ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

একটি বৃক্ষ অথবা ফুলের ঝরে পড়া || তাপস রায়

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি বৃক্ষ অথবা ফুলের ঝরে পড়া || তাপস রায়

দ্বিজেন শর্মা, আলোকচিত্র: সংগৃহীত

একে একে চলে যাচ্ছেন সেইসব মানুষ যাঁরা নিজ কর্মগুণে মহীরূহে পরিণত হয়েছেন। সমাজে তাদের অবদান শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তৃত। আমরা সেই শাখাতলে দাঁড়িয়ে শীতল হতাম তাদেরই কর্মপূণ্যে। অথচ কতটা নিভৃতেই না তাঁরা দিনযাপন করেছেন। যারা এই গুণের খোঁজ রাখতেন তাদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন তাঁরা। তাদের সংস্পর্শে জুটত ভরসা, অনুপ্রেরণা। সেই প্রেরণা নতুন এক স্বপ্ন রচনায় উৎসাহিত করত আমাদের। কারণ তাঁরা যে স্বপ্ন লালন করতেন সেগুলো অন্যপ্রাণে ছড়িয়ে দিতে পারতেন অনায়াসে। যা আর কখনও সম্ভব হবে না তাদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে। কারণ তাঁরা চলে গেছেন সব কিছুর উর্ধ্বে। এই চলে যাওয়া মানুষের তালিকায় সর্বশেষ নাম দ্বিজেন শর্মা।

উদ্ভিদবিদ্যা আমার পড়ার বিষয় ছিল। সেই সুবাদে ছাত্রাবস্থাতেই ‘দ্বিজেন শর্মা’ নামটি আমাদের জানা হয়ে যায়। এরপর কর্মজীবনে এসে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হয়। যতই জানি তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না- একজন মানুষ প্রকৃতিকে কী করে এতটা উপলব্ধি করতে পরেন? তাঁর নিসর্গপ্রেম, বৃক্ষমায়া, প্রকৃতির প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা আমাদের কাছে তাঁকে অনন্য করে তোলে। আমরা নতুন করে জানি একজন ‘বৃক্ষসখা’কে। আমরা তাঁর কারণেই এই শহরে ইট-পাথরের দালানে থেকেও গাছের দিকে ফিরে তাকাতে শিখি। অনেক দিন পর স্মরণ করি সেই কথাটি, যে কথা বলেছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু- গাছেরও প্রাণ আছে। দ্বিজেন শর্মার কারণে কথাটি আমাদের পুনরায় মনে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাগিদ দিয়ে তিনি আমাদের আরো স্মরণ করিয়ে দেন, সেই প্রাণ আমাদের প্রয়োজনে আমাদেরকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে- এ ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।

দ্বিজেন শর্মা এমন এক সময়ের মানুষ যাঁরা এই উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাঁর তারুণ্যের দিনগুলোতে এই জনপদ প্রকম্পিত হতো মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে। স্বাধীকার আন্দোলনের দাবি তখন কোটি তরুণ প্রাণে লালিত স্বপ্ন। দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ সবই ঘটেছে তাঁর চোখের সামনে। এই যে রাজনৈতিক ডামাডোল- এটি তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। কারণ তা অসম্ভব ছিল। যুক্ত হন বামরাজনীতির সঙ্গে। এজন্য আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছে। অথচ সেই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সময়েও; ভেবে অবাক হই তাঁর হৃদয়ে নিসর্গপ্রেম কঁচি তরুলতার মতই সজীব। পাশাপাশি সেখানে দেখি একজন গভীর মানবতাবাদীর বেড়ে ওঠা।

বৃক্ষের প্রতি দ্বিজেন শর্মার কৌতূহল বা মমত্ববোধের উন্মেষ ছোটবেলা থেকেই। বাবা ভিষক চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন কবিরাজ। বাড়িতেই নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছ ছিল। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলা যায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে সিলেটের বড়লেখা থানার শিমূলিয়া গ্রামে। পাথারিয়া পাহাড়ের আরণ্যক নিসর্গ তাঁর শৈশবসঙ্গী। আর ওই যে মানবতাবাদী মনের কথা বললাম, ধারণা করি এই গুণ তিনি পেয়েছিলেন মা মগ্নময়ী শর্মার কাছ থেকে। তিনি সমাজসেবী ছিলেন। পরিবারে বই পড়ার অভ্যাস ছিল। সেটি কিশোর দ্বিজেন শর্মার মধ্যেও প্রবাহিত হয়। সুতরাং বলা যায় বাংলার শ্যামল প্রকৃতির মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা এবং মনোবিকাশ। তিনি দেশের নদ-নদী, খাল-বিল-বন চষে বেড়িয়েছেন উদ্ভিদের নতুন প্রজাতির সন্ধানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন করেছেন শৈবাল নিয়ে উচ্চতর গবেষণা। স্বাভাবিকভাবেই কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে। ফলে তিনি গবেষণায় আরো বেশি মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। কিন্তু এই তাকেই আবার দেখি পেশাজীবনের এক পর্যায়ে দেশ ত্যাগ করতে। আজ আমরা সকলে জানি, ১৯৪৭ সালে তিনি সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদের চাকরি নিয়ে মস্কো চলে যান। সেখানে ছিলেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সে-বছর অনুবাদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদ সেলে চাকরিরত অবস্থায় দ্বিজেন শর্মা সত্তরটিরও বেশি বই অনুবাদ করেন। এই পর্যায়ে তাকে আমরা সাহিত্যের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করি। পরবর্তীতে তাঁর এই সাহিত্যবোধ এবং গভীর সাহিত্যপ্রজ্ঞা বিভিন্ন নিবন্ধ-প্রবন্ধে প্রতিফলিত হয়েছে। যে কারণে তাঁর রচিত উদ্ভিদবিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলোতেও আমরা বিভিন্ন গল্পকাহিনি দেখি। যেগুলো কোনোভাবেই আরোপিত মনে হয় না। বরং এসব লেখায় ইতিহাস এমনকি বিভিন্ন লোককাহিনিও ভীষণ প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়। 

‘শ্যামলী নিসর্গ’ দ্বিজেন শর্মার আকরগ্রন্থ। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ বইটিতে তিনি চমৎকার সাযুজ্জ্যে, সরল বয়ানে ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ, জসীমউদদীনের কবিতা, মধ্যযুগের কাব্যগাঁথার মাধ্যমে গাছ, লতা-পাতা, ফুলের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোতেও উপমা বয়ানে সাহিত্যের প্রভাব সুস্পষ্ট।

দ্বিজেন শর্মার লেখালেখি শুরু সাহিত্য দিয়ে। ১৯৪৯ সালে কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ছোটগল্প। গল্পটি ছিল আত্মজীবনীমূলক। এরপর আরো গল্প প্রকাশিত হলেও সেই তালিকা দীর্ঘ নয়। তিনি কথাসাহিত্য থেকে ধাবিত হন বিজ্ঞানের দিকে। আমরা তাঁর কলম থেকে পাই ‘সপুষ্পক  উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’ ‘গাছের কথা ফুলের কথা’ ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’ ‘বাংলার বৃক্ষ’ ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’ ‘সতীর্থ বলয়ে ডারউইন’র মতো বেশ কিছু বই।  শুধু বড়দের জন্য নয়, ছোটদের জন্যও লিখেছেন তিনি। ‘ফুলগুলি যেন কথা’ ‘গহন কোন বনের ধারে’ যে কোনো কিশোর পাঠককে মুগ্ধ করে নিসর্গপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। এই কাজটিই তিনি করতে চেয়েছেন আপন উৎসাহে। পেশাজীবনের শুরুতে বিভিন্ন কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়িয়েছেন।  এই জ্ঞান কীভাবে জনকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করা যায় এই ছিল তাঁর ভাবনা।

সমাজচিন্তক হিসেবেও দ্বিজেন শর্মা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ‘শ্যামলী নিসর্গে’র ভূমিকায় আমরা তাঁর সুচিন্তিত মতামত পাই যেখানে তিনি লিখেছেন: ‘আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পুনর্গঠন তো বিপ্লবেরই নামান্তর। এখন এই প্রকল্প অবশ্যই অগ্রাধিকারী। দেশের শিল্পসম্পদ ও নিসর্গ পরস্পর যুক্ত ও পরিপূরক। প্রথমটির জন্য দ্বিতীয়টির অনাদর- অনাবশ্যকই শুধু নয়, ক্ষতিকরও বটে।’ এই ক্ষতি কতটা, কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেই পথও দেখিয়েছেন তিনি।

এ কথা কে না জানে, দ্বিজেন শর্মা এক জীবনে অসংখ্য গাছের চারা  রোপণ করেছেন। যেখানেই থেকেছেন গাছ লাগিয়েছেন, বাগান তৈরি করেছেন। শুধু এটুকুতেই দায়িত্ব শেষ মনে করেননি।  নিজ হাতে সেগুলোর পরিচর্যা করেছেন, করতে শিখিয়েছেন। অনুসারীদের শিখিয়েছেন, কী করে এই প্রকৃতিতেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয় প্রাণের জন্য। গাছের প্রয়োজনীয় চর্যা নিয়ে কথা বলেছেন। তাকে আমরা রমনা উদ্যানে দেখেছি অনুসারীদের নিয়ে গাছ বিষয়ক বিভিন্ন আয়োজনে।  এই ফুল-তরু তাঁর এতটাই আপন ছিল।  তাঁর প্রয়াণে বৃক্ষ, তরু, ফুল যেমন হারালো তাদের প্রিয় সখাকে, আমরা হারালাম একজন বিজ্ঞানমনস্ক নিসর্গপ্রেমীকে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়