ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রুদ্র একপাত্রে পান করেছেন শিল্প ও জীবন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৬ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রুদ্র একপাত্রে পান করেছেন শিল্প ও জীবন

হাসান মাহামুদ : রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি। ‘প্রতিবাদী কবি’ হিসেবেও তিনি খ্যাত। তার সবচেয়ে বড় যে প্রাপ্তি, তিনি কবিসত্তার  পাশাপাশি দ্রোহী, সংগ্রামী, আপোশহীন এক অপ্রতিরোধ্য তারুণ্যের প্রতীক হতে পেরেছেন।

সেই সাম্যের তিনি অপ্রতিরোধ্য তরুণ, যে সকল অন্যায়ের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট স্বরে বলছে-‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। সাম্যবাদের স্বপ্ন ছড়াতে-ছড়াতে যে ছুটে যাচ্ছে আদিগন্ত, ‘দিন আসবেই, দিন আসবেই দিন সমতার’। রুদ্র লিখেছেন, ‘মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর আকাশ দ্যাখা হয় না/এতো কিছুই দ্যাখার থাকে, এতো কিছু দেখতে হয় মাটিতে প্রতিদিন’।

সেই রুদ্রই আবার বলছেন, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে। জীবনবোধের তাড়নায় ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদের মুখর হয়েছেন। একইসঙ্গে কবি হয়ে লিখেছেন শেকড়ের কথা, ‘বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন’ কিংবা ‘আমরা কি হারাইনি লালনের একতারা মাটির হৃদয়/আমরা কি হারাইনি প্রিয় পথ, প্রিয়তম গ্রামের ঠিকানা?’ তিনি লিখেছেন: ‘যে মাঠ থেকে এসেছিল স্বাধীনতার ডাক, সে মাঠে আজ বসে নেশার হাট’, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণ-আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত।

শুধু কবিতায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ফোটাবার পারঙ্গমতায় নয়, রুদ্র তার সাহসী জীবনাচার দিয়েও সেই বিশ্বাস যাপন করেছেন, মিছিলে নেমেছেন, শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেছেন। রুদ্র সার্থকভাবে সক্ষমতা দেখিয়ে গেছেন শিল্প ও জীবন- যা একপাত্রে পান করার। বাংলার কাব্য ইতিহাসে এই প্রতিভা কিংবা অর্জন বিরল। এখানে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনন্য।

তবে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর যে স্বকীয়তা অন্যদের থেকে তাকে স্বতন্ত্র করেছে তা হলো, তিনি একইসঙ্গে ‘প্রতিবাদী’ আবার ‘রোমান্টিক কবি’। তিনি লিখেছেন, ‘উপদ্রুত উপকূল’, ‘ফিরে পাই স্বর্ণগ্রাম’, ‘মানুষের মানচিত্র’, ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’। আবার প্রতিবাদী হয়ে তিনিই লিখেছেন, ‘ছোবল’, ‘গল্প’ ও ‘মৌলিক মুখোশ’। নাট্যকাব্য হিসেবে লিখেছেন ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’।

আবেগ আর প্রতিবাদের ভাষার অপরূপ মিশ্রণে লিখে গেছেন দুই হাতে। পঁয়ত্রিশ বছরেরও কম সময় তিনি বেঁচে ছিলেন। এই অল্প সময়ে এতো বেশি লিখে গেছেন যে, তা নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে ঈর্ষণীয়। তিনি লিখেছেন সাতটি কাব্যগ্রন্থসহ পাঁচ শতাধিক কবিতা, একটি কাব্যনাট্য, অর্ধশতাধিক গান ও বেশকিছু ছোটগল্প। ‘মনুষ্য জীবন’ নামে একটি বড়গল্পও লিখেছিলেন তিনি। শিল্পের প্রতি প্রবল দায়বদ্ধতা ছাড়া এমন সৃষ্টিযজ্ঞ সম্ভব নয়।

‘ভাল আছি ভাল থেকো’ গানটি বাংলার একটি অমর গান। এই গান পরবর্তীতে রেকর্ড করা হয়েছে কম করে হলেও চারটি দেশে। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা বেশ কিছু কবিতার চরণ জনপ্রিয় বাণী এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় অহরহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’, ‘দিন আসবেই, দিন সমতার’, ‘বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন’, ‘যে আছে আলোয়, আছে তার রাতে ফেরার সম্ভাবনা’।

স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতাপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাদের অন্যতম। রুদ্র ছিলেন সাংগঠনিকভাবেও সিদ্ধহস্ত। তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৬ সালের আজকের দিনে (১৬ অক্টোবর) বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। মাটি ও মানুষের প্রতি আমূল দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। জন্মদিনে সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক সত্তরের দশকের অন্যতম এই কবিকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন।

যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’-এ। একইসঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। বাংলাদেশের কবিতায় এক অবিস্মরণীয় নাম।

অকাল প্রয়াত এই কবি তার কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। সাহস ও স্বপ্নে, শিল্প ও সংগ্রামে সমর্পিত এই কবি তার স্বল্পায়ু জীবনক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারুণ্যের দীপ্ত সড়কে। নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে; হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই কণ্ঠস্বর। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়