ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সৈয়দ শামসুল হক স্মরণ

শেষ-শয্যার চরণধ্বনি || মারুফ রায়হান

মারুফ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শেষ-শয্যার চরণধ্বনি || মারুফ রায়হান

সৈয়দ শামসুল হক, আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

দেশের একমাত্র সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জীবনের শেষ জন্মদিনটি আমরা বর্ণিলরূপেই উদযাপন করেছিলাম। সেটি ছিল তাঁর আশি বছর পূর্তিরও উপলক্ষ। আমরা কেউই ভাবিনি যে, তাঁর সান্নিধ্যে পরবর্তী জন্মদিনটি আমরা পালন করতে ব্যর্থ হবো। কারু পক্ষেই কি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব পরবর্তী বছর তিনি পরিকল্পনা অনুযায়ী সাহিত্যসৃষ্টি করতে পারবেন? ডিসেম্বরের একেবারে শেষদিকে তাঁর জন্মদিন। তার কয়েক মাসের মধ্যে চিকিৎসার জন্যে তিনি লন্ডনে যান। সেখানে ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। পরবর্তী কয়েক মাস লন্ডনের হাসপাতালেই চিকিৎসা চলে। চিকিৎসকদের অনুমোদন সাপেক্ষেই তিনি লন্ডনের হাসপাতাল ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি যখন জানতে পারি যে, বিদেশি চিকিৎসকরা নাকি তাঁকে আর মাত্র ছয় মাস আয়ুর কথা জানিয়েছেন। ছয় মাস আরো গুটিয়ে এক মাসে নেমে আসবে, এটাও আমাদের ভাবনায় ছিল না। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হন কবি, এক মাসের মধ্যেই শেষ শয্যা পাতেন জন্মভূমি কুড়িগ্রামে। অথচ তাকে বেশ শক্তসমর্থই দেখাতো এক বছর আগেও। অসুস্থতার তেমন উদাহরণ ছিল না। হ্যাঁ, এটা তো ঠিকই যে ক্যানসারের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলে ওই মরণব্যাধি পরাস্ত হতো। আমরা আবারও লেখার টেবিলে পেতাম সব্যসাচীকে। আমাদের দুর্ভাগ্য!

তিনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই যতক্ষণ রোগশয্যায় ছিলেন, সময় নষ্ট করতে চাননি। যখন নিজ হাতে আর লিখতে পারছিলেন না (ক্যানসার ধরা পড়ার পর আর ল্যাপটপে লিখতেন না) তখন মুখে মুখে লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন; জীবনসঙ্গিনী সেসব অনুলিখন করছিলেন। তিনিও সাহিত্যিক, ফলে প্রায় শতভাগ সঠিকভাবেই তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে আমরা বিশ্বাস করতে পারি। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ২০১৬-এর এপ্রিল মাসে সব্যসাচী লেখকের কর্কট রোগ শনাক্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন তিনি কিছু লেখেননি। পরে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জুন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন, তবে ল্যাপটপে নয়, কাগজে কলমে। নিজের হাতে শেষ কবিতাটি লেখেন ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায়। এরপর থেকে মুখে মুখে বলে গেছেন, স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখে নিয়েছেন। এভাবে কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর সে কবিতা শুনতে চাননি। শুধু বলেছেন, সময় নেই। সৈয়দ শামসুল হকের জীবন-সায়াহ্নের এই কবিতাগুচ্ছ থেকে ৫৫টি ( সেইসঙ্গে ২০১৫ সালে লেখা আরো ৫টি)  লেখা নিয়ে যে কবিতাগ্রন্থ (শব্দই চিকিৎসিত করে- প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন) তাঁর প্রয়াণের পর একুশের বইমেলায় বেরিয়েছে সেখানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় অনুলিখনকারী আমাদের কিছু তথ্য দিয়েছেন। এতে সচেতন পাঠকের মনে দুয়েকটি প্রশ্ন আসবেই।

প্রথমত ১২ জুনের পর থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত কবি যেসব কবিতা লিখেছেন সেগুলো এই গ্রন্থে নেই কেন? সেসব কি কবির ইচ্ছাতেই অপ্রকাশিত থাকলো? ঢাকায় হাসপাতালে শেষ দিনগুলোতে সৈয়দ হক প্রায় প্রতিদিনই লিখেছেন, এমনকি ২৪ ঘণ্টায় দশটি পর্যন্ত কবিতা রচনার উদাহরণ রয়েছে। এদিক থেকে তিনি বিরল ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এটি তাঁর সপ্রতিভতা, দায়বদ্ধতা ও সক্রিয়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও একাগ্রচিত্ত না হলে এমনটা অসম্ভব। ফলে আমাদের এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, জুন-জুলাই ২০১৬ পর্বেও তিনি কবিতা লিখেছেন এবং সেগুলো নিশ্চয়ই প্রকাশযোগ্য। তবে সে সম্পর্কে পাঠকদের কিছু জানানো হয়নি। একইভাবে ১২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় একমাসের কবিতার বিষয়েও জানতে পেলেন না পাঠকেরা ওই ভূমিকা থেকে। সাধারণ অনুমানে কি আমরা ধরে নেবো গ্রন্থের শেষ কবিতাটি ২২ সেপ্টেম্বর লেখার পর জীবনের শেষ পাঁচ দিন তিনি আর কবিতার কোনো পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেননি?এসব প্রশ্নর উত্তর জানাটা জরুরি নয় হয়তো, কিন্তু বিষয়টি ভূমিকায় খোলাসা হলে ভালো হতো। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর শেষের চরণ-ধ্বনি প্রসঙ্গে যাবার আগে তাঁর শেষ জন্মদিন উপলক্ষে লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করি:
“... সৈয়দ হকের কবিতাগ্রন্থ ‘ভালোবাসার দিনে’ আজ হাতে তুলে নিলাম। কবিকে ভালোবাসার জন্য এই বা মন্দ কি- এই ভালোবাসার দিনে। অভিন্ন শিরোনামে ৭১টি স্বতন্ত্র কবিতা। তবে মূল সুর ওই অভিন্নই। কবি এটি লিখেছেন লন্ডনে বসে, ২০০৯ সালের জুলাইয়ের মধ্যভাগে মাত্র দু’ সপ্তাহের ভেতরে। এই হলো কবিতার ঘোর, এই হলো ভালোবাসার ঘোর। কবিতার জন্যে ভালোবাসা, মানবীর জন্য প্রেম।  প্রেম- নিজেই সে গরিব গ্রহের এক আশ্চর্য সুন্দর ধ্বনিময় কবিতা। দুটি টলটলে থরথর উথালপাথাল হৃদয়ের নৈঃশব্দে নিহিত এক পরম প্রাণভোমরা। (আবার একটি হৃদয় নিষ্ক্রিয় ও মৌন রইলেও তুমুল সংঘটিত হতে পারে প্রেম!) প্রেমে পড়লে চতুর চণ্ডালও কবি। আর কবির প্রেম? সে তো মহার্ঘ্যবিশেষ, যার সুঘ্রাণ পায় প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ। প্রতিটি প্রেমই নতুন, বলতে পারি অভিনব। কিন্তু তার অভ্যন্তরে ফুটতে থাকা অনুভূতিগুচ্ছ সকলই পুরাতন। সেই চিরপুরাতনকে নতুন শব্দ ও বাকভঙ্গিমায় চিরনূতন রূপেই কবি আমাদের সামনে তুলে আনতে সক্ষম। তাই প্রেমিক কবিমাত্রই পরম ঈশ্বর!
প্রেমিক কখনো বালকও বটে (কিংবা বালিকা); প্রেমে পাগল হলে সেটাই সংগত। তবু পরিণত কবির প্রেমপঙ্ক্তি চিত্রপটে ধরে রাখে প্রেমের দর্শন, সূক্ষ্ম সঞ্জিবনী। সেখানে প্রাজ্ঞের অভিজ্ঞতার শাঁস, আর প্রতারিতের পতনের ফাঁস মিলেমিশে থাকতে পারে। এখন আমি সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালোবাসার দিনে’ পর্যটন করতে গিয়ে ছুঁয়ে যেতে পারছি ভালোবাসার ভুলগুলোকে, ফুলগুলোকে। কবি নির্দিষ্টভাবে নিজের কথা বলেন প্রেমের কবিতায়, আবার পৃথিবীর বহু প্রেমিকের বহুল স্বরও বেজে উঠতে পারে তাঁর শব্দে। নিজেকে শত প্রেমিকের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেয়া, এবং শত প্রেমিককে নিজের মধ্যে ধারণ- উভয়ই অসম্ভব নয়। অন্তত কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এমনটা অস্বাভাবিক মনে হয় না। বলতে চাইছি, প্রতিটি প্রেমেরে কবিতার নায়ক অবধারিতভাবে স্বয়ং কবিই হবেন- এটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। তবু কবি যখন উচ্চারণ করেন, তা তাঁর নিজেরই জীবনের উচ্চারণ। অপরের প্রেমের অভিজ্ঞতা কবির নিজের ভালোবাসার উপলব্ধি না হলে তা কবিতা হবে কেন? একটি প্রেমকাব্য যদি প্রেমিকমাত্রেরই প্রেমকাব্য হয়ে উঠতে পারে (শতভাগ না হলেও) তবে সেটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের। কবির চরণকে আউড়ে বলা যায়, এ তো আমারই অভিজ্ঞতা, কবি! আমি লিখিনি, আপনি লিখেছেন। ”

২.
সাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ হকের বেড়ে ওঠার সময় সেই পঞ্চাশের দশকে এই ঢাকা নগর একসঙ্গে ধারণ করেছিল এক ঝাঁক আধুনিকতামনস্ক মানুষকে। এঁদের কেউ কবিতা, কেউ গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, কেউ শিল্পকলা কিংবা চলচ্চিত্রাঙ্গনে আনন্দ সন্ধান করেছেন, আবার কেউবা সাংবাদিকতায় ব্রতী হয়েছেন। নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল সেইসব নামের কয়েকটি এখানে উল্লেখ্য আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আনোয়ারা সৈয়দ হক। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও প্রগতিশীলতা রুদ্ধ করার নানা প্রয়াসের ভেতর বাঙালি একদিকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছে, অন্যদিকে সৃষ্টিশীলেরা নতুন চিন্তা চেতনা সংযুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাচ্ছে। এঁদের কথা সৈয়দ হক নিজেই সবিস্তারে লিখে গেছেন ‘তিন পয়সার জোছনা’ গ্রন্থে। মাত্র চার বছর আগে এটি তিনি লিখে শেষ করেন। বলা যায় জীবনের শেষ পাদে দাঁড়িয়ে নিজের যৌবনের সময়ের দিকে ফিরে তাকানো। লেখালেখির সূচনাকাল যে কোনো লেখকের জন্যেই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। অগ্রজ লেখক সৈয়দ হককে সাবধান করে বলেছিলেন- একজন সফল লেখকের পেছনে পড়ে থাকে নিরানব্বইজন লেখকের লাশ। কী মারাত্মক কথা! লেখকের মৃত্যু খুবই সহজ, লেখকের জন্ম ততটাই কঠিন। আর সবক্ষেত্রে ব্যক্তিলেখকের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও একনিষ্ঠতা কার্যকর নাও হতে পারে। পারিপার্শ্ব, সঙ্গী, সান্নিধ্যের মানুষ, প্রেরণা, কিংবা গঠনমূলক সমালোচক এবং পৃষ্ঠপোষক- সব কয়টি বিষয়ই একজন জন্ম নিতে থাকা লেখকের জন্য জরুরি। সৈয়দ হকের সূচনাপর্বের যে ক’জন ব্যক্তির নাম এখানে উচ্চারিত হয়েছে তাঁরা কোনো না কোনোভাবে একজন সব্যসাচীর গড়ে ওঠায় ভূমিকা রেখেছেন। অধুনা নিবিষ্ট লেখকের জন্য প্রযুক্তি যেমন সহায়ক হচ্ছে, তেমনি দিনের বড় অংশ তাতে অপচয়ও হচ্ছে। লেখকের নিজস্ব বলয়ে অবস্থান, নিভৃতি ও নিমগ্নতা অত্যন্ত প্রয়োজন। আজকের লেখক এ দিক দিয়ে অসহায়। সৈয়দ হকের উত্থানপর্বে নানা অপচয়ের ফাঁদ কমই ছিল। তাই তিনি অঢেল লিখে গেছেন। সংসারে থেকেও সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লেখার সময়ের ভাগে টান পড়েনি। কারণ সর্বংসহার মতো তাঁর জীবনে যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্বের বড় অংশ নিজ কাঁধে তুলে নেন তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক। তাঁর প্রতিও পাঠকদের কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, জীবনের শেষ দিনগুলোতেও সৈয়দ হকের লেখা সৃজনের সহযাত্রী হতে পেরেছিলেন এই মহীয়সী।

আজ সব্যসাচী লেখকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে চোখ বুজলে দেখব এক আশ্চর্য পাঠাগার জেগে আছে। তাঁর একেকটি বুক শেলফে একেক ধরনের গ্রন্থ, সব তাঁরই লেখা। এক্ষেত্রে তিনি এক ও অদ্বিতীয় এই বাংলায়। কোনো শেলফে গল্পের বই, কোনোটায় উপন্যাস, একটা পুরো র্যা ক ভরে আছে কাব্যনাট্যে, আরেকটা শেলফ ভর্তি শুধু কবিতারই বই। কাছেই আরেকটা শেলফে অনেক অনেক গদ্যের বই, অনুবাদও বা বাকি যায় কেন? এত বই, এত আলো! ‘সৈয়দ শামসুল হক পাঠকক্ষে’ আজ আমাদের আরেকবার প্রবেশ হোক, সাহিত্যের পাতাগুলা থেকে আলো ঠিকরে বেরুতে থাকুক অক্ষরের, ধ্বনির, আশা ও সম্ভাবনার। সর্বোপরি বোধের, জীবনকে ভালোবাসার।

৩.
শব্দই চিকিৎসিত করে- কবিতাগ্রন্থের এমন সুনিশ্চিত ধারণাপ্রকাশকারী তেজী নাম নিঃসন্দেহে ভিন্নধর্মী। ‘চিকিৎসিত’ শব্দ ব্যবহার থেকে আমরা নিশ্চিতরূপেই সৈয়দ হকের শব্দবোধ সম্পর্কে আরো একবার জেনে উঠতে পারি। কর্কট রোগের চিকিৎসার কয়েক ধাপ রয়েছে, প্রতিটি ধাপই রোগীর জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু রেডিওথেরাপি- কেমোথেরাপি যে কর্কট-আক্রান্ত রোগীকে যথাযথ চিকিৎসিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, অল্প কয়েক মাসের মধ্যে আমরা তাঁকে হারিয়েছি, এটা এখন বাস্তব। সৈয়দ হকের বসবাস ছিল শব্দজগতে। তাই শব্দই তাঁর শেষ দিনগুলোতে হয়ে উঠেছে অপার্থিব শুশ্রুষা ও পরম আশ্রয়। যন্ত্রণাকাতর শয্যা থেকে তিনি জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। যতক্ষণ পেরেছেন ততক্ষণ শব্দসৃষ্টিই হয়ে উঠেছে তাঁর ব্রত। বইটিতে প্রমাণ পাচ্ছি অন্তিমশয্যায় মাত্র নয় দিনে ৩৩টি কবিতা তিনি মুখে মুখে রচনা করে গেছেন। যে কবি চলে যাচ্ছেন, যাবার আগে নিজ হাতে লেখার শক্তিটুকু পর্যন্ত যার রহিত হয়ে গেছে, তিনি যতক্ষণ পারছেন উচ্চারণ করে যাচ্ছেন কবিতার চরণ। এমন একটি আশ্চর্য পরিস্থিতিতে জীবন-মৃত্যুর চূড়ান্ত বোধ ও সত্যটুকু আমরা তাঁর কাছে সংগত কারণেই প্রত্যাশা করব। নিশ্চয়ই এ বাড়াবাড়ি আমাদের। কিন্তু তিনি যে সৈয়দ হক, এই বাংলার স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত এক বহুমাত্রিক লেখক। এই ভূখণ্ডে তিনিই অভিষেক ঘটাবেন আনকোরা অভিনব কিছুর, আর পুরো লেখক-সমাজ বিস্মিত হবে। তাই আমরা কান পেতে শুনতে চাই যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই তিনি এমন কিছু জানিয়ে যাবেন যা এই বঙ্গসমাজ জানতো না। এমন কিছু তিনি বলে যাবেন, যা আর কোনো লেখক বলেননি। কেননা তিনি প্রাজ্ঞ, প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথের সমান আয়ু তিনি পেয়েছেন, আর রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে এত বিচিত্র শাখায় চর্চাকারী সৃষ্টিশীল আর কোনো লেখককে আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। বোধ ও চিন্তাকে যথাযথ ভাষা দেবার অননুকরণীয় ক্ষমতা রাখেন তিনি। তাই স্বার্থপর আমরা কান পেতে রাখি, কী তিনি আমাদের বলে যেতে চান; আর সেই মহার্ঘ্য সত্য, দর্শন আর অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা সমৃদ্ধ হবো। আমরা আরো অর্থপূর্ণরূপে জীবিত থাকার মন্ত্র ও রসদ পেয়ে যাব! আসলে আমরা কী চাই, সেটি কেন কবির কাছে গুরুত্ব পাবে- একথাও একসময় ভাবতে হয়। মৃত্যুর পাশে শুয়ে আর কোন কবি আমাদের মুঠো মুঠো কবিতা দিয়েছেন! তাই যা পাই, তাতে কেন সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকি না!

ব্যাধি শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম যেদিন তিনি কলম তুলে নিলেন সেদিন কাগজে ফুটলো চলে যাওয়ার প্রসঙ্গই। প্রথম পঙক্তিই হলো- ‘মৃত্যুপরে মৃত্তিকায় এই দেহ প্রোথিত যখন...’। কাফনের চাদর ঢেকে দিতে চাইলো কবিতাকে, শব্দে ভরে উঠতে চাইলো লোবানের গন্ধ; নিঃশব্দে ধ্বনিত হলো কবর-সন্নিহিত ‘চল্লিশ কদম’। কিন্তু পরে চিকিৎসার একাধিক ধাপ পেরিয়ে কবি স্বদেশে ফিরলে তাঁর কবিতায় উঠে আসতে থাকলো বহুবিধ ভালোবাসার কথা। তাঁর ভালোবাসা হলো স্বদেশ, সহধর্মিনী ও শব্দ-সহযাত্রী, মানে কবি। তবু মাঝে-মাঝে কবিতায় মাথা তুললো কর্কট প্রসঙ্গ। কর্কটের বৃক্ষডালে কর্কশতার সুরে পাখির ডাক শোনা গেল। কর্কটের বিষবৃক্ষের ছায়ায় কবির দুটি স্তবক পাঠ করা যাক:
কর্কটের পুষ্পডালে
সবুজ শব্দের আবার উত্থান দেখে
আমিও উত্থিত
প্রসন্ন এ ভোরে
(অনুলিখনে প্রথম কবিতা, ২৪ সংখ্যক কবিতা)

এবার ঘুমোও তুমি
শব্দফলে কর্কটের সবুজ শাখায়
(২৯ সংখ্যক কবিতা)

এখানে উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে যান ১০ সেপ্টেম্বর এবং কবিকে বলেন, তাঁর চিকিৎসার সব দায়িত্ব তিনি নেবেন। ‘শব্দই চিকিৎসিত করে’ গ্রন্থে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কবির নতুন যেসব কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে সেগুলো দেখছি ১১ সেপ্টেম্বর থেকে লেখা শুরু হয়েছে। ঘোষণারই মতো ব্যক্ত হয়েছে নতুন কবিতা লেখার প্রত্যয়। শাদার ভেতর সাতটি রঙ সুপ্ত থাকার কথা বলে গেছেন কোনো কোনো মনীষী। আরোগ্যসদনে শাদার বহুলতা প্রথাগত। কিন্তু কবি যখন বলেন:
‘এই শাদার ভেতরে
সাতটি রঙ অপেক্ষায় রয়েছে
কখন আমাকে
তারা রঞ্জিত করে
উত্তোলিত করবে নতুন কবিতায়॥’
- তখন আমার উৎকর্ণ থাকি তা শোনার জন্যে। সুনির্দিষ্টভাবে নাম বা পরিচয় না থাকলেও ১২ সেপ্টেম্বরে লেখা ২১ সংখ্যক কবিতায় আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই উপস্থিত দেখি। কয়েকটি লাইন এমন:
‘একজন আমার পাশে
এসে বসলেন
মুখে তার অপরূপ
বাংলার ছবি
আমন ধানের গন্ধ
ঝরে পড়ছিল
...তিনি বললেন
এই সবুজ দেশ
আপনার অপেক্ষায়
আমার মায়ের কোলের ভেতরে
এই বাংলার ভেতরে
এই পৃথিবীর ভেতরে
আপনাকে বিদায়
নয়, স্বাগতম...

কবিতার প্রকরণ বিষয়ে শুদ্ধতাবাদী ছিলেন সৈয়দ হক এবং প্রচলিত ছন্দের বাইরে তিনি খুব বেশি হাঁটেননি। লন্ডনপর্বের কবিতায় দেখছি চতুর্দশপদীর পাশাপাশি দীর্ঘ কবিতাও রয়েছে। সবগুলোই টানটান অক্ষরবৃত্তে রচিত। কিন্তু ঢাকায় ফেরার পর কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাস শিথিল হয়ে পড়ে, এক থেকে চারটি শব্দ নিয়ে গঠিত হতে থাকে ছোট ছোট লাইন। এভাবে ওপর থেকে নিচে লতানো লাইনগুলো বেশ লম্বা দেখায়। অক্ষরবৃত্তের চাল কিংবা অন্তমিল কোনো কোনো কবিতায় হঠাৎ হঠাৎ লক্ষ্য করা গেলেও এই কবিতাগুচ্ছ মূলত থেকেছে ছন্দমুক্ত।  
বইয়ের শেষ তেত্রিশটি কবিতাকে আমরা একটি দীর্ঘ কবিতা হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি। যেখানে কবির পূর্বসূরি ও সমকালীন অল্প ক’জন কবির প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে। স্বদেশের জননীস্বরূপা নদীগুলো বয়ে চলে। আর সর্বোপরি নারীর ভালোবাসা জোছনা ও শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়। অন্তিমযাত্রায় পথক্লেশে মৃত্যুদূতকে থামিয়ে দিয়ে এই যে ভালোবাসার জন্যে ও ভালোবেসে শব্দসৃষ্টি, সেটি শব্দঘোরগ্রস্ত মানুষের জন্য এক পরম আশ্রয়। কবি বলছেন: ‘তুমি হাত ধরে থাকলেই
আমার বিশ্রাম’
এই ‘তুমি’-কেও তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন মঞ্জু বলে (কবিপত্নীর ডাকনাম)। জীবনের কদর্যতায় বিপর্যস্ত পাঠকও তাঁর কবিতার হাত ধরে থাকলে পাবে এক ধরনের বিশ্রাম। কবিকে আবারো সালাম।

পুনশ্চ:
সৈয়দ হকের কর্কট-ক্রান্তিকালপর্বে লেখা ‘ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাব তোমার রুমালে’ চরণটি এই কবিতার বইয়ে তো পেলাম না! কাগজে পড়লাম অসুস্থ হওয়ার পর সৈয়দ শামসুল হক ২০০ কবিতা লিখেছেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কবি পিয়াস মজিদকে (যাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে বইটি) আজ দুপুরে ফোন করলে তিনি জানান ১৬০টি নতুন কবিতা লেখার কথাই তিনি জানেন। এগুলো নিয়ে মোট তিনটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করে রাখা হয়। বেশ, ওই দুটি গ্রন্থে নিশ্চয়ই তা পাবো, যা এটিতে খুঁজেছিলাম: আমূল আলোড়িত হওয়ার মতো কোনো সত্যের নির্যাস, নতুন চিত্রকল্প কিংবা অভাবিত ভাবনা।  
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়