ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

একচক্ষু হরিণীরা : নবম পর্ব

রাসেল রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একচক্ষু হরিণীরা : নবম পর্ব

চৌদ্দ
সেদিন ‘জরুরি কাজ আছে’ বলে আহিরের বাসা থেকে বেরিয়ে আসি আমি। আহিরও আর আটকায়নি। সেদিনের পর আজ গেলাম আহিরের বাসায়, প্রায় সাত মাস পর। এর মধ্যে আহির একবারও বাসায় যাওয়ার কথা বলেনি। বিকেলে অফিসের সামনে দেখা করতে গেলাম আহিরের সাথে। আজ তাকে দেখতে আসার কথা। পাত্রপক্ষ দেখে গিয়েছে, নাকি রাতে আসবে, এখনো জানি না। দেখা হওয়ার পর আহির প্রথমেই যেটা বলল, তোমাকে এমন বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? দুপুরে ভাত খেয়েছ?

হুম।

কী দিয়ে খেয়েছ ভাত?

আধমিনিট ভেবে উত্তর দিই, কই মাছ আর লাউ।

আহির করুণ স্বরে বলে, তোমাকে না বলেছি আমার সঙ্গে মিথ্যে না বলতে! তাও কেন মিথ্যে বলো বারবার?

ওই আধ মিনিট সময় নেওয়াতেই ধরে ফেলেছে আহির। সময় না নিলেও সে ধরে ফেলত, আমি নিশ্চিত। আগেও কয়েকবার মিথ্যে বলতে গিয়ে ধরা খেয়েছি আহিরের কাছে। কীভাবে কীভাবে জানি সে আমার মিথ্যেগুলো ধরে ফেলে। তাই এবার না খাওয়ার ব্যাপারটি স্বীকার করি বিনা বাক্যে।

টাকা নেই তোমার কাছে একদম?

না। এক জায়গা থেকে একটা বিল পাওয়ার কথা ছিল, পাইনি।

আমার এই পত্রিকায়ও না তুমি কিছু বিল পাও? ওটা নাওনি এখনো?

নাহ।

কেন?

আমি এই পত্রিকাতে আর লিখব না। এটা থেকে আর কোনো বিলও নেব না।

আহির আর কথা বাড়ায় না। আমার চাকরি না হওয়ার বিষয়টা জানে দেখেই হয়তো কখনো পারতপক্ষে এই পত্রিকার কথা তোলে না সে। নিজের ব্যাগ হাতড়ে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে আহির। বলে, এটা রাখো।

টাকাটা নিতে নিতে বললাম, এটাও কিন্তু ধার। ফেরত দেবো। চার হাজার পাঁচশ হলো। তোমার বিয়ের আগেই ফেরত দেবো। পাত্র কি দেখতে এসেছিল, নাকি আসবে- কোনটা?

আহির তার স্বর্গীয় হাসিটি ঢেলে দিল। এই মুহূর্তে রাত্রি হলে মানুষ নির্ঘাৎ জ্যোৎস্না ভেবে বসতো। আমার কথার উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে আহির বলল, চলো, আজ দুজনে বাইরে খাই। আমি যদিও দুপুরে খেয়েছি, তাও তোমার সাথে খেতে ইচ্ছে করছে।

একটু থেমে আবার বলল, নাহ, বাসায় চলো। আজ গরুর মাংস রান্না করেছি। হেঁটে যাব না, একটা সিএনজি ডাকো।


সিএনজিতে করে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। তার উপরে দিন খুব বড় নয়। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। সিএনজিতে বসে আমি আরও একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাত্র দেখতে এসেছে কি না? আহির আবারও কথা ঘুরিয়ে গেল। আমি আর বাড়াইনি। সে নিজেই বলবে। বাসায় ঢুকে আহির বলল, তুমি চাইলে গোসল করে ফেলতে পারো। জহিরের লুঙ্গি আছে বাসায়, ওটা পরে গোসল করো। তোমার পরনেরটাই পরতে হবে আবার, জহিরের কাপড় তোমার লাগবে না।

আমি বললাম, গোসল করতে হবে না। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি।

তুমি গোসল করে আসো, প্লিজ। সারা গা দিয়ে ঘামের গন্ধ আসছে তোমার। কই কই হেঁটে বেড়াও রোদে!

আমি বিব্রত বোধ করি। এতক্ষণ সে ঘামের বিকট গন্ধ পেয়েছে। আবার ভালোবাসাও বোধ করি। সামান্য নাক কোঁচকায়নি সিএনজিতে বসে। দূরে সরে থাকেনি। এজন্যই আহির হলো আহির।


গোসল করে বের হয়ে দেখি আহির প্লেটে ভাত নিয়ে বসে আছে। দুজনে একসাথে ভাত খেতে বসি। ভাত মাখাতে মাখাতে আহির বলল, পাত্রপক্ষ সকালে এসেছিল। দেখে গেছে।

আমি খুব আনন্দ আনন্দ ভাব নিয়ে বললাম,  কী বলেছে তারা? আর দেখল কীভাবে? চুল খোলো, একটু হাঁটো, এভাবে?

আরে, ওসব নাহ! এখন কি আর ওই যুগ আছে? আসলো, সামান্য সময় থাকল, চা-বিস্কুট খেয়ে বিদায় নিল। আংটি পরিয়ে গেছে। সামনের মাসেই বিয়ে। আজ-কালের মধ্যে বিয়ের ডেট জানাবে।

আমার বুকে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। নাকি কতগুলি মোষ দৌড়ে গেল রক্তে, নখের ডগা থেকে হৃদপিণ্ড পর্যন্ত? হৃদয়বর্তী এই তাণ্ডব আহিরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে, নাকি তার বাঁ হাতে কড়া রোদে ঝিকঝিক করে ওঠা তরবারির মতো উজ্জ্বল আংটিটা এতক্ষণ পর্যন্ত আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, সেজন্য-বুঝতে পারলাম না।

মুখে যথেষ্ট হাসি ঝুলিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, পাত্র কী করে?

পরমাণু শক্তি কমিশনে সিনিয়র অফিসার না কী যেন?

কী যেন মানে? ঠিকভাবে খোঁজ নেবে না?

খোঁজ নিয়েছে তো!

কে খোঁজ নিয়েছে?

বাবা খোঁজ নিয়েছে। কোনো ঝামেলা নেই। বাবার এক সহকর্মী ওখানে কাজ করে। ছেলেদের বাসাতে ভদ্রলোক ভাড়া থাকেন আঠারো বছর। ঝামেলা থাকলে জানতেন।

তবু খোঁজ নিয়ে দেখো। আজকাল কাউকেই ভরসা করা যায় না।

ধুর! সবাই খারাপ নাকি?

তুমুল আহত হলাম। বিয়ের আগেই ভদ্রলোকের পক্ষ নিয়ে আহির আমার সাথে তর্ক শুরু করে দিয়েছে।

তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে আমি চলে যেতে চাইলাম। আহির বলল, আর কিছুক্ষণ থাকো না, প্লিজ! বাবা আর জহির গ্রামে গেছে। সেখানে সামান্য যে জমিজমা আছে আমাদের তা নিয়ে কী ঝামেলা যাচ্ছে। একবারে বিক্রি-টিক্রি করে আসবে। বিয়েতে খরচ আছে তো। আজ ওখানেই থাকবে। জহিরকে রেখে যেতে চাইছিল, কিন্তু জমিটা নিয়ে জটিলতা একটু বেশিই। বাবা একা পারবেন না। আমি জোর করে জহিরকে সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার দুঃসম্পর্কের এক ফুপু থাকেন পাশেই। রাতে তার থাকার কথা ছিল। বাবা বলে গেছেন। কিন্তু বেচারির ভয়াবহ জ্বর এসেছে। দুপুরে ফোন করেছিলেন উনি। আমাকে যেতে বলেছেন ওনার ওখানে। আমি না করে দিয়েছি। ওনার বাসায় আমার ভাল্লাগে না। ওনার একটা ছেলে আছে, আমাকে দেখলেই খুব কুৎসিতভাবে তাকায়। বরং এখানে একা থাকতে ভালো লাগবে আমার।

রাতে আহির কীভাবে থাকবে, ভেবে দুশ্চিন্তা হলো। খুব ভালো হতো আমি এখানে রাতে থেকে গেলে। অন্য রুমে ঘুমোতাম। কিংবা সারারাত গল্প করতাম দুজনে। ইচ্ছে করল বলতে, আহির তুমি চাইলে আমি থাকতে পারি রাতে তোমার সাথে। দুজন সারারাত গল্প করব না হয়। বলা হলো না। শেষে আমাকেও ফুপুর ওই কুৎসিতভাবে তাকানো ছেলেটির মতো ভেবে বসার সমূহ আশঙ্কা আছে। আজ যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, এমনিতেই তার সাথে সবকিছু বলা উচিত না। প্রতিটা শব্দ মেপে মেপে বলা উচিত।


ভাত খেয়ে একটা সিগারেট খাওয়া অভ্যাস আমার। সিগারেট হাতে নিয়ে উসখুশ করছি। ধরানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। আমার দিকে তাকালেই আহির ভিতর পর্যন্ত সব পড়ে ফেলে। সে বলল, বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাও, আমি গোসল করে আসব একটু।

‘আচ্ছা’ বলে আমি বারান্দায় চলে গেলাম। রাস্তা থেকে তির্যকভাবে সোডিয়াম আলো পড়েছে বারান্দায়। সবকিছু আধো-স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় গিয়েই আগে চোখ গেল গ্রিলে। গ্রিল ফাঁকা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আজও অমন কিছু থাকলে আমি নিজে সাবধানে একটা জামা টেনে দিতাম।

সিগারেট ধরিয়ে আগে ফুলগাছগুলোর দিকে তাকালাম। প্রজাপতি দুটোকে খুঁজছি। কই গেল এই আশ্চর্যদ্বয়? টবের সারিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নতুন কিছু ফুল ফুটে আছে। এরাও নীল রঙের। প্রজাপতি দুটোকে দেখা গেল এই নীল ফুলের আড়ালে। আশ্চর্য! আছে, তারা এখনো আছে! একই গাছে চুপচাপ বসে আছে। গায়ের রঙে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, সোডিয়াম আলোর জন্য হয়তো।


দুইটা সিগারেট শেষ করার পর আহির এলো। গোসল করে এসেছে। একটা তোয়ালেতে মাথা মোড়ানো। খুব কমনীয় লাগছে তাকে। শাড়ি পরেছে আকাশী রঙের একটা। সম্ভবত তার সাথে প্রথম যেদিন দেখা হয় আমার, এটাই পরে ছিল সে। ভেজা কাপড় বারান্দায় নাড়তে নাড়তে বলল, কী, প্রজাপতি দুইটাকে দেখেছ?

হেসে বললাম, হুম। এবং আশ্চর্য হয়েছি।

এত সামান্যতে আশ্চর্য হতে নেই-বলতে বলতে আহির দেখলাম কালো রঙের একটা অন্তর্বাস আমার সামনেই বারান্দায় নাড়ছে। তার ভেতরে সামান্য আড়ষ্টতাও নেই।

আহিরকে সামান্য অপরিচিত মনে হচ্ছে আজ। একটু পরিবর্তন এসেছে। এমনকি চেহারায়ও।

প্রজাপতি দুইটা ভয়াবহ সুন্দর না, বলো? আহির ছেলেমানুষী গলায় জানতে চাইল।

হুম-আমি নিখাদ মুগ্ধতা প্রকাশ করে বললাম। জোড় নাকি? হয়তো বাচ্চাকাচ্চাও দেবে এখানেই।

কে জানে! না দিলেই ভালো। প্রজাপতির বাচ্চা নাকি শুয়োপোকা হয়। শুয়োপোকা ভীষণ ভয় পাই আমি।

এই দুইটা স্পেশাল প্রজাপতি। এদের বাচ্চাকাচ্চাও সরাসরি প্রজাপতিই হবে, দেখো।

হুম। পৃথিবীর সুন্দরতর প্রজাপতি এরা। সুন্দরতর এবং সুন্দরতম।

কিশোরীসুলভ একটা চাপল্য ভর করছে আহিরের উপর। এই চাপল্য দেখতে বড় ভালো লাগছে আমার। আহিরকে আরও চপল করার লোভেই আমি বললাম, এদের একটা তুমি।

আহির স্বর্গীয় একটা হাসি দিল। রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ভেবো না আমি তোমাকে বলব যে তুমি অন্যটা। মোটেই না!

আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, সব মেয়েরাই বড় নিষ্ঠুর।

আমার রাগ দেখে আহির বিভ্রান্ত হলো বোধ হয়। সে আমায় শান্ত করার জন্য বলল, আরে! আমি ঠাট্টা করেছি। তুমি এর চেয়েও সুন্দর।

আমি আরও রাগার ভান করলাম। আহির প্রায় কেঁদে ফেলল। তার চোখে জল জমতে শুরু করেছে দেখে আমি হেসে ফেললাম জোরে। আহির আমার দিকে তেড়ে আসলো। সেও হাসছে। তার চোখে নিচে মাত্র অশ্রু জমে উঠছিল।

বাঁ হাতের চেটো দিয়ে অশ্রু মুছতে মুছতে সে বলল, মুকুল, তোমায় একটা জিনিস দেবো বলে আজ এখানে জোর করে নিয়ে এসেছি। চোখ বন্ধ করবে, প্লিজ! আগে বলো, আমায় খারাপ মেয়ে ভাববে না তো?



পনেরো
সুবিদ আলী, আমার দাদু যখন মারা যায়, তখন আমার বয়স দুই বছর। তার শীর্ণতর অবস্থা যেন কিছুটা কেটে উঠছিল কিছুদিন। হঠাৎ একদিন তিনি আমার মাকে বললেন, পারুল, মা, আজ গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে মন চাইতেছে। আমি গরুর মাংস কিনে নিয়ে আসি। তুমি আদা, রসুন বেঁটে রাখো।

গরুর মাংস কিনতে গিয়ে দাদু আর জীবিত ফেরত আসেননি। বাজারে গিয়ে হঠাৎ কাদাপানির মধ্যে বুক চেপে শুয়ে পড়েন। একবারে মৃত্যু। লোকজন ধরাধরি করে তাকে নিয়ে আসে। কেউ খবর দিয়েছিল বাবাকে। মা আদা বাঁটছিলেন। হঠাৎ কেউ ডাকাডাকি করছে শুনে তিনি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখেন, বাবাকে একজন ধরে নিয়ে আসছে। বাচ্চাদের মতো জোরে জোরে কাঁদছেন তিনি। ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলে মা বের হয়ে আসেন। সবাই ধরাধরি করে দাদু সুবিদ আলীর মৃতদেহ উঠানে রাখে। সেই মৃতদেহের দিকে একবার মাত্র তাকান মা। পরক্ষণেই মাথা ঘুরে পড়ে যান। তারপরে তার চুলায় আর কখনো গরুর মাংস ওঠেনি।

কার কাছে যেন এই কাহিনি শুনেছিলাম বড় হয়ে। আমি নিজেও অনেকদিন গরুর মাংস খাইনি। ঢাকায় এসে আস্তে আস্তে শুরু করি আবার। অবশ্য এমন ঘটনার উদাহরণ আগেও আছে। ইংরেজ শাসনামলে স্বাধীনতাসংগ্রামী বালমুকুন্দকে জেলখানায় দেখতে এসে তার একবছর আগে বিয়ে করা স্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, জেলখানায় তিনি কী খান? বালমুকুন্দ জানিয়েছিলেন, দুখানা রুটি। সেটা শুনে স্ত্রী রামরাখী আমৃত্যু দুখানা রুটি খেয়ে ছিলেন। স্বামীর ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য সেও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একাত্তরের শহীদ আজাদের মায়ের ভাত না খেয়ে থাকার ঘটনা তো আমরা অনেকেই জানি। আমার মা বাদ দিয়েছিলেন গরুর মাংস খাওয়া। এমনকি মুরগিও বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। মাংস খেতেই পারতেন না। জন্মের পর আমাদের বাড়িতে কোনোদিন আমি মাংস রান্না হতে দেখিনি। ফলে ঢাকায় আসার আগে আমি যা মাংস খেয়েছি এর-তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে।

সত্যি কথা হলো আব্বা বলার আগেই আমি আমার চোখ নেওয়ার জন্য আম্মার প্রতিজ্ঞার কথাও জানতাম। কোনো এক বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে জেনেছিলাম। ঐ একই লোক বলেছিল। সে কিভাবে জেনেছিল, জানি না। জানার ইচ্ছাও হয়নি। ঠিক বিশ্বাসও করিনি। তবে সামান্য সন্দেহ আমার মনে ঢুকে গিয়েছিল। এরপর আব্বা যখন আমায় আর কখনো বাড়ি আসতে বারণ করলেন, তখন আর সন্দেহ থাকল না। আব্বা ঠিক আমায় চোখ নেওয়ার কথা সরাসরি বলেননি। শুধু বলেছিলেন, আমি যেন তখনই ঢাকায় চলে যাই। আর কখনো বাড়িতে না আসি। তাতে আমার ক্ষতি হবে।

এতেই আমার বোঝা হয়ে গিয়েছিল। আমি সোজা চলে আসি। সাড়ে চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল। আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত অপরাধবোধ থেকে সামান্য মুক্তি পাইনি। কিন্তু সাহসও সঞ্চয় করতে পারিনি। আমি জানি, হুট করে কোনো একদিন ঠিকই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে আব্বা-আম্মার কাছে উঠব। বলব, আম্মা, এই চোখ নাও। যা দেখার এতদিনে সব দেখে নিয়েছি। আর আফসোস নেই।

শুধু জানি না, কবে সব দেখা শেষ হবে আমার।


পাশের লোকটিকে তৃপ্তির সাথে গরুর মাংসের হাড় চুষতে দেখে এসব পুরনো গল্প মনে পড়ে যায় বারংবার। হোটেলে ভাত খেতে বসেছি। কাল রাত থেকে কিছু খাইনি। পকেট একদম ফাঁকা। দুপুরের পর পর খিদেটা বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো পেটে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মাথার মধ্যে বয়ে যাচ্ছে একটাই চিন্তা, কোত্থেকে টাকা পাওয়া যায়? কোনো জায়গাই মাথায় আসছে না। সবাইই এক বা একাধিকবার ধার দিয়েছে। সরাসরি না করে দেবে। একমাত্র আহিরই ছিল, হুটহাট টাকা ধার দেওয়ার। যদিও তার কোনো ধারই এখন পর্যন্ত শোধ করিনি, তবে দ্রুতই সব শোধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখব না। ভেবেছিলাম ঠাট্টা করছে, কিন্তু আহিরের সামনের সপ্তাহে সত্যি সত্যি বিয়ে। জোর তোড়জোর চলছে। কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছে। সেদিন দেখলাম বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে শপিং করছে। মুখে তার সেই পোষা প্রজাপতিদ্বয়ের মতো উজ্জ্বল আভা। আহ, ওই আভাঅলা মেয়েটির জন্য আমি শূন্যতা অনুভব করেছিলাম!

এবং সেই মুহূর্তে ওই আভা, ওই উচ্ছলতা, ওই উজ্জ্বলতা আমার একদমই সহ্য হচ্ছিল না। আহিরের অনিচ্ছাকৃত স্বার্থপরতা টের পাচ্ছিলাম তীব্রভাবে। আর টের পাচ্ছিলাম আমার তীব্র রাগ। মরে গেলেও দ্বিতীয়বার আহিরের কাছে যাওয়া যাবে না। সুতরাং না খেয়ে মরে গেলেও আহির বাদ ঋণদাতার লিস্ট থেকে। আর কে থাকে, কে থাকে... নাহ, কারও কথাই মাথায় আসে না! আচ্ছা, লেখার বিল বাকি আছে কই কই? সেও তো একটাও বাকি নেই, সব তুলে খেয়ে ফেলেছি আগেই। একটা ছাড়া। আহির যে পত্রিকায় কাজ করে। ওদের ওখানে মোটামুটি বড় একটা বিল জমে আছে। কিন্তু ওরা আমায় পরীক্ষায় টেকার পরেও অতিরিক্ত যোগ্যতার অভিযোগে চাকরি দেয়নি। এমন বাজে পত্রিকার বিল আনা পাপ।

শেষমেশ ক্ষুধা আমাকে ঐ পাপ করতে বাধ্য করল। বিল আনতে গেলাম।

পত্রিকার অ্যাকাউন্ট সেকশনে যেতে হলে প্রুফ সেকশন পার হয়ে যেতে হয়। আমি তাড়াহুড়ো করে আরেকদিকে তাকিয়ে দ্রুত পার হলাম প্রুফ সেকশন। তাও দেখে ফেলল আহির। জোরে ডাক দিয়ে বসল, মুকুল।

আমি না শোনার ভান করে হেঁটে গেলাম। দৌড়ে এসে আহির আমার সামনে দাঁড়াল। কী হয়েছে তোমার? ডাকছি, না শোনার ভান করে হেঁটে যাচ্ছ কেন?

আমি যেন মাত্র দেখতে পেলাম, এমন ভঙ্গিতে বললাম, আরে আহির, কেমন আছ? ভালো তো?

আহির জবাব দিল না। চোখ লাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আর একটু এমন কাটলেই সে কেঁদে ফেলবে। বিশ্রি কাণ্ড হবে শেষে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আসছি, দাঁড়াও। বিলটা তুলেই আসছি।

আহির সুবোধ বালিকার মতো মাথা নেড়ে নিজের ডেস্কে গেল। টাকা রিসিভ করে সিগনেচার দিতে দিতে শুনতে পেলাম আহিরের গলা, কাকে যেন বলছে, সমীর’দা, একটু ম্যানেজ করবেন প্লিজ? আমি বের হয়ে যেতাম। শরীরটা একদম ভালো লাগছে না।

অচেনা পুরুষ কণ্ঠ, সম্ভবত সমীর’দা বললেন, আচ্ছা। আপনি যান। আধ মিনিটের মধ্যে আহির পাশে এসে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, আমি বাইরে চায়ের দোকানে দাঁড়াচ্ছি। সোজা চলে আসো।

বের হয়ে দেখি আহির একটা রিকশা ঠিক করে গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের দোকান পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য তার হয়নি। আমাকে দেখেই বলল, ওঠো। আমি রিকশায় উঠে বসলাম। সে আমায় নিয়ে এসে রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর মধ্যে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।

আহির ভয়ংকর! সে সবসময়ই আমাকে দেখে ভিতর পর্যন্ত আঁচ করে ফেলে। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়