ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একচক্ষু হরিণীরা : সপ্তম পর্ব

রাসেল রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একচক্ষু হরিণীরা : সপ্তম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

চল্লিশ বছর আগে ঘটা ঘটনাটিতে কিছু শূন্যস্থান ছিল। পেটের পাশে দীর্ঘ এবং গভীর ক্ষতচিহ্নটি কেন সৃষ্টি হয়েছিল, টানা তিন বছর রাস্তায় রাস্তায় ভেল্কি দেখানো বাবা সেদিন কেন অমন অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন, সেসব পরিষ্কার হয়ে গেল। শূন্যস্থানগুলি এতদিনে ভর্তি হলো মাহমুদ আলীর কাছে।

বাবার চেহারাও ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। বাবাকে দেখেন না প্রায় চল্লিশ বছর। কণ্ঠ শোনেন না বিশ বছরাধিক। আহা, বাবা তাকে কত ভালোবাসতেন! সব বাবাই হয়তো বাসেন। তবু প্রত্যেক সন্তানের মনে হয় যে তার বাবাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। তারচেয়ে বেশি ভালো কোনো বাবাই তার সন্তানকে বাসে না। সেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাবার চেহারা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। নিজের প্রতি তীব্র লজ্জা বোধ করলেন মাহমুদ আলী।

স্বপ্ন! এটাকে কি স্বপ্ন বলা যায়? চল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা ঘুমের মধ্যে সিনেমার পর্দার মতো পুনরাবৃত্ত হওয়াকে কি স্বপ্ন বলা যায়? কে জানে! মাহমুদ আলী আবার চোখ বোজেন।

ঘুমানোর জন্য চোখ বোজার এই বিষয়টাও মাহমুদ আলীর কাছে অদ্ভুত মনে হয়। তাকিয়ে থাকলেও পৃথিবী তার কাছে সুতীব্র অন্ধকার বৈ কিছুই মনে হয় না। তবু কেন ঘুমানোর সময় অন্ধেরও চোখ বুজে আসে?

পিতা সুবিদ আলী খুব চেষ্টা করেছিলেন সন্তানের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার জন্য। পারেননি। পারবেন কীভাবে? টাকাপয়সা, সম্পত্তি যা ছিল, টাইফয়েডের হাত থেকে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য প্রায় সবই হারিয়ে বসে ছিলেন। টাইফয়েড খুব হালকা কোনো অসুখ নয়। কিন্তু এমনও অসুখ কি, যে বাঁচার কোনো আশাই থাকবে না? চুল সব ঝরে যাবে? দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেবে? শরীরের স্বাভাবিক গঠন কেড়ে নেবে। এগুলো নিতে নিতে একজন পিতার সম্পদটুকুও নিয়ে নেবে? নিয়ে এমন অবস্থায় ফেলবে যে মানুষ ঠকিয়ে সন্তান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষ ঠকিয়ে খেতে হবে? এসব জানতেও মাহমুদ আলীর এখন আর কৌতূহল হয় না। কৌতূহল মরে গেছে অনেক আগে। এখন নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা। অবশ্য সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার বিষয়টি খুব আনন্দময় নয়।

অবশ্য সেদিনের পর বাবা আর রাস্তায় ভেল্কিবাজির খেলা দেখাননি। সামান্য যা জমিয়েছিলেন, তা দিয়ে ছোট্ট একটা পান-সিগারেটের দোকান দিলেন। মাহমুদ আলীয় বাবার সাথে বসতে শুরু করলেন দোকানে। আস্তে আস্তে নোট চিনতে লাগলেন, কোথায় কোন সিগারেট থাকে মুখস্থ হয়ে গেল, নির্ধারিত জায়গায় সাজানো জর্দা, সুপারি, চুন খুঁজে পাওয়া ছিল মুহূর্তের ব্যাপার।

চোখ বন্ধ করে আবার পিতা সুবিদ আলীর মুখ দেখার খুব চেষ্টা করলেন মাহমুদ আলী। পারলেন না। ভেসে উঠল নিজের পুত্র সন্তানের মুখ, যে সন্তানকে তিনি নিজে বলেছেন আর কখনো বাড়িতে না আসতে। সেই মুখ তার কল্পিত। বাস্তবে কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হবেও না কোনোদিন। আহা, কেমন আছে তার পুত্র?

দশ
ফাঁকে নুরীর সাথে দেখা হওয়ার গল্পটা বলে নিই। তার গল্প বলব বলেছিলাম, সেটা বলে ফেলি।
আমার এক বড় ভাই আছেন, জুয়েল ভাই।। তিনি আমায় খুব ভালোবাসেন। ভালোবাসার প্রকাশস্বরূপ তিনি বলে রেখেছেন, মুকুল, তোমার যখন ইচ্ছা আমার কাছে আসবা। তোমার জন্য মদ ফ্রি। খেতে ইচ্ছে হলেই চলে আসবা।

আমি মাঝেমধ্যেই মদ খেতে চলে যাই। বিদেশি বোতল। তার আকাশী রঙের ফ্রিজে শিভাস রিগালের বড় একটা মজুদ থাকে সবসময়। টাকা খরচ করে অমন দামি মদ খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। জুয়েল ভাই আমাকে খাওয়ান। খাইয়ে আলাদা আনন্দ পান তিনি। এই আনন্দ নিখাদ। হোটেলে নারীদের বিল দেওয়ার মতো না।

একদিন জুয়েল ভাই বললেন, মুকুল, চলো, তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। জুয়েল ভাই কোথাও নিয়ে যাওয়ার কথা বললেই সতর্ক হয়ে যাই। আগে একবার বলেছিলেন, বড় একটা দাও মেরেছি, বুঝলা মুকুল! চলো, দুদিন ঘুরে আসি। তুমি লেখক মানুষ। অভিজ্ঞতা হবে। লেখকদের জন্য অভিজ্ঞতার দাম খুব বেশি। এক গ্যালন শিভাস রিগালের চেয়েও বেশি। খুব জরুরি জিনিস!

সেবার অভিজ্ঞতা দিতে তিনি আমায় টাঙ্গাইলে পতিতাপল্লীতে নিয়ে গেলেন। সেই অভিজ্ঞতা ভয়ংকর।
এবার জুয়েল ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে সতর্ক গলাতেই বললাম, কই যাবেন, ভাই?
জুয়েল ভাই চোখ মটকে বললেন, আছে এক জায়গা।

জুয়েল ভাই চোখ কুঁচকে তাকালেন। এই তোমাদের বড় খারাপ স্বভাব! কাউকে বিশ্বাস করতে চাও না একবাক্যে। স্পষ্ট বিরক্তি জুয়েল ভাইয়ের চোখে।
আহা, রাগছেন কেন? আচ্ছা, কই যাবেন, সেটা তো একটু আন্দাজ দেন। অন্তত মানসিক প্রস্তুতিটা নিই। আগেরবারের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না।
কী খারাপটা হয়েছিল, শুনি? তুমি কোন মহাপুরুষ, সে আমার জানা আছে! ভ্রু কিছুটা সদয় হলো জুয়েল ভাইয়ের। ভাঁজ কমে গেল। বললেন, এবার দূরে কোথাও যাচ্ছি না, হাঁদারাম। একটু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যাব। কিছু জিনিস কিনতে হবে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুকুল ভাই কী কিনতে যান, জানা আছে আমার। এটা তেমন রিস্কি কিছু না। বললাম, চলেন।

কিছুদিন থেকে সন্ধ্যার পর সোহরাওয়ার্দীর গেট বন্ধ হয়ে যায়। তাও ঢোকার অন্য ব্যবস্থা আছে। লুকায়িত প্রবেশপথ দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকি। মধ্যবর্তী রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোই। কিছুদূর গিয়ে জুয়েল ভাই বসতে বলে চট করে ঘাসের উপরে বসে পড়েন। আমিও বসি। জুয়েল ভাই বসিয়েই চেঁচিয়ে ওঠেন, ইশশিরে। ভেজা। কেউ মুতে-টুতে গেছে কি না, কে জানে!

আমি হাসতে হাসতে বলি, এখনো তো শীত আছে। সম্ভবত শিশির।
বিশ্বাস নাই বাঙালিরে!
তা ঠিক। আমি আবার হাসি।
জুয়েল ভাই বিরক্ত হন। তুমি অল্পতেই বেশি হাসো, মিয়া। কারো মুতের উপর বসাটা হাসির কিছু হইল?
আরও জোরে হেসে ফেলি আমি। জুয়েল ভাই বিরক্ত মুখেই কাকে ফোন দেন, দ্রুত আসো। বসে আছি।
ওপাশ থেকে সম্ভবত কই আসবে জানতে চাচ্ছে। জুয়েল ভাই চেঁচিয়ে ওঠেন, এতদিনেও জিগাও? অন্য কোথাও বসছি কোনোদিন?- বলে লাইন কেটে দেন। দূরে তাকান। দুটি ছায়া এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। মেয়েদের অবয়ব। আমি বলি, এদের না উঠিয়ে দিছে? এরা আসে কোত্থেকে?
জুয়েল ভাই এখনো বিরক্ত হয়ে আছেন, এরা থাকেই এর মধ্যে। নতুন করে কোত্থেকে আসবে?
বলতে বলতে দেখি অবয়ব দুটি এগিয়ে এসেছে আমাদের দিকে। উদ্যান আলো-আঁধারি মেশানো। তবু এদের মধ্যে একটি অবয়ব আমার চেনা মনে হয়। অবয়বটিও বোধ হয় আমাকে চিনতে পেরেছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। অন্য সঙ্গীর হাত টেনে ধরেছে। আমি ডাকলাম, এই শোনো...
প্রথমজন দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় নারীমূর্তিটি দ্বিধায় আছে, আসবে কি না।
আমার ডাক শুনে জুয়েল ভাই কিছুটা অবাক হয়েছেন। তার চোখ বলছে, তোমার এসবদিকে আগ্রহ আছে, জানতাম না তো! খুব তো পবিত্র পবিত্র ভাব নাও।
জুয়েল ভাইয়ের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে আমি আবার ডাক দিই, এদিকে আসো তো।
দুজনই এগিয়ে আসে। দ্বিতীয়জনকে আমি চিনি না। তবে প্রথমজন আমার চেনা। একসময় সে একটি ছোট স্টিলের গ্লাস নিয়ে এসে ছোট ছোট পায়ে আমার পাশে এসে বসত এক কাপ চা খাবে বলে। তার নাম নূরী।

নূরীকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। সে অনেকদিন ধরেই ঢাকাতে আছে। বছর তিনেক। এই পেশাতেও কম দিন হয়নি। আড়াই বছরের মতন। পর পর দু বার মরা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার অপরাধে তার স্বামী তাকে তালাক দেয়। স্বামীর সংসারে আর থাকা হয়নি। বাড়িতে গিয়েছিল।

মইদুল কাকা, নূরীর বাবা এখন বৃদ্ধ। মাথার সমস্যা বেড়েছে। রোজ চা বেচতে যেতে পারে না। তিনজনের খাওয়া, ছোট বোনের পড়ালেখার খরচ, এর মধ্যে নূরীর সংসারে ঢোকা মানে বাড়তি বোঝা। সে জেনেবুঝে আবার বাবা-মায়ের সংসারে যেতে পারে না। আমার মায়ের দেওয়া গহনাটা চুরি করে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। সেটা বেচে কিছুদিন চলতে চলতে গার্মেন্টসে ঢোকে। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা কাজ করে যা পেত, ভালোই চলে যেত। পরে হঠাৎ একদিন তার বস তাকে ডেকে নেয়। কোনোপ্রকার রাখঢাক না রেখে সরাসরি কুপ্রস্তাব দেয়।

প্রথম প্রথম মেনে নেয়নি নূরী। পরে চাকরি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয় মেনে নিতে। উপায় কী! সঙ্গী মেয়েরা বোঝাল, জলে থেকে কুমিরের সাথে যুদ্ধ না করাই ভালো। তারচে যা করতে চায় করতে দিক, তাতে নূরী ভালোই থাকবে। কয়েকজনের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিল তারা কত ভালো আছে। গার্মেন্টসে রানীর হালে চাকরি করে যাচ্ছে। ওভার টাইমের টাকাটাও অন্যদের থেকে বেশি বেশি পাচ্ছে। বরং বস যে নূরীর দিকে চোখ দিয়েছে, এটা তার কপাল। এমন কপালের জন্য অনেকে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদে। একটু ভালো থাকা-পরার লোভ কার না আছে!

নূরীও ভালোই ছিল। তারা থাকত এক বসতিতে, ছোট্ট এক রুমে গাদাগাদি করে কয়েকজন। তাও কষ্ট বোধ হতো না এক ফোঁটা। একদিন এক রুমমেট আবদার করে বসলো, নূরী যেন তার জন্য একটু সুপারিশ করে দেয় বসের কাছে। কিচ্ছু না; স্রেফ সে যে বসের সাথে শুতে আগ্রহী- এটা জানালেই চলবে। মেয়েটার বাড়িতে পঙ্গু স্বামী। চারটা বাচ্চা সারাদিন ক্ষুধার জ্বালায় ট্যাঁও ট্যাঁও করে কাঁদে। শ্বশুর-শাশুড়িকেও দেখতে হয়। এভাবে আর পারছে না।

বসকে বলে দিয়েছিল নূরী। বসও মেনে নেয়। কিন্তু তার দুদিন পরই ‘মা অসুস্থ, বাড়ি যেতে হবে’ বলে চাকরি ছাড়ে নূরী। এই নোংরামি সহ্য হচ্ছিল না আর। মেয়েদের তো উপায় নেই। কিন্তু বস নামের লোকটার মুখ প্রতিদিন দেখা তার পক্ষে সহ্যাতীত হয়ে উঠেছিল। ভাবল, যেহেতু নোংরামি মেনে নিতে হচ্ছেই, পাপের পথেও পা বাড়িয়ে দিয়েছে টাকার জন্য, তাহলে কষ্ট করে কেন? এরচে স্বাধীনতাই ভালো। একজনের কাছে শুনেছিল সোহরাওয়ার্দী-রমনা পার্কের কথা, সরাসরি রাতে এসে দাঁড়াল। ভয় হয়নি একটুও। কারণ ভয় পাওয়ার অবস্থা সে ইতোমধ্যে হারিয়ে বসেছিল।
দেহপসারিণীর খাতায় নাম লেখাতে একবিন্দু খারাপ লাগেনি নূরীর। কোনো পাপবোধও নেই। এখন সে রীতিমতো ভালো আছে।

নূরীর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তার জন্য ছোট্ট একটা চাকরি ঠিক করে খুঁজতে যাই, পাইনি আর। কয়েকবার গেছি খুঁজতে। জুয়েল ভাইয়ের লিংক ভালো, এদিকে চেনাজানা বিস্তর, তাকে দিয়ে খোঁজ করিয়েছি। কিন্তু নূরী নামের কারো অস্তিত্ব নেই। কেউ চেনে না তাকে। নূরী অন্য কোনো নাম নিয়ে মিশে ছিল এদের ভিড়ে।
এখনো মাঝেমধ্যে রাতবিরাতে গোপন দরজা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকি। খুঁজি একজোড়া পরিচিত অবয়ব।

এগারো
পারুলের চোখের নিচে কালি পড়েছে। যদিও তার ভেঙে পড়ার চিহ্ন বলতে চোখের নিচের ঐ কালিটুকুই। এছাড়া চালচলন দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই নারীর একমাত্র ছেলে মুকুল গত চার বছর ধরে লাপাত্তা। একদিন বাড়ি এসে বাবা মাহমুদ আলীর কাছে কী কী শুনে ছেলে বাড়ি ছাড়ে। আর আসেনি। বছরখানেক পর তিনি ছেলেকে খুঁজতে যান। খোঁজা বলতে ছেলের ভার্সিটিতে গিয়েছেন। আর তো কোনো জায়গা তার চেনা ছিল না। গিয়ে শোনেন ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে। ভার্সিটিতে আসে না আর। কারও সাথে কোনো যোগাযোগও নেই। কোনো বন্ধুবান্ধবও তার খোঁজ দিতে পারল না। তবে এটা নিশ্চিত হলেন যে ছেলে মারা যায়নি। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। পত্র-পত্রিকাতে নাকি তার কবিতা ছাপা হয়। অনেকে তাকে চেনে। অবশ্য পারুলের ধারণা বন্ধু-বান্ধব একটু বাড়িয়ে বলছে। নইলে কেউ ঠিকানা না জেনে পারে? বন্ধুবান্ধব এমনিতেই একটু বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করে।

মজার ব্যাপার হলো মুকুলের এক সহপাঠী পারুলকে তার একটি বই দিয়েছে। সেই বই মাহমুদ আলী রোজ মাথার কাছে নিয়ে ঘুমান। ছবি তুলে দোকানে বইয়ের মলাট বাঁধাই করে টানিয়ে রেখেছে। যে দোকানে আসে, তাকেই ছেলের গল্প বলে। কাপুরুষ ছেলের গল্প, যে ছেলে বাবাকে চোখ দিতে হবে বলে ভয়ে পালিয়ে যায়। সে কবি হলেও কী, আর দেশের প্রেসিডেন্ট হলেই কী!

মুকুল ধারণাই করতে পারবে না, কোন পর্যায়ে একজন মা তার সন্তানের চোখ নেওয়ার কথা কল্পনা করতে পারেন। ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি পারুলের মনে নেই। তবে এটা তার স্পষ্ট মনে আছে যে তাকে তার শ্বশুর সুবিদ আলী কুড়িয়ে পান। তিনি তাকে বাবার স্নেহেই বড় করেন। কখনো পারুলকে আলাদাভাবে দেখেননি। মাহমুদ আলী ছিল তার কলিজার টুকরা। কলিজার অন্য টুকরাটি ছিল পারুল।

পারুলকে সুবিদ আলী ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। একজন পিতার দিক থেকে দেখলে এই চাওয়ায় কোনো অন্যায় নেই।
আঠারো-উনিশ বয়স যখন তাদের, তখন সুবিদ আলী সিদ্ধান্ত নেন পারুল আর মাহমুদ আলীর বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ততদিনে পারুল পাশের বাড়ির মনিরের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। মনির তাকে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তার বাড়ির অবস্থাও ভালো ছিল। সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলার ক্ষমতা ছিল। সেসব কথা মুগ্ধ করত পারুলকে। তবে তখন সবকিছু ছাপিয়ে পারুলের কাছে মনিরের একমাত্র যোগ্যতা হয়ে উঠেছিল তার চক্ষুষ্মাণতা। মনির দেখতে পেত। মনিরের উপস্থিতি তার লোভ জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, অন্ধ মাহমুদের সাথে সুবিদ আলী তার বিয়ে দেবেন। মনিরের সাথে সম্পর্ক কোনোদিন মেনে তো নেবেনই না, বরং জানতে পারলে খুন করে ফেলবেন।

ছোট্ট মফস্বল। এখানে কেউ হাঁচি দিলেও তা গোপন থাকে না। খুব লুকিয়েচুরিয়ে দুজনে দেখা করতে লাগলেন। এক খাঁ খাঁ পূর্ণিমার রাতে পারুল মনিরের হাত ধরে পালান। তখন কোনো অন্ধু যুবক মাহমুদ আলীর কথা মাথায় আসেনি, যে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল পারুলের উপর। মনে পড়েনি স্নেহশীল পিতা সুবিদ আলীর।
মনির আর পারুল পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। স্ত্রী পরিচয় দিয়ে মনির তাকে ঢাকার একটা হোটেলে ওঠায়। হোটেলেই তাদের রাত্রিবাস হয়। মনির তাকে বিয়ে করবে বলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিয়ের আগেই তাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়। এক্ষেত্রে মনিরকে তিনি দোষ দেন না। মনির খুব জোর করেনি তাকে। তার নিজেরই সম্মতি ছিল।
প্রথম রাতের স্মৃতি পারুলের এখনো স্পষ্ট মনে আছে। মনির যখন পাশে এসে বসল, পারুলের শরীর কাঁপছিল। মাতায় ওড়নাটা আরও দীর্ঘ করে টেনে দেয় সে। আস্তে আস্তে ঘোমটা সরিয়ে কপালে একটা দীর্ঘ চুমু খায় মনির। তারপর গালে হাত রেখে বলল, ইশ, তোমার এই আঁচিলটা যদি না থাকত! উুলে যেন একটা কলঙ্ক।
পারুল চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, অমন কলঙ্ক চাঁদেরই থাকে!

দু রাত একসঙ্গে ছিলেন। তৃতীয় রাতে পুলিশ হোটেলে রেইড দেয়। মনিরকে তারা নারী আটক করে। মনিরের উপর নারী পাচারের অভিযোগ ছিল।
একরাত পুলিশ হেফাজতে থাকতে হয় পারুলকে। তারপর তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেনে উঠিয়ে দেয় পুলিশ। ট্রেনে আসতে আসতে মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল পারুলের। একবার ভেবেছিলেন আত্মহত্যা করবেন। সাহসে কুলায়নি।

নানাকিছু ভাবতে ভাবতে একসময় নিজেকে তিনি আবিষ্কার করেন সেই পুরনো বাড়িতে। সুবিদ আলী আর মাহমুদ আলীর বাড়ি। সুবিদ আলীর সামনে দাঁড়ানো। পুরোটা সময় তিনি ঘোরের মধ্যে ছিলেন। ওই ঘোরটুকুই তাকে বাঁচিয়ে দেয়। নইলে নির্ঘাৎ সুইসাইড করে ফেলতেন।

পারুলকে দেখে সুবিদ আলীর কিছুই বললেন না। শুধু তার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি ঝরতে লাগল। না, পারুল কাঁদেননি। তার অশ্রু ফুরিয়ে গিয়েছিল আগেই। সুবিদ আলীর সামনে দাঁড়িয়ে পারুল শুধু বললেন, মাফ করে দেন, আব্বা। সুবিদ আলীকে তিনি আর মাহমুদ আলী, দুজনেই আব্বা বলে ডাকতেন।

আব্বা ক্ষমা করেছিলেন।  পাড়া-প্রতিবেশী অনেক কিছু বলেছিল। তিনি চিলের ছানার মতো আগলে রেখেছিলেন পারুলকে। পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো প্রসঙ্গই তিনি তোলেননি আর। আশ্চর্য বিষয়, মাহমুদ আলীও কখনো এই প্রসঙ্গ তোলেনি তার সাথে।

মাহমুদের সঙ্গে পারুলের বিয়ে হয় এই ঘটনার ঠিক ছ মাস পরে। পারুল তখন ছ মাসের অন্তসত্তা। গর্ভের সন্তান মাঝেমধ্যে নড়েচড়ে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব। পারুল চেয়েছিল সন্তান নষ্ট করতে। সেই প্রথম সুবিদ আলী তার গায়ে হাত তোলেন। তিনি বলেছিলেন, আর কখনো যেন এই কথা শুনি না আমি।

ফুলশয্যার রাতে সাধারণত স্ত্রী খাটে লাজুক সাজে বসে থাকে, নতুন বর এসে দরজা লাগায়। পারুলের ক্ষেত্রে ঘটল উলটোটা। মাহমুদ আলী খাটে বসে ছিল, পারুল দরজা লাগিয়ে এসে খাটে বসল। মাহমুদ আলী হাতড়ে হাতড়ে এসে তার পাশে বসে। প্রথমেই সে পারুলের পেটে হাত রাখে। ফিসফিস করে বলে, পারুল, এটি আমার সন্তান। আমার বাচ্চা। বলো তো, তুমি কী চাও? ছেলে, না মেয়ে?

পারুল কিছু বলে না। নিশ্চুপ বসে থাকাতেই সে স্বস্তি পাচ্ছিল। ঠোঁট কামড়ে ধরে সামলাচ্ছিল কান্না।
মাহমুদ আলীর অনুভূতিশক্তি খুব তীক্ষ্ম। সে টের পেয়ে যায়। বলে, পারুল, তুমি কান্না করো নাকি? একটু থেমে আবার বলে, শোনো, যে যা বলুক, তুমি গায়ে মাখবা না। এই বাচ্চা আমার। আমি অর বাবা। তুমি আমার বউ। বলতে বলতে মাহমুদ আলী পারুলের ঘোমটা সরায়। কপালে হাত রাখে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে হাত নেমে আসে গালে। থমকে যায়।
পারুল, এটা কী? আঁচিল?
পারুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। না, চাঁদের কলঙ্ক। বলেই তার বুক কেমন যেন ধ্বক করে ওঠে। পুরনো চিত্রেরই দৃশ্যায়ন হচ্ছে না তো?
মাহমুদ আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, আহ, যদি আমি দেখতে পেতাম, তোমার এই কলঙ্কটুকুকেই সবচে বেশি ভালোবসতাম।
হ্যাঁ, পারুল ওই একটি মুহূর্তেই মাহমুদ আলীর প্রেমে পড়েন। গালভর্তি অশ্রু নিয়ে ডান হাত দিয়ে তিনি মাহমুদ আলীকে স্পর্শ করেন। বাঁ হাত পেটে রেখে বলেন, এই সন্তানকে ছুঁয়ে তোমায় কথা দিচ্ছি, আমার এই সন্তানের একটি চোখ তোমায় দেবো। সেই চোখ দিয়ে তুমি আমায় দেখবে। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়