ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুন্দরীতমার প্রতি || শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ২৩ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুন্দরীতমার প্রতি || শামসুর রাহমান

হে সুন্দরীতমা, হে সর্বস্ব আমার-
লোকচক্ষুর আড়ালে, বিছানায় বালিশে বুক চেপে এই চিঠি লিখছি। রাত বাড়ছে, আমি জেগে-জেগে ভাবছি, মনে হচ্ছে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস এসে লাগছে আমার চোখেমুখে, আর আমি মাতাল হয়ে গেছি তোমার সত্তার গহন থেকে উঠে-আসা সৌরভে। ভাবতে ভালো লাগছে, আমার কলমনিঃসৃত এই শব্দাবলি ধন্য হবে তোমার চোখের আলোয়। এই তো আমি দেখছি, তুমি পড়ছ আমার চিঠি সবার কৌতূহলী, তীক্ষ্ম দৃষ্টি এড়িয়ে। তুমি বহু কষ্টে খুঁজে নিয়েছ নির্জনতা এই একটি কি দুটি কাগজের পাতা আদর করবার জন্য।

জানি না, এই মুহূর্তে তুমি কী করছ? তুমি কি ঘুমের হ্রদে ডুব সাঁতার দিচ্ছ এখন? তুমি কি দেখছ এমন কোনো স্বপ্ন, যে-স্বপ্নে মাধুর্য পদ্মের মতো ফুটে আছে সাবলীল? হয়তো তোমার ঘুমন্ত চোখের কিনার থেকে এখন একপাল তৃষ্ণার্ত হরিণ স্বপ্ন পান করছে। হয়তো বালিশে ছড়ানো তোমার রেশমি সোনালি চুল, হয়তো এক গুচ্ছ লুটিয়ে পড়েছে তোমার মুখে। আহ্ তোমার চুল, যা মুঠোয় নিয়ে খেলা করতে ইচ্ছে করে আমার। তোমার চোখের পাতা কি কেঁপে উঠছে ঘন ঘন? তুমি কি পাশ ফিরে শুলে? তোমার মেরুন শাড়ির আঁচল কি খসে পড়ল বুক থেকে? জানি না, জানার উপায় নেই আমার। আমি শুধু ভাবছি ঘুমন্ত তোমাকে। ভাবছি, তুমি হয়তো জেগে আছো হাসপাতালের কেবিনে, তোমার মায়ের শিয়রে। এ-ও কি হতে পারে না যে, কিছুতেই তোমার ঘুম আসছে না। তুমি চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ভাবছ আমার কথা? স্তব্ধ রাত্তিরে একা-একা তুমি আমার কথা ভাবছ, কত মধুর এই ভাবনা।

এই চিঠি লিখছি আর মনে পড়ছে গত শুক্রবারের কথা। কখনো ভাবিনি একটা দিন এমন সুন্দর হতে পারে। শুক্রবার সকাল থেকেই একটা সুর জেগে উঠেছিল আমার ভেতর তোমাকে দেখতে পাওয়ার আশায়। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলাম সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির জন্য, যখন আমি গিয়ে দাঁড়াব তোমার সামনে। চেয়ার টেনে বসব তোমার মুখোমুখি, সমুদ্রের মতো অতল তোমার চোখে পাঠ করব আমার নিয়তি, তোমার হাত তুলে নেব হাতে। আমি প্রতীক্ষা করে ছিলাম স্বর্গীয় কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। জানতাম না, দৈবদয়ায় এমন আশ্চর্য সুন্দর একটা দিন উপহার পাব আমি। আর যখন তোমার ঠোঁটে, নরম উষ্ণ ঠোঁটে আমার ওষ্ঠ আশ্রয় পেল, তখন আমার শিরায় শিরায় জ্বলে উঠেছিল রাশি রাশি নক্ষত্র, আমাদের দুজনের হৃৎপিণ্ডের যুগলবন্দী বেজে উঠল অপরূপ সুরে। সেই মুহূর্তে মৃত্যু হলেও কোনো খেদ থাকত না আমার। তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, শুধু এই ভাবনা মনকে পীড়িত করত।

যে-পথিক মরুভূমির জ্বলন্ত বালিয়াড়িতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, মরীচিকার পেছনে ছুটে ছুটে অবসন্ন, তার দৃষ্টিপথে যদি এক হৃদ্য মরুদ্যান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে কোনো শুভক্ষণে- সেকি সেখানে আশ্রয় লাভের লোভ সম্বরণ করতে পারে কখনো? তাই, তোমার আলিঙ্গনে সরোদের মতো বেজে উঠেছিল আমার অস্তিত্ব। তাই তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, তোমার বুকে মুখ গুঁজে এই বিরূপ বিশ্বের সকল প্রহার, দুঃখ-শোক, বঞ্চনা-যন্ত্রণার স্মৃতি মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম সেই মুহূর্তে।

একটি দুপুর তুমি রূপান্তরিত করেছিলে কোনো গুণীর অপূর্ব তানে। তুমি এসেছিলে বলে দোতলা ফ্ল্যাটের একটি ঘর বাগান হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। সমুদ্রের ঢেউ গড়িয়ে পড়েছিল তোমার রাজহাঁসের মতো পায়ে। তুমি এসেছিলে বলে একটি সামান্য ঘর অসামান্য মুকুট পরেছিল। তুমি এসেছিলে বলে একজন কবির হৃদয়ে শবেবরাতের দীপাবলি; তুমি এসেছিলে বলে একটি প্রগাঢ় চুম্বনে অমরত্ব লাভ করেছে একজন দুঃখী মানুষ। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমি আমার সর্বস্ব অর্পণ করেছি তোমার কুন্তলে।

তাই, হে আমার অন্নজল, অস্তিত্বের গান, তোমাকেই চাই। চাই তোমার ভালোবাসা। কতকাল আমাকে অপেক্ষা করতে হবে তোমার আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে  সেই কথা শোনার জন্য, যে-কথা শুনলে আমি হবো সম্রাট। যে-কথা শোনার জন্য আমার অস্তিত্ব উন্মুখ হয়ে আছে সর্বক্ষণ, কখন উচ্চারিত হবে সেই বাণী? কখন তুমি আমার কানে কানে কোনো স্বপ্নিল রাতে বলবে, ‘ভালোবাসি, তোমাকে ভালোবাসি’? ভালো থেকো। থাকবে তো? ভালোবাসা।

একান্ত তোমারই কবি।

পুনশ্চ: সোমবার তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ায় কী যে কষ্ট হয়েছে আমার তা কী করে বোঝাব?
০৬/০২/১৯৮০

বি.দ্র.: শামসুর রাহমান। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ। আজ কবির ৮৯তম জন্মদিনে কবি-স্মরণে এই প্রেমের চিঠি প্রকাশ করা হলো। এমন একাধিক পত্রসাহিত্য কবি রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে ১৯৮০ সালে রচিত এই লেখা সম্প্রতি কবির পুত্রবধূর মাধ্যমে আমাদের হাতে এসেছে। তাঁর প্রতি রইল শুভকামনা। কবির ছবিটি তাঁর পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত।      
 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়