বুক রিভিউ
ললিতা : জটিল মনস্তত্ত্বের উপন্যাস
ফারহানা রহমান || রাইজিংবিডি.কম
ফারহানা রহমান : বহু বছর আগে রুশ-মার্কিন উপন্যাসিক ভ্লাদিমির নাবোকভের (১৮৯৯-১৯৭৭) বিখ্যাত উপন্যাস ‘ললিতা’ পড়েছিলাম, আর সত্যি বলতে কী, কখনোই আর সে উপন্যাসটি ভুলতে পারিনি। ভ্লাদিমির নাবোকভের অনবদ্য গদ্যশৈলী কিংবদন্তীয় রূপ ধারণ করেছিল তার জীবনকালেই। সাহিত্যচর্চার শুরুতে রুশ ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি ইংরেজিতে অভিনব গদ্যশৈলীতে উপন্যাস রচনার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। এ ছাড়া লেপিডপ্টেরোলোজিতে (Lepidopterology) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ও দাবা খেলার বিশেষ কিছু চালের সমস্যার সমাধান উদ্ভাবন করেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
‘ললিতা’ সর্বপ্রথম ১৯৫৫ সালে প্যারিসে, ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কে এবং ১৯৫৯ সালে লন্ডনে বের হয়। এটি নাবোকভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে পরিচিত। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত তার সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবেও খ্যাত। প্যারিসে বইটা প্রকাশ হবার পরপরই বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। তার পেইল ফায়ার (১৯৬২) নামের উপন্যাসটিও বহুল পরিচিত। তিনি যে শব্দ নিয়ে খেলতে ও খুঁটিনাটি বিস্তারিত বিবরণ দিতে ভালোবাসতেন, সেটা তার এই দুটি উপন্যাস পড়লেই বোদ্ধা পাঠকের বুঝতে আর কোনো অসুবিধা হয় না। ১৯৬২ ও ১৯৯৭ সালে দুইবার এই বইটি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়।
গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, এক নবযৌবনা কামাক্ষী কিশোরী ললিতাকে। যে তার অর্ধনগ্ন শরীর দ্বারা নানা কামাতুর ভঙ্গিমায় তার বিপিতাকে চোখের ভাষাতে হাতছানি দিয়ে তাকে উত্তপ্ত ও উদ্ভ্রান্ত করে তুলছে। কিন্তু ভেতরের প্রকৃত ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। গল্পের নায়ক ফরাসি প্রফেসর হামবার্ট হামবার্ট একজন ইউরোপীয় সাহিত্যের পণ্ডিত, তিনি তার কিশোর বয়সে কিশোরী প্রণয়ী এনাব্যালাকে অকালে হারান। সম্ভবত সে কারণেই পরবর্তীতে ৯-১৪ বছর বয়সী মেয়ে শিশুদের প্রতি তিনি এক ধরনের গভীর যৌন আকর্ষণ বোধ করতে থাকেন। প্রফেসর হামবার্ট এই বয়সী কিশোরীদের নিমফেট নামে আখ্যায়িত করেন। ভ্লাদিমির নাবোকভ তার এই গল্পটিতে এমন এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন যা পাঠকের চেতনাকে আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করতে বাধা দেয়।
মাতৃহারা শিশু ললিতার শেষ ভরসা ছিল তার বিপিতা। যার অভিভাবকত্বের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তার নিরাপত্তা। কিন্তু চিরকালের শিকারী পুরুষ, তার নগ্ন ভোগাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্যেই নানারকম নীতিবাক্য উদ্ভাবন করেন এবং পাঠককে তার পক্ষে দাঁড় করিয়ে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার যথার্থ আয়োজনই করেছিলেন। বলা বাহুল্য, বহুলাংশে সে অভীপ্সা পূরণে সক্ষমও হয়েছিলেন। ১২ বছর বয়সী ললিতাকে দেখে তার বিপিতা হামবার্ট এতোটাই লোভাতুর হয়ে ওঠেন যে, তিনি ললিতা অর্থাৎ ডলরিজ হেযের বিধবা মা শার্লট হেযকে বিয়ে করেন, শুধুমাত্র মেয়েটির সংস্পর্শ পাওয়ার আশাতেই। পরবর্তীতে ললিতার মার মৃত্যুর পর প্রফেসর হামবার্ট ললিতার অফিশিয়াল অভিভাবকত্ব লাভ করার দরুন কি নির্মমভাবে তিনি তার লোভাতুর ও কামাতুর চোখে ভোগের লালায়িত লিপ্সা দিয়ে প্রতিনিয়ত ললিতাকে বলাৎকার করেন সেই বর্ণনাই আমরা দেখতে পাই উপন্যাসটি জুড়ে।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ললিতা। যদিও তার প্রকৃত নাম থাকে ডলরিস হেয। ৩৭-৩৮ বছর বয়স্ক ফরাসি সাহিত্যের প্রফেসর, কবি ও গবেষক ড. হামবার্ট ললিতার সৎ বা বিপিতা। ললিতা নামটি তারই দেওয়া। হামবার্ট একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। তিনি তার লেখালেখির কাজে অ্যামেরিকার র্যা মসডেলের ছোট শহর নিউ ইংল্যান্ডে এসে একটি বাসা ভাড়া নেন। র্যা মসডেলে এসে হামবার্ট দেখতে পান যে, তাদের বাড়িটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। সার্বিক অবস্থা দেখে হামবার্ট দিশেহারা হয়ে পড়েন এবং নিউ ইংল্যান্ড ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। সে সময় শার্লট হেয নামক একজন বিধবা মহিলা তাকে বিচলিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য হামবার্টকে তার বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে হামবার্ট শার্লটের অনুরোধ উপেক্ষা করলেও যেই না তিনি ললিতাকে লক্ষ করেন সে মুহূর্তেই তিনি মেয়েটির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং বাসাটি ভাড়া নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
ড. হামবার্ট যিনি ‘নিমফেট’ মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ এড়াতে না পেরে নিজেকে প্রায়ই অসুস্থ বলে সন্দেহ করতেন এবং চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝেই স্যানিটোরিয়ামে যেতেন। তিনিই কি না আবার একসময় তার কন্যা সমতুল্য বিধবা বাড়িওয়ালী শার্লট হেযের ১২ বছর বয়সী কন্যা ডলরিস হেয বা ললিতার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন, আর এজন্য তিনি সমাজকে পর্যন্ত অস্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। ড. হামবার্ট প্রথম দর্শনেই ভীষণভাবে ললিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ললিতার কাছাকাছি থাকার জন্য। আর সে কারণেই তিনি ছলনার আশ্রয় নিয়ে ললিতার বিধবা মাকে বিয়ে করতেও পিছুপা হন না। এদিকে ললিতার প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ ও অসম প্রেম দিন দিন সীমাহীন হয়ে উঠলে বিষয়টি হামবার্ট একসময় তার ব্যক্তিগত ডাইরিতে লিখতে থাকেন। ডাইরিতে তিনি আরো লেখেন যে, তিনি ললিতার মাকে অর্থাৎ শার্লটকে ভীষণভাবে ঘৃণা করেন, কারণ তিনি মনে করেন শার্লট তার ও ললিতার মধ্যকার প্রেমের সম্পর্কে বাধা হিসেবে কাজ করছে। তবে সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন ললিতার মা অর্থাৎ ড. হামবার্টের স্ত্রী শার্লট হেযের কাছে ডাইরিটা ধরা পড়ে যায় আর শার্লট ব্যাপারটিকে কিছুতেই মেনে নিতে না পেরে রাগে-দুঃখে-অপমানে ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার পথে বেসামাল অবস্থায় একটি চলন্ত ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে নিহত হন।
স্ত্রীর এই মৃত্যুতে হামবার্ট এক ধরনের স্বস্তি বোধ করেন। ফলে সামার ক্যাম্প থেকে তিনি নিজেই ললিতাকে আনতে যান এবং সেখানে তিনি ললিতার বায়োলজিক্যাল পিতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। সামার ক্যাম্প থেকে তিনি ললিতাকে নিয়ে বাসার না ফিরে বরং অ্যামেরিকার বিভিন্ন স্থানে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ভ্রমণ করতে থাকেন। হামবার্ট ললিতার কাছে তার মার মৃত্যুর কথা প্রথমে গোপন করলেও পরে এক সময় প্রকৃত সত্য স্বীকার করেন।
এভাবেই প্রফেসর হামবার্ট ললিতাকে নিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সারাদিন ড্রাইভ করে শেষে রাত হলে কোনো হোটেল বা মোটেলে থাকা শুরু করলেন, যাতে ললিতা কোনোভাবে পালাতে না পারে বা কোনাভাবে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে না পারে। এভাবেই এক বছর ধরে নানারকম টর্চারের মাধ্যমে তিনি ললিতার ওপর কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। সুযোগ পেয়ে ললিতাও একসময় ক্ল্যার কুইল্টি নামক এক পর্নগ্রাফির পরিচালকের সাথে পালিয়ে যায়। প্রফেসর হামবার্ট অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ললিতার আর কোনো সন্ধ্যান পান না। এদিকে প্রায় দুবছর পর হামবার্টের কাছে কিছু টাকা চেয়ে ললিতা একটি চিঠি পাঠায়।
১৭ বছর বয়সের বিবাহিত ললিতাকে দেখে তিনি আবারও তার প্রেমে পড়ে যান এবং ললিতাকে তার সাথে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। কিন্তু ললিতা আর ফিরে আসে না। এদিকে ললিতার কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানায় গিয়ে হামবার্ট ক্ল্যার কুইল্টকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় খুঁজে বের করে তাকে হত্যা করেন। এরপর তিনি নিজেকে আইনের হাতে সমর্পণ করেন। এভাবেই কিছুদিন পর একসময় জেলখানায় করনারি থম্বসিসে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি আত্মজীবনীতে তার সব কথা লিখে যান। এর কয়েক মাস পর ললিতাও একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যায়। হামবার্টের নিজের জবানিতে ললিতাকেন্দ্রিক তার পুরো জীবন উপাখ্যান তুলে ধরেন।
একজন বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষের কিশোরী বালিকার প্রতি যৌন আকর্ষণকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হলেও এর মূল উপাদান কিন্তু মানবজীবনের নানাবিচিত্র সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে রচিত হয়েছে। নাবোকভ তার অসাধারণ লেখনীতে, প্রতিটি বাক্যে তার উচ্চ রসবোধের চমৎকার ছোঁয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ কাহিনীকে এক অসামান্য বোধের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। শিল্প-সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার সে সীমারেখা তা শিল্পীর তুলিতেই আঁকা হয়, সাধারণের পক্ষে সেটা কতটুকু গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা শিল্পীর বিবেচ্য বিষয় নয়। শিল্পীর কাজ শিল্প সৃষ্টি করা আর ‘ললিতা’ নাবোকভের এমনই এক অসাধারণ গদ্যশৈলীর উপন্যাস যাকে তিনি এক অভিনব উচ্চ পর্যায়ের শিল্পে পরিণত করেছিলেন। যা গত শতাব্দীতে সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস হিসেবে বিবেচ্য হয়েছিল। এটিকে একইসাথে একটি আদর্শ মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবেও গ্রহণ করা হয়েছে বলে বোদ্ধা পাঠক মনে করেন।
১৮৯৯ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবারগে ভ্লাদিমির নাবোকভ জন্মগ্রহন করেন। ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ফরাসী ও রুশ সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা শেষ করে তিনি বার্লিন ও প্যারিসে সাহিত্যে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৪০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্যারিসের অলিম্পিয়া প্রেস থেকে তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘ললিতা’ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যান। এটি যে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস তাতে কারো কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এই একটা বই তাকে নিয়ে এসেছে পরিচিতির শীর্ষে ও সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায়। দিয়েছে নাম, যশ, অর্থ, খ্যাতি, দুর্নাম সবকিছুই। নাবোকভ প্রথমে ইংরেজিতে ‘ললিতা’ উপন্যাসটি লেখেন। পরে তিনি এটি রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন। টাইম ম্যাগাজিনের লিস্টে ১৯২৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ১০০টি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে ‘ললিতা’ স্থান করে নেয়। এ ছাড়া ১৯৯৮ সালের মডার্ন লিটারেরি লিস্টে ২০ শতকের চতুর্থ স্থান দখল করা উপন্যাস হিসেবে এবং ২০০২ এ বুক্লুবেন ওয়ার্ল্ড লিটারেরিতে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সেলিব্রেটি বই হিসেবে ‘ললিতা’ স্থান করে নেয়। আর এত কিছুর পর এটি যে একটি অসাধারণ উপন্যাস এতে পাঠকের মনে অন্তত সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ অক্টোবর ২০১৭/সাইফ/রফিক
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন