ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গণেশকে বিসর্জন দিতে মন চাইত না: পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণেশকে বিসর্জন দিতে মন চাইত না: পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পূজার স্মৃতি মানেই একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে যৌবন পেরিয়ে কৈশোর, তারপর শৈশবে চলে যাওয়া। যেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বদলে যায় প্রকৃতি আর পরিবেশ। আমার জন্মশহর ফরিদপুর। শৈশবের সময় কেটেছে সেখানে। দুর্গাপূজা যখন আসতো প্রকৃতি ঠিক এখনকার মতো নয়; অনেক শান্ত ছিল। ঘোর বর্ষা শেষে সতেজ প্রকৃতিতে আসতো পূজার দিন। দিন শেষে হালকা কুয়াশা পড়ত।

পূজা মানেই ঘরদুয়ার নতুন সাজে সাজবে। আর বাড়ির ছোটরা সবাই নতুন পোশাক পাবে। আমাদের পূজার আনন্দ শুরু হতো কয়েকটি জায়গা থেকে। আমরা দর্জিকে বলতাম ‘খলিফা’। পূজা ঘিরে খলিফাদের কাজের চাপ বেড়ে যেত। কী পোশাক পাব, কী রঙের হবে- এমন চিন্তা মাথায় ছিল না। একটা বিষয় জানতাম, পূজা মানে নতুন জামা, পূজা মানে নতুন জুতা।

রেডিমেড পোশাক আমরা পেতাম না। বায়না দিয়ে পোশাক বানাতে হতো। আর বায়না দিয়ে আসার পরেই পোশাকের জন্য শুরু হতো অপেক্ষা। একদিন, দুইদিন গেলেই দোকানে গিয়ে খোঁজ শুরু করতাম পোশাক বানানো হলো কি না। দেখা যেত অনেক সময় ষষ্ঠীর দিনও পোশাকটি হাতে পেতাম না। সপ্তমী বা তারপরের দিন পোশাক পেতাম। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও সেগুলোর ভাঁজ খুলতাম আবার ভাঁজ করতাম। তারপর বালিশের কাছে রেখে ঘুমাতে যেতাম।

আমরা বছরে জামা পেতাম দুইবার। এক পয়লা বৈশাখে, আর দুর্গাপূজায়। এখনকার মতো সারা বছর কেনাকাটার উৎসব আমাদের ছিল না। পূজা উপলক্ষে রেডিওতে অনুষ্ঠান হতো। তখন সব বাড়িতে রেডিও ছিল না, আমাদের বাড়িতে একটা ছিল। আশপাশের অনেক মানুষ জমা হতো রেডিও শোনার জন্য। সারা বাড়ি গমগম করত উৎসবের আমেজে। সারা রাত জেগে থাকতাম। পূজার দিনগুলোতে মা ঘুমাতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতেন না। ভোরের দিকে যখন একটু একটু কুয়াশা পরতে শুরু করত তখন একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে দিতেন।

পূজা আসার আগেই যখন মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি শুরু হতো আমাদের কাজ ছিল সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা। বন্ধুরা মিলে দেখতাম। গণেশের পেটটা কেমন হলো, পেঁচাটা কেমন হলো। আমার সবসময় মনে হতো পেঁচা, গণেশটাকে যদি বিসর্জন না দিয়ে আমার কাছে রেখে দিতে পারতাম! আসলে কোন মণ্ডপের প্রতিমা ভালো হয়েছে এই ছিল আলোচনার বিষয়।

ষষ্ঠীর দিন থেকেই বিশেষ করে সন্ধ্যায় মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে যেতাম পূজা দেখতে। এদিকে পায়ে থাকত নতুন জুতা। দেখা যেত কিছুদূর হাঁটার পর পায়ে ফোসকা পরে গেছে। এরপর জুতা হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করতাম। কুমার নদীর ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো। নদীর পাড়ে বসতো মেলা। বিজয়াতে প্রণাম করে যে টাকা-পয়সা পেতাম, তার প্রায় সবটা খরচ হয়ে যেত মেলায়। মাটির খেলনা, বাঁশি এগুলো কিনতাম।

বিসর্জনের দিন নদীতে দেখা যেত সারি সারি নৌকা। নৌকায় দর্শনার্থীরা থাকত। তারা যে হিন্দু পরিবারের তা নয়, অনেক মুসলিম আসতেন বিসর্জন দেখতে। এই সম্প্রীতি সবসময় দেখেছি ফরিদপুরে। বন্ধুরা মিলে হিসাব করতাম যে, কে কয়টা মণ্ডপে যেতে পেরেছে। যে বেশি মণ্ডপে যেত অলিখিতভাবে সে হয়ে যেত প্রথম। 

সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। পূজা এলে বয়স্করা থাকতেন নিমগ্ন। আমাদের এখন সেই বেলা। ছোট বেলার প্রিয় বন্ধুদের মনে পড়ে, মনে পড়ে নিমাইকে। ওরাও এখন হয়তো আমার মতো নিজেরা নিমগ্ন হয়ে থাকে। আর ছোটদের আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করে দেয়। মায়ের মৃত্যুর পর পূজায় আর ফরিদপুরে যাওয়া হয় না। সেইসব দিন এখন কেবল স্মৃতি। মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রাস্তা, মানুষজন আর নদী। স্কুল পেরিয়ে যখন কলেজে পৌঁছেছিলাম পূজা এলে বন্ধুরা মিলে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম কামারখালী, মধুখালী, কানাইপুর। কখনো গড়াইয়ের পাড়ে, কখনো চন্দনার পাড়ে, আবার কখনও কুমার নদীর পাড়ে। সবাই মিলে ঠিক করতাম গন্তব্য।

অনুলিখন: স্বরলিপি

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়