ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মোহাম্মদ আল-মাহমুদীর বরাতে যা ঘটেছিল তার সারসংক্ষেপ

জি এইচ হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৪ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মোহাম্মদ আল-মাহমুদীর বরাতে যা ঘটেছিল তার সারসংক্ষেপ

মূল: জাকারিয়া তামের
ভাষান্তর: জি এইচ হাবীব


মোহাম্মদ আল-মাহমুদীর বয়েস হয়েছে, একা একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকেন। দারা-পরিবার নেই, আর যেহেতু কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন, তাই করার মতো কিছু নেই হাতে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসবেন তিনি, গদাইলস্করি চালে রাস্তা ধরে হাঁটবেন, একটু থামবেন নিজের পছন্দের খবরের কাগজটা কেনার জন্য, তারপর ফের তার প্রাতঃভ্রমণ চালিয়ে যাবেন শোরগোলভরা রাস্তাটাকে কাচের দেয়াল দিয়ে আড়াল-করা ক্যাফেটার উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে তিনি ভেতরে যাবেন, তারপর পার্লার টেবিলটা খোঁজ করবেন, যেটা তাঁকে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকার সুযোগ দেবে; সেখানে কোনো কথা না বলে বসে থাকবেন তিনি, নারগেলি (হুকা) আর চিনিছাড়া কফির কাপের জন্য। তারপর পকেট থেকে একজোড়া চশমা বের করে পরে নিয়ে খবরের কাগজে ডুবে যাবেন, নারগেলিতে টান দিতে থাকবেন, আর মাঝে মাঝে কৌতুকপূর্ণ চোখে রাস্তার দিকে তাকাবেন।

ক্ষুধা অনুভব করলে তিনি ধীরে, নিমরাজি ভঙ্গিতে উঠে পড়বেন, তারপর কাছের একটা রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসবেন। নির্লিপ্তভাবে খাবেন, তারপর তড়িঘড়ি ক্যাফেতে ফিরে আসবেন খবরের কাগজ পড়া আর নারগেলি সেবন চালিয়ে যেতে, চা-কফিতে চুমুক দিয়ে যেতে, একেবারে রাত নামার আগ পর্যন্ত; আর তখন তিনি ক্যাফে ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে যাবেন, জামাকাপড় ছেড়ে তাঁর চওড়া বিছানায় গা মেলে দেবেন এবং মুহূর্তের মধ্যে গভীর ঘুমে ঢলে পড়বেন।

তিনি মাকে স্বপ্ন দেখবেন। মা তাঁকে খুব করে বকবেন কেন তিনি এতদিনেও বিয়ে করেননি সেজন্য, আর কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে একটা শিশুর জন্য আবদার করবেন যে-শিশু তাঁকে বলবে, ‘দাদি, আমাকে একটা বেলুন কিনে দাও।’
কাজেই তিনি তখন ঘুম থেকে উঠে পড়বেন, গলা ছেড়ে অনেকক্ষণ কান্নার ইচ্ছের কারণে মুষড়ে পড়ে, অস্বস্তি বোধ করে।

একদিন তিনি বরাবরের মতো ক্যাফেতে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন এবং নারগেলি সেবন করছিলেন, এমন সময় খবরের কাগজটা তাঁর আঙুলগুলো থেকে খসে পড়ে গেল এবং একটা গোঙানি দিয়ে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকা হলো, এবং তিনি জোর দিয়ে বললেন, ভদ্রলোক মারা গেছেন। তখন তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, গাঁইতি আর কোদাল আনা হলো এবং যে-টেবিলে তিনি বসতে অভ্যস্ত ছিলেন তার নিচে একটা গর্ত খোঁড়া হলো এবং যত্ন করে তাঁকে তুলে নিয়ে সেই গর্তে শুইয়ে দেওয়া হলো; বেশ কিছু মাটি ঢিপ করে ফেলা হলো তাঁর ওপর। তিনি রাগে গজগজও করলেন না, বিরক্তও হলেন না, বরং রাস্তা ধরে হাঁটা, বাড়ি আর রেস্তোরাঁয় যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে সুখের হাসি হাসলেন এবং খুব মন দিয়ে ক্যাফের খদ্দেরদের কথাবার্তা, নারগেলির গড়গড় ধ্বনি আর পরিচারকদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে লাগলেন। রাতে অবশ্য বেশ একঘেঁয়ে আর ভয় লাগবে তাঁর, কারণ তখন ক্যাফেটা ফাঁকা হয়ে যাবে, আর সেটার দরজা বন্ধ থাকবে।

একদিন বেশ ক’জন পুলিশ ক্যাফেটা ঘেরাও করল। তারা মোহাম্মদ আল-মাহমুদীকে তাঁর গর্তটা থেকে বের করল, তারপর তাঁকে থানায় নিয়ে গেল। সেখানে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাঁকে খুব কঠোর গলায় বলল, ‘আমরা জানতে পেরেছি আপনি সরকারের কাজের সমালোচনা করেন, সেসব নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেন, সেগুলোকে গাল-মন্দ করেন, আর দাবি করেন যে সরকারের সব আইনই যাবতীয় সয়-সম্পত্তির মালিক, গাড়ি-ঘোড়া আর বড় বড় পেটঅলাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে।’

আতঙ্কভরা বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে মোহাম্মদ আল-মাহমুদী বলে উঠলেন, ‘সরকারকে আমি অভিশাপ দেই? ঈশ্বর রক্ষা করুন। যে-কুয়োর পানি খাই সেটাতেই আবার থুতু ফেলি না আমি। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার ব্যাপারে। অফিসার হিসেবে সবার আদর্শ ছিলাম আমি, আর আমি আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম। জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার ব্যাপারে। একবারের জন্যেও মাতাল হইনি আমি, কোনো নারী সম্পর্কে খারাপ কোনো মন্তব্য করিনি, কারো ক্ষতি করিনি, আমি ছিলাম...’

সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাঁর কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনার সম্পর্কে আমাদের কাছে যে রিপোর্ট এসেছে তা মিথ্যে নয়, আর যারা সে রিপোর্ট দিয়েছে তারা খুব বিশ্বস্ত।’

মোহাম্মদ আল-মাহমুদী ভয়ে কেঁপে উঠলেন এবং কাঁপা কাঁপা গলাতেই বললেন, ‘ঈশ্বরের নামে দিব্যি দিয়ে বলছি, সারা জীবন রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলিনি আমি, আর কোনো দিনই সরকারের বিরুদ্ধে বা যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো অপমানজনক কথা উচ্চারণ করিনি।’

‘হা হা!’ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হেসে উঠল। ‘আপনার কথা দিয়েই আপনাকে ঘায়েল করছি আমি। আপনি বলছেন, আপনি কখনো সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কুৎসা রটাননি কিন্তু আপনি তো একথাও বলেননি যে, সরকারের কোনো প্রশংসা করেছেন কখনো। আপনার কী মত? সরকার কি প্রশংসার যোগ্য নয়?’
মোহাম্মদ আল-মাহমুদী কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু সুপারিন্টেন্ডেন্টই বলে চলল, ‘এমনকি আপনার কথা সত্য হলেও ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক, কারণ অন্যরা সবাই কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে উঠেছে, তিক্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষকে যে মান্য করার দরকার আছে, সেকথা ভুলে গিয়ে তারা গালাগাল করছে সরকারকে, যারা ক্ষমতায় আছে তাদেরকে। তারা এটা উপলব্ধি করে না যে রাজনীতি সবাই বোঝে না।’

মোহাম্মদ আল-মাহমুদী দুর্বল গলায় বললেন, ‘তা ঠিক। সবাই রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে, আর রাষ্ট্রের প্রত্যেক দায়িত্বশীল মানুষের নামে জঘন্যতম কথাবার্তা বলছে। আমার কথা যদি বলেন...’
তাঁকে একটা মৃদু জিজ্ঞাসু স্বরে বাধা দিয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই শুনতে পান ক্যাফেতে কে কী বলে? যারা বলে তাদের নামও নিশ্চয়ই আপনার জানা?’

মোহাম্মদ আল-মাহমুদী ওপর-নিচ মাথা নাড়লেন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট হেসে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে আপনি ভালো মানুষ এবং একজন ন্যায়পরায়ণ নাগরিক, আর আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা থেকে যাতে মুক্তি পেতে পারেন, সেজন্য আমি আপনাকে আসলেই সাহায্য করতে চাই কিন্তু আপনারও আমাকে সাহায্য করতে হবে।’
যারপরনাই অবাক হয়ে মোহাম্মদ আল-মাহমুদী বলে উঠলেন, ‘আমি তো মৃত; আমি কী করে আপনাকে সাহায্য করব?’

সুপারিন্টেন্ডেন্ট একটা প্রসন্ন হাসি হাসলেন, তারপর বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব সহজ, আর মজার। শুনুন...’
মোহাম্মদ আল-মাহমুদী শুনে গেলেন সুপারিন্টেন্ডেন্টের কথা, তারপর খুব হৃষ্টচিত্তে ক্যাফেতে নিজের গর্তে ফিরে গেলেন, কারণ এতদিনে করার মতো একটা কাজ পেয়েছেন তিনি। মাঝরাতে ক্যাফেটার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও এখন থেকে আর নিঃসঙ্গ, একঘেয়ে আর ভীত বোধ করবেন না তিনি। কারণ, যাতে ভুলে না যান আবার, সেজন্য সেই সময়েই তিনি চট করে লিখতে বসে যাবেন ক্যাফের খদ্দেরদের কথোপকথন।

 


লেখক পরিচিতি: জাকারিয়া তামের ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক-এ জন্মগ্রহণ করেন। তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করলেও ১৯৬০-এর দশকে তাঁর প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘তেজী সাদা ঘোড়ার হ্রেস্বারব’র মাধ্যমে নিজেকে তিনি আরবি কথাসাহিত্যে একটি নতুন কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি আরবি সংবাদপত্রে কাজ করতে গিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দামেস্কে নানা সরকারি পদে চাকরি করেছেন। লন্ডনেই বর্তমান নিবাস। তাঁর ছোটগল্পের একটি সংগ্রহ, Tigers on the Tenth Day, ১৯৮৫ সালে ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছিল।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়