ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একচক্ষু হরিণীরা: দ্বিতীয় পর্ব

রাসেল রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৮ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একচক্ষু হরিণীরা: দ্বিতীয় পর্ব

অপরিচিত মেয়ে দেখলে এই ‘কই যেন দেখেছি...’ বোধ হওয়া হয়তো এক ধরনের ইচ্ছাকৃত অসুস্থতা মনে হয় আমার কাছে। আমার সাথে রাশেদ পড়ত, কোনো মেয়ের সাথে ভাব জমানোর জন্য ও এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করত। কাজেও দিত খুব। একবার অবশ্য এক মেয়ে থাপ্পড়ও মেরেছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে সেবার আবার আমি ওর সাথেই ছিলাম। রাশেদকে থাপ্পড় খেতে দেখে আমি এমন ভান করলাম যে একে আমি চিনিই না! সোজা একটা রিকশায় উঠে বসলাম। সেই নিয়ে আরেক বিশ্রী কাণ্ড! জান বাঁচাতে রিকশায় উঠে পড়েছিলাম, সামান্য এগোতেই মনে আসলো পকেটে পয়সা নেই আমার। আবার নামতেও সাহস হচ্ছিল না তখুনি। রিকশাঅলাটাও ছিল খচ্চর প্রকৃতির। আমি যখন তাকে ধমক-টমক দিয়ে কাটানোর সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছি, তখন সে বলল, মামা, আপনে যে ঐ থাপ্পড় খাওয়া মামার লগে আছিলেন, আমি দেখছি। নাটক-ফাটক বাদ দিয়া ভাড়া দ্যান।...

এইসব স্মৃতি মনে করতে ভালো লাগে না। অথচ এই ভয়াবহ বৃষ্টি আর এক জোড়-ভ্রু নারী আবার সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো।

পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট চা-দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নেন। একটা স্টার সিগারেটও দিয়েন।

জোড়-ভ্রু মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার মানে আমাকেও চেনে বোধ হয়। আমি বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি বসুন, প্লিজ। বাসে আমার সিটের পাশে কোনো নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে এভাবে সিট ছেড়ে দিই আমি। দিয়ে তার দিকে আর তাকাই না। এটুকু ভদ্রতা দেখানোর অহম আমার আছে। বেশিরভাগ মেয়েই থ্যাংকস বলে। ভালো লাগে। কেউ কেউ আবার এমন ভাব করে যেন এটা তার অধিকার। সেটাও মন্দ লাগে না। নারীদের সবকিছুই স্বর্গীয়, এটা বুঝলেই পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য বেড়ে যেত।

আমি দাঁড়াতে আকাশী-শাড়ি সামান্য বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, না থাক, থাক। আপনি বসুন না।

আমি জোর করে বললাম, বসুন বসুন। আমি দাঁড়িয়ে চা খাব। সমস্যা নেই।

মেয়েটা বসল না। আমাকে দাঁড় করিয়ে সম্ভবত সে বসতে রাজি নয়। এখন অনেক মেয়েই ছেলেদের যেচে করা উপকার নিতে স্বস্তি বোধ করে না। কিংবা এই মেয়েটা ঠিক এভাবে চাপাচাপি করে বসতে হয়তো রাজি নয়। তবে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। পাশে দাঁড়ানো বিশ্রি চেহারার এক লোক যেভাবে খালি বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে, শেষে না চক্ষুলজ্জার ধার-না-ধেরে বসে পড়ে, সেই ভয়ে আমি আবার বসে পড়লাম।

এমন সময় আরেকটা বাস আসায় আমার পাশের জন সিট ছাড়ল। এবার মেয়েটা বসল। আমার সাথে যথাসাধ্য দূরত্ব রেখে। তবে ওপাশের জনের সাথে তার শরীর লেগে আছে, আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম। থাকুক।

ঠান্ডা বাতাস আসছে। আমার পরনের পাঞ্জাবিটা পাতলা। শীত লাগছে। চুলার কাছে বসতে পারলে ভালো হতো।

দোকানদার চা দিলো। চায়ে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে স্বর্গীয় স্বাদ পেলাম। এখন সিগারেটটা ধরালেই হয়। সিগারেট ধরাতে গিয়েও থমকে গেলাম। দোকানে ঝোলানো লাইটারটা টান দিতেই মেয়েটা কেমন যেন নাক কুঁচকালো মনে হচ্ছে। সিগারেট ধরালাম না। সে বোধহয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বলল, আরে, আপনি সিগারেট খেতে চাইলে খান। সমস্যা নেই।

আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মিহি একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবেন?

নাহ্‌। কনডেন্সড মিল্কের চা আমার ভালো লাগে না। আর লাল চা-ও আমি খাই না।

আজ একটা খেয়ে দেখেন। আপনি ভিজে আছেন। ভালো লাগবে। শীত লাগছে বোধ হয় আপনার।

মেয়েটার মতের তোয়াক্কা না করে আমি দোকানদারকে একটা চা দিতে বললাম। তারপর দ্বিধা-সঙ্কোচ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আপনাকে কোথাও দেখেছি আগে? কেন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে।

অজান্তেই আমার হাত গালে চলে যাচ্ছিল। সামলে নিলাম। মেয়েটা শব্দ করে হাসছে। সবাই এমনিতেই তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল, হাসি শুনে একসাথে সরাসরি তাকাল। সম্বিৎ পেতেই কুঁকড়ে গেল সে। একটু বিব্রত। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। এই প্রশ্নে এত জোরে হাসার কিছু নেই। এতটা ঘনিষ্ঠ নিশ্চয়ই নয় যে, না চিনলে অমন হাসতে হবে। বাল্যকালের বান্ধবী-টান্ধবী নাকি? তেমন হলে নিশ্চয়ই চিনতাম। আমার স্মৃতিশক্তি অত খারাপ নয়।

ঠান্ডা বাতাস বাড়ছে। আজ কপালে খারাবি আছে। ঠান্ডা লাগলে আমার হাঁচি শুরু হয়ে যায়। ম্যারাথন হাঁচি। শ দুয়েক দিয়ে ফেলতে পারি। এখানে শুরু না হলেই নয়। এক পরিচ্ছন্ন নারীর পাশে একের পর এক হাঁচি দিয়েই যাচ্ছি, দৃশ্যটা খুব স্বস্তিকর নয়।

আমার কৌতূহলমাখা দৃষ্টি দেখেই বোধ হয় আকাশী-শাড়ি প্রশ্ন করল, আপনার ইন্টারভিউ কেমন হলো?

তখনই বুঝতে পারলাম, মেয়েটাকে কেন চেনা মনে হচ্ছে। একটু আগে আমি একটা চাকরির ভাইভা দিয়ে এসেছি। প্রুফ রিডারের চাকরি। পত্রিকার ভাষায় বলে সম্পাদনা সহকারী। চাকরি আসলে স্রেফ বানান দেখা। আটজনকে ভাইভায় ডেকেছে। এই মেয়েটাও ভাইভা দিতে এসেছে। ডান পাশের সোফায় জবুথবু হয়ে বসে ছিল। এখন মনে পড়েছে। স্মৃতি সবসময়েই সামান্য হিন্টস চায়।

চায়ে বড় একটা চুমুক দিলাম। তারপর সিগারেটে। ঘন একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি ছেড়ে বললাম, ইন্টারভিউ বোধ হয় ভালোই হয়েছে। কিন্তু চাকরিটা হবে না।

মেয়েটা অবাক হয়ে তাকাল, ইন্টারভিউ ভালো হলে চাকরি হবে না কেন? তাছাড়া সবার ভাইভা-ই মিনিট দশেক করে হয়েছে। আপনারই তো দেখলাম আধঘণ্টার মতো ভাইভা হলো।

হবে না দেখেই অত দীর্ঘ ভাইভা হলো। তারা মোটামুটি জোর করে প্রমাণ করে ফেলেছে যে এই চাকরি আমি বেশিদিন করব না। নতুন কোনো সুযোগ পেলেই সেখানে জয়েন করব। খুব দ্রুতই আমার এই চাকরি ছেড়ে ভাগার আশঙ্কা।

আপনার তো দেখছি ‘বরে শাপ’ হয়ে গেল।

আমি হাসলাম।

জোড়-ভ্রু আগের কথার খেই ধরে বলতে লাগল, কিন্তু জোর করে কেন করবে অমন? আপনার কি ধারণা, চাকরির লোক এরা আগেই ঠিক করে রেখেছে? তেমন তো মনে হয়নি।

না না। তা নয়। অন্য একটা ব্যাপার।

অন্য ব্যাপার মানে? আচ্ছা থাক, না চাইলে বলতে হবে না। আপনি আবার ভেবে না বসেন যে আমিও এই চাকরিতে ঢুকতে চাই বলেই এমন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চাইছি। কৌতূহল হচ্ছে একটু।

‘না চাইলে বলতে হবে না’ বলেও মেয়েটা যেভাবে তাকিয়ে আছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে সে আসলে উত্তরটা শুনতে উদগ্রীব। অন্যরাও দেখছি হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এখন চাকরি বিষয়ক কথা শুনলেই মানুষ লোভাতুর হয়ে ওঠে। আগে সরকারি চাকরি ছিল সোনার হরিণ। এখন যেকোনো চাকরিই সোনার হরিণ। সেখানে অতিরিক্ত যোগ্যতার জন্য একজনের চাকরি হচ্ছে না, সেটা কৌতূহল-উদ্দীপক তো বটেই। তার উপরে এখানে দাঁড়ানো অর্ধেকের বেশি লোকেরই চাকরি নেই বলে মনে হচ্ছে আমার। ভাইভা দিতে আসা দুয়েকজনও থেকে বসতে পারে। এমন অপূর্ব রূপবতী নারীকে যে মস্তিষ্ক ভুলে বসে ছিল, সেখানে অন্যদের চেনার প্রশ্নই নেই।

লোকগুলির দৃষ্টি ভালো লাগছে না। অতিরিক্ত কৌতূহলী এবং ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টি। সবাইকে উপেক্ষা করে বললাম, রিটেনে আমার মার্কস সবচেয়ে বেশি। তাও অন্য একটা কারণ আছে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন না, আমি কবিতা লিখি। জানার কথাও না। এটুকু বলে তার দিকে তাকালাম?

কবিতা লেখেন বলে চাকরি হলো না? কী বলেন!

না না, তা নয়। আসলে দুর্ভাগ্যক্রমে একটি মোটামুটি পরিচিত পুরস্কার জুটে গেছে আমার। আপনার ভাষায় ওটাই মূলত ‘বরে শাপ’। এইচআর ডিপার্টমেন্টের লোকেদের ধারণা, প্রুফ রিডারের চাকরির জন্য আমি ঠিক লোক নই। কিংবা আমার জন্যই প্রুফ রিডারের চাকরি ঠিক নয়। খুব ভালো কোনো অফার আমি অন্য কোথাও থেকে পেয়ে যাব। আর তখন তাদের নতুন করে আবার সার্কুলার দিতে হবে। এসব জটিল সম্ভাবনার ভিতর দিয়ে তারা যেতে চায় না।

কী অদ্ভুত!

আমি হাসতে হাসতে বললাম, এই দেশে তো সবই অদ্ভুত। এরচেয়েও কত অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় আছে। বাদ দিন। আপনার ভাইভা কেমন হলো?

বেশি ভালো না। আজকের পত্রিকার শিরোনাম জানতে চেয়েছিল। বলতে পারিনি। সকাল নটায় ভাইভা। বাসার জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে দিয়ে আসতে আসতে পত্রিকা দেখার সুযোগ ছিল না। অথচ দেখেন, আমি এই পত্রিকাটাই পড়ি। প্রথম প্রশ্নেই ধরা খেয়ে পরে পারা প্রশ্নও অনেক পারিনি। চাকরিই নেই আমার ভাগ্যে! নইলে ‘অঘ্রান’ বানানে স্বরে-অ, ঘ-এ র-ফলায় আ-কার, মূর্ধণ্য ণ বলি? কী সহজ প্রশ্ন!

সামান্য দীর্ঘ একটি শ্বাস ছাড়ল মেয়েটি। ওতেই বোঝা হয়ে গেছে আমার, চাকরিটা কত গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য। আমি হেসে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম পরিবেশ। আশপাশের সব লোকই হাসল। তবে বেশি পোক্ত হাসি না। এদের কেউই অঘ্রান বানান জানে না বোধ হয়। জানার কথাও না।

মেয়েটা বলল, আপনার নাম জানা হলো না। যদিও আমি মাঝে মধ্যে কবিতা পড়ি-টড়ি, তবে সে ঐ রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ হয়ে সুনীল-শক্তি-জয় পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। আপনি নাম বললেও চিনব না, আগেই সরি বলে নিচ্ছি।

এবার আমি হা হা করে হেসে ফেললাম। আমার নাম মুকুল।

পুরো নাম বলেন। কবিদের পুরো নাম বলতে হয়।

হেসে বললাম, মুকুল মাহমুদ।

ওহ, আপনার নামও পরিচিত মনে হচ্ছে। আগে দেখেছি বোধ হয়। ওই পুরস্কারের খবরেই হয়তো। আমি সব পত্রিকাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। তবে আপনার কবিতা পড়িনি কখনো। যা-ই হোক, আপনাকে অভিনন্দন। আর আমি বলে রাখছি, আপনার চাকরিটা হবে, দেখবেন। সেজন্যও অভিনন্দন।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আমার চাকরিটা হবে না। তবু এই ‘অভিনন্দন’টা মাথায় গেঁথে গেল সোনার বরশির মতন। ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আপনার নামটা জানা হয়নি।

আমি আহির।

স্মার্ট ভঙ্গিতে বললাম, পুরো নাম বলেন। পাঠিকাদের পুরো নাম বলতে হয়!

আহির চোখ টিপে বলল, আমি তো আপনার পাঠিকা না। সুতরাং পুরো নাম জানা আপনার ভাগ্যে নাই।

থতমত খেয়ে গেলাম। একে যেমন ভেবেছিলাম, তেমন মোটেই না। সতর্ক থাকতে হবে, যতক্ষণ আছি।

বৃষ্টি সামান্য কমে এসেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাস এসে চলে গেছে। আহিরকে বললাম, আরেকবার চা খাবেন নাকি?

আহির খুব আস্তে বলল, খাওয়া যায়। একটা পাউরুটিও খাব। সকালে খেয়ে আসার সময় পাইনি।

দোকানদারকে আগাম দাম দিতে গেলে সে নিতে রাজি হলো না। বলল, আগাম দিতে হবে না। পরে দিয়েন।

আহির বলল, এখন পরে দেবে কেন? তখন যে বললেন, আগাম টাকা দিতে হবে!

দোকানদার দেঁতো হাসি দিয়ে বলল, আপনাগোর কথা শোনার জন্যই বাস আসার পরেও অনেকেই যায় নাই, আপনারা খেয়াল করেন নাই। চা বিক্রি হইতেছে ভালো। আর বাস আসলেও একসাথে দুইজনই বাসে উইঠা যাইবেন, সেই সম্ভাবনা কম। দুইজন একসাথে উঠতেই পারবেন না। ভাইজান পারলেও আপনে পারবেনই না। আপনেরা ধীরে সুস্থে চা খান। বলতে বলতে দোকানদার চা বানিয়ে ফেলল, তার হাত বেশ দ্রুত।

এখান থেকে চা খেতে ইচ্ছেই হচ্ছিল না আর। দোকানদার এমনভাবে বলেছে যেন আমরা দুজন দর্শণীয় বস্তু। কিন্তু কিছু বললাম না। আহির এদিক-ওদিক কোথাও না তাকিয়ে একমনে আস্তে আস্তে রুটি খাচ্ছে। সবাই খুব আগ্রহ ভরে সেই খাওয়া দেখছে। আচমকা ‘হালুম’ করে জোর একটা শব্দ করে এদের চমকে দিতে মন চাইল। এই অদ্ভুত ভদ্র সমাজে সেটাও সম্ভব না।

আহিরের রুটি খাওয়া শেষ হয়েছে। আমি নিশ্চিত, আমাদের আর কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বড়জোর মাথায় অভিনন্দনের সোনার বড়শিটা নিয়ে ঘুরতে হবে। একসময় সে বড়শি ছুটে যাবে। অন্য কোনো বড়শি গেঁথে যাবে। হয়তো সেটা হিরের, কিংবা রুপার। কিন্তু দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই কি নেই একদম? একই সাথে রহস্যময় এবং কৌতূহল-উদ্দীপক কিছু বলে চমকে দিলে কেমন হয়? আর কখনো দেখা না হলেও দেখা করার ইচ্ছেটা থাকবে, এমন কোনো চমক! কীভাবে ভয়ানক চমকে দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ধড়াম ধড়াম করে বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও। সেই শব্দের সঙ্গে দারুণ টাইমিং মিলে গেল আমার কথাটার, আচ্ছা আহির, একটা জিনিস বলেন তো সত্যি করে, যদি আমার একটি চোখ না থাকে, চোখের এই জায়গায় একটা বড় গর্ত থাকে, কেমন লাগবে? খুব ভয়ংকর?

আহির তো ভয়ানক চমকালই, অন্যরাও খুব চমকে গেল । আহিরের চায়ের কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল আমার গায়ে। পাউরুটি খেতে খেতে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, ছ্যাঁকা টের পেলাম না।

আমার মা সত্যিই একটি চোখ নিয়ে নিতে চাইছে আমার। বাম কিংবা ডান—যেকোনোটা—আমার যেটা দিতে ইচ্ছে হয়।

তিন

মাহমুদ আলী ভেবেছিলেন পারুল ভুলে গেছে যে সে একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল, মুকুল বড় হলে তার একটা চোখ মাহমুদ আলীকে দেবে। সেটা যে ভুল ধারণা, একদিন টের পেলেন।

রাত বেশ গাঢ় হয়েছে। দূরে কোথাও একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে যাচ্ছে, ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ। কার কাছে যেন মাহমুদ আলী শুনেছেন এটা তাদের ডানার গুঞ্জন। ডানার গুঞ্জন এত তীব্র হয়? ঝিঁঝিঁ পোকার ডানা কি ধাতব? মাহবুব আলীর দেখতে ইচ্ছে হয়। আরও অনেক অনেক কিছু দেখতে ইচ্ছে হয় তার। শুনেছেন পাহাড় থেকে অনবরত পানি ঝরে, একে ঝরনা বলে, মাহমুদ আলীর ঝরনা দেখার ইচ্ছে হয়। পাহাড় দেখার ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় সমুদ্র দেখার। বালুভর্তি মরুভূমি...

তারচেয়েও তীব্র যে দেখার ইচ্ছে, তা হলো পারুলকে আর তার সন্তানকে। আহা, যদি দেখতে পেতেন। করুণাময় একদিন যদি তাকে দেখার ক্ষমতা দিতেন!

সমুদ্র আর মরুভূমির কথা মনে আসলেই মাহমুদ আলী আনমনে দুটি লাইন আওড়ান—

বাঁপাশে সমুদ্র আর ডানপাশে মরুভূমি, হায়!

একচক্ষু হরিণীরা তবু কেন মরে পিপাসায়?

পিতা সুবিদ আলীকে মনে পড়ে তার। সুবিদ আলী রাস্তায় রাস্তায় যখন খেলা দেখাতেন, তখন এই লাইন দুটি দিয়ে শুরু করতেন। সবার উদ্দেশে আচমকা জ্যা-মুক্ত তিরের মতো ছুড়ে দিতেন এই ধাঁধাঁ। কী সহজ উত্তর, অথচ কখনো কাউকে সঠিক জবাব দিতে দেখেননি তিনি। তখন তার ছ-সাত বছর বয়স বোধ হয়। খেলার পুরোটা সময় তিনি এই উত্তর ভাবতেন, কেন হরিণীরা পিপাসায় মারা যায়, যেখানে পাশেই আছে থই থই সমুদ্র? শুনেছেন, সমুদ্রের পানি দূর থেকে নীল দেখায়। সেটা নিশ্চয়ই কারণ নয়। আরেকটা কারণ হতে পারে সমুদ্রের পানি নাকি ভয়ানক লবণাক্ত। লবণের জন্য পান করার উপযোগী থাকে না। সেটাই কি মূল কারণ?

এখন অবশ্য এই দুই লাইনের মূল রহস্য মাহমুদ আলী জানেন। সহজ উত্তর।

দক্ষিণ পাশের জানালা খোলা। জোর বাতাস আসছে। বাতাসে ভেসে আসছে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ। পারুল বাড়ির সামনে সারিবদ্ধভাবে রজনীগন্ধা লাগিয়েছেন। গভীর রাতে নেশা ধরানো ঘ্রাণ ভেসে আসে। সেই ঘ্রাণ মাহমুদ আলীকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় স্নেহশীল মায়ের মতো। নিজের মাকে তিনি দেখেননি। মায়ের কোনো ছবি ছিল না। তবু পারুলের সঙ্গে থেকে তিনি মা সম্পর্কে নিজের মতো একটা ধারণা নিয়েছেন। মাঝে মাঝে মায়ের অভাব বোধ করেন তিনি। পারুলের স্পর্শ সেসব অভাব ঘুচিয়ে দেয়।

রজনীগন্ধার ঘ্রাণ মাহমুদ আলীর ঘুম ধরিয়ে দেয়। তিনি শোয়ার প্রস্তুতি নেন। পারুলের চুল আচড়ানো শেষ হলে স্বামীর পাশে এসে বসেন। কোলের মধ্যে হাত টেনে নিয়ে বলেন, সময় এসে গেছে। এবার ঈদে মুকুল বাড়ি এলে তাকে কথাটা বলতে হবে।

মাহমুদ আলী চমকে গেলেন। না জানার ভান করে বললেন, কী কথা? কীসের সময়?

ভুলে যাওয়ার ভান কোরো না। আমি জানি তোমার মনে আছে।

মাহমুদ আলী অভিনয়ে মনোযোগ দেন। সত্যি মনে নেই! কী কথা?

বিয়ের প্রথম রাতে আমি পেটের সন্তান ছুঁয়ে কসম খেয়েছিলাম যে সে বড় হলে তার একটা চোখ তোমায় দেবো। একটা চোখ দান করার মতো যথেষ্ট বড় সে হয়েছে। সেই সময় এসে গেছে। কেন না জানার ভান করছ?

মাহমুদ আলী ধাক্কা দিলেন পারুলকে? কীসব বলো তুমি! সে সময় তুমি অস্থির ছিলে। বিপর্যস্ত ছিলে। ঝোঁকের বশে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলে। এখনও সেসব মনে রেখেছ তুমি? আর তুমি কীভাবে ভাবছ, আমি বাবা হয়ে সন্তানের চোখ নেব? আমি কি পিশাচ?

পারুল আরও কাছে এগিয়ে এসে বসেন স্বামীর। ফিস ফিস করে বলেন, আমি পিশাচ। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়