গার্ল ফ্রেন্ডও। থাকে তারা আর্লিংটনে। লিভ টুগেদার করছে। এটাও খুব স্বাভাবিক এখানে। বিয়ে কবে কখন করবে জানে না। রেবেকার তো জানারই কথা নয়। তবে রেবেকা মেয়েটাকে ভালোই পছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাকে তুমি কেন পছন্দ করো?

উত্তরে বলল, সে খুব ভালো মানুষ, আমার ছেলেকে খুশি রাখে। ব্রেন্ডা আশপাশে থাকলেই দেখি আমার জেইসনের চোখে-মুখে খুশির ছটা। Thats enough for me. সব বুড়ির মুখে তৃপ্তির হাসি।

চলবে...



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়