ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কবি জয় গোস্বামীর সাক্ষাৎকার

সাকিরা পারভীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৭, ২৫ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবি জয় গোস্বামীর সাক্ষাৎকার

রানাঘাটের পুরনো বাড়িতে মাত্র তেরো বছর বয়সে লিখেছিলেন প্রথম কবিতা ‘ফ্যান’। তাঁর কলম আজো প্রগাঢ় দাম্ভিকতায় চলমান। বাংলা ভাষার আধুনিক কবি জয় গোস্বামী কবিতাকে মিলিয়েছেন জনারণ্যে। তাঁর কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ। ঔপন্যাসিক হিসেবেও পেয়েছেন লেখকখ্যাতি। জীবনানন্দ-উত্তর অন্যতম এই কবির সাথে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা :

সাকিরা পারভীন : আপনি কবিতার মানুষ। আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা কী?
জয় গোস্বামী : আমি বলতে পারবো না। অনেকেই জিজ্ঞাসা করে তো, সে জন্যই বলছি। একটা আর্ট ফর্ম। আমার লেখা থেকে নাটক হয়েছে,  গান হয়েছে। আপনি যদি এখন শীতের দেশে যান তাহলে আপনার পোশাক পরিচ্ছদ বদলে যাবে, আপনার খাদ্যাভ্যাস বদলে যাবে; আপনার দিন রাত্রীর যে ঘড়ি- বদলে যাবে। অথচ মানুষটা কিন্তু আপনি একরকমই আছেন। সেই সময় আমি সাকিরা পারভীনকে দেখবো হয়তো একটা ফারের কোট পরা। মাথায় ক্যাপ দেওয়া, পায়ে অসম্ভব বড় জুতো।

এরপর আপনাকে দেখে প্রাথমিক অবস্থায় আমার মনে হবে যে, আমি সাকিরাকে চিনতে পারছি না। এই যে একটা শিল্প যখন আর একটা শিল্প মাধ্যমের দিকে যায় তখন তার নিজের কিছু কিছু উপাদান তাকে ছেড়ে দিতে হয়। আবার ওখান থেকে কিছু উপাদান তাকে গ্রহণ করতে হয়। আমরা একটা উপন্যাস ভেবে যেভাবে পড়বো ঠিক সেভাবে আমরা যখন একটা ফিল্ম দেখছি তখন সেটাকে একটা ফিল্ম হিসেবেই দেখবো। অন্তত তাই হওয়া উচিত।কবিতা কি? আমি এক কথায় উত্তর দিতে পারবো না। আমি একটা ছবি দেখেছিলাম; কার ছবি, মনে করতে পারছি না। যাই হোক, ছবিতে একটা বিষয় ছিল যেটা আমার ‘মেঘ বালিকায়’ আছে।

‘আকাশের সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি’ ... এই চিত্রকল্পটা। ধরুন একটা মেয়ের কাছে একটা ছেলে যাচ্ছে, কারণ মেয়েটির সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়েছে। সে যখন গেল তখন দেখলো যে জায়গায় মেয়েটি ছিল সেখানে সে নেই। জিজ্ঞেস করে জানলো, সে স্টেশনে চলে গেছে। ছেলেটি পাগলের মতো সাইকেল চালিয়ে ওই স্টেশনে গেল। স্টেশনে সে যখন ঢুকছে তখন মেয়েটিও ঢুকছে। আমার কাছে এই মুহূর্তের দৃশ্যটাই কবিতা।

সাকিরা পারভীন : কেমন করে কবি হলেন?
জয় গোস্বামী : সে তো আমি জানি না। মাথায় কোনো লাইন আসলে লিখে রাখতাম। তারপর কিছু কিছু ছাপা হতে লাগল। তারপরে আস্তে আস্তে এখন... এই আর কি।  মাঝে মাঝে কতগুলো লাইন আসতো যেমন যে কথাগুলো কাউকে বলতে পারছি না। অথচ নিজেও যে সবটা বুঝতে পারছি তা নয়। মাথার ভেতর কত কথা আসছে, সেটা গদ্য কথাও হতে পারে। সেটা ডায়েরিতে বা খাতায় লিখে রাখতাম। লিখতে লিখতে একসময় কবিতার চেহারা নিল। তারপর একসময় মনে হলো, লোভ হলো যে, এটা ছাপালে কেমন হয়! বা আমার লেখা ছাপা হয় কিনা! এই ভেবে আমি পোস্টে লেখা পাঠাতাম। দশটা লিটল ম্যাগাজিনে পাঠালাম। দেখা গেল দুটো ছাপা হলো, আটটা হলো না। তাতে আমি খুব ভেঙ্গে পড়তাম এমন নয়, ভাবতাম লেখা বুঝি ভালো হচ্ছে না। তো লেখা ছাপা হলে সে খবর জানতে জানতে দেখা যেত ছ’মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ততদিনে আরও অনেক নতুন লেখা হয়ে গেছে। এভাবে ডাকে পাঠিয়ে পাঠিয়েই আমার কবিতার জগতের মধ্যে আসা। যা পাঠাতাম তার নাইনটি পারসেন্ট ছাপা হতো না।

একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি, আমি অন্য কিছু করতে পারতাম না। আমি খুব লেখাপড়া শিখিনি, আর আমার সাস্থ্য খুব খারাপ। স্কুলে পড়ানো, কলেজে পড়ানো বা ব্যাংকে চাকরি করা এই ধরনের কোনো যোগ্যতা আমার নেই। সাগরময় ঘোষ আমায় বলেছিলেন, তুমি এসো দেশ পত্রিকায় চাকরি করো। এই আমি চাকরি করতে শুরু করি। পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাকে নিয়ে আসেন সংবাদ প্রতিদিনে। এরপর রোববার কাগজটাকে নতুন করে তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু ততদিনে আমি চলে আসি।

সাকিরা পারভীন : আপনার ছোটবেলার কথা জানতে চাচ্ছি। বলবেন একটু…
জয় গোস্বামী : আমার জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। পাঁচ বছর বয়সে মা-বাবা আমাকে আর ছোটকে নিয়ে চলে যান রানাঘাট। তার ঠিক একধারে ছিল নদী, আরেক ধারে রেল স্টেশন। সেই স্টেশনের ওপারেই মাঠ পেরিয়ে গ্রাম ছিল। নদী পেরোলে পুরোটাই গ্রাম। সেখানেই ছিলাম আমি পরবর্তী বত্রিশ বছর। না, না একত্রিশ বছর। একত্রিশ বছরের মাথায় আমি কলকাতা এসে থাকতে শুরু করি। কারণ কলকাতায় আমার চাকরি হয়। সাঁইত্রিশ বছর বয়স থেকে আমি কলকাতা শহরে থাকি। ছোটবেলা যেভাবে কেটেছে তাতে অনেক গাছপালা, অনেক পুকুরঘাট, অনেক ছড়ানো জায়গা ছিল তখন। খুব জনবহুল জায়গা ওটা ছিল না।

সাকিরা পারভীন : আপনার অনেক কবিতার মুহূর্ত বা রচনার মুহূর্ত জানতে ইচ্ছে করে... আপনার নিবিষ্ট যে ভ্রমণ... একান্ত যে বিচরণ সেগুলোর কথা। ‘কবি’ বা ‘দেবী’ ...এমন অনেক কবিতার নেপথ্য...
জয় গোস্বামী : দেখুন, ‘কবি’ নিজেকে নিয়ে লেখা নয়। আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক লেখার চেষ্টা করেছি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছি- তা অবশ্য বলিনি। তবে এই কবিতাটা পড়লেই বুঝতে পারবেন যে কোনো মহাকবির উদ্দেশ্যে বলা। আপনি একটু আগে আমাকে ‘দেবী’ নামে একটা কবিতার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন, সেই কবিতাটা আমি বিরাশি বা তিরাশি সালে লিখেছি। রচনাকালে একটা জিনিস হয় জানেন? আমি জানি না এটা অন্য লোকের হয় কি না। কিন্তু আমি যখন এটি লিখতে শুরু করলাম তখন একটা অতি নিবিষ্টতার মধ্যে মনটাকে নিয়ে চললাম। এমন হতে পারে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি তো নিবিষ্টতার মধ্যে হেঁটে চলে যাচ্ছি, তারপর বাড়িতে এসে কাগজ কলম নিয়ে সেটা মনে করছি। যখনই কাগজ কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলাম তখন মনটা ওই মুহূর্তে একেবারে নিবিষ্ট হয়ে গেল। তখন আর নিজেরও জানা থাকে না যে, একটা কবিতা আট লাইন, সতেরো লাইন, উনত্রিশ লাইন নাকি চল্লিশ লাইনে শেষ হবে। জানি না, বুঝতে পারি না। ঠিক শেষ হবার আগের মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে শেষ হবে, শেষ হবে- শেষ হয়ে গেল। লেখার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গতিটা বাড়তে থাকে। মনের গতিটা তরলের মতো। তিন লাইন চার লাইনে যে গতিটা আসে সেটা ধরুন আট-দশ লাইনে এসে গতি অনেক বেড়ে যায়। আবার ষোলো-সতেরো লাইনের সময়ে ভেতরে খুব তাগাদা তৈরি হচ্ছিল। তারপর একটা সময় হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। আপনি এই পুরো জিনিসটা বুঝতে পারবেন, ‘একটা অজানার মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করবার অভিজ্ঞতা হয়’। সেই সময় আমি যখন কবিতাটা লিখলাম, তারপর ধরুন তিন-চারদিন ধরে কিছু কিছু জায়গায় সংশোধন করলাম, যখন প্রুফ এলো তখন আবার একটু কাটাকুটি করলাম- ওই পর্যন্ত একটা কবিতার সঙ্গে আমার জড়িয়ে থাকা। ওই কবিতাটি যখন আমি লিখে উঠলাম তারপরেই আমার জীবনের ওপরে নানা সংগ্রাম, নানা ঘটনা, নানা অনুভূতি নানা ধরনের সামাজিক অভিজ্ঞতা, নানা ধরনের অন্তর্লীন অভিজ্ঞতা এমনকি রাত্রে দেখা স্বপ্ন- এগুলো সবই জমা হতে লাগলো। যে মুহূর্তে আমি কবিতাটি লিখেছি আমার কবিতাটি লিখতে সময় লেগেছে আধ ঘণ্টা। যদি দীর্ঘ কবিতা লিখে থাকি তাহলে হয়তো সেটা লিখতে সময় লেগেছে সাত দিন। তখন পুরোটা সময় ওই কবিতার মধ্যে ছিলাম। এবার এর মধ্যে থেকে যখন বেড়িয়ে এলাম, বেড়িয়ে এসে জীবন যাপন করছি তার মধ্যে নানা ধরনের কথা, আওয়াজ, গান, ঘটনা, দুঃখ এবং আমার নিজের নানা রকম লেখা, অন্যদের পড়া এগুলো আমার মনের ওপর জমা হচ্ছে। আর যে মুহূর্তে আমি কবিতা লিখছিলাম কবিতার যে রচনা ভঙ্গিটা; সেটা ক্রমশ তলায় চলে যাচ্ছে। এইবার ধরুন বত্রিশ-তেত্রিশ বছর পর যদি কেউ সেই কবিতাটা লেখার সময় কী ঘটেছিল প্রশ্ন করে তখন আর তল পাওয়া যায় না। তবে সেই কবিতাটার বিষয়ে যদি আমি কিছু লিখতে যাই, তখন কিছুটা হয়তো আন্দাজ বা অনুমান হয়তো পাওয়া যায়। অনেক কবিতা আছে যেগুলো স্রোতের  মতো চলে আসে। সেই কবিতাগুলো সম্পর্কে পরবর্তীকালে বলতে গেলে অনেক জায়গায় নিজের কাছেই ফাঁক মনে হয়। সেই মুহূর্তে যখন পার্টিকুলারলি ছিলাম তখন একটা অবস্থা, তারপর যদি দশ বছর পর কেউ জিজ্ঞাসা করে, তাহলে তখন আমি আর সেই ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবো না। তার ওপর অনেক স্তূপ মানে হিপ অব এক্সপেরিয়েন্স জমে গেছে। খুঁড়তে খুঁড়তে নিচে যাওয়া আর সম্ভব না। আমি সাত দিন আগে যে কবিতাটি লিখেছি সেই কবিতাটি নিয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি তার কাছাকাছি যেতে পারবো। কিন্তু এরপর আর পারবো না। এটা আমার অসহায়তা বলতে পারেন।

সাকিরা পারভীন : আপনি খুব স্বাপ্নিক বিচিত্র ধরনের; আপনার মতো অনেকেই এমন হতে চাইবেন। আপনার কথা বলার ধরনও বিচিত্র। আবার সব সময় বলেনও না। আপনার লেখার ধরনও বিচিত্র নয় কি? ফরমায়েশি কবিতা লেখা নিয়ে অনেক রকম কথা প্রচলিত আছে... 
জয় গোস্বামী : বিভিন্ন পত্রিকা থেকে আমাকে বিষয় বলে দেওয়া হয়েছে এবং আমি সেই বিষয়ে লিখেছি। তার জন্যে এই পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় অংশ আমাকে খুবই বিদ্রুপ করেছে। তারা যে ভুল তা নয়। কারণ তারা মনে করেন, কোনো একটা বিষয় দিয়ে দেওয়া হলে, সেভাবে লিখে দিলে  কবিতারও অপমান, নিজেরও অপমান। এটা হলো এক রকম যুক্তি। আবার নিজের অভিজ্ঞতা আমি যদি বলি, আমিও আগে অনেকটা এরকম ভাবতাম। যখন আমি এই ধরনের কোনো বিষয়ের ওপর কবিতা লিখতাম তখন এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি। যারা একথা বলেন তারা আমার মতো এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাননি। কারণ তাদের পেশা সাহিত্য নয়। সাহিত্যটাকে তারা অনেক শুদ্ধ রাখতে পেরেছেন। কিন্তু আমি শুদ্ধ রাখতে পারিনি। আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি যে সব সময় ফরমায়েশি কবিতা লিখি তা নয়। নিজের ইচ্ছেয়ও লিখি। পিকাসো একটা কথা বলেছিলেন, ‘একবার একটা ক্যানভাসের সামনে যখন দাঁড়াই মনে হয়, আমি নিজেকে শূন্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছি কী উঠে আসবে সেটা না জেনেই’। আমিও সেই পদ্ধতিটার সঙ্গে পরিচিত।

ধরুন একজন ব্যাট হাতে তিনরান করে ফিরে আসছে, আরেকজন একশ। ওই অভিজ্ঞতাটার স্বাদ তাদের জানা। একজনের এক্সিলেন্স আছে সে অনেক উপরে উঠে যেতে পারছে। আরেকজনের এক্সিলেন্স নেই, সে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে বলি, যখন আমি জীবিকার জন্য লেখা শুরু করলাম, আমার কাছে ফরমায়েশি লেখা আসতে শুরু করলো। মনে হতে লাগলো আমি শুন্যের ভেতর পাথর ছুঁড়ে দিচ্ছি। নিজেকেই যেন ছুঁড়ে দিলাম আমি। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিটকে ছিটকে গেল। সেইটাই হয়ে গেল আমার কবিতা।

আরেক রকম হচ্ছে, আমি একটা পাথরে দাঁড়িয়ে আছি। প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান। অথবা একেবারেই একটা নৈর্ব্যক্তিক একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে আমি নিজেকে কবিতার মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম। কী উঠে আসবে জানি না। এই দুটোর মধ্যেই একটা জিনিস আছে। সেটা হচ্ছে অজানার মধ্যে ভ্রমণ। যে অজানা আমার অন্তঃস্থলের। প্রত্যেকের অন্তঃস্থলে একটা সরোবর আছে। প্রত্যেকের দিকে তাকালেই আমি অন্তত কিছুটা দেখতে পাই- কয়েকটা লতাগুল্ম দুলছে, তারপর আর তলাটা দেখা যায় না। কিন্তু ওইটুকু যে আমি দেখতে পাচ্ছি সেটা আবার আরেকজন দেখতে পাবে না। কারণ স্বপ্নের কোনো দ্বিতীয় দর্শক হয় না।

যাই হোক, ফরমায়েশি কবিতা লিখতে গিয়ে আমার বহু কথা শুনতে হয়েছে। যেমন ধরুন ‘মানসাধু’ বলে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম পোখরানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর। তারপর আমি আরেকটি কবিতা লিখেছিলাম। সেটি অবশ্য আমি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকার জন্য লিখিনি। ‘ধ্রুবপদ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বছরে একবার বের হতো। সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদক। তারা বামণ-ফকিরদের নিয়ে একটা সংখ্যা করেছিলেন, তাতে একটি কবিতা ছিল। আমাকে সেই কবিতার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। আমি লিখে দিয়েছিলাম। সেও কিন্তু ফরমায়েশি লেখাই। তাই বলছি, আমার কাছে লেখাটা ফরমায়েশি বা ফরমায়েশির বাইরের লেখা এখন এমন আর মনে হয় না। আমি এভাবেই চলেছি।

রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যা মানায় তা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে মানায় না। ফরমায়েশি লেখা লিখতে গিয়ে আমি আরেক ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি। আমি মনে করি, যত রকমের পরীক্ষার মধ্যে নিয়ে যেতে পারবো তত নিজেকে যাচাই করতে পারবো।

সাকিরা পারভীন : তাহলে আপনি বলতে চাইছেন ক্ষেত্রবিশেষে কাব্যরচনা  চ্যালেঞ্জ?
জয় গোস্বামী :
ঋতুপর্ণ ঘোষ একটা সাক্ষাৎকারে তার এক বন্ধুকে জানিয়েছিলেন, তিনি প্রথম দিকে যে ছবিগুলো করেছিলেন, সেই ছবিগুলো করেই নাম হয়ে যায় এবং পুরস্কার পান। ‘১৯ শে এপ্রিল’ বা ‘অসুখ’র মতো ছবি এখন আর করতে পারি না। কিন্তু শুধু আমি আমার স্কিল দিয়ে আর কাজ করতে চাই না। যে কাজটা করতে গেলে আমাকে নিজেকে যাচাই করতে হবে, আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে আমি সেই ধরনের কাজ করতে চাই। আমাকে আরও পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

কথাটি তার লিখিত ইন্টারভিউতে ছাপা আছে। তিনি ফিল্ম সম্বন্ধে কথাটি বলেছেন। তার এই কথাগুলো কবির ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমি যখন লিখতে শুরু করেছি, ফরমায়েশি লেখার মধ্যে এসেছি তখন ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। আমি সব সময় ভেবেছি, এটিকে আমি একটা পরীক্ষা হিসেবে নিয়ে দেখতে পারি যে, আমি ভাষাটাকে আর একটু জানতে পারলাম কিনা। আমি আরেকটু কবিতার পথে যেতে পারলাম কিনা। আপনি যদি দেখেন প্রাচীন মন্দিরগাত্রে যে সমস্ত ভাস্কর্য আছে সেগুলো নানা ধরনের মিথুন মূর্তি। আমরা সবাই জানি, এসবের ভঙ্গি কি? যে সব ভাস্কর এইসব ভাস্কর্য মন্দিরগাত্রে তৈরি করেছিলেন তারা সবাই শিল্পী। তারা এই কামকলা সৃষ্টিরূপেই দেখেছেন। তাই তার নানা আঙ্গিক, নানা ফর্ম, নানা অঙ্গভঙ্গি দেখতে চেয়েছেন। যদি আমরা শুধু কয়েকটা কবিতা পড়ে তার থেকে কবিতা লেখা শিখবার চেষ্টা না করে বাকি যে আর্ট ফর্মগুলো আছে বা এই ধরুন শুধু বই না পড়ে যদি আমি একটা দোকান পড়ি, বা একটা রাস্তা পড়ি, ভিড়ভর্তি বাস পড়ি বা একটা চলন্ত ট্রেন  পড়ি; তাহলে সেটাও কিন্তু একরকম পড়া। আমি বলতে চাইছিলাম যে, অত বৈচিত্র দরকার নেই মানুষের মিথুন ভঙ্গিতে। তাছাড়াও মানুষের মূলকর্ম সমাধা হতে পারে। কিন্তু শিল্পীরা কেন তার দিকে তাকালেন? অর্থাৎ তার নতুনত্ব, নতুনভাবে জিনিসটিকে তারা দেখতে চাইছে। এটাও তো একটা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। মিলন যেমন সৃষ্টির প্রক্রিয়া, তেমনি কাব্য রচনাও সৃষ্টির প্রক্রিয়া। আমাদের মতো কিছু মানুষ; হয়তো আমরা পেশার জন্য কাজ করি কিন্তু আমরা এসেছিলাম একটা সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকবো বলেই। কিন্তু বিদ্রুপ করা বা প্রথমেই জিনিসটিকে উড়িয়ে দেওয়া একটা পথ, আবার নিজের অন্তঃসার খরচ করে সেই জিনিসটির মধ্যে আর কী কী আছে সেটা দেখাও একটা পথ।

সাকিরা পারভীন : খুব সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে আপনার একটা লেখা পড়লাম...
জয় গোস্বামী :
ভূমিকম্প নিয়ে লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। পত্রিকা থেকে যখন আমাকে লিখতে বলা হয়, তখন আমি প্রথমে চেষ্টা করি। যদি হয় তাহলে ফোন করে জানিয়ে দেই। যদি না হয় তাহলেও ফোন করে জানিয়ে দেই যে, আমার হয়নি। এটা কিন্তু অনেকে বলতে পারেন না। ধরুন একটি ছেলে একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করলো। এবং সে জানাতে রাজী হলো যে, তোমাকে আমি পছন্দ করি। কিন্তু সেই মেয়েটির তো ছেলেটিকে পছন্দ নাও হতে পারে। এমন নয় যে, মেয়েটির অন্য কোনো প্র্রেমিক আছে। আসলে তার তো ভেতরে একটা জাগরণ আছে, সেই জাগরণটাই বলে দেবে ‘এই আমার প্রেম’। ঠিক জাগরণটা তার এলো না। কবিতা রচনাও তাই। যদি সেই জাগরণ না আসে তাহলে তো আর কৃত্রিম উপায়ে তাকে জাগরিত করা যায় না।

 

জয় গোস্বামী ও সাকিরা পারভীন, কলকাতা কবির বাসভবনে


সাকিরা পারভীন : শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে- আপনার কী রকম? কোনো কোনো কবিতায় আপনার টুকরো জীবন উপস্থিত নয়কি? 
জয় গোস্বামী :
সব মানুষই সাধারণ- কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এইরকম কোনো রেসিপি হয় না। মানুষ চেষ্টা করতে করতে নিজের পথ খুঁজে নেয়। এই যেমন আপনি সেলাই দিদিমনির কথা বললেন, মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয়- এই ধরনের কিছু কবিতা আছে যা খুব প্রত্যক্ষভাবে কোনো ঘটনার সাথে যুক্ত। সে সম্পর্কে আমি কিছুটা বলতে পারি। ধরুন সম্পূর্ণ একটা নতুন স্থলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। আবার ধরুন আমি বিড়ালের সঙ্গে কথা বললাম (বিড়ালের সঙ্গে আমি নিয়মিত কথা বলি)। দেখা যায় আমি শুয়ে আছি তারা আমার বুকের ওপর উঠে ডাকে। আমি সাড়া দেই, তারা তাদের ভাষায় কথা বলে। তাদের সঙ্গে আমি যে ভাষায় কথা বলছি, আর আপনার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলছি, আবার আমি আমার মেয়েকে যখন ফোন করবো তখন তার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলবো, বা আমার কোনো পুরনো বন্ধুর সঙ্গে যেভাবে কথা বলবো- আমাদের স্বরগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় বিভিন্ন সময়ে; কিংবা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কে। ধরুন একজন নারী-পুরুষ ঘরের মধ্যে চুম্বনরত। এ সময় দরজায় টোকা পড়লো। তারা আলাদা হয়ে যাবে। তাদের ওই সম্পর্কটা কিন্তু সকলেই জানে। কিন্তু তারা যদি বাহিরে চলে আসে তাহলেই তারা আর সেই সম্পর্ক প্রকাশ করবে না। স্বামী-স্ত্রী ঘরে রয়েছে। বাইরে থেকে বাবা কি মা ডাকছেন। তখন তারা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকলেও বাইরে এসে সে অবস্থায় থাকবে না।

কবিতার মধ্যে এই সব স্বরই আসবে। এই ঘনিষ্ঠ স্বরও ধরা পড়বে, আবার কখনো বাইরে চলে এসেছে যে সামাজিক স্বর- তাও ধরা পড়বে। কোনো কোনো কবিতায় সবগুলো স্বর একে অপরের সাথে মিলেমিশে যাবে। আমাদের অবচেতনের মধ্যে তো এসব একেবারে মিলেমিশে আছে।

সাকিরা পারভীন : মালতিবালা নিয়ে বলবেন আরেকটু। কোনো প্রেম, ওই সময়ের জ্বালা, এর সঙ্গে লেখা না-লেখার সংযোগ...
জয় গোস্বামী :
সেই সব লেখাগুলো আলাদা করে বা নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। যখন স্পষ্ট চরিত্র বা স্পষ্ট করে একটি সামাজিক দিক লক্ষ্য করে বলবেন তখন আবার বলা যায়। যেমন এই মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয়। আমি আগেও বলেছি, আমার মা স্কুলের মিসট্রেস ছিলেন। এবং ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যাবার পর সেই স্কুলের যে দিদিমণিরা তারা আমাকে আর আমার ভাইকে মানুষ করেছেন (অনেক সময়)। অত ছোটবেলা থেকেই আমি মেয়েদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছি, না বুঝে। পরবর্তীকালে যখন পেছন থেকে দেখেছি তখন বুঝে দেখেছি। তাদের কারও কারও সারা জীবন বিয়ে হতো না। তারা ভাইয়ের সংসার দেখতেন। আস্তে আস্তে ভাইকে বিয়ে দিতেন, বোনকে বিয়ে দিতেন। ভাইয়ের সন্তানদের বড় করতেন। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হতো। তারপর একটা সময় ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যেত। তাদের যৌবনকাল থেকে আমি ওই পর্যন্ত দেখেছি। এখনো যখন ভাবি তখন দেখতে পাই। এই যে ঘটনাটা সত্যিই একজন ছিলেন (তিনি আমার থেকে বড়) তার কাছে শহর থেকে একটি ছেলে আসতো। শহর মানে কলকাতা। ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হলো। একসময় ছেলেটি শহরে ফিরে গেল। সে আর এলো না। ভদ্র মহিলা জীবিকা অর্জন করতেন। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে; কবিতাটা লিখেছি কিন্তু আমি অনেক পরে। তিরিশ বছর আগে জীবিকা নির্বাহের যে প্যাটার্ন কিংবা ক্রুশ কাঠি দিয়ে ঢাকনা, জলের ঢাকনার বিশেষ কোনো প্যাটার্ন। আসন তৈরির যে প্যাটার্ন সেগুলো বুনে দেবার জন্য কিছু গৃহশিক্ষিকা থাকতো। তারা দুপুর বেলা যখন স্বামীরা কাজে চলে গেছে তখন বৌদের গিয়ে সেগুলো শেখাতো। হাতে একটা কালো বেটে হ্যান্ডেলের ছাতা নিয়ে আমি সেই মহিলাকে যেতে দেখেছি। এভাবে সে জীবিকা নির্বাহ করতো। তো এমন একজন নারীকে আমি ৮৮ কি ৮৯ সালে দেখলাম। কেন? কারণ ইতিমধ্যে ৮৫ সালে একটি মেয়ে আমার জীবনে এসেছে। তখন আমার পেশা ছিল গরুর দুধ আর ঘুটে বিক্রি করা। আমি আর আমার ভাই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এগুলো বিক্রি করতাম। তারপর আস্তে আস্তে বাড়িতে বাড়িতে গ্যাস আসতে শুরু করলো। তখন তারা বললো যে, আমাদের ঘুটে দরকার নেই। পাশের বাড়িটি ছিল স্বচ্ছল। তারা আমাদের সাহায্য করবার জন্য দুধ-ঘুটে বিক্রির সুযোগটা দিল। কিন্তু সেই বাড়িতেও এক সময় গ্যাস এসে গেল। তখন সেই ঘুটের ঝোলা নিয়ে আমি ফিরে আসছি। আমার ভাই তখন আমাকে বলল, ‘তুই তার পরের বাড়িতে লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করলি না কেন?’ কথাটি তখন আমার মাথায় আসেনি। এইরকম আমার জীবন যাত্রা।

এ সময় একদিন কলকাতার খুবই উচ্চশিক্ষিতা একটি মেয়ে কবিতা পড়ে আমার বাড়ি এলো। তার আগে আমি আর কোনো মেয়েকে দেখিনি যে কবিতা পড়ে। ফলে আমার মতিভ্রম হলো। এ ভাবে আমার তিনমাস কেটে গেল। তিনমাস পর আমি তার বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখলাম একটা ছাদখোলা বাড়ি। তারা আর্থিকভাবে খুবই সচ্ছল। এবং আমি যা ভাবছিলাম, সে হয়তো আমার কবিতা পছন্দ করেছে, হয়তো অন্যদের মুখে শুনেছে বা কারও কাছে হয়তো চেয়ে নিয়েছে। হয়তো শুনেছে ছেলেটি গরিব, অসুস্থ এবং ভালো কবিতা লেখে। আর সেটিকেই আমি প্রেম বলে ভুল করছি। আমাদের মিলমিশ হওয়া সম্ভব না। আমি তাকে দশটা চিঠি লিখলে সে একটারও উত্তর দিত না। সারা জীবনে সে আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল। খুব সাবধানী চিঠি ছিল। তার মধ্যে কোথাও এরকম কোনো কথা ছিল না যে আমি বিষয়টি বিচার করতে পারি। তখন আমার নিজের সম্পর্ক জ্ঞান এলো আর কি! কেবল জানটা বেরিয়ে গিয়েছিল আমার। তখন আমি সন্ধ্যামাসির কষ্টটা বুঝতে পারলাম। তারপরে আমি কবিতাটা লিখেছি। সেলাই দিদিমণি কবিতা মোটেও তা নয়। ওটা আমরই কবিতা।

সাকিরা পারভীন : সংগীত নিয়ে আপনার ভাবনা ... এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
জয় গোস্বামী : কাল আপনারা চলে যাবার পর রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ ব্যাধিতে খুব কষ্ট পেয়েছি। যখন আমার শারীরিক কষ্ট হয় তখন কোনো গানটান শুনতে পারিনে, কোনো কিছুতে মন দিতে পারিনে। শুধু শরীরের কষ্টটা কখন কমবে এর জন্য আমি ওষুধ খেয়ে অপেক্ষা করি। শরীরের মধ্যে যেমন কষ্ট আছে তেমনি সমাজের মধ্যে কষ্ট আছে। পেশার জগতে কষ্ট আছে, সংসারের মধ্যে কষ্ট আছে। সবকিছুর মধ্যে কষ্ট আছে। কিন্তু এই জানালা দিয়ে আপনি একটু বাইরে তাকিয়ে দেখুন, বাইরে গাছ দেখা যাচ্ছে। সংগীত হলো আমার কাছে ওই রকম। আমি একটু আগে একটি মেয়েকে বলছিলাম যে, ‘তুই জানালায় দাঁড়া আমি বারান্দায় দাঁড়াচ্ছি’। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। ও তাহলে বুঝতে পারবে; মানে আমি ওকে বোঝাতে চাইলাম যে, ক্ষা রা পা জ্ঞা মা ঋ সা এই স্বরে তিনতালের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি পড়ছে... দেখে বুঝতে পারবি রা কোথা থেকে এসেছে। তো অন্তরে সেই জিনিসটা নেই। কারও জীবনে নানা অস্থিরতা আছে, সেই অস্থিরতার মধ্যে সে ওই জায়গা থেকে একটু আনন্দ পাবে। আমার মেয়ে ছাড়া আর সেই রকম কেউ আছে তা ঠিক নয়। আছে একজন দুজন। একজন হয়তো ডাক্তার, একজন হয়তো রসায়নবিদ।

সাকিরা পারভীন : ধরে নিলাম, সে রকম কেউ আছে বা নেই। সেই থাকা না থাকার সঙ্গে ব্যক্তি বা সত্তার প্রেমের সম্পর্ক ঠিক কী রকম? রাগ সংগীতে আপনার এতো দখল! অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে। যেমন সংগীতের সঙ্গে কবিতার কোনো প্রেম আছে কিনা?
জয় গোস্বামী :
রাগ সংগীত সম্পর্কে আমার যে ধারণা... দিন যেমন সকালবেলা আস্তে আস্তে বেলা বাড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমার জীবনেও এখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। প্রথম দিকে রোদের তাপ যেমন থাকে, কিরণ যেমন থাকে, তেমন জীবনের শেষের দিকে থাকে না। তবে একটা আশা থাকে জীবনে প্রেম আসবে। তখন ওই ‘ভালোবাসিয়াছি ভালোবাসারে’ সে রকম একটা ভাব থাকে। তারপর তা আসে একবার, দুবার, তিনবার, তারপর চলে যায়। বিচ্ছেদ এক সময় হয়, হয় না। প্রতিদিনের ব্যবহারে, অতিরিক্ত ব্যবহারে প্রেম বৃদ্ধ হয়ে যায়। সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তারপর কর্তব্য, তারপর দাবি। দাবির ওপরে পাল্টা দাবি। অধিকারবোধ। দাবি জীবন নষ্ট করে। দাবি জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি নষ্ট করে। দাবি মানে দাবি মেটানোর এবং কর্তব্য পালন নিয়মিত। প্রেমের মধ্যে সরাসরি সংযোগ থাকে, যোগাযোগ থাকে। এই প্রেমের মৃত্যু নাই। দূরে থেকেও মনে মনে একজনকে তার সুন্দর মুখটির কথা ভাবা যায়।

কবিতা রচনা কেবল ভাষার অনুশীলন নয়। আমাদের অগ্রজ কবিরা এই বাংলার; তারা বলে গেছেন- কবিতা হচ্ছে ভাষা শিল্প। এটা সম্পূর্ণ মানসিক। প্রত্যেক কবির কবিতা সম্পর্কে একটা নিজস্ব তত্ত্ব থাকে। আপনাদের দেশের কবিরাও বলেন, ‘কবিতা হবে এই রকম’। আমার এমন ধারণা কখনো ছিল না।

প্রেম হবে এ রকম- আমার ধারণা নেই। সংগীত কতো রকম দেখুন। তার সামান্যই আমি জানতে পেরেছি। আর প্রেমের সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ হতে পারে হয়তো ঈশ্বরের। ঈশ্বর কি আমি জানি না। দিলীপ কুমার রায় নামে একজন বাঙালি গায়ক মারা গেছেন অনেক দিন। তার যে গায়কী এটা তিনি ভগবত সাধনায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই গায় কিন্তু তার গায়কী আয়ত্ব করা যায় না। যেমন শক্তির কবিতা। আপনি পড়েই বুঝতে পারবেন- এটি শক্তির কবিতা। গানেরও তেমনি ঘরাণা আছে, গায়কী আছে। বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন রকম তাই প্রেমের ধরন। আমি এমন অনেক মানুষ দেখেছি, তিনি তার স্ত্রীর প্রেমিকের কাছে চিঠি পৌঁছে দিচ্ছেন। আমার একট ছোট উপন্যাস আছে ‘খাদ’। তার মধ্যে এই কথাটা আছে। আমি দেখে খুব অবাক হয়েছি। একবার যে দেখেছি তা নয়, দু’বারও দেখেছি। যেই আমি দাবি করতে আরম্ভ করলাম তখন কেউ আবার দাবি পূরণ করতে আরম্ভ করলো। এটা তো আর কবিতা নয়। কবিতা আমি যখন খুশি কারেকশন করতে পারি। কবিতাটি যখন ছাপা হয়ে চলে গেল, আর তার ওপর পজিশন নেই। আমার জীবন সম্পর্কে যদি কেউ যা হয়নি তাই বলে তাহলে খুব দুঃখ হয়। আমার জীবনে যা ঘটেনি তা যদি প্রচারিত হয় এবং সে কথা ছাপা হয় এবং তা প্রায়ই হয়। অনেক সময় নাম করে অনেক সময় নাম না করে। এবং এসব যখন লোকমুখে ফেরে তখন অসম্ভব কষ্ট হয়। এবং সেই কষ্টে অন্তরটা শুকিয়ে যায়। যারা করেন তারা জানেন যে এভাবে আমাকে কষ্ট দেওয়া যায়। আমার পশ্চিমবঙ্গে কোথাও কোনো কবিতা সমাজে যাতায়াত নেই।

কবি যখন কবিতা সমাজ থেকে দূরে থাকতে চান তখন এক বিষণ্ন সন্ধ্যা নামে। তখন আলাপচারিতা থমকে যেতে চায়। জয়ের এই বিষাদ উচ্চারণের পর থমকে যান সাকিরাও। দুই কবির নীরবতার আড়ালে লেখা হয় অজানা অনেক কবিতার জন্ম গাঁথা। কেননা শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্যেই থাকেন কবি।



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুন ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়