ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লেখকের মৃত্যু || মোজাফ্‌ফর হোসেন

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেখকের মৃত্যু || মোজাফ্‌ফর হোসেন

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

বর্তমান সময়ের লিডিং কথাসাহিত্যিক শরিফ চৌধুরী। তার লেখায় ফুটে উঠেছে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষ এবং সাবলটার্নদের কথা। তিনি মানবতাবাদী লেখক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে, কৃষি-আবহে। বাবা ছোটখাটো জমিদার ছিলেন বটে এবং সংসার-জীবনে কোনদিন অভাব-অনটনের জ্বালা টের না পেলেও জীবনমুখী খেটে খাওয়া মানুষদের খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন। অনুভব করার চেষ্টা করেছেন তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা। তাই তো নিম্নবিত্তদের যে হাহাকার, ক্ষুধা ও কামের জ্বালা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, সেটা সমসাময়িক বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর মতো করে কেউ তুলে আনতে পারেননি। এখন তিনি গুলশানে ফ্ল্যাট কিনে ওখানেই বসবাস করছেন। কেন্দ্রে থাকলেও ভুলতে পারেননি প্রান্তিক মানুষগুলোকে। অদ্যাবধি সেই সব মানুষ নিয়েই লিখে যাচ্ছেন। তার এই দায়িত্ববোধ ও প্রখর লেখনীশক্তির কারণে ইতোমধ্যেই বহু পুরস্কার, সম্মাননা ও খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। জনদরদী, জীবনমুখী, মহাত্মা ইত্যাদি বিশেষণ যে যার মতো করে বসিয়ে দিয়েছে তার নামের আগে।
কিছুক্ষণ আগে শরিফ চৌধুরীর গুলশানের ফ্ল্যাটে একটা দৈনিকের সম্পাদক এসেছেন তার ইন্টারভিউ করতে। বর্তমানে টেলিভিশন ও কাগজে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। বিদেশি নামি-দামি আসবাবপত্র দ্বারা সজ্জিত গেস্টরুমে বসে আছেন মাঝবয়স্কা নাজমা আনোয়ার।

আকলির মা নাজমা আনোয়ারকে গেস্টরুমে বসিয়ে ভিতরে গেছে শরিফ সাহেবকে বলতে। শরিফ সাহেব বিয়ে করেননি। এই বিশাল ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। সুন্দরী কিংবা কমবয়স্কা কাজের মহিলা রাখলে পাছে পাঁচজনে পাঁচরকম রটনা রটাবে, ইমেজের ক্ষতি হবে- এই ভেবেই আকলির মাকে বস্তি থেকে উঠিয়ে এনেছেন। আজকাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই অনেকে আসছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ঝাড়িটা যায় আকলির মায়ের ওপর দিয়েই। আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না।
আমার অনুমতি ছাড়া কোথাকার কাকে তুমি গেস্টরুমে বসিয়েছ? কোনো ছোটকাগজের কর্মী-টর্মী নয় তো? হলে এখনও সময় আছে খেদিয়ে দাও। বলো আমি অসুস্থ। শরিফ সাহেব আকলির মায়ের দিকে না তাকিয়েই বললেন কথাগুলো।
না সাহেব। মেয়িটাকে দেকি ভালো ঘরের বুলি মনে হলু। বুলল একটা পেপার থেকি এসিছে। আকলির মা বেশ ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়।
ঠিক আছে, কিছুক্ষণ বসতে বল। শরিফ সাহেব আধাঘণ্টা পরে শালটা গায়ে জড়িয়ে গেস্টরুমে আসলেন। নাজমা আনোয়ার শরিফ সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে সালাম করতে ঝুঁকতে যাবেন এমন সময় তিনি থামিয়ে দিলেন- ও সব অন্য কারও জন্যে তুলে রাখো। তারপর, বলো কেন এসেছ? হাতের ইশারায় বসতে বললেন।

হাতব্যাগ থেকে পুঁচকে একটা আয়না বের করে শেষবারের মতো নিজের চেহারা ঠিক করে নিয়ে নাজমা আনোয়ার শরীরটাকে কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বললেন- স্যার, আমাদের কাগজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে। এ উপলক্ষ্যে আপনার একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে...।

বেশ। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শরিফ সাহেব বললেন। ঝটপট শুরু করো। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং।

স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ?

তেমন কিছু না। মাসখানেক হলো থেকে থেকে জ্বর আসছে।

জ্বর কিন্তু ভালো লক্ষণ না! হেলায় উড়িয়ে দেবেন না। আামার এক নানা...

দেশের নামকরা ডাক্তার আশরাফ বিল্লাহ আমার দেখাশোনা করছে। কী জানতে চাও বলো?- শরিফ চৌধুরী থামিয়ে দিয়ে বললেন।

আপনার ‘কুদ্দুসের নীল আকাশ’ উপন্যাসটির জন্যে দুই বাংলা থেকে অনেক পুরস্কার পেলেন। অনূদিতও হয়েছে ইংরেজিতে। এই উপন্যাসটি সম্পর্কে আপনার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছিলাম।
এই উপন্যাসটাও আমার অন্য উপন্যাসগুলোর মতোই সমাজের এমন এক শ্রেণির মানুষ নিয়ে যাকে নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে অন্য উপন্যাসগুলোর থেকে এখানে মেজাজ ও মেসেজটা ভিন্ন: আমি দেখাতে চেয়েছি, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুদ্দুসের জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। বউ ভেগেছে ভাইয়ের ছেলের সাথে। মেয়ে দুটা বেশ্যাবৃত্তি করে জীবনধারণ করছে, ছেলেটা জেলে। নানা কিসিমের সমস্যা। তবুও কুদ্দুস পরিপূর্ণভাবে সুখী একজন মানুষ। বস্তির চালের ছিদ্র দিয়ে সে নীল আকাশ দেখে। আকাশে টসটসে চাঁদ দেখে তার যৌনপ্রবৃত্তি জাগে। তারাদের সে সন্তানের মতো ভালোবেসে নিজের দেওয়া নাম ধরে ডাকে। মেঘ হচ্ছে তার বাহন। প্রাপ্তির খাতা তার শূন্য, তবুও জীবনের ওপর কোনো অভিযোগ নেই। এখানেই কুদ্দুস আলাদা। এখানেই কুদ্দুসের সাথে আমাদের পার্থক্য।

এ বইটি নিয়ে তো আপনি অনেকগুলো পুরস্কার পেলেন। অনুভূতিটা কেমন?

উম্...দেখো, তথাকথিত পুরস্কার আমার কাছে মুখ্য না। মানুষের স্বীকৃতিই আমার কাছে বড় পুরস্কার। আর তা ছাড়া আমার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত মানুষগুলোর জন্যে কিছু করতে পারছি, তাদেরকে বিশ্বে একটি আইডেনটিটি দিতে পারছি- এই ভালোলাগাটাই মুখ্য, অন্য সব গৌণ!
আপনার উপন্যাস এবং গল্পের চরিত্রগুলো সাধারণত সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষেরা। কেন? এদেরকে নিয়ে লিখলে চলে বেশি এজন্যে, নাকি এটা একধরনের দায়বদ্ধতা থেকে লেখা?
আকলির মা চা-বিস্কিট নিয়ে হাজির হয়। বয়স হয়েছে তার। ইদানিং চোখে বেশ কম দেখছে। টেবিলে ধাক্কা খেয়ে পানির গ্লাসটা শরিফ চৌধুরীর পায়ের কাছে পড়ে গেল। কিছুটা পানি ছিটকে ভিজে গেল তার প্যান্ট, বাকিটা পানি পিচ্ছিল মেঝেতে সাপের মতো মাথা দুলাতে দুলাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

শরিফ চৌধুরী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তেলে-বেগুনে তেতে উঠলেন- চোখের মাথা খেয়েছ নাকি? দেখে কাজ করতে পারো না? এক থাপ্পড় দিয়ে...! বাক্যটা শেষ না করে ডান হাতটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বললেন, কিছু মনে করবে না। এই ছোটলোকের জাতদের একটু টাইটে না রাখলে ঠিক থাকে না। anyway, খুবই ভালো প্রশ্ন। দেখ, ওদের নিয়ে অনেকেই তো লিখছে; সবারটা কি চলছে? চলছে না। আর হ্যাঁ, এখানে সমাজের ঐ মানুষগুলোর প্রতি আমাদের লেখক হিসেবে একটা দায়বদ্ধতা তো অবশ্যই আছে। আমি সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি বললে নিশ্চয় ভুল বলা হবে না।

আপনার চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবজীবনে ঘনিষ্ঠতা বা সম্পর্ক কতখানি?
সম্পর্ক তো একটা আছেই। বাস্তবজীবনে যেমন আছে তেমন কল্পনাজগতেও আছে। আমি বানিয়ে কিছু লিখি না। আবার ওইসব মূর্খ লেখকদের মতো যা দেখি, যা শুনি সেটার জেরক্স কপি বসিয়েও দিই না। দেখি, বুঝি, তারপর নিজের মতো করে চরিত্রগুলো নির্মাণ করি। যাকে বলে বাস্তবের বিনির্মাণ। চরিত্রগুলো বাস্তবে আছে হয়ত কিন্তু তাদের খুঁজে পেতে হলে তোমাকে আমার উপন্যাসেই আসতে হবে।
আপনার উপন্যাসে যৌনতা তীব্রভাবে ধরা দেয়। আপনার অধিকাংশ চরিত্রই অতিমাত্রায় কামুক-প্রকৃতির। লিবিডোর কথা আসেনি, আপনার এমন গল্প উপন্যাস নেই বললেই চলে। কেন?

লিবিডো বাদ দিয়ে কি তুমি মানুষকে ভাবতে পারবে? মানুষকে সম্পূর্ণভাবে আঁকতে হলে তার যৌনাঙ্গগুলো তুমি যেমন এড়িয়ে যেতে পারো না, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমন। আমি সেটিই করি। বাড়িয়ে কিছু করি না বলেই আমার ধারণা।
এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি, আপনি বিয়ে করেননি কেন? পশ্চিমের দেয়ালে সেঁটে থাকা ‘লাস্টসাপার’ ছবিটার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে নাজমা আনোয়ার প্রশ্নটি করে।

শরিফ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন- দেখো, মানুষকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজেকে নিয়ে ভাববার আর অবকাশ মেলেনি। বয়সটা কখন যেন পার হয়ে গেল! আসলে কাজ মানে সামগ্রিক অর্থে মানুষকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছি যে নিজেকে আর আত্মকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে পারিনি।

বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় সর্বত্র থেকে অসংখ্য ছোটকাগজ প্রকাশিত হচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
সে তো খুবই আনন্দের কথা। ছোটকাগজই তো আমাদের সাহিত্য স্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যারা গভীর নিষ্ঠার সাথে এই কাজটি করছে তাদের প্রতি আমার শুভকামনা রইল। তাদের জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা। হাসি হাসি মুখ করে বললেন তিনি।

তরুণ লেখকদের সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে?

তিনি কিছু বলতে যাবেন এমন সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল, তিনি ভদ্রতাস্বরূপ একটু ইশারা করে কলটা রিসিভ করলেন।

বিকাশ বাবু, বলুন কি খবর?...এক্সাটলি...আমারও একই দশা...হাহা।...ওদের বলবেন এডভান্স পেমেন্টটা পাঠিয়ে দিতে। ...হ্যাঁ, নেক্সট মান্থ যাবো, ওরা আমাকে একটা সম্বর্ধনা দিতে চান। অনেকদিন থেকেই ধরেছেন, সময় করে উঠতে পারছি না।...ও আবার লেখক হলো কবে? সব ইতরামো বুঝলেন, বিকাশ বাবু।... এক্সাটলি, দিস ইজ হোয়াট আ’ম টকিং এ্যবাউট...আই সি। আচ্ছা, এই একটা কাগজের সম্পাদক এসেছেন, ইন্টারভিউ দিচ্ছি।...সেই ভালো।

ফোনটা রেখে নাজমা আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিকাশ বাবু কলকাতার নাম করা প্রকাশক। ওখানে আমার বইগুলো তিনিই করেন। ও হ্যাঁ, আমরা কোথায় যেন ছিলাম?

তরুণ লেখকদের কথা বলছিলাম। নাজমা আনোয়ার মনে করিয়ে দিলেন।

তরুণদের বই আমার বিশেষ পড়া হয়ে ওঠে না। অনেক তরুণ আমাকে উৎসর্গ করে কিংবা এটা-ওটা লিখে বই পাঠায়। নেড়েচেড়ে দেখব অত সময় কোথায়! এটা ছেপো না। লিখে দিও, তরুণদের কাজের খোঁজখবর আমি রাখি। তরুণদের ব্যাপারে আমি সবসময় আশাবাদী।

স্যার, এই সময় যারা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, তাদের মধ্যে কার কার লেখা আপনাকে বেশি টানে?

সত্যি বলতে কেউ না। এ কথাগুলো রেকর্ড করো না, হ্যাঁ? দেখো, এখন মুদির দোকানদাররা লেখালেখি করে। সব মূর্খ। ওদের লেখা পড়তে হলে চামচিকার রুচি লাগে। আমার সেই রুচি নেই। আমি পত্রিকা খুলে নিজের লেখাটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে রেখে দিই। তুমি এই প্রশ্নটাই বাদ দিয়ে দাও। অনেক হলো। তুমি বরং ওঠো আজ। বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

একটা সেলফি স্যার?- নাজমা আনোয়ার তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে অনুরোধ করলেন।

নিশ্চয়। ফেসবুকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট আমার নামে একটা পেইজ চালায়, ওখানে দিয়ে দিও। সেলফিটা তোলা হলে ডুপ্লেক্স বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন শরিফ চৌধুরী।

খ.
আজ রোববার। ডা. আশরাফ বিল্লাহ আসবার কথা মঙ্গলবার, সাপ্তাহিক চেকআপ করতে। কিন্তু আজ তাকে জরুরি তলব পাঠিয়ে আনা হয়েছে। শরিফ চৌধুরীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না মোটেও। খাটে শুয়ে আছেন তিনি, ডা. আশরাফ বিল্লাহ তার প্রেশার মেপে দেখছেন।

চৌধুরী সাহেব, মনে হচ্ছে ক্রমেই অবস্থার অবনতি ঘটছে।

কার অবস্থার- আমার না আপনার যন্ত্রের? মশকরা করে বললেন শরিফ চৌধুরী।

উম্...! বুঝলেন চৌধুরী সাহেব, মাঝেমধ্যে মানুষের অসুখ হবার প্রয়োজন আছে, এতে করে প্রাণভরে বিশ্রাম নেয়া যায়।

সে যা বলেছেন! নইলে পৃথিবী থেকে যে ডাক্তার শ্রেণিরও বিলুপ্তি ঘটবে!

হা হা! আপনার সাথে কথায় পারে কে!

ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলাম, কয়েকদিন ঘুমিয়ে কাটান সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আশরাফ বিল্লাহ বললেন।

ডাক্তার?

কিছু বলবেন?

হু, ঠিক আছে; আপনি বরং আসুন।

গ.
শরিফ চৌধুরী টেবিলে বসে লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইদানিং ঘুমটা ভালো হচ্ছে না তার। ঘুমিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত ভুতুড়ে সব স্বপ্ন দেখছেন। চোখের পাতা এঁটে আসতেই অন্ধকার রুমে আরও দুজনের উপস্থিতি টের পেলেন তিনি। শরিফ চৌধুরী চিৎকার দিয়ে আকলির মাকে ডাকলেন, কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না তার।

তোরা আবার এসেছিস? তিনি রাগান্বিত গলায় বললেন।

সাহেব, আমি আমার বউকে খুন করতে পারবু না! পুরুষ কণ্ঠটি কাতর স্বরে বলে।

কিন্তু তোর বউকে খুন না করলে যে আমি উপন্যাসটা জমাতে পারব না!

আমি যে তাকে খুব ভালোবাসি!

চোরের আবার ভালোবাসা?

সাহেব, চোর হলে কি বউকে ভালোবাসতে নেই? জেদ চেপে যায় পুরুষ কণ্ঠটির।

শোন্, তুই হচ্ছিস মাতাল, জুয়াড়ি..! তোর মতো মানুষ বউকে খুন করবে এটা আমাদের সমাজে খুবই প্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। শরিফ সাহেব বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

আমি পারবু না। আপনি বইটা অন্যভাবে শেষ করেন! আচ্ছা, আমি যদি চুরি করা ছেড়ি দি, জুয়া-মদ বেবাক ছেড়ি ছুড়ি সাধারণ মানুষ হয়ে যাই? আপনের মতো ভালা মানুষ? তাহলে হয় না?

তুই সাধারণ মানুষ হয়ে গেলে আমার উপন্যাসের বিশেষত্ব থাকল কোথায়? তোদের সাথে আমার ব্যবধানটাই তো ওখানে। এ ব্যবধান তো ঘুচবার নয়। মরতে তোকে হবেই!

আমি মরতি চাই নি সাহেব। আমি বাঁচতি চাই। স্ত্রী কণ্ঠটি আকুতি জানিয়ে কেঁদে ওঠে।

পেট পুরে খেতে পাস না! নেশাখোর স্বামীতে মেটে না দেহের জ্বালাও! তোর এত বাঁচার শখ কেন? শরিফ সাহেবের পাগল হবার অবস্থা।

তবু, তবুও আমি বেঁচি থাকতি চাই। বেঁচে থাকতি আমার ভাল্লাগে! আমার সুখ লাগে!

মানুষ আমার উপন্যাস পড়বে তোদের মতো ছোটলোকদের ভালোলাগা দেখতে? ওরা তোদের হাহাকার, সর্বনাশ দেখতেই আমার উপন্যাস পড়ে! তারা সুখ পায়! স্বস্তি পায় নিজেদের তোদের সাথে তুলনা করে! নিজেরা কিছুটা হলেও ভাল আছে- এই ভেবে। আর আমি পাই প্রচার-প্রতিষ্ঠা! তোদের মতো নিঃস্ব ছোটলোকদের যদি সুখের বন্যায় ভাসিয়ে দিই তাহলে পৃথিবীর এত জ্ঞান, অর্থ, সম্মান- এসবের মূল্য কোথায়? এসব যে একেবারে অর্থহীন হয়ে যাবে!

মানুষ! মানুষ! হায়রে মানুষ! স্ত্রী কণ্ঠটি শরিফ চৌধুরীর পায়ে মাথা খুটতে খুটতে বলে।

কিন্তু আর না। আপনের নির্দেশে অনেক অপরাধ করছি, আর কিছুতেই না। আমি আমার ফুলবানুরে মারতি পারবু না। প্রয়োজনে...! চোখ বড় বড় করে মাথা উঁচু করে তেড়ে আসে পুরুষ কণ্ঠটি।

কি বল্লি? হারামজাদা! আমাকে ভয় দেখাস? হা! হা! হা! আমি তোদের প্রভু, তোদের সৃষ্টিকর্তা। আমি যেমন করে চাইব তেমন করেই হবে সব। আমার ইচ্ছাই এখানে চূড়ান্ত। তোদের জীবনের করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়েই শেষ হবে আমার এই উপন্যাস।

কিছুতেই না। কিছুতেই মানবো না আমরা। প্রয়োজনে আমরা আপনার গল্প থেকে বের হয়ে যাব।

কোনো লাভ হবে না। আমার গল্পের বাইরে তোদের কোনোই অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীর কেউ জানবে না তোদের কথা। হা হা করে হেসে ওঠেন শরিফ সাহেব।


মধ্যরাতে তার হাসির আওয়াজ শুনে ছুটে আসে আকলির মা। আকলির মায়ের হাতের স্পর্শে শরিফ চৌধুরীর ঘুম ভেঙে যায়।

কে? কে? শরিফ চৌধুরী গোঙাতে থাকেন।

স্যার আমি- আকলির মা! কি হয়িচে? কে ছোটলোকের বাচ্চা? আপনি এমুন করচেন কেনে?

কিছু না। আমাকে একগ্লাস পানি দে। শরিফ চৌধুরী স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন।

একি! আপনার গা তো জ্বরে পুড়ি যাচ্ছি! ডাক্তারকে ফোন করবু?

এত রাতে? থাক। দরকার নেই।

তালি একটা ঘুমের ওষুধ খান? দেবো?

ঘুম? না! না! আমি ঘুমাবো না। তুই যা। উপন্যাসটা শেষ করতে হবে।

শোন আকলির মা, তোর তো অনেক দুঃখ! স্বামী ছেড়ে গেছে। একমাত্র মেয়েটার সন্ধান পেলি না। কখনো আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করেনি তোর?

কি সব অলক্ষুণে সাহেব? আত্মহত্যার কথা ভাবাও পাপ! এ কাল তো আর ফিরি আসবি না। পরকালটাও খোয়াবু নাকি?

না ধর তোকে বলা হলো, গল্পের মানুষগুলোর মতো তোরও কোনো পরকাল নেই। নেই তাই স্বর্গ-নরকের সম্ভাবনাও। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঘটে গেল তোর সকল কষ্টের অবসান। তাহলে?

তবুও কেমন জানি ডর করে! বেঁচি থাকতি কার না পরাণ চায়!

মৃত্যুকে তোরা এত ভয় পাস কেন বুঝি না!

সাহেব, ডাক্তার আপনাকে বেশি রাত জাগতি মানা করিচে।

যা তুই।

শরিফ চৌধুরী খুব ক্লান্ত। একটু এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে আরেকটু ক্লান্ত হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমটা চেপে ধরে তাকে।

তুমি? কে তুমি? কার অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছ?

হুজুর, আমাকে চেনলেন না? আমি কুদ্দুস।

কুদ্দুস! কোন কুদ্দুস? না আমি কোনো কুদ্দুসকে চিনি না।

এত তাড়াতাড়ি ভুলার কথা ছেল না? এক চাদিফাটা দুপরে নারায়ণগঞ্জের বস্তিতে আপনি এসিলেন, আমার কাছে- মনে পড়ে?

হ্যাঁ, হবে হয়ত। কি চাও এখন?

হুজুর, আপনি না বুলিলেন, আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখে আপনি আমার জীবনটাকে বেবাক পাল্টে দেবেন?

হ্যাঁ, আমি আমার কথা রেখেছি। আজ তো তুমি তারকা! দেশ বিদেশের মানুষ তোমার নাম জানে।

সবাই চেনে আপনার বইয়ের কুদ্দুসকে। সবাই জানে, নীল আকাশ দ্যাখলেই কুদ্দুসের খাওন লাগে না। কেন্তু, ভুখ যে আমাকে শ্যাষ কইরা দিলো! আপনি না বুলিলেন...! কিন্তু কই কেউ তো আইলো না আমার কাছে? সবাই আপনার প্রশংসা করে, কাগজে আপনের মেলা ছবি দেহি। আপনি পুরস্কার পাইলেন, মেলা টাকা পাইলেন। কেন্তু আমার তো কিচু হইলো না। রাস্তার কুদ্দুস আমি, রাস্তায়ই থ্যাইকা গেলাম! আর আপনে...?

তোর মতো ছোটলোকের নাম দেশবাসী জানে- আর কি চাস্ তুই?

খাওন চাই, একটা বালিশ চাই। আর চাঁদ দেখে আমার কিচ্ছু হয় না। ওসব মিছা কথা। আমার দেহ চাই। মরা, তাজা, শুকনো- দেহ একটা হইলিই হইবো।

আমি মাগীর ব্যবসা করি, না? দানের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছি? এখানে কেন এসেছিস?

আমার হিসসা বুইঝা লইতে।

কি বললি? কিসের হিসসা? দারোয়ান! দারোয়ান!

চিৎকার কইরেন না। আমি যাইতেসি। তই হিসাব বুইঝা লইতে আবার আমু। আমার পোলাটা জেল থ্যইকা ছাড়া পাইছে। ও এখন সৎ-পথে রোজগার করে। আমার বউটা মারা গেছে, আমি হেরে মাপ কইরা দিছি। আপনার উপন্যাসে লিইখা দিয়েন।

দারোয়ান! দারোয়ান!

শরিফ চৌধুরীর চিৎকার শুনে আবারও ছুটে আসে আকলির মা।

সাহেব, কি হয়িচে? দারোয়ানকে ডাকেন কেনে? সাহেব!

তুমি? কিছু হয়নি। ডাক্তারকে কাল একবার আসতে বল।

শরিফ চৌধুরী উঠে বসেন। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় যান। আকাশে একথালা চাঁদ তার দিকে তাকিয়ে ছ্যাবলার মতো দাঁত বের করে যেন হাসে বলে মনে হয়। শরিফ চৌধুরীর বিশ্রি লাগে হাসিটা। ভেতরে আসেন, টেবিলের বাতিজোড়া জ্বালিয়ে ভুলে যেতে চান চাঁদের কথা।

ঘ.
বহুদিন পর শরিফ চৌধুরীর বাল্যবন্ধু কবি মাসুম আজিজ এসেছেন। মাসুম আজিজ স্বভাব-কবি। কবিতার জন্যে তিনি জীবনে অনেক ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত দুটোর বেশি বই বেরোয়নি। যে দুটো বই বেরিয়েছে তাও আবার তাঁর অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে। মাঝে ধারধুর করে একটি কবিতার কাগজ করতেন, এখন আর কেউ ধার দেয় না। বেশ কয়েকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি। কিন্তু বই করবে কে? তার নেশা কবিতা। কবিতা থেকে তাকে ছাড়াতে পারে এমন কোনো নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ঢাকায় এসেছিলেন একটা কবিদের সম্মেলনে। ভাবলেন অনেক আগের পুরনো বন্ধুটার সাথে একবার দেখা করে যাই।  

তা কবি যে! পথ ভুল করে নাকি?

না বন্ধু, পথঘাট ঠিকঠাক দেখেশুনেই আসতে হয়েছে।

এতদিনে খোঁজখবর নিতে আসলে?

উ-হু, দিতে আসলাম। তোমার খবর তো আজকাল মিডিয়াতেই পাওয়া যায়।

তোমরা কবিরা কথার জাদুকর! তোমাদের সাথে পেরে ওঠা বড় মুশকিল!

আজকাল কথাসাহিত্যিকরাও কিন্তু কম জানে না! তুমি তো দেখিয়েই দিলে...

কি-যে বলো না! সবই মানুষের ভালোবাসা। বুঝলে হে?

মানুষের ভালোবাসা? হুম! সে তো বটেই!

আমার কথা বাদ দাও, তোমার কথা শুনি। শুনলাম অভাবে পড়েছ?

অভাব? যার কিছু নেই তার আবার অভাব কিসের? অভাব তো হবে তোমাদের!

হা! হা! হা! ভালো বলেছো। তবে জানো কি বন্ধু- সবই আছে কেবল শান্তি নেই!

বিয়েটা যদি করতে, তাহলে...?

তুমি তো সবই জানো!

এত টাকা তোমার; বাইরের কোনো ভালো ডাক্তারকে দেখালেই পারতে?

চেষ্টা করিনি আবার! বাদ দাও ওসব কথা।

এত খ্যাতি, এত টাকা- এসব কার জন্যে শুনি?

কেউ নেই বলে তো এগুলোর দরকার বেশি বেশি। কিছু একটা নিয়ে তো বাঁচতে হবে। নিজেকে ভুলিয়ে রাখা আর কি!

হুম্! তা, এই বইমেলায় কি বই বেরুচ্ছে তোমার?

একটি উপন্যাস নিয়ে পড়ে আছি বহুদিন থেকে। শেষের দিকে আটকে গেছি। কিছুতেই এগুতে পারছি না।

আটকে গেছো মানে? তোমাকে আটকায় কার সাধ্য!

গল্পের চরিত্রগুলো কেনো জানি...

চরিত্রগুলো আবার কী করেছে?

না, ও কিছু না। কবিরা বুঝবে না ওসব। ইনফ্যাক্ট, আমি নিজেই ঠিকমতো বুঝতে পারছি না।

উপন্যাসটির নাম কি দিলে?

‘কুঁড়েঘর!’

বন্ধু, একটা হিসেব আমি কিছুতেই মেলাতে পারলাম না, একটু ধরিয়ে দিবে?

কেন? অংকে তো তুমি আমার থেকে বরাবরই ভালো ছিলে।

কিন্তু জীবনের অংকে তুমিই জিতেছো। তুমি তো জীবনে কখনো অভাব দেখনি। সোনার চামচ-মুখে জন্ম তোমার। তবুও তোমার উপন্যাসে অভাবে জর্জরিত, অসহায়, না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর চরিত্র এত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে কি করে? পুকুরের জল দেখলেও ক্ষুধায় আমার পেট চো চো করে কিন্তু কই হাহাকার নিয়ে তো একটা পঙ্‌ক্তিও লিখতে পারলাম না!

যার যেটার অভাব সে সেটা নিয়েই তো থাকবে- নাকি?

উম্, হ্যাঁ...হবে হয়ত...। একটু আনমনা হয়ে মাসুম আজিজ বললেন। জানো বন্ধু, বহুদিন থেকে অল্প অল্প করে কিছু টাকা গুছিয়েছিলাম। ভাবছিলাম এইবার একটা বই করবো। ছোট মেয়েটা খালি বলে, বাবা তোমার বই হবে না? ওর মায়ের ক্যানসার ধরা পড়লো। আমার লেখালেখি ও কোনো দিনই সহ্য করতে পারেনি। সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। কত চেষ্টা করলাম পারলাম না। কবিতাকে আমি আর ধরে নেই, কবিতারাই আমাকে ধরে আছে। গরিবের এসব ঘোড়ারোগ কেন যে হয়! তোমার অসুখটা আমার হলেই ভালো হতো, কবিতা আর সংসারের পাল্লা দিয়ে এই টানাপড়েন আমার আর ভাল্লাগে না। প্রকৃতির আশীর্বাদে আমি পেলাম ঘোড়া আর তুমি পেলে চাবুক! হা… হা…।

হাসতে থাকে দুই বন্ধু।

ঙ.
ওষুধ বোধহয় ঠিকমত খাচ্ছেন না! অবস্থার তো আরো অবনতি ঘটেছে দেখছি। ডা. আশরাফ বিল্লাহ শরিফ চৌধুরীর পাল্‌স পরীক্ষা করতে করতে বললেন।

আচ্ছা ডাক্তার, আমরা সবাই কোনো না কোনো উপন্যাসের চরিত্র না-তো? সময়ের কলম মহাকালের খাতায় লিখে চলেছে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত! আমাদের অস্তিত্ব কি শুধুই পৃথিবী নামক এই উপন্যাসের মধ্যে বন্দি! এই উপন্যাসের কি আর কোনো খণ্ড বেরুবে, ডাক্তার?

জটিল প্রশ্ন! এ রহস্য-উন্মোচন ডাক্তারের জ্ঞানের বাইরে।

এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে আমরা সবাই ঐ বইয়ের চরিত্রগুলোর মতোই একটি নির্দিষ্টতার মাঝে বন্দি? কেউ একজন আমাদের লিখে চলেছেন আপন মেজাজে!

আমি কিন্তু ইচ্ছা করলেই একটা ইনজেকশন পুশ করে আপনাকে চিরকালের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারি; আমি চিন্তা করতে পারি ইচ্ছামতো- এত স্বাধীনতা আপনি দেন কি আপনার চরিত্রগুলোকে?

কিন্তু তবুও আপনি জানেন না আপনার গল্পের শেষটা, এক্ষেত্রে আপনি আমার চরিত্রগুলোর মতোই অসহায়।

হুম্...জ্বর বেড়ে গেছে। না, এভাবে আর হবে না। আপনার বায়ু পরিবর্তন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। ঘুরে আসুন কোথাও থেকে। দেশের বাইরে কোথাও।

দেখি, উপন্যাসটা শেষ করি আগে।

ঠিক আছে। আমি বরং উঠি। আপনি কাজটা সেরে নিন। টেবিলে ঘুমের ওষুধ রেখে গেলাম, খেয়ে নেবেন।

চ.
রাত ২টা। শরিফ চৌধুরী চেয়ার-টেবিলে বসে লিখে চলেছেন। রাজ্যের ঘুম তাঁর চোখে কিন্তু উপন্যাসটি শেষ না করে আজ কিছুতেই ঘুমাবেন না তিনি। ক্লান্ত শরীরের সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করেই জেগে রইলেন। কিন্তু আজ জেগে থেকেও মুক্তি হলো না তার।

আবার এসেছ? কি চাও তোমরা?

আপনার হাত দিয়ে এখনো কলঙ্কের রক্ত টপ্ টপ্ করে ঝড়ে পড়ছে! আমরা আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি। এক পুরুষকণ্ঠ বলে।

আমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে। আমি প্রতিশোধ চাই। অন্য একটি পুরুষকণ্ঠ যোগ করে।

আমি কোনো পাপ করতে চাইনি। আমার সমস্ত পাপের জন্যে আপনিই দায়ী। আমি আপনার শাস্তি চাই। আর এক পুরুষকণ্ঠ বলে ওঠে।

সাহেব, আমার গল্পটা ফেরত দেন। আমি বদলি গিছি। আমি দুনিয়ার কাছে আর খারাপ হয়ি থাকতি চাই নি। এক নারীকণ্ঠের আর্তি। 

তোমরা? আমি তোমাদের দেখে নেবো।...আমি তোমাদের সব্বাইকে পুলিশে দেব।

পুলিশ? পুলিশকে আমরা ডরাই না স্যার। আমাদের না আপনার লেখার বাইরে কোনো অস্তিত্ব নেই? আমাদের কেউ ধরবার পারবো না। সমবেত কণ্ঠস্বর শরিফ চৌধুরীর দিকে ধেয়ে আসে।

একি? তোমরা এভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসছো কেন? শরিফ চৌধুরী ভয়ে কুকড়ে যান। না, না, এ অসম্ভব- এ হতে পারে না! আমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছি। আমি নিশ্চয় জেগে নেই। ওয়েক আপ- নিজেকেই নিজে বলেন তিনি।

স্বপ্ন? স্বপ্নই তো! আমরা সবাই স্বপ্ন দেখছি। আমরা কেউ আর জেগে নেই। সমবেত কণ্ঠস্বর উত্তর দেয়।

না, এ অসম্ভব! ছেড়ে দাও আমাকে। আমাকে বাঁচতে দাও দয়া করে।

মৃত্যুকে এত ভয় কিসের চৌধুরী সাহেব? খুব চেনা এক নারীকণ্ঠ আরও কাছে এসে জিজ্ঞেস করে। কানের ভেতর গরম নিঃশ্বাস মিশিয়ে বলে- আমার কোনো সন্তান ছিল না। কিন্তু আপনি আমাকে আকলির মা বানিয়েছেন। আমি এখন সত্যি সত্যি আমার আকলিকে চাই। আমার হারিয়ে যাওয়া আকলিকে এনে দিন, সাহেব।

তা হয় না। আকলি আমার নির্মিত। ও কখনোই বাস্তবে ছিল না। নেই। তোমার একটা মেয়ে ছিল বলেছিলে; জন্মের পরমুহূর্তেই ডাস্টবিনে ফেলে এসেছো। কিন্তু আমি যার নাম দিয়েছি আকলি, সে অন্য মেয়ে।

আমি আমার মেয়েকে চাই। আপনি না সৃষ্টি করতে পারেন? নারীকণ্ঠ বলে। অন্য কণ্ঠস্বরগুলো তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শরিফ চৌধুরীর দুকানে আগুনের উত্তাপ মিশিয়ে বলে- যদি নতুন করে কিছু সৃষ্টি না হয়; তবে ধ্বংস হোক আজ সব।   

তোমরা আমাকে মারতে পারো না। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। এতটা বিশ্বাসঘাতক তোমরা হতে পারো কি করে?

আমি চোর, আমি মাতাল, আমারে কেউ বিশ্বাস করে না, আপনিই বলেছেন। পুরুষ কণ্ঠটি কানের ভেতর থেকে মুহূর্তের জন্য বের হয়ে এসে বলে কথাগুলো। কেউ একজন অন্ধকার থেকে গলা চেপে ধরে। শরিফ চৌধুরীর কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে আসে। মেঝেতে পড়ে তড়পাতে থাকেন তিনি।

ছ.
সকাল ৭টা। মেঝেতে সাদা কাপড় দিয়ে জড়ানো কথাসাহিত্যিক শরিফ চৌধুরীর মৃতদেহ। ইনস্পেক্টর তানভির সুমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন রুমের চারপাশ। তেমন কোনো আলামত না পেয়ে উনি বেশ হতাশ হচ্ছেন সেটা তার ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে। আকলির মাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।

গতকাল বাসায় কে কে এসেছিল?

স্যারের মেলা দিনের একবন্ধু আর ডাক্তার।

রাতে তুমি আর স্যার ছাড়া বাসায় আর কেউ ছিল?

না। কেউ ছিল না। আকলির মা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর করে।

তুমি কখন স্যারকে মৃত হিসেবে আবিষ্কার করলে?

সকালে চা দিতি গি’ দেখি, স্যার মেঝিতে পড়ি আছে। অনেক ডাকাডাকি করলাম, কোনো সাড়াশব্দ নেই। গায়ে হাত দি’ দেখি...! আকলির মা কথা বলতে বলতে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে।

রাতে রুমের ভেতর থেকে কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?

না।   

যদি খুন হয়ে থাকে তবে তোমাকে আমাদের আবারও লাগবে! তুমি আমার অনুমতি ছাড়া শহর ছেড়ে কোথাও যাবে না। এটা আমার নির্দেশ।

ইনস্পেক্টর সুমন আরও একবার ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন।

খুন? কি বুলেন আপনি? স্যারকে খুন করা হয়িচে? হায় আল্লাহ! আমি একি শুনছি। আকলির মা মেঝেতে পড়ে মাথা খুটতে থাকে।

এখন এতটা নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। হার্ট এ্যাটাক কিংবা আত্মহত্যাও হতে পারে- মেডিক্যাল টেস্টের পর সব জানা যাবে। ডেড বডিটা গাড়িতে তোলো। কনস্টেবলদের ইশারা করে বললেন।

আত্মহত্যা? না, না, স্যার আত্মহত্যা করতি যাবে কুন দুঃখে! স্যারের কি ভাতের অভাব না মানের?

আমি আবার আসবো। তোমার নামটা কি যেন?

আকলির মা। স্যার এই নামেই ডাকতেন।

এটা তো স্যারের একটা উপন্যাসের নাম।

হঁ। হেইডা আমি।

আকলি এখন কোথায়?

বইটা পড়েননি?

পড়িনি, তবে সিনেমাটা দেখেছি। শেষটায় তোমার মেয়েটা ওভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো, ভেরি স্যাড! শোনো, কাদের সাথে স্যারের ওঠা-বসা তার একটা তালিকা করে আমাকে দিবে। শরিফ সাহেব খুব ভালো মানুষ ছিলেন বলে জানি। এমন সাক্সেসফুল একজন মানুষের জীবনের এইভাবে ইতি ঘটবে- ভাবা যায় না!


 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়