ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সাংবাদিকতায় ‘মওলানা আকরম খাঁ’ পুরস্কার চালু হোক

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাংবাদিকতায় ‘মওলানা আকরম খাঁ’ পুরস্কার চালু হোক

হাসান মাহামুদ : চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা সাধারণ জনগণ বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়েই পৃথিবীতে সংবাদ মাধ্যমের আবির্ভাব, যার মুখ্য উদ্দেশ্য সংবাদ প্রচার। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে গণমানুষের আশা আকাঙ্থার প্রতিফলন ঘটাতে শতাব্দিব্যাপী ‘সংবাদপত্র’ তথা ‘সংবাদ মাধ্যম’- এর প্রতিটি শাখা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান পৃথিবীতে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে সংবাদপত্র শিল্প অর্থাৎ সংবাদ মাধ্যমের চেহারা ও চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ভার্সন থেকে এসেছে ইলেকট্রনিক মাধ্যম, অনলাইন গণমাধ্যম। পরিবর্তন এসেছে পরিচালনা ও মালিকানায়ও।

সংবাদপত্রের মালিকানা কিছুকাল পূর্বেও মিডিয়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজপতি কিংবা রাজনৈতিক দল ও নেতাদের হাতে থাকত। কিন্তু বর্তমানকালে মিডিয়ার সব ধরনের মাধ্যমই বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের হাতে। ফলে সাংবাদিকতায় সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পাশাপাশি বাণিজ্যিকীকরণের প্রভাব বেড়েছে। এতে বাংলাদেশেও সাংবাদিকতা ও সংবাদ মাধ্যম নানামুখী কর্মতৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। বলা চলে, যুগেরও চাহিদা এসব। এখন মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করা এবং পরিচালনা করা অনেকটাই সহজ হয়ে পড়েছে পারিপার্শ্বিকতার কারণে। কিন্তু সংবাদপত্র শুরুর গল্প এতোটা সহজ ছিল না।

ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭৮০ সালে ইংরেজদের প্রচেষ্টায় সর্বপ্রথম ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ হয়। প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসকরা রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে রাজ্যের যাবতীয় খবর সংগ্রহ করে তা রাজদরবারে পেশ করতেন। এর ফলে রাজ্যের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো সংগৃহীত খবর তথা তথ্যের ভিত্তিতে। মুঘল আমলে ওয়াকিয়া নবিশের মাধ্যমে শাসনকার্যে নিউজ লেটার, রাজকীয় বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য লিখিত তথ্য বিভিন্ন প্রশাসনিক জেলার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ রাজদরবারে সরবরাহ করা হতো। ওই সময় শাসকরা তাদের সামগ্রিক স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় মুদ্রণ ব্যবসায়ী জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৮০ সালে দুই পাতার সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। পরবর্তী ছয় বছরে কলকাতায় আরো চারটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো- ক্যালকাটা গেজেট, বেঙ্গল জার্নাল, ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন অব ক্যালকাটা অ্যামিউজমেন্ট এবং ক্যালকাটা ক্রনিকল।

ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের সঙ্গে সংবাদ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের বিরোধ ঘটলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। এই প্রক্রিয়ার ফলে জেমস অগাস্টাস হিকির ছাপাখানা ১৭৮২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসন কর্তৃক জব্দ করে বিক্রি করা হয় এবং হিকি এতে সর্বস্বান্ত হন। পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল জার্নাল, ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড, ক্যালকাটা জার্নাল ও আরো কয়েকটি সংবাদপত্রের ওপর কোম্পানি প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সংবাদ মাধ্যম তার বিকাশমান ধারায় বাধাগ্রস্ত হয়। ১৮১৮ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের হাত ধরে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র দিকদর্শন প্রকাশিত হয়। দিকদর্শন প্রকাশের মাস খানেক পর প্রকাশ হয় জয় গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় সমাচার দর্পণ নামে আরেকটি বাংলা পত্রিকা। ১৮১৮ সাল থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত কলকাতাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও বাঙালিদের কাছে তা বিশেষ সমাদৃত হয়ে উঠে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩১ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর এক অনন্য ধারার সৃষ্টি করে। তখন থেকে সংবাদ প্রভাকরকে অবলম্বন করে শিক্ষিত পাঠক সমাজের মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস দেখা দেয়। তাতে গদ্যরীতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে এবং নব্য কিছু লেখকেরও আবির্ভাব ঘটে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তীকালে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে সংবাদপত্র বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে সুস্পষ্ট চেতনাবোধ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত ভূ-খণ্ড তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের একটি অনুন্নত এলাকা। যেখানে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক আর মুদ্রণ ব্যবস্থার সুযোগ একেবারেই ছিলনা। তারপরও ১৮৪৭ সালে রংপুর জেলা শহর থেকে বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসেবে ‘রংপুর বার্তাবহ’ তৎকালীন জামিদার কালীচরণ রায় চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় ও গুরুচরণ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

তবে এই অঞ্চলে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মওলানা আকরম খাঁর আগে এবং তার সমসাময়িককালে উল্লেখযোগ্য অনেক মুসলমান খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিক মাসিক, ত্রৈমাসিক, দৈনিক ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মওলানা আকরম খাঁ প্রথম ব্যক্তি, যিনি তার প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার একটা দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনা করেন।

তার প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদ’ ও মাসিক ‘মোহাম্মদী’ ব্রিটিশ আমলে আত্মপ্রকাশ করে দীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও কিছুকাল এই পত্রিকা দু’টির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। মুসলিম বাংলার নবজাগরণে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে, সামাজিক সংস্কারে, লেখক সৃষ্টিতে ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে বলা হয় উপমহাদেশের মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার অগ্রনায়ক। মুসলিম সমাজের জাগরণের লক্ষ্যে ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে নিজের সম্পাদনায় ‘দৈনিক আজাদ’ প্রকাশ করেন। সেই সময় এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল এবং দৈনিক আজাদ ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র। তখনও আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কোনো আন্দোলনও শুরু হয়নি। কিন্তু আকরম খাঁ দৈনিক আজাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার একটি বিরাট অর্জন ও স্বীকৃতি এনে দেন। পরবর্তী সময়ে এই পত্রিকা ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও তখন মুসলিম লীগের সমর্থন যোগাতে এই বাংলা পত্রিকাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক, ধর্মশাস্ত্রবিদ ও সুপণ্ডিত। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা-আন্দোলনের অন্যতম নেতা, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও মুসলিম লীগের নেতা। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মওলানা আকরম খাঁ ‘মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার জনক’ এবং ‘বাংলা মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত’ হিসেবে খ্যাত। তাকে ‘বাংলা সাংবাদিকতার দিকপাল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মওলানা আকরম খাঁ শক্তিশালি গদ্যলেখক হিসেবেও খ্যাতিমান। বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণ তথা রেনেসাঁর তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রচনা একজন চিন্তাশীল ও মননশীল লেখক এবং শক্তিমান গদ্যশিল্পীর পরিচয় বহন করে। বিভিন্ন সময়ে তার একাধিক প্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা পাঠক শ্রেণি ও বোদ্ধামহলে বেশ প্রশংসিত ও খ্যাত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- সমস্যা ও সমাধান, আমপারার বাংলা অনুবাদ, মোস্তফা-চরিত, মোস্তফা-চরিতের বৈশিষ্ট্য, বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম, মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস, তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খণ্ড, অনুবাদ), টীকা-ভাষ্য (অনুবাদ) প্রভৃতি। মৌলিক রচনা ছাড়াও তার বাংলায় অনুদিত গ্রন্থগুলো প্রমাণ করে তিনি একজন দক্ষ অনুবাদক। তিনি মুসলিম বাংলা সাহিত্যের দিকপাল হিসেবেও খ্যাত। তিনি ছিলেন মাতৃভাষা প্রেমিক, আজীবন এই ভাষার সেবক। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা-আন্দোলনে ছিল তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ।

‘বাংলা সাংবাদিকতার দিকপাল মওলানা আকরম খাঁকে অনেকেই নামে চেনেন না। অনেকেই আছেন, যারা তার নাম জানলেও তার অবদান সর্ম্পকে পুরোপুরি অবগত নন। অথচ তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি জাতীয় প্রেরণার উৎস হতে পারেন। তাকে নিয়ে নিয়মিত আলোচনার উপলক্ষ্য তৈরি করা উচিত। তাহলে তিনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেন।

এক্ষেত্রে এই প্রবাদ প্রতিম সাংবাদিকের নামে জাতীয়ভাবে একটি পদক বা পুরস্কার চালু করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের অবদানের জন্য প্রতিবছর এই পদক বা পুরস্কার দেয়া হবে। তাহলে অন্তত জাতীয়ভাবে মওলানা আকরম খাঁ চর্চা হতে পারে।
 

মওলানা আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের আজকের দিনে (৭ জুন) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মওলানা আকরাম খাঁর জীবনের শেষের দিনগুলো কেটেছে লেখালেখি, সাহিত্য চর্চা ও ধর্ম-কর্মতে ঢাকেশ্বরী রোডের বাসায়। তিনি ১৯৬৯ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকার বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জুন ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়