ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ও রোলিংস : ছোটগল্পে অভিন্ন কথক

মোজাফফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাথ ও রোলিংস : ছোটগল্পে অভিন্ন কথক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মারজরি কিনান রোলিংস

|| মোজাফফর হোসেন ||

বাংলা সাহিত্যে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেধা ও গভীর জীবনদর্শনের যে পূর্ণতা ঘটেছিল তা তাঁর ছোটগল্পে এসে অনেকখানি উপচে পড়েছে। অন্যদিকে গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন আমেরিকান গল্পকার মারজরি কিনান রোলিংস (Marjorie Kinnan Rawlings, ১৮৯৬-১৯৫৩) সাহিত্যের সব শাখায় পদচারণা না করলেও গল্প ও উপন্যাস (বিশেষভাবে The Yearling) লিখে বিশ্বসাহিত্যে বেশ সম্মানের সাথে ঠাঁই পেয়েছেন। বহুদিক থেকে অমিল থাকা সত্ত্বেও মারজরি কিনান রোলিংসয়ের ছোটগল্প ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ (A Mother in Mannville) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ উভয়ের মধ্যে এনে দিয়েছে চিন্তা, চেতনা ও অনুভবের এক অসম্ভব ঐক্য।

খ.
রোলিংস বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে কম পঠিত হলেও নিজ দেশে ছোটগল্পের এক দক্ষ কারিগর হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর গল্পে মানুষের সঙ্গে পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক শৈল্পিকভাবে উঠে এসেছে। তিনি প্রকৃতির মাঝে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন; তাই তো প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে ফ্লোরিডা থেকে ছুটে যেতেন দক্ষিণ ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের নিশ্চুপ, ছন্দময় প্রকৃতির মাঝে। অনেকে মনে করেন, লেখক এখানে জেরি নামের এক অনাথ শিশুর সাক্ষাৎ পান, তার জন্যে তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেন। ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে একজন শিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকেই লেখক জেরির আবেগ-অনুভূতির সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটান।

অন্যদিকে জমিদারি তদারকি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান, পরিচিত হন বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও মানুষের সাথে; যার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর প্রতিটি গল্পে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিছক মনগড়া কাহিনি নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পেয়েছেন এই গল্পের প্লট। যে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি নিজে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্ট মাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।’ অন্যত্র লিখেছিলেন, ‘আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখনও ঘটেনি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।’ একই মনোভাব তাঁর আরো একটি উক্তিতে ফুটে ওঠে, ‘আমি একটা কথা বুঝতে পারি নে, আমার গল্পগুলোকে কেন গীতিধর্মী বলা হয়। এগুলো নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তা তো করি নে আমি।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি লেখেন ১৮৯১ সালে আর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটি লেখা হয় ১৯৩৬ সালে। দুটি গল্পে পরিবেশ, কাল ও পাত্র ভিন্ন হলেও পরিসীমা, প্রকাশভঙ্গী, ঘটনার প্রবাহ, চরিত্রের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বোঝাপড়া, জীবনদর্শন এবং সর্বোপরি পাঠকের বেদনা ও আত্মপোলব্ধিতে আশ্চর্যরকমের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গল্প দুটি শুরু হয় দুটি চরিত্রের নতুন পরিবেশে আগমনের মধ্য দিয়ে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টার কলকাতার ছেলে, নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে এসে তাকে থাকতে হয়। এখানে তার সঙ্গী বলতে পিতৃ-মাতৃহীনা অনাথ বালিকা রতন ছাড়া আর বিশেষ কেউ হয়ে ওঠে না।

‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখক ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে কয়েকটি লেখা শেষ করার উদ্দেশ্যে ছুটি কাটাতে যান; যেখানে জীবনের আনাগোনা খুবই কম, কান পাতলে শোনা যায় প্রকৃতির ফিসফাস। এখানে এসে লেখক জেরি নামক এক বালকের সঙ্গে পরিচিত হন; জেরি হয়ে ওঠে লেখকের খুব কাছের একজন।

গ.
দুটি গল্পে চারপাশের চিত্র ও চরিত্রকে স্বল্প পরিসর নিয়ে রিয়েলিস্ট আর্টিস্টদের মতো করে স্পষ্টভাবে অঙ্কন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে নিয়ামক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে প্রকৃতির মাঝে ডুব দিয়ে অনুভব করতে হয় গল্পের প্রধান দুই চরিত্র পোস্টমাস্টার ও রতনের অনুভূতি। গল্পের কাহিনির শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে। পোস্টমাস্টার শহরের ছেলে তাই নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে এখানে থাকতে হয়। অন্ধকার আটচালার মধ্যে তার অফিস; দূরে একটি পানাপুকুর আছে যার চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব না ঘটলেও পোস্টমাস্টারের অবস্থা ডাঙায় তোলা মাছের মতো। গ্রামের মানুষজনের ভদ্রসমাজের আচার-রীতি জানা নেই, এছাড়াও নিকটে নীলকুঠি থাকায় অনুমান করা যেতে পারে, গ্রামে ইংরেজদের শাসন ও শোষণ দুটোই বিদ্যমান। তাইতো পোস্টমাস্টারের সাথে বাইরের জগতের কোনো যোগসূত্র থাকে না। হাতে কাজ না থাকলে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন, তাতে প্রকৃতির স্তবগান রচিত হয় ঠিকই- ‘কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলো কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।’

সন্ধ্যায় যখন গ্রামের গোয়ালঘর থেকে ধূপের ধোঁয়া রাজ্যভ্রমণে বের হয়, ঝোপ ঝাড়ে ঝিল্লি ডাকে, নেশাখোর বাউলের দল উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠে; আবার যখন- বর্ষায় ‘মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস’ বইতে থাকে এবং ভেজা প্রকৃতির গন্ধে মাতাল হয়ে একটি পাখি তার ‘একটানা সুরের নালিশ...করুণ সুরে বার বার আবৃত্তি’ করে তখন পোস্টমাস্টারের মন প্রিয়জনদের জন্য আনচান করে ওঠে। আবার পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে, ‘আর আসব না’। তখন তাদের গভীর নীরবতা ভেঙে, ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করে একটি মাটির সরার উপর টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়তে থাকে। এ যেন প্রকৃতির সাথে ব্যথার আত্মার আত্মীয়তা! তাইতো পোস্টমাস্টার যখন রতনকে রেখে নৌকায় ওঠে- বর্ষায় প্লাবিত জলরাশি পোস্টমাস্টারের চোখের অশ্রুর মতো ছলছল করতে থাকে, পোস্টমাস্টারকে জানিয়ে দেয় রতনকে সঙ্গে আনার কথা, একইসঙ্গে পালের হাওয়া ও অনুকূল স্রোতধারা নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারের বেদনাহত হৃদয়ে জানান দেয়- বিচ্ছেদই জীবনের চিরন্তন সত্য।

দুটি গল্পেই, বিদায়ী যাত্রায় প্রকৃতি পোস্টমাস্টার ও গল্পকথকের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পোস্টমাস্টারের নৌকা অনুকূল স্রোত ও পালের হাওয়ায় দ্রুততার সাথে গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয়। ওদিকে, ‘দ্য মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে, লেখক গাড়িতে চড়ে অনুধাবন করেন- ‘পশ্চিম আকাশ বেয়ে সূর্য নেমে যাচ্ছে। রাত নামার আগেই পাহাড় থেকে বের হয়ে যেতে পারলে ভালই হবে।’

‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে উপমা (Simile) ও রূপকের (Mataphor) মাধ্যমে। গল্পের শুরুতে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের চিত্র আঁকা হয়েছে এভাবে- ‘শীতকালে মাঝে মধ্যে এত তুষারপাত হয় যে সেটি দ্বীপপুঞ্জের পাদদেশে অবস্থিত গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দ্বীপের চূড়াগুলো কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়। তুষার উপত্যকা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসে। এবং এত তীক্ষ্মভাবে বাতাস বয় যে, এতিমখানা থেকে যে সকল ছেলে দিনে দুইবার দুধ নিয়ে বেবি কটেজে যায় তাদের হাতের আঙুলগুলো শীতে কাটার মতো বিঁধে।’ লেখক জেরির শৈল্পিকভাবে কাঠ কাটার শব্দ তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘শব্দটা আর মোটেও বিঘ্ন করার মতো মনে হলো না, মনে হচ্ছিল একটানা বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনছি।’

লেখক জেরির প্রকৃতি বর্ণনাতেও রূপক ও উপমার আশ্রয় নিয়েছেন-
‘তার চুলগুলো ছিল ভুট্টার খোসার মতো। আর চোখ- তীক্ষ্ম, বৃষ্টি জমে থাকা পাহাড়ি মেঘের মতো, ধূসর, আড়ালে নীল আকাশের লুকোচুরি খেলা।’

এবং ‘একটা উজ্জ্বল আভা তার ভেতর থেকে বের হয়ে এলো, যেন পড়ন্ত সূর্য যে সম্মান জানিয়ে পাহাড় ছুঁয়ে যায়, সেই স্পর্শটা ওকে দিয়ে গেল।... চোখের পর্দাটা সরে যেত, যে কারণে আমি তার গভীরে প্রবেশ করে তার কৃতজ্ঞতাবোধটুকু, তার চরিত্রের শক্ত খোলসের ভেতর নরম আঁশটা, দেখে আসতে পারতাম।’ [ অনুবাদ: বর্তমান আলোচক।] এমনিভাবে লেখক রোলিংস ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে অতি দক্ষতার সাথে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ঘ.
অনাথশিশু রতন ও জেরি- এই দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্প দুটি আবর্তিত হয়। রতন নিজের সম্পর্কে খুব বেশি বলে না, চাইলেও বাবার সন্ধ্যাবেলার ঘরে ফেরার দৃশ্য ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মিছামিছি মাছ ধরার খেলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে না তার; তাইতো পোস্টমাস্টারের পারিবারিক গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে এবং আলাপচারিতায় চির পরিচিতের ন্যায় পোস্টমাস্টারের পরিবারের সকলকে ‘মা দিদি দাদা’ বলেই সম্বোধন করে। রতন আর পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক তখন আর কাজের মেয়ে ও মালিকের সম্পর্ক থাকে না; বয়সের পার্থক্য ও শ্রেণিবৈষম্য ঘুচে গড়ে ওঠে মানবিক সম্পর্ক। লেখক ও জেরির মধ্যেও অভিন্ন সমীকরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবলমাত্র গল্পকথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ (3rd person narrative) হওয়াই রতনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তেমন করে ফুটে ওঠে না যেমন করে ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে জেরির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে মারজরি কিনান রোলিংস নিজেই অন্যতম প্রধান চরিত্র (1st person narrative), তাই জেরিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন তিনি- গল্পটি অনেকাংশে হয়ে ওঠে চরিত্রপ্রধান।

জেরির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে যখন জেরি লেখকের দ্বিধা দূর করতে বলে- ‘Size don’t matter chopping wood.’ এবং জেরির সততা ও স্বাধীনচেতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন হাতলভাঙা কুড়াল দেখিয়ে লেখককে বলে- ‘I’ll pay for it, I broke it. I brought the axe down careless.’ তখন লেখকের ব্যবহৃত ‘Integrity’ শব্দটি জেরির ক্ষেত্রে যথার্থ প্রয়োগ বলে মনে হয়।

ঙ.
শিশুদের সাথে পরিবারের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও অনিবার্য। মা-বাবা ও ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাদের শিরা-উপশিরায় বয়ে আনে অপার আনন্দ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও রোলিংস তাঁদের এই দুটি গল্পের মূল চরিত্র হিসেবে তুলে নিয়েছেন অনাথ শিশু রতন ও জেরিকে। গল্পে দুজনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে-

‘মেয়েটির নাম রতন বয়স বারো-তেরো।’(পোস্টমাস্টার) এবং ‘his name was Jerry; he was about twelve years old and he had been at the orphanage since he was four.’ (এ মাদার ইন ম্যানভিল)।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভালোবাসার কাঙাল হওয়ার দরুন রতন ও জেরি খুব সহজে তাদের মনিব পোস্টমাস্টার ও লেখককে আপন করে নিয়েছে।
রতন তার দাদাবাবু অর্থাৎ পোস্টমাস্টারের পরিবারের গল্প শুনে নিজেকে সেই পরিবারের একজন হিসেবে ভাবতে থাকে। পোস্টমাস্টারের সেবায় সে তার বালিকা হৃদয় উজাড় করে দেয়। রান্না করা, গোসলের পানি আনা, তামাক সাজার কাজগুলো এত মনোযোগ ও ভালোলাগার সাথে করে যে কাজগুলো করে তার এতটুকু ক্লান্তিবোধ আসে না। পোস্টমাস্টার রতনকে পড়ালে রতন বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে; রতন পড়াশোনার মর্ম উপলব্ধি না করলেও দাদার আগ্রহে যাতে কমতি না ঘটে সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হলে রতন তার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেয়। বালিকা রতন আর তখন বালিকা থাকে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে, ‘সেই মুহূর্তে সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল’। রতন ডাক্তার ডেকে আনে, যথাসময়ে ওষুধ খাওয়ায়, সারারাত শিয়রে জেগে থাকে আর থেকে থেকে জানতে চায়, ‘হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি?’ রতন দাদাবাবুর সান্নিধ্য পাবার জন্য ঘরের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সুযোগ পেলেই একজন যথার্থ শ্রোতার বেশে দাদাবাবুর হাঁটুর কাছে বসে পড়ে। এই সখ্যর সূত্র ধরে গল্পের শেষের দিকে পোস্টমাস্টার চলে যেতে চাইলে রতন একবুক আশা নিয়ে পোস্টমাস্টারের সঙ্গী হবার আশাবাদ ব্যক্ত করে।

একইভাবে, জেরি এবং লেখকের সম্পর্কও তথাকথিত মনিব ও কাজের ছেলের সম্পর্ক ভেঙে নতুন এক সম্পর্কের জন্ম দেয়। কাঠচেরাই করার জন্য জেরিকে ঠিক করা হলেও সে সার্বিকভাবে লেখক ও তাঁর কুকুরটির খোঁজখবর রাখে। লেখক যাতে বৃষ্টির মৌসুমে শুকনো কাঠ পায় সে জন্যে কিছু কাঠ গর্তে সরিয়ে রাখে, এছাড়াও লেখকের হাঁটার পথে একটি পাথর পড়ে থাকলে জেরি গর্ত করে সেঁটে দেয়, যে কাজগুলোকে লেখক বলেছেন ‘...unnecessary things…done only by the great of heart.’ সময়ের পরিক্রমায় জেরি ও লেখক পরস্পরের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। জেরিও রতনের মতন লেখকের সান্নিধ্য পাবার জন্য কেবিনের বাইরে ঘোরাফেরা করে এবং সুযোগ পেলেই লেখকের পাশে বসে পড়ে। গল্পে বেশ কয়েকবার এই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে–

“He made simple excuses to come and sit with.”

“He sat by fire with me.”

“He came everyday…and stayed to talk.”

“He would lie on the floor…and wait quietly for me.”

একরাতে জেরি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে লেখককে বলে, ‘তুমি দেখতে খানিকটা আমার মার মতোই’, যে ম্যানভিলে বাস করে এবং প্রতি বড়দিন ও জন্মদিনে তাকে উপহার পাঠায়। জেরি গর্ব নিয়ে বলে, গত বড়দিনের আগেরবার তার মা তাকে একজোড়া জুতা উপহার দিয়েছে। আরো জানায়, লেখকের দেওয়া এক ডলার টাকা দিয়ে সে তার মাকে একজোড়া হাত মোজা কিনে দেবে। গল্পের শেষে লেখকের প্রতি জেরির ভালোবাসা আরো তীব্রভাবে ধরা দেয় যখন মিস ক্লার্ক বলেন, ‘He has no mother. He has no skates.’ জেরি লেখককে ম্যানভিলে বসবাসরত তার মায়ের গল্প শোনায়, প্রকৃতপক্ষে যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। জেরির এই মিথ্যে বলার কারণ হলো, সে লেখকের মধ্যে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। জেরি লেখকের মাতৃত্ব ছুঁতে চায় সর্বাঙ্গে। জেরি লেখক ও তাঁর পোষা প্রাণীটিকে জীবনের একটি অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। লেখককে সেটা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টাও করে।

একইভাবে, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতন তার নারীসুলভ আচরণ দিয়ে পোস্টমাস্টারের হৃদয়ে পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিতে চায়। এখানে রতন আর জেরির প্রতি পোস্টমাস্টার ও লেখকের ভালোবাসা দায়িত্ববোধ ও করুণা থেকে নিঃসৃত কিন্তু তাঁদের প্রতি রতন আর জেরির যে ভালোবাসা তাতে কোন খাদ নেই; অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এ ভালোবাসার স্রোতধারা প্রবাহিত হয়- সমাজের চিরন্তন কোনো নিয়মের ছাঁচে পিষ্ট হয়ে নয়।

চ.
‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের সমাপ্তির দিকে এসে পাঠকদের হৃদয়ে একই ব্যথার সুর অনুরণিত হয়। পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে, ‘রতন, কালই আমি যাচ্ছি।’ এবং লেখিকা জেরিকে, ‘I am leaving tomorrow’। রতন আর জেরি যেন বাক হারিয়ে প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নির্লিপ্তভাবে। নিজেদের ভেতর আর নিজেরা থাকে না- নিমিষে পৃথিবীর সবখানে কি যেন হাতড়ে ফেরে! রতন পোস্টমাস্টারের সাথে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে বলে, ‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’ কিন্তু জেরি আর কোনো কথাই বলে না। সে হয়ত বুঝতে পেরেছিল পোস্টমাস্টারের মতো লেখকও বলবেন, ‘সে কী করে হবে।”

পোস্টমাস্টার চলে যাবার সময় বলেন, ‘রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবে তাঁকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।’ এবং ‘রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।’ পোস্টমাস্টারের এই কথাগুলো রতনের গায়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতন বিঁধে। বালিকা রতন আর আবেগ দমিয়ে রাখতে পারে না; পোস্টমাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।’

একইভাবে, লেখিকার অনুভূতি—‘You have been my good friend, Jerry. I shall often miss you. Pat will miss you too.’ এবং ‘but here’s some money I’d like to leave with you to buy things for him…’ জেরির কাছে আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে। সে দুপুরের খাবার না খেয়ে সবার আড়াল হয়ে যায়।

বিদায়ী মুহূর্তে পোস্টমাস্টারের সাথে রতনের এবং লেখকের সাথে জেরির আর দেখা হয় না। নৌকা ছাড়লে পোস্টমাস্টার রতনের জন্য গভীর ব্যথা অনুভব করেন; তার ইচ্ছা করে- ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।’ কিন্তু ততক্ষণে সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারকে আত্ম-সান্ত্বনার নৈরাশ্যবাদী দর্শন উপলব্ধি করান- ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’ সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে, ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখিকা জেরির শেষ দেখা না পেয়ে আত্ম-সান্ত্বনার দর্শন আওড়ান- “I was almost relieved for I knew I should never see him again, and it would be easier not to say good-bye to him”. কিন্তু রতন আর জেরি আত্ম-সান্ত্বনার কোনো উপলক্ষ দাঁড় করাতে পারে না। আত্মসমর্পণ করে মানবজীবনের সহজ ও সাধারণ মূর্খতার কাছে- সেটি হলো মিথ্যে আশা- রতন অফিসকক্ষের চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে তার ‘দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে’ এই প্রত্যাশা নিয়ে। অন্যদিকে জেরি কতদিন লেখকের কেবিনের চারপাশে আশায় বুক বেঁধে ছুটে গেছে কে জানে!

ছ.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে কলকাতার উলাপুর গ্রামে ভরা বর্ষার আবহে যে বারো বর্ষীয়ান অনাথা বালিকার স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস রচনা করেছেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মারজরি কিনান রোলিংস- এর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে অসহনীয় শীতের মাঝে বসবাসরত আরেক বারো বর্ষীয়ান অনাথ বালক জেরির মধ্য দিয়ে। দুটি গল্প ভিন্ন দুটি আবহ ও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠলেও বেশ কয়েকটি দিক থেকে অভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও রোলিংস তাঁদের গল্পের উপজীব্য হিসেবে দুটি বারো বছর বয়সের অনাথ শিশুকে বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ য়ুংয়ের (Jung) ‘ইলেক্টা কমপ্লেক্স’ (Electra Complex) ও রোলিংস ফ্রয়েডের (Freud) ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ (Oedipus Complex)-কে চরিত্র চয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের প্রধান চরিত্র পুরুষ হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ অন্য একটি প্রধান চরিত্র হিসেবে রতন নামের একজন বালিকাকে দাঁড় করিয়েছেন। একইভাবে, রোলিংস তাঁর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে দুটি বিপরীত লিঙ্গের সহাবস্থান দেখান: নারী লেখক ও জেরি। ছেলেরা মাকে বেশি ভালোবাসে, মেয়েরা বাবাকে- প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম এটাই। তাইতো জেরি খুব সহজেই নারী লেখককে মায়ের স্থানে ভাবতে পারে, রতন পোস্টমাস্টারকে দাদা ডেকে আপন করে নিতে পারে নিমিষে। ভালোবাসার দুর্বোধ্য এই জালে জড়িয়ে পড়েন লেখক ও পোস্টমাস্টারও।

রবীন্দ্রনাথ ও রোলিংস গল্পের শিশুচরিত্র রতন ও জেরির জেন্ডার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। রতনের মাতৃসুলভ আচরণ ও জেরির কাঠ কাটার সামর্থ তাদের ভেতরের নারী ও পুরুষ সত্তার প্রকাশ ঘটায়। রতনের সুপ্ত নারীসত্তা যেমন পোস্টমাস্টারকে কাছে টেনে নেয়, তেমনি জেরির ভেতরের সুপ্ত পুরুষত্ব নারী লেখককে আপন করে নিতে সাহায্য করে।

দুটি গল্পেই রতন ও জেরি তাদের একাকীত্ব ঘুঁচিয়ে পোস্টমাস্টার ও লেখককে অবলম্বন করে নতুন জীবনের সন্ধান করতে থাকে। কিন্তু পোস্টমাস্টার ও লেখক তা পারেন না। তারা জগতের নিয়মের কাছে অপারগতা প্রকাশ করেন। যে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের সেই অমোঘ বাণী- লেট দেয়ার বি লাইট, সো দেয়ার ওয়াজ লাইট- কথাটি আরোপ করলেন ব্যক্তির ওপরে- আমি ফুলকে বললাম সুন্দর, সুন্দর হলো সে, এখানে সেই রবীন্দ্রনাথই দাঁড় করালেন অস্তিত্ববিরোধী (anti-existentialist) পোস্টমাস্টারকে। রোলিংসও ব্যর্থ হলেন সিদ্ধান্ত নিতে। এখানেই অবুঝ দুটি শিশু রতন ও জেরির কাছে পরাজয় ঘটলো গভীর জীবনবোধসম্পন্ন পোস্টমাস্টার ও লেখকের। বাস্তবতার দোহাই দিয়ে মানবতার পরাজয় ঘটলো জীবনবাদী দুই লেখকের গল্পেই।

পোস্টমাস্টারের এই পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ঔপনিবেশিক চেতনা। কেননা তার যে অস্তিত্ব সেটা ছিল সর্বাংশে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার ভেতর বিলীয়মান। যে কারণে রতনের মতো মানবিক সম্পর্কের বোধ তার ছিল না। রতন তার সঙ্গে যেতে চাইলে তিনি এই চাওয়ার কোনো হেতু খুঁজে পান না। পরিবর্তে টাকা দিতে চান। সবকিছু মাপার মাণদণ্ড হলো অর্থ, এ জ্ঞান পোস্টমাস্টারের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার কাছ থেকে রপ্ত। নামহীন এই পোস্টমাস্টার কলকাতায় ফিরে যেতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন; অথচ তিনি গ্রাম্য প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা দেখিয়ে কাব্যচর্চা করেন- এমনই স্ববিরোধী চেতনা তিনি বহন করেন মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে রোলিংসও অবচেতনে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার বাহক। তিনি জীবন নিয়ে লিখবেন বলে জীবনের কাছাকাছি গেলেন, লেখা শেষ হতেই সেই জীবনকে কোনো তোয়াক্কা না করেই আবার নিজের ভোগবাদী জীবনের মোহে শহরে ফিরে এলেন। দুটি গল্পেই দুই জীবনবাদী লেখক তাদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে নিজেরাই উপহাস করলেন। ব্যঙ্গ করলেন শিল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি।



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়