ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘তোমরা তো সত্যিকারের বন্ধু হে!’

নির্মলেন্দু গুণ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘তোমরা তো সত্যিকারের বন্ধু হে!’

|| নির্মলেন্দু গুণ ||

একবার আমি আর হাসান (কবি আবুল হাসান) স্থির করলাম একটা ছোট্ট আলমারি কিনব। যাতে আমাদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদে রাখা যায়। কিছু টাকাও ছিল তখন হাতে। কিন্তু সমস্যা হলো আলমারিটি রাখা নিয়ে।

কোথায় রাখা যায়? অগত্যা পল্টনস্থ স্কাউট ভবনের নিচের তলায় যে দোকান থেকে ঐ আলমারি কিনব বলে সাব্যস্ত করেছিলাম, ঐ দোকানের একজন কর্মচারীকেই একদিন বললাম, ভাই, আলমারি আমরা কিনব ঠিকই কিন্তু আমাদের একটা শর্ত আছে। শর্তটি হলো, আলমারির দাম আমরা এখনই দিয়ে দেব। কিন্তু আলমারিটি আমরা নেব না। ওটি আপনার দোকানের এক কোণায় পড়ে থাকবে। আমরা শুধু এর চাবিটি নিয়ে যাব। এর মধ্যে আমরা আমাদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখব। আপনাদের ব্যবসার যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকটা আমরা লক্ষ্য রাখব। প্রতিদিন এসে আপনাদের বিরক্ত করব না। কালেভদ্রে আমরা আসব। রাজী থাকলে বলেন।

আমাদের কথা শুনে বিক্রেতার চোখ ছানাবড়া। অনেকক্ষণ বাকরহিত থাকার পর ভদ্রলোক বললেন, এমন অদ্ভুত কথা আমি এই জীবনে প্রথম শুনলাম। যান, আপনাদের আলমারি কিনতে হবে না। দয়া করে চা খেয়ে বিদায় হন।

স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়, অভিমানে হাসান চা খেতে চাচ্ছিল না, কিন্তু আমি দেখলাম ওটাই লাভ। বললাম, হ্যাঁ চা চলতে পারে।

অগত্যা আমরা চা খেয়ে বিদায় হলাম। আমাদের নিজস্ব আলমারি আর হলো না।


হাসান সঙ্গে না থাকলে ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবিতা লেখা আমার হতো না। কে জানে, আমি হয়তো শুধু জুয়াড়িই থেকে যেতাম। আবুল হাসানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আমার দীর্ঘ ‘অসমাপ্ত কবিতা’ লিখেছিলাম লন্ড্রির কাপড় ঢুকিয়ে দেওয়া একটা নিউজপ্রিন্টের প্যাকেটের গায়ে। ঐ প্যাকেটটিতে আর লেখার জায়গা অবশিষ্ট ছিল না বলেই লেখার পর ঐ কবিতাটির নাম দিয়েছিলাম ‘অসমাপ্ত কবিতা’। পল্টনের জনসভায় প্রদত্ত তোফায়েল আহমদ প্রমুখ ছাত্রনেতাদের ভাষণ এবং ছাত্রজীবনে মুখস্থ হয়ে যাওয়া বিদায় হজের ভাষণটিকে ঐ কবিতা রচনায় ব্যবহার করেছিলাম। শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের সংলাপ প্রক্ষেপণ পদ্ধতিও আমার মনে ছিল। এসব কারণেই ঐ দীর্ঘ কবিতাটি প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই অনেকেই মুখস্থ করে ফেলতে পেরেছিলেন।

আমি যে রাতে অসমাপ্ত কবিতাটি লিখি, সে রাতে আবুল হাসান লিখেছিল ‘মিস্ট্রেস: ফ্রি স্কুল স্ট্রিট’  নামক তার মিষ্টি প্রেমের কবিতাটি।


... আমি আমার গ্রামের বাড়ি থেকে কবি আহসান হাবীবকে সদ্য শুভ্র শিকড় গজানো একটি বিরল স্থলপদ্মের কলম এনে উপহার দেই। আবুল হাসান ঐ ঘটনাটি জানত না। আমি তাকে বলিনি। হাবীব ভাই খুব খুশি হন। তিনি আমাকে তাঁর মোহাম্মদপুরের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যান। ঐ বাড়িতে স্থলপদ্মের কলমটি রোপণ করা হবে। একদিন বাড়ির উঠোন আলো করে এর ডালে ডালে ফুটবে শত শত স্থলপদ্ম। ঐ দিনটির কথা ভেবে আমার মন ব্যাকুল হয়। হাবীব ভাইয়ের বাড়ি তৈরির কাজ তখন শুরু হয়েছে। পেছনে টাকার জোর নেই, তাই কবে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলা মুশকিল। হাবীব ভাই এ নিয়ে বেশ চিন্তিত।

দৈনিক পাকিস্তানে আগে শুধু হাসানের কবিতা বেরুতো- এরপর আমার কবিতাও ঘন ঘন ছাপা হতে শুরু করে। একটি বিশেষ সংখ্যায় এমন ঘটনা ঘটে যে, হাসান খুবই অবাক হয়। ঐ সংখ্যায় আমার কবিতা যায়, হাসানের কবিতা যায় না। হাবীব ভাই তখন ক্ষিপ্ত আবুল হাসানকে হাসতে হাসতে জানিয়ে দেন যে, আমি স্থলপদ্মের প্রতিশ্রুত কলমটি এনে দিয়েছি। আমি তখন হাসানের সামনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। ভাবি, কেন যে ওটা লুকাতে গেলাম? হাসান হাসে। সেই হাসি এমন দুর্বোধ্য নয় যে, তার অর্থ আমি বুঝতে পারি না।


শিল্পী কালাম মাহমুদের কৃপায় বিশেষ সংখ্যার কবিতায় আমার ও আবুল হাসানের নামের ওপর রঙের প্রলেপ পড়ে। কোন কবিতা যাবে আর কোন কবিতা যাবে না- তা হাবীব ভাইয়ের ওপর নির্ভর করলেও- কোন কবিতাতে রঙ যাবে আর কোন কবিতাতে যাবে না, তা নির্ভর করত শিল্পী কালাম মাহমুদের ওপর। সেজন্যই আমরা নারিন্দায় কালাম ভাইয়ের বাড়ি খুঁজে বের করি। বিরাটাকৃতির রোটারি অফসেট মেশিনে গভীর রাতের দিকে পত্রিকা ছাপা হতো। পরদিন হয়তো কোনো বিশেষ সংখ্যা বেরুবে। সেখানে আমাদের কবিতা যাবে- তাই আমরা দৈনিক পাকিস্তানের চারপাশে রাতভর প্রবল উত্তেজনা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমাদের চোখে কিছুতেই ঘুম আসে না। কবিতাকে জাগিয়ে রেখে কবির কি ঘুমানো উচিত?


কবি হাসান হাফিজুর রহমান আমার ও আবুল হাসানের সম্পর্কটাকে খুব এনজয় করতেন। মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে মজা দেখতেন। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের সম্পাদক। নামের মিল থাকার কারণে আবুল হাসানের প্রতি তার কিছুটা পক্ষপাত থাকলেও আমার প্রতিও তার সবিশেষ দুর্বলতা ছিল। লেখক সংঘ থেকে ‘পরিক্রম’ নামে একটা মাসিক পত্রিকা বের হতো। এক সময় কবি গোলাম মোস্তফা ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। হাসান ভাই তখন ঐ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পান। তার একজন বিশ্বস্ত সহযোগী দরকার। ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকার কাজ করার অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে হাসান ভাই আমাকে ওই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা বলেন। প্রুফ দেখা, লেখকদের লেখা সংগ্রহ করা, ইত্যাদি কাজ। বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কোনো দরকার নেই। এ তো আর কণ্ঠস্বর নয়। লেখক সংঘের টাকা আছে। আমি মহানন্দে কাজে লেগে গেলাম। হাসানও তখন বেকার। হাসান রেগে গেল, তাকে কাজটা না দিয়ে হাসান ভাই কাজটা আমাকে দিলেন বলে। তখন হাসান ভাই আমাকে না জানিয়ে একই কাজ আবুল হাসানকেও দিলেন। হাসান ভাই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতা পরীক্ষা করবার জন্যই এমন করে থাকবেন।


প্রথমে দুজনের মধ্যে ওই কাজ নিয়ে একটু মন কষাকষি হলেও, আমরা ব্যাপারটা বুঝে ফেললাম। আমরা ঠিক করলাম বেতন যা পাই দুজন ভাগ করে নেব। দ্রৌপদীকে যদি পঞ্চভ্রাতা মিলে ভাগ করে নিতে পারে, তো লেখক সংঘের সামান্য বেতনের এই কাজটি কি আমরা দুজন ভাগ করে নিতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব।

চাকরি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বাধেনি দেখে হাসান ভাই খুবই অবাক হলেন। তিনি তখন স্বীকার করলেন, তোমরা তো সত্যিকারের বন্ধু হে! না, কবিদের মধ্যে এ রকমের বন্ধুত্ব আমি আর দেখিনি।


* ‘আমার কণ্ঠস্বর’ থেকে সংগৃহীত

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়