ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একচক্ষু হরিণীরা : তৃতীয় পর্ব

রাসেল রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একচক্ষু হরিণীরা : তৃতীয় পর্ব

মাহমুদ আলী পারুলের মুখের দিকে তাকান। তার অক্ষম চোখে আলাদা কোনো ছাপ পড়ে না। সমস্ত অভিব্যক্তি কপালের ভাঁজে এসে জমা পড়ে শুধু। পারুল সেসব ভ্রুক্ষেপ করেন না। আগের কথার খেই ধরে তিনি বলতে থাকেন, আমিই পিশাচ। আমি চাই মুকুলের একটা চোখ। মুকুলকে আমি এজন্যই বড় করেছি। ও তোমায় একটা চোখ দেবে। সেই চোখ দিয়ে তুমি আমায় দেখবে। এটা হতেই হবে। মুকুল দেবে। সে দিতে বাধ্য। সেভাবেই তাকে আমি বড় করেছি। তাকে ঠিকভাবে বড় করার জন্য আমি আর কোনো বাচ্চাও নিইনি।

সত্যিই পারুল বড় কষ্ট করেছেন। একটা ঘটনা প্রায়ই মনে পড়ে মাহমুদ আলীর। ছোটবেলা থেকেই সামান্য আমিষ না হলে ভাত খেতে পারতেন না তিনি। আবার মুকুলকে আলাদা মাছ কিংবা ডিম দিতেই হতো। নইলে সে খায় না। তখন চরম অভাবের সংসার। মাহমুদ আলী অন্ধ দেখে পারুলই সমস্ত বাজার করেন। সেই সময়টাতে পারুল বাজারে গিয়ে পাঁচ টাকা ভাগের চিংড়ি দরাদরি করে চার টাকায় কিনে আনেন। আশপাশ থেকে কচু শাক, কলমি শাক, মালঞ্চা শাক, লাউ শাক তুলে এনে সেই চিংড়ি দিয়ে রাঁধেন। মাহমুদ আলীর খাওয়া হয়ে গেলে আলাদা চিংড়ি বেছে বেছে সেটাকে তেলে একটু ভাজা দিয়ে মুকুলকে খাওয়ান। এভাবে বহু দিন গেছে তাদের। অথচ অভাবের প্রভাব স্বামী-সন্তান থেকে যতটা পেরেছেন, দূরে রেখেছেন। 

তবু মাহমুদ আলী পারুলকে ধমক দেন, তুমি চুপ করো। এসব আর কখনো বলবে না আমার সামনে।

পারুল ধমক দিয়ে বলেন, তুমি চুপ করো!

মাহমুদ আলী পারুলের আওয়াজ লক্ষ করে হাত চালালেন। চড়টা পারুলের থুতনিতে লাগল। মাহমুদ আলীর নখ লেগে একপাশের চামড়া উঠে গেছে। তিনি সেটা টের পেলেন না। পারুল হাত দিয়ে গাল চেপে বসে রইলেন। সম্ভবত বিয়ের রাতের সেই দিনটি ভাবছেন, যেদিন তিনি গর্ভের সন্তানকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, বরের বেশে পাশে বসে থাকা এই মানুষটিকে গর্ভস্থ সন্তানের একটি চোখ তিনি দেবেন।

মাহমুদ আরেকদিকে ঘুরে শুয়ে রইলেন। সম্ভবত তিনিও ভাবছেন বিয়ের রাতের সেই দিনটির কথা।

একটা বয়সের পর মাহমুদ আলী সম্পূর্ণ বড় হয়েছেন পারুলের উপর ভর করে। তখন তার বয়স কত? সাত বোধ হয়! সেই সাত বছর বয়স থেকে পারুল আর তিনি একই বাড়িতে থাকেন। ছ-সাত বছর বয়সে পারুলকে তারা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। মাহমুদ আলীর পিতা সুবিদ আলী নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিলেন পারুলকে। তার উদ্দেশ্যই ছিল বড় হলে অন্ধ ছেলের সাথে পারুলের বিয়ে দেওয়া। তিনি সেভাবেই বড় করছিলেন পারুল আর মাহমুদকে।

ফলে যেটা হলো, মাহমুদ পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যান পারুলের। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা একা একাই পারতেন সব, প্রস্রাব-পায়খানা করার জন্যও কারও সাহায্য লাগত না। তবে খাবারটা এনে দিতে হতো পারুলকেই। মাহমুদ আলী টয়লেট থেকে এলেই এখনো পারুল ভেতরে গিয়ে ঝাঁটা আর পানি নিয়ে পরিষ্কার করতে লেগে যান। পারুলের মোটেই ঘেন্না লাগে না। সুবিদ আলী তাকে সেভাবেই বড় করেছিলেন।

মাহমুদ আলীর স্পষ্ট মনে আছে, যেবার তারা দেনার দায়ে পালিয়ে যান, তিনি কতটা নির্ভরশীল ছিলেন পারুলের উপর। কিছু মালপত্র, সন্তান আর অন্ধ স্বামীকে নিয়ে পালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে পারুল একা। অন্ধকারে এক হাতে জিনিসপত্র আর পুত্র, অন্য হাতে মাহমুদ আলীকে নিয়ে সে ট্রেনে উঠেছে বিনা টিকেটে। নতুন একটা জায়গায় গিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছে। সেদিনের অন্ধকারে পারুলের হাতের কাঁপুনি এখনো অনুভব করেন মাহমুদ আলী। তার হাত কাঁপে।

কী কষ্টটাই করেছে পারুল! কী কঠিন ছিল সেসব দিন!

ভার্সিটি বন্ধ হলেই মুকুল বাড়ি আসে প্রতিবার। মাহমুদ আলী সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকেন, এই বুঝি পারুল বলে বসল মুকুলকে, এবার তোমার একটা চোখ দিয়ে যাবে আব্বাকে। সামনের সপ্তাহেই অপারেশন।

মুকুলের মনের অবস্থা কী হবে তখন? নিজের পিতা সম্পর্কে কী ধারণা হবে তার? ভাবতেই শিউরে ওঠেন তিনি।

মাহমুদ আলী জানেন, পারুল অনেকদিন ধরে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছেন। চোখের অপারেশনের জন্যই। আর সন্তানও নেননি তারা। ঐ টানাটানির অবস্থায় আরেকটি সন্তান বোঝা হয়ে আসত। তার উপরে পারুলের তখন টাকা জমানোর নেশা। মাহমুদ আলী এতদিন সেসব দেখেও না দেখার ভান করেছেন। হয়তো সন্তানের একটি সুস্থ চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখার গোপন লোভ তারও ছিল। হয়তো গভীরে কোথাও লোভ এখনো রয়ে গেছে তার—পারুলকে দেখার লোভ।

তাছাড়া মাহমুদ আলী জানেন, পারুল কতটা জেদি মেয়ে! তিনি তার শিরা-উপশিরা পর্যন্ত চেনেন। সে ঠিকই মুকুলকে চোখ দিতে বাধ্য করবে। তাই প্রতিবার মুকুল আসার পর থেকেই ভয় আর আকাঙ্ক্ষার মিশ্র একটা অনুভূতি তাকে কাঁপায় মিহিভাবে। মুকুল বাড়ি আসার পর এবারও একই অবস্থা হলো। ঘুম উড়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ। শেষে একদিন মুকুলকে একা পেয়ে বললেন পারুলের বিষয়টা। পুরোটা বলতে পারেননি। ভাসা ভাসা বলেছেন। বলেছেন সেদিনই মুকুলকে পালিয়ে যেতে। আর কোনোদিন বাড়িতে না আসতে। যেন বাড়িতে আসলেও আসে তার মৃত্যুর পর, আগে না।

মুকুল খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, আম্মা যদি চান আমার চোখ নিতে, আমি দেবো না কেন? নিশ্চয়ই দেবো।

মাহমুদ আলীর বুক ভরে যায়। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি এসব কিচ্ছু শুনতে চাই না। তুমি আর কখনো বাড়ি আসবা না।

মুকুল বাবার মাথায় হাত রেখে বলল, আব্বা, আম্মা যদি আমার দুইটা চোখও চান, আমি দেবো।

ঠিক ঠিক সেদিন বিকেলেই পালিয়ে যায় মুকুল। আর কখনো বাড়ি আসেনি সে। যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। ব্যবহৃত সেলফোন নম্বর বন্ধ। মুকুল যাওয়ার পরে মাহমুদ আলী তীব্রভাবে টের পান, পরোক্ষভাবে তিনি কতটা চাইছিলেন যে, মুকুল যেন থেকে যায়। পৃথিবী দেখার লোভ গাঢ়ভাবেই তার ছিল। তারচেয়েও তীব্র লোভ ছিল পারুলকে দেখার। সেই লোভের চেয়ে পিতৃস্নেহ খুব বড় হয়ে উঠতে পারেনি। সম্ভবত বড় এবং গাঢ় হয়ে যা উঠেছিল সেটি পুত্রের কাছে পিতার আত্মমর্যাদা, যে-কারণে তিনি মুকুলকে পালিয়ে যেতে বলেন।

মুকুলের হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ায় পারুল অবাক হয়েছিলেন ভীষণ। তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে মাহমুদ আলীই তাকে কিছু বলেছেন। নইলে কাউকে কিছু না বলে সে চলে যাবে কেন? আস্তে আস্তে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। একসময় তিনি নিশ্চিত হন যে মাহমুদ আলীই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে কিছু একটা বলে। এরপর অনেকদিন স্বামীর সাথে কথা বলেননি পারুল।

পারুল একা একাই খোঁজ করেছেন মুকুলকে। ঢাকায় চলে যান একা। নানা জায়গায় খোঁজ নেন। কী হয়েছে-না হয়েছে, পারুল খোলাখুলি করে কিছু বলেনওনি স্বামীকে। তবু মাহমুদ আলী ধারণা করেছেন, মুকুল লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। গেলে পারুল ঠিকই ধরে নিয়ে আসতেন।

আজকাল পারুল বাড়িতে বসে বসে কাঁদেন প্রায়ই। মাহমুদ আলী বুঝতে পারেন না, ছেলের দুঃখে, নাকি স্বামীকে চোখ না দিতে পারার শোকে এই কান্না।

চার

মাহমুদ আলীর পিতা, মুকুলের পিতামহ সুবিদ আলী মোটামুটি সচ্ছল মানুষ ছিলেন। বাজারে চালু দোকান। বিপত্নীক মানুষ। একটি মাত্র ছেলেসন্তান রেখে স্ত্রী মারা গেছেন, সন্তানের জন্মের সময়ে। কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই। আন্দাজও করার সুযোগ পাননি সুবিদ আলী। স্ত্রী সালেহা শক্তপোক্ত মহিলা ছিলেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। সালেহা বেশ ভালো এবং সরল নারী ছিলেন।

সালেহার স্মৃতিতে, নাকি শিশুসন্তান মাহমুদকে অনিশ্চয়তায় ফেলতে চাননি বলে সুবিদ আলী আর বিয়ে করেননি—ঠিক বোঝা যায় না। শুধু দেখা গেল মাহমুদকে তিনি পিতৃস্নেহ আর মাতৃস্নেহের এক মিশেলে বড় করতে লাগলেন। অন্যদিকে ব্যবসাও সামলাচ্ছেন শক্ত হাতে। ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভয়ানক পরিশ্রম করেন।

ছ বছর বয়সে গিয়ে দেখা গেল মাহমুদও মায়ের গড়ন পেয়েছে। চেহারায়, স্বাস্থ্যেও। বেশ মোটাসোটা। পাড়াপড়শী এলেই আগে মাহমুদের গাল ধরে টান মারে। কার অভিশাপ আছে কে জানে, ওই বয়সে আবার ঘনিয়ে আসলো বিপদ। মাহমুদ শক্ত অসুখে পড়ল। অ্যালোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথি ডাক্তার গুলে খাওয়ালেন বাবা সুবিদ আলী। বদ্যি, কবিরাজও বাদ দেননি। কেউ অসুখ ধরতে পারল না। মোটাসোটা মাহমুদ শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেল। মাথার চুল সব পড়ে গেল। জায়গায় জায়গার নরম স্পষ্ট তালু দেখা যায়।

ছেলের উপশমের জন্য সুবিদ আলী জায়গাজমি সব বিক্রি করলেন। শুধু থাকার ঘর আর দোকান রেখেছিলেন। সেটাও বেচলেন। ছেলের জীবন আগে। তাও সুস্থ হলো না মাহমুদ। সুবিদ আলী যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন প্রায়, তখন হঠাৎই মাহমুদ সেরে উঠল। বেঁচে গেল। মাথায় চুল গজালো আবার। স্বাস্থ্যও ফিরে পেতে শুরু করল। শুধু দৃষ্টিশক্তি কমে আসতে লাগল ক্রমাগত। আট মাসের মাথায় ছোট্ট মাহমুদ আলী পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেল।

তেমন কোনো সম্পদ ছিল না আর সুবিদ আলীর। তাও তিনি ছেলের চোখের চিকিৎসা করাতে চাইলেন। ডাক্তার বলল, চোখ পাল্টাতে হবে। যদি নতুন চোখ লাগানো যায় তাহলেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব। বেশ খরচ হবে।

আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা সুবিদ আলীর ছিল না।

একসময় সুবিদ আলী বন্ধুদের প্ররোচনায় খুব জুয়াটুয়া খেলেছিলেন। ঠিক জুয়া বললে আসল ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না। জুয়া খেলেছেন মানে ভয়াবহ জুয়া খেলেছেন। যৌবনে তিনি ছিলেন একদম বাউণ্ডুলে ধরনের। গ্রামের মোটামুটি সচ্ছল পিতার একমাত্র ছেলে। কম বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় একা হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থা তাকে আরও লাগামছাড়া করে দেয়। গ্রামে তিনি থাকতে চাইতেন না। শহরে-মফস্বলে ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। যাত্রাপালার এক দলে ছিলেন কিছুদিন। কাজ করেছেন সার্কাস পার্টিতেও। এভাবে লাগামহীন ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই জুয়ার খপ্পরে পড়েন। নেশা হয়ে যায়। জুয়ার নেশায় বাড়ির ভিটেমাটি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছিলেন। বন্ধক ছাড়িয়ে আনার কোনো অবস্থা ছিল না। শেষ সম্বল বসতবাড়ি বেচে এনে ঠিক করলেন এটা দিয়ে হারানো সব উসুল করবেন। যদি না পারেন তো ঢাকায় চলে যাবেন, আর গ্রামের দিকে আসবেন না। আর যদি পারেন, একবার সব উসুল করে জুয়া খেলা চিরজীবনের জন্য বাদ দেবেন।

সুবিদ আলী পেরেছিলেন। বন্ধক ছাড়িয়ে তিনি আর জুয়ামুখো হননি। বাদ দিয়েছিলেন সকল জুয়ারি বন্ধুর সান্নিধ্য। ভয়ংকর এক জুয়ারি সংঘ গড়ে উঠেছিল তার। সেই সংঘে এমন লোকও ছিল, যে সংসার করছে জুয়ায় জেতা অন্য একজনের বউয়ের সাথে।

এই দুঃসময়ে তিনি সর্বস্ব দিয়ে জুয়া ধরতে চাইলেন পুত্রের জন্য। ঠিক আক্ষরিক অর্থে জুয়া খেলা নয়। গ্রামে অবশিষ্ট সামান্য বসতবাড়ি বিক্রি করে ছেলের চোখের চিকিৎসা করাতে চাইলেন। কিন্তু ঐ সময় আই ট্রান্সপ্লান্ট সহজ ছিল না। আর বন্ধুরাও বারণ করল। বসতবাড়ি বিক্রি করতে বাধা দিল না ঠিক, তবে সেটা দিয়ে ছেলের চোখের চিকিৎসা করতে নিষেধ করল। বোঝাল, আল্লাহ না করুক, সুবিদ আলীর যদি কিছু হয়ে যায়, অন্ধ ছেলে কীভাবে বেঁচে থাকবে। কে দেখবে তাকে? তার উপরে ছেলের বয়স একদম কম। তারচেয়ে আপাতত ছেলে কিছু করে খেতে পারে, এমন ব্যবস্থা করে যাওয়াই বেশি যৌক্তিক।

অন্ধ ছেলেকে নিয়ে সুবিদ আলী পড়লেন মহা চিন্তায়। মাহমুদ তখন সাতে পড়েছে। মৃত্যুভয় কাবু করে ফেলল সুবিদ আলীকে। যদি সত্যি সত্যি কিছু হয়ে যায় তার, ছেলে কীভাবে চলবে? চোখ যদি ঠিক হয়ও, খাবে কী, থাকবে কই? সুবিদ আলী সাধারণত কারও বুদ্ধি নেন না। নিজের বুদ্ধিতে চলাই তার ধর্ম। এবার মেনে নিলেন। এমনিতেই নিজের শারীরিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না, ছেলের চিন্তায় একদম কাহিল হয়ে পড়েছেন। মৃতবৎ অবস্থা তার। বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ হয়ে গেছেন শেষ কিছুদিনে।

তিনি মাহমুদ আলীর চোখের চিকিৎসা নিয়ে আর ভাবলেন না। বরং ছোট একটা কাঠের ঘর ভাড়া নিলেন। দোকান দিয়ে বসলেন একটা, পান-সিগারেটের। ছেলেকে নিয়ে রোজ বসেন। আস্তে আস্তে ব্যবসা বোঝান। হিসেবপত্র শেখান। দশ টাকা, একশ টাকার নোট চেনান। পাঁচ টাকার নোটের সঙ্গে পঞ্চাশ টাকার নোটের পার্থক্য, একশ টাকার সাথে পাঁচশ টাকার। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, সুবিদ আলী নিজেই এখন চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন, কোনটা একশ টাকার নোট, কোনটা পাঁচশ’র। আস্তে আস্তে মাহমুদও পারদর্শী হয়ে উঠল। সে এখন স্পষ্ট করেই টাকা চিনতে পারে। পান বানাতে পারে। জর্দা, সুপারি, চুন, খয়ের সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন সুবিদ আলী। মাহমুদ ঠিকভাবে পান বানায়। সিগারেটও সুবিধামতো সাজানো। সিজার আর বাংলা ফাইভ দিতে তার ভুল হয় না। আস্তে আস্তে দোকানের আয় বাড়ছে। মাহমুদ আলী আবার মোটা হচ্ছে, আর সুবিদ আলী হতে লাগলেন শীর্ণতর।

আগে ছেলের সাথে সুবিদ আলী রোজ দোকানে বসতেন। এখন মাঝে মাঝে ঘরে থাকেন। শুধু ভোরবেলা সুবিদ আলী গিয়ে দোকান খুলে দিয়ে আসেন, আর রাতে বন্ধ করার সময়ে যান। মাহমুদ একাই দোকান চালায়। ছেলের ক্ষমতায় সুবিদ আলী মুগ্ধ। হায়, এই ছেলের যদি চোখ থাকত, তাহলে নির্ঘাৎ সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতো!

কদিন হলো সেকেন্ডহ্যান্ড একটা রেডিও কিনেছেন সুবিদ আলী। ঘরে থাকলে রেডিও ছেড়ে বসে থাকেন। বিশেষ করে দুপুরে খাবার পর অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া তার নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাড়ির সামনেই দোকান, খুব চিন্তাও বোধ করেন না। আশপাশের সব দোকানদার পরিচিত। সুবিদ আলীকে তারা পছন্দ করে। তার উপরে মাহমুদ আলীও সবার ভালোবাসার পাত্র। একটু মোটা হচ্ছে দেখে আবার সবার গাল টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। মাহমুদও সেটা উপভোগ করে। গালে কারও স্পর্শ পেলেই সে বলে দিতে পারে, কে! অদ্ভুত ব্যাপার!

সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর অনেকক্ষণ গড়াগড়ি করলেন সুবিদ আলী। ঘুম আসছিল না। হাঁটতে হাঁটতে দোকানে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন এক আশ্চর্য দৃশ্য। মাহমুদের বয়সীই এক মেয়ে মাহমুদ আলীর পাশে বসে লজেন্স খাচ্ছে। তিনি গিয়ে মাহমুদকে জিজ্ঞেস করলেন, এইটা কেরে বাপ? এরে দোকানে জায়গা দিছিস কেন? তোরে বলছি না, কাউরেই দোকানের মধ্যে বসতে দিবি না!

চিনি না, আব্বা। বলল, হাঁটতে পারতেছে না, খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই বসতে দিলাম। লজেন্স লজেন্স বলল, একটা দিলাম। আবার চায়। আবারও দিলাম।

সুবিদ আলী মেয়েটাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হলো না। সে অতি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শেষে সুবিদ আলী ধমকালেন। ধমকের ফলে যেটা হলো, মেয়েটা শুধু তার নাম বলল, চম্পা। ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আঙুল দিয়ে একবার পুবের রাস্তা দেখায়, একবার পশ্চিমের। লোকজন জড়ো হয়ে গেল, কেউ একে চেনে না।

সবাই খুব চেষ্টাচরিত্র করল চম্পার ঠিকানা জানতে। কোনো ফল হলো না। এক রহস্যজনক চরিত্র হয়ে চম্পা জায়গা করে নিল সুবিদ আলীর বাড়িতে। ঘরের মেঝেতে বিছানা করে দিয়েছেন তিনি, চম্পা সেখানে ঘুমায়। তিনি আর মাহমুদ আলী খাটে ঘুমান।

প্রথম প্রথম সুবিদ আলী চম্পার ঠিকানা জানতে কিছু চেষ্টা-চরিত্র করলেন, পরে হাল ছেড়ে দিলেন। ঠিক হাল ছেড়ে দিলেন না, তার মনে অন্য একটা পরিকল্পনা বাসা বেঁধেছে। কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখতে চাইলেন, চম্পার খোঁজে কেউ আসে কি না। কিংবা আশেপাশের কোথাও থেকে কোনো হারানো মেয়ের খোঁজ করছে—এমন কোনো খবর না আসার প্রত্যাশায় বসে থাকেন। কেউ খোঁজ করল না।

সুবিদ আলী নিজেই খুব চাচ্ছিলেন, কেউ না আসুক চম্পার খোঁজে। তার চাওয়াই পূরণ হলো। ছ মাস অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন নিজের কাজ। এটা ছিল তার দীর্ঘ পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। (চলবে)


 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়