ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বুক রিভিউ

বিধান রিবেরুর অনুধ্যানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ড. নাজনীন বেগম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিধান রিবেরুর অনুধ্যানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বইটির প্রচ্ছদ

ড. নাজনীন বেগম: লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরুর ভাষার মাসে প্রকাশিত ‘অনুভূতিতে আঘাতের রাজনীতি ও অন্যান্য’ বইটি সমকালীন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রতিবেশের এক অনবদ্য দলিল। বইটির শিরোনাম তাই নির্দেশ করছে। ২০১৭ সালে প্রকাশ পাওয়া গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশনায় ঐতিহ্য। উৎসর্গ করেছেন জাহাঙ্গীর আলমকে। লেখক ভূমিকায় উল্লেখ করেন গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো মূলত দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা কিংবা অনলাইনে ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তারই সুচিন্তিত এবং সুসংবদ্ধ রূপই আলোচ্য বইটি। প্রবন্ধগুলো সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব অভিমত একজন সংবেদনশীল মানুষের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বিষয়ের বর্ণনা এবং গভীরে প্রবেশ করা হয়েছে। ঘটনা পরম্পরায় যদিও ২০১৩ সাল থেকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক সংকট আর অস্থিরতা তুলে ধরা, কিন্তু বইটি শুরু করা হয় ২০১৬ সালে ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ওপর রচিত একটি বিষণ্ণ আর প্রতিবাদী কবিতা দিয়ে। এমন পাশবিক নির্মমতা প্রবন্ধাকারে না লিখে কাব্যশিল্পের মহিমায় নির্মাণ করার যৌক্তিকতাও লেখক ব্যক্ত করেছেন। তাৎক্ষণিক অনুভূতিতে জর্জরিত হওয়ার বেদনাসিক্ত অবয়ব কাব্যশিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে লিখিত প্রতিটি প্রবন্ধে আছে সমকালীন বিষয়ের সঙ্গে ঘটনার নিরবচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা, লেখকের তাড়িত অনুভূতি, সর্বোপরি বিদ্যমান অবস্থা দেখার সূক্ষ্ম আর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান দৃষ্টি।

‘আমাদের দেশটা জোম্বিপুরী’ প্রবন্ধটি এক প্রতীকী আলেখ্য। যেখানে স্বদেশকে নিয়ে যাওয়া হয় কল্পনার স্বপ্নপুরিতে। যেখানে মানুষে মানুষে কোন ফারাক নেই। নারী-পুরুষেও কোন তারতম্য নেই। ফলে বর্ষবরণের মতো সাংস্কৃতিক বলয়ে নারীকে অসহনীয় পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় না। স্বাধীনতা আর সমস্ত অধিকার নিয়ে নারীরা নিরাপদে নির্বিঘ্নে চলতে পারে। এমন সুস্থির, নিরাপদ আর কাঙ্ক্ষিত সামাজিক আঙিনা পেতে কতদূর যেতে হবে- এই বেদনা লেখককে উদ্বিগ্ন আর উৎকণ্ঠিত করে তোলে। এই সামাজিক বিপন্নতায় সারা দেশের সঙ্গে লেখকও এক অদম্য অস্থিরতার শিকার হচ্ছেন। এখান থেকে পরিত্রাণে উপায়ই বা কি? দেশের প্রতি লেখকের সচেতন দায়বদ্ধতা পাঠককে সত্যিই এক মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়।

‘শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে কেন’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার যে অরাজক পরিস্থিতি তার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে সরকারি বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র অবস্থানকে উপেক্ষা করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন আর ক্লাসবর্জন কর্মসূচি প্রশ্নবিদ্ধ করে বিভিন্ন প্রসঙ্গে অবতারণা করা হয়। অষ্টম বেতন কাঠামোতে সরকারি আমলাদের সঙ্গে শিক্ষকদের তারতম্যের বিষয়টিও উঠে আসে। সঙ্গত কারণেই লেখকের চিন্তায় অনিবার্য কিছু বিষয় এসে যায়। যেমন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের গুণগতমান সেই সঙ্গে অকারণে অপ্রয়োজনে তাদের বিদেশে পাড়ি দেয়া, সর্বোপরি শিক্ষাকে পণ্য কিংবা বাণিজ্যিকীকরণের বেহাল চিত্রটিও লেখকের সংবেদনশীল চেতনায় ধরা পড়ে। এছাড়া জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের প্রতিও লেখক সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই সংক্ষিপ্ত বরাদ্দ শিক্ষার মানকে নামিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মুনাফাভিত্তিক ধনবাদী সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার এমন ধস সার্বিক কাঠামোর অনিবার্য পরিণতি।

লেখকের ছোট্ট একটি প্রবন্ধ ‘ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে’ উল্লেখ করা হয়, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে প্রতিটি নাগরিক তার পূর্ণ অধিকার আর মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া সহিংসতা প্রমাণ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে আরম্ভ করে আইন প্রয়োগের অধিকার পর্যন্ত থাকে না সংশ্লিষ্টদের। হামলা, ছিনতাই, রাহাজানির মতো দুর্বিপাক তো আছেই তার সঙ্গে নাকি অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে পুলিশী অপতৎপরতা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার পরিণামে যেভাবে হত্যার মতো ধ্বংসযজ্ঞ নিরন্তর চালানো হচ্ছে তার বিপরীত দিকটাও ভেবে দেখার আবেদন জানায় এই সচেতন লেখক। এখানে তিনি কিউবা কিংবা ভেনেজুয়েলাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, শত ষড়যন্ত্রের পরও মানুষের আস্থার কারণে সেসব দেশে শান্তি বিনষ্ট হয়নি। আমাদের দেশের সরকারকেই যে কোন মূল্যে জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করতে হবে। এটা করতে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। আর এই শিক্ষা ইতিহাস থেকেই নেয়া বাঞ্ছনীয়। লেখকের প্রবন্ধের বিদগ্ধ অনুভবে পাঠক নানামাত্রিকে তাড়িত হয়, সমস্যার গভীর গিয়ে উত্তরণের উপায়ও যথার্থভাবে খোঁজার চেষ্টা করে। গ্রন্থ যদি সমাজ ব্যবস্থার স্বচ্ছ দলিল হয় তাহলে লেখক সেই মাপের একজন সমাজ নিরীক্ষকও। তাই বিধান রিবেরু সমাজ ও মানুষের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে একজন সুদক্ষ সমাজ গবেষক।

‘নৈরাজ্য ও জনগণের আস্থা’ প্রবন্ধটিও একই বিষয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে অন্য মাত্রায় বিদ্যমান ঘটনাসমূহকে উপস্থাপন করা হয়। এখানে যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি দেওয়া থেকে শুরু ব্লগার, লেখক, প্রকাশক এমনকি ধর্মীয় গুরুদের ওপর রক্তাক্ত সহিংসতাকে অনভিপ্রেত সামাজিক অব্যবস্থার করুণ পরিণতি হিসেবে নির্দেশ করা হয়। লেখকের ধারণা ’৭১ সালের সেই বিধ্বংসী অপশক্তি আবার নতুন রূপে সামাজিক অভিশাপের ভিন্নমাত্রার বার্তা নিয়ে সমাজ জীবনে তার কালো থাবা বসিয়েছে। সর্বসাধারণের নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা কিংবা ধর্মান্ধতা, দেশের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিশ্বাস হারানো সব মিলিয়ে উদ্ভূত অরাজক পরিস্থিতি সর্বনাশের খেলায় উম্মত্ত হয়ে আছে। তার থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য নতুন প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারায় নিজেকে শাণিত করতে হবে, নতুন উদ্যোমে স্বাধীনতার ভাবাদর্শে স্বদেশকে এগিয়ে নেয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হতে হবে। বাস্তব সামাজিক অবয়ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আত্মকেন্দিক নিমগ্নতায় সামনে চলার পথই রুদ্ধ হবে না পাশাপাশি অপ্রয়োজনী আবর্জনাগুলোও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

লেখকের এই গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ পায় ‘তরুণরা বসে আছেন সর্বনাশের আশায়’ প্রবন্ধে। উন্নত প্রযুক্তি আর যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে ক্লান্তি, অবসাদ এবং পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার যে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির আবির্ভাব হয় সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা অনেকাংশে কমে যা পুরো আর্থসামাজিক বলয়কে সঙ্কটের পর্যায়ে নিয়ে যায়। যা প্রতিবারের পথ বর্তমান প্রজন্মকেই উদ্ভাবন করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে এসেই যায় ২০১৩ সালের সেই সাড়া জাগানো শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। নবজাগরণের এই স্রোতে সিক্ত হয়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর আদর্শিক চেতনা, দেশাত্মবোধের নিবিড় পরিচর্যা শুধু যে বক্তৃতা কিংবা স্লোগানে প্রকাশিত হয়েছিল তা নয়, সুসংবদ্ধ লেখনীও এই বেগবান ধারাকে নানামাত্রিকে উদ্বেলিত করেছিল যা যুদ্ধাপরাধী থেকে শুরু করে ধর্মান্ধ মৌলবাদকেও বিব্রত অবস্থায় ঠেলে দেয়। অর্থাৎ লেখকের স্থির বিশ্বাস নতুন যুগের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উদ্দীপ্ত চেতনায় সমস্ত সামাজিক বন্ধন জালকে ছিন্নভিন্ন করে সারা বাংলাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। এমন সাড়া জাগানো গণজাগরণ কেন যে মাঝ পথে হোঁচট খেল তাও বিমর্ষ অনুভবে লেখকের চিত্তকে তাড়িত করে। তবে লেখকের আশ্বস্ততা এখানে যে উদীয়মান তরুণ-তরুণীরা প্রয়োজনে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো অশান্ত স্রোতের কাণ্ডারী হতেও পিছপা হয় না। সে নজির তারা ইতোমধ্যে দেখিয়েছে। প্রয়োজনে আগামীতেও সেই উন্মত্ততায় দেশের সর্বনাশ বিপর্যয়কে ঠেকাতে তাদের সময় লাগবে না।

লেখকের সরাসরি অভিমত তুলে ধরা হলো: ‘সময় হচ্ছে আগুনের সেই স্ফুলিঙ্গ, তরুণদের মধ্যে বারুদ জমা করা আছেই। সময় হলে এই বারুদ আকাশ আলো করে বিস্ফোরিত হবে। প্রকাশ করবে তাদের বুদ্ধিমত্তার পরাকাষ্ঠা। প্রতিবাদের সময় দাবি মেটাতেই আগামীতে আবারও তরুণরা জ্বলে উঠবে। সকল নিয়ে তারা বসে আছেন সর্বনাশের আশার। এই সর্বনাশের অপর নাম গুণগত পরিবর্তন ঘটানো।’

‘বাংলাদেশ কি পুরাণের সিসিফাস’ প্রবন্ধে লেখক গ্রীক পুরাণের রাজা সিসিফাসকে জন্মান্ধ কবি হোমার বুদ্ধিমান রাজা হিসেবেই উপস্থাপন করার কথা শুরুতেই বলেছেন। শুধু দেবতারাই রাজার বুদ্ধির কাছে পরাভূত তাই নয়, এমনকি দেবরাজ জিউসেরও তার তীক্ষ্ণ নজর থেকে রেহাই নেই। দেবরাজের সমস্ত অন্যায়, অবিচার প্রকাশ করে দিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া গ্রীক পুরাণের এই কৃতী রাজার অন্যতম মননশক্তির অবিচলিত প্রত্যয় ক্রুদ্ধ জিউস সিসিফাসের মৃত্যুদূত হিসেবে থানাটোমকে মর্তে পাঠান। সেই মৃত্যুবার্তা বিঘ্নিত করে সিসিফাস পুনরায় জিউসকে টেক্কা দেয়। কিন্তু এক সময় সেই অজেয় সিসিফাসও দেবতাদের শৃঙ্খলে বাধা পড়েন এবং অনন্তকাল শাস্তি ভোগ করতে থাকেন।

এই প্রসঙ্গের জের টেনে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের অর্জন যেমন আকাশ ছোঁয়া, পাশাপাশি তার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর সংস্কৃতির বলয়ের বিপর্যস্ততাও চোখে পড়ার মতো। বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা যৌতুকের কোপানলে পড়া থেকে শুরু করে নিরাপত্তাহীনতার কঠিন শৃঙ্খলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাও অহরহ চলছে শুধু নয়, প্রতিনিয়ত বৃদ্ধিও পাচ্ছে। স্বাধীন দেশে রাজাকার-আলবদররা মন্ত্রীত্ব পেয়ে তাদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকাও বহাল তবিয়তে উড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সনদ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সততা, নিষ্ঠা, আইনানুগ বিধিনিষেধ কোনটাই আজ ধরাছোঁয়ার মধ্যেই পড়ে না। সাড়ে সাত কোটি দেশের জনসংখ্যা আজ ষোলো কোটি। শিক্ষার সংখ্যাগত মান বাড়লেও গুণগত মান নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। কর্মজীবী ও শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বাড়লেও সমাজে আজও তারা নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত হচ্ছে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন হচ্ছে কিন্তু বিধিবদ্ধ জোরালো কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমনভাবে তৈরি হচ্ছে না। বেকায়দায় কিংবা নিয়ন্ত্রহীনতার সংস্কৃতিতে আবদ্ধ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মপ্রক্রিয়া যোগ্য আর উপযুক্ত প্রার্থীকে তার যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারছে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির শৃঙ্খলে এমনই বাধা পড়ে আছে সেখান থেকে ছাড় পাবার কোন সম্ভাবনা দেখাই যাচ্ছে না। দেশের ঐতিহ্যিক স্থাপনার ওপর অপসংস্কৃতির আগ্রসনের ভয়াবহ পরিণতিকে কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসবই দেশের জন্য অশনিসংকেত। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এই সব অশুভ ক্ষতচিহ্ন নিরাময় করতে না পারলে দেশকে সঠিক অবস্থানে নিয়ে যেতে আরও সময় ব্যয় হতে পারে।

এভাবে বইজুড়ে বিভিন্ন প্রবন্ধে লেখকের দেশপ্রেম, আদর্শিক চেতনা, ন্যায়-অন্যায় বোধ, আধুনিক মননশীলতা, তথ্যপ্রযুক্তির শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, সব মিলিয়ে সুসংবদ্ধ চৈতন্যের এক অনবদ্য রচনা শিল্প যা সচেতন পাঠক মাত্রই নিজেকে সে জায়গায় দাঁড় করিয়ে নিমগ্ন হতে বেশি সময় নেবে না। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক বলয়ের এক অদম্য অস্থিরতায় দেশের টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় লেখকের তাড়িত অনুভব পাঠক সমাজকেও ভাবিয়ে তোলে। দেশের কৃষি জমির অব্যবস্থা থেকে শুরু করে, ব্যক্তি জীবনের প্রচলিত জীবন প্রবাহের টানাপোড়েন, আধুনিকতার অভিঘাত, মৌলবাদের জঘন্য উত্থান, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার, সাধারণের মধ্যে পাঠ বিমুখতা, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অচ্ছেদ্য অগণতান্ত্রিক অপকৌশল সব মিলিয়ে সার্বিক সমাজ ব্যবস্থার যে বেসামাল অবস্থা- প্রতিটি প্রবন্ধ তারই সুস্পষ্ট এবং স্বচ্ছ প্রতিবেদন। যা পাঠককে সমকালীন সমাজ প্রতিকূলতাকে চেনাতে যেমন সাহায্য করবে একইভাবে সে সঙ্কট কাটাতে নতুন করে ভাবনার প্রেরণাও যোগাবে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ এই চার বছরের সমাজের গুণগত পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক অসঙ্গতিও পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা দেবে। এরই মধ্যে অনেক অর্জনকে যেমন অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি অনেক জঘন্য ঘটনার বীভৎসতা ও মানুষের মনে হতাশা আর বিদগ্ধ অনুভব তৈরিতে ইন্ধন যুগিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায়ের যথার্থ প্রয়োগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন উদ্যোমে জাগিয়ে তোলে। আবার জঙ্গীবাদের অশুভ আগ্রাসন বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় যে প্রলয় বিক্ষুব্ধ আবহের জন্ম দেয় তাও গণমানুষের জন্য এক অশনিসংকেত। ২০১৪ সালে প্রতিপক্ষ শক্তির জ্বালাও পোড়াও  সাংঘর্ষিক অভিযানে ও চলতি অর্থবছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে পৌঁছানো পুরো দেশের জন্য এক শুভযোগ বললে বেশি বলা হবে না। নারীদের ওপর সহিংস আক্রমণ জনগোষ্ঠীর অর্ধাংশের যে চিত্র জনসম্মুখে চলে আসে তা সংখ্যায় যতই নগণ্য হোক যে কেন দায়বদ্ধ নাগরিককে আলোড়িত না করে পারে না। এভাবে সমাজের সিংহভাগ স্পর্শকাতর অর্জন আর নেতিবাচক পর্যায়গুলো লেখকের সুচিন্তিত অভিমতে যেভাবে পাঠকের সামনে বিধৃত হয়েছে সেখানে তিনি সময়ের বলিষ্ঠ পথিকই শুধু নন, একজন বিদগ্ধ সমাজ-সমীক্ষকও। তার এই বইটি সচেতন পাঠক সমাজে আদৃত হবে নিঃসন্দেহে এই ধারণা ব্যক্ত করা যায়। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়