ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কবি বিমল গুহ: আকাশচারী মৃত্তিকাপুত্র

আসাদুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ২৫ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবি বিমল গুহ: আকাশচারী মৃত্তিকাপুত্র

আসাদুল্লাহ: কবি বিমল গুহ। ব্যক্তিবয়সে নয় কবিবয়সে স্বাধীনতার সমান বয়সী। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তার কবিসত্তার উন্মেষ ও উত্থান। ইতিমধ্যে কেটে গেছে বিয়াল্লিশ বছর। চার দশকের অধিক। স্বীয় কবিত্বের উন্মেষ-উত্থানবিন্দু থেকে বিমল গুহ আজ অনেকটা পথ এগিয়েছেন। কবি হিসেবে তিনি এখন সুগন্ধী ফুলের মতো বিকশিত। পূর্ণ বিকশিত নন। না। এই অপূর্ণতা তার অপারগতা নয়। আদতে তার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। কাব্যকীর্তির নিরিখে বিমল গুহ যথার্থই সম্ভাবনাময় বিকাশমান কবি। তার অনেক দেবার আছে। ক্ষমতাও আছে। ইতিমধ্যে তার কাব্যের সৌগন্ধ কবিতার হাওয়ার স্বতঃসঞ্চারিত। তবু তাঁর কীর্তির মূল্যায়নে সমাপনী মন্তব্য করবার সময় হয়নি। সচেতন পাঠক তার কবিতার গতি প্রকৃতি এবং সম্ভাবনা প্রবণতা শনাক্ত করবার চেষ্টা করতেই পারেন। একজন কবিতাপ্রিয় বিমল গুহ অনুরাগী হিসেবে এ নিবন্ধে আমি ধরবার চেষ্টা করব তাঁর কবিতাসত্তার বিশেষ একটি প্রবণতা। এ প্রবণতা শুধুই স্বাতন্ত্র্য নাকি খানিকটা দুর্বলতাও; সেটাও ভাববার বিষয় বইকি।

কথায় বলে Morning shows the day। কাব্যচর্চার পূর্ণ কালের নিরিখে অহংকার, তোমার শব্দ-নামীয় প্রথম কাব্যকে সকালবেলা ধরে নেওয়াই সমীচীন বোধ করি। এ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘আলোক বর্তিকা’। কবিতার শুরুতে কবি জানান দিচ্ছেন-

আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না

বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়,

বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না

প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়,

কবিতাটির শেষের শ্লোকে সরস্বতীকে উদ্দেশ্য করে কবি বলেন-

প্রেমপালিতা তুমি হরিণীর মতো যেই কাছে এসে বসো, আমি

ত্রিকালদর্শীর মতো ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে

আকাশের নাভিমূল ছুঁই,

পাঠকভেদে কবিতার পঙ্‌ক্তিমালার ধ্বনি-দ্যোতনা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়ে থাকে। মহাশ্বেতাকে কবির প্রিয়তমা বলে ঠাহর করলে বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। যাকে বলা হচ্ছে ‘প্রেমপালিতা তুমি হরিণীর মতো’। তিনি মনের মানুষ নয় তো কি? এখানটায় কবি বিমল গুহ প্রথম রাতেই বিড়াল মারলেন। আধুনিক বাংলা গানে আছে- আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে; তুমি যেন ভুল বুঝো না...। দেবতার সঙ্গে দূরত্ব তার অনেক। তাই নৈবেদ্য-উপচারে নিবেদন। ভালোবাসায় কেবলি নৈকট্য। মনের কথা ‘বলিতে ব্যাকুল’। কথার নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। কবির সরলোক্তি- ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে আকাশের নাভিমূল ছুঁই। ভবিষ্যতের কথা সে তো স্বপ্ন। কল্পনা। শুরুতে কবি তাই বিশ্বাসে ভর করে আকাশকে স্পর্শের স্বপ্ন বুননের আপ্তবাক্য শোনান- ‘বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়’। বিষয়ের সহজ থেকে কঠিনে উপস্থাপন-কৌশলের মতো কবির কবিতাগাঁথুনি। মাটির মানুষ মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার কথা ভাবতে ভাবতে কবিতার শেষাংশে এসে আকাশের নাভিমূল স্পর্শ করেন। সহযোগী শক্তি হরিণীর মতো কাছে এসে বসা প্রেমপালিতা। আকাশ তো অনেক আলোকবর্ষ দূরে। তবু কবিতায় ছুঁয়ে দেন- তার ভালোবাসার বরকতে। কবির কাব্যসাধনার আকাশযাত্রার এভাবেই শুরু। ‘একরাত্রির গল্প’ শীর্ষক কবিতায় আকাশ, চাঁদ, তারা, নৌকা প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে লক্ষ করি কবির অস্তিত্বের সমগ্রতা ও একাগ্রতা। সত্তার নতুন আবির্ভাবের মতো, ঊর্ধ্বযাত্রার মতো কবির সেই জন্মান্তরযাত্রা। বিমল গুহ চমৎকার বলেছেন-

কাল সারারাত

অনভিপ্রেত এক ঢেউয়ের দোলায় ছুটে চলেছিলাম-

ছুটে চলেছিলাম কোনো এক মহোৎসবের পথে,

স্বপ্ন নয়, ঘুমও নয়।

অবচেতনায় ছুটে চলেছিলাম মহাযানে, জলযানে

প্রথমবারের মতো।

কবির অন্তর্গত এবং অন্তর্জলীযাত্রার গুঢ় সমাজেও বিদগ্ধ পাঠক অনাস্বাদিতপূর্ব কাব্য পাঠের আনন্দ পেয়ে থাকবেন উপযুক্ত শ্লোকে। কবি বিমল গুহ অবচেতন মনেই বারবার আকাশকে নামিয়েছেন তার কাব্যের জমিনে। ‘আকাশ পথে, অন্ধকারে’ শীর্ষক কবিতাগল্পে তা সাধারণ পাঠকেরও দৃষ্টি কাড়ে। প্রেমিকা শুভার জন্য কবি আকাশের একটি তারা ধার নেন। স্বল্প মেয়াদি ধার। সকালে তারাটা ফেরত দিতে হবে। কবির আবদার শুভা যেন তারাটা মুঠোয় রেখে দেয়। যেন কেউ না দেখে রাত দুপুরে আবার সেই তারাটা অন্ধকারে আকাশপথে উড়িয়ে দিতেও বলেন কবি। প্রেমের পথ তো কুসুমাস্তীর্ণ নয়। প্রতিকূলতা-সংকুল। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কবির কৌশল-

দেখবে তখন ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে ঠিক বারোটায়

আঁধার এসে গিলে নেবে সূর্যটাকে

এক পলকে দিন দুপুরে রাত নামাবো,

আকাশমুখী বিমল গুহর কাব্যকলার এক তুঙ্গমুহূর্ত ধরা পড়েছে পঙ্‌ক্তিটিতে। মনে পড়ে শামসুর রাহমানের কবিতায় ঘড়ির কাঁটার মতো প্রেমী নরনারী মিলে যায়। আমাদের বিমল গুহ ঘড়ির কাঁটা থমকে দেন বারোটায়। বারোটা এমন এক সময়, বড়োই শানদার। এর পরেই তেরোটা (অর্থাৎ একটা) বাজবে। কিংবা বারোটা এক মিনিটেই শুরু হবে নতুন তারিখ। নতুন দিন। নতুন সম্ভাবনা। নতুন ইতিহাস। শুধু কি তাই? না। আরো কথা আছে। বাংলা গান পাই- ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে। জোছনা লুকাতে’। যেন প্রিয়া প্রেমিকার পাশে সবার অলক্ষ্যে আসতে পারে। প্রেমিক নামের পাগলই কেবল ভাবতে পারে- চাঁদের জোছনা লুকিয়ে রাখার কথা। মোদ্দা কথা, প্রেম ও প্রেমিকার জন্য কী না পারা যায়? কবি বিমল গুহ অমন করেই দিনদুপুরে রাত নামান। শুধু কবি হলে সম্ভব হতো না। প্রেমিক কবি বলেই সম্ভবপর। এটাও শেষ কথা না। আরেকটা কথা বলার আছে। সেটা হলো ভালোবাসার স্বাধীনতা। স্বাধীনতার আনন্দও বলা যায়। এই স্বাধীনতা ও আনন্দ আমরা দেখেছি মেজদার কাছে পড়তে না বসার জন্য মেসোমশায়ের আদেশে শ্রীকান্তদের মুক্তিতে। দেখেছি পল্লিকবির ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় শহুরে বন্ধুকে ‘আচ্ছা না হয় দিয়ে দিও তাও’ চরণাংশে। কবি বিমল গুহ বলেন-

রাত দুপরে উড়িয়ে দিও সেই তারাটা

একটা পথের অন্ধকারে

আকাশ পথে অন্ধকারে,

অন্ধকারে।

কেন? যে উপহার দেওয়ার জন্য দিনদুপুরে রাত নামানো। সেই উপহার আবার ফেরত দেওয়া কেন? নজরুল তো প্রিয়ার খোঁপায় তারার ফুল দিতে চেয়েছেন। বিমল গুহ সেই তারা প্রিয়ার হাতে দিয়ে ফেরত দিতে বলেন। কেন? আমার বিবেচনায় এখানেই বিমল গুহর স্বাতন্ত্র্য। এ স্বাতন্ত্র্য শুধু তাঁর নয়। তাঁর কালেরও। কবি বিমল গুহ প্রকৃতির স্পর্শে ধন্য হন। প্রিয়াকে ঋদ্ধ করেন। নিজেও হন আনন্দে ঋদ্ধ। সমৃদ্ধ মানবতার পক্ষে ছোটলোকি বেমানান। মায়ের ছেলে মায়ের বুকে ফিরে যাবার মতো প্রকৃতির ধন প্রকৃতিরই থাকুক। পরিবেশ বাঁচুক। ধরিত্রী বাঁচুক। প্রকৃতি সমৃদ্ধ থাক। কবি তো প্রিয়া পেলেন। উপকরণের আর প্রয়োজন কী? ভালোবাসা প্রাপ্তির আনন্দ ও স্বাধীনতা থেকেই কবির দাবি- ‘রাত দুপুরে উড়িয়ে দিও সেই তারাটা’। সে-ই ভালো। তারা উড়িয়ে দিলে আলোরও আড়াল হবে। অন্ধকার অন্ধকার। দুয়ে মিলেএকাকার। তাই তো শুভাকে নিয়ে ‘আকাশপথে অন্ধকারে’। বিমল গুহ যখন ‘স্বদেশের দিকে মুখ ঘোরান’ জন্মভূমির অপরূপ রূপে মুগ্ধ হন; তখনো দেখি- সৌন্দর্যের উপকরণের তালিকাভুক্ত রয়েছে নীলাকাশ। আকাশে কি দেশ বা রাষ্ট্রের সীমানা সীমান্তে খণ্ডিত? না। তবু এই ‘তবু’র ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। লক্ষনীয়, আকাশ ও মৃত্তিকা মাতৃগর্ভে যমজের মতোই কবিভাবনায় পাশাপাশি অবস্থান নেয়। কী চমৎকার পঙ্‌ক্তি-

আষাঢ়ের জলভর্তি মেঘ, নীলাকাশ

মৃত্তিকা, ফুল-ফল, ফলবান বৃক্ষের নিকটে নত হই।

মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে হয়-

       ‘আহ কী সুন্দর এই প্রিয় জন্মভূমি’।

আকাশ সীমানা-সীমান্তহীন বলেই উদারতার প্রতীক। ধৈর্যের রূপকে আকাশ ভালোবাসার সাবধানি সময়। প্রেমযুক্ত দুই নর-নারীর পরমকাল। বিমল গুহর উপলব্ধি অভিব্যক্তি-

ধৈর্য মানে চন্দ্রবোড়া সাপ

বুকের তাপে নিবিড়ে পোষমানা,

ধৈর্য মানে তোমার-আমার চোখ

আকাশ জোড়া রঙিন সামিয়ানা।

আধুনিক কবিতার অন্যতম স্বভাব রূপকায়ণ ও প্রতীকায়নের অসম্ভব সুন্দর কাব্যায়ন হয়েছে উপর্যুক্ত শ্লোকে। ‘রঙিন সামিয়ানা’ শব্দবন্ধ পাঠককে মিলনানুষ্ঠান বিবাহের ব্যঞ্জনা দেয়। কবির তাড়াহুড়ো নেই। মিলনের লক্ষ্যেই ধৈর্য ধারণ। সেই ধৈর্যের সম্প্রসারণই কবির কথিত উদার নীলাকাশ ও রঙিন শামিয়ানা।

জীবন তো নিরন্তর ভালোবাসা নয়। সমস্যা-সমরসংকুল। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের গরিব মাঝি দেবীর কাছে (দেবীর পরিচয় না জেনে) বর চেয়েছিল- আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। স্বজনদের জন্য এরকম শুভ কামনা সবারই থাকে। কবি বিমল গুহ এর ব্যতিক্রম নন। তাঁরও মানবিক যাত্রা- সংসারের দিকে। কিন্তু স্ববিরোধে দ্বান্দ্বিক সে সংসারযাত্রা। কবির বাঁ-হাত সংসারবিবাগী এবং তার টান ছিন্নমূল অন্য এক সংসারের দিকে। আর ডান হাত? সে অন্যদিকে। কবির ভাষায়-

শূন্যে নীলিমার দিকে বাড়িয়ে ডানহাত

সাজাই শব্দের ডালপালা।

তোমার সংসার ধনধান্যে বসুন্ধরা

বৃক্ষের মতন তুমি পাতাও সংসার লোকালয়ে

মাটি ও বৃষ্টির ছন্দে পরিপূর্ণ সংসারী হয়ে ওঠো।

পাঠকগণ ইতিপূর্বে কবি নজরুলের বিদ্রোহের ও ভালোবাসার দ্বান্দ্বিক সহযাত্রা লক্ষ করেছেন- এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি এবং অন্য হাতে রণতূর্য-সমন্বয়ে। কবি বিমল গুহ প্রেমিকার জন্য পরিপূর্ণ সংসারের আশীর্বাদে রাখেন। এই আশীর্বাদ ভারতচন্দ্রের অপত্যের জন্য দুধেভাতের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু বিমল গুহর ভালোবাসা আদতে আকাশযুদ্ধ। বামহাত ও ডানহাত যথাক্রমে রণতূর্য ও বাঁশরির মতোই। নীলিমায় (অর্থাৎ আকাশে) হাত বাড়িয়ে (অর্থাৎ প্রার্থনা বা মোনাজাতের বদৌলতে) শব্দের ডালপালা সাজানো; মাটি ও বৃষ্টির (অর্থাৎ আকাশের আশীর্বাদ) ছন্দের সমন্বয় ঘটানো- সে এক আকাশযুক্ত বই তো নয়। এটাও লক্ষণীয় যে, পরিপূর্ণ সংসারে উপকরণ মাটি এবং বৃষ্টির ছন্দ। এই পরিপূর্ণতা কবি বিমল গুহর আধুনিক ও মানবিক কাব্যভাবনার অন্যতম স্বভাব। ‘আগামী উৎসব’ নামীয় কবিতায় লক্ষ করি নতুন ভূমিতে আগামী ফসল বোনেন। স্বপ্নও বোনেন। কবিকণ্ঠে স্বপ্ন বুননের কথা-

আমিও তাৎক্ষণিকভাবে তোমার স্বপ্নগুলো

বুনে দিই আকাশের বিশ্বাসী খামারে,

আমার বিবেচনায় ‘আকাশের বিশ্বাসী খামার’ আধুনিকতার স্বভাবপুষ্ট অসাধারণ এক রূপকল্প। খামার আবাদ বা প্রজন্ম বৃদ্ধির প্রতীক। ফসলের সমৃদ্ধ গোলা বা ভান্ডারের সংকেত। আবার ‘আকাশের বিশ্বাসী খামার’ শব্দবন্ধে জোর ও জঙ্গমতার কাব্যিক অভিব্যক্তি লক্ষণীয়।

আকাশ যে কেবল উদার হবে, আশীর্বাদের হবে- কবি তা ভাবেন না। ঝড় তুফান গুমোট নিম্নচাপের মতো অবাঞ্ছিত ও ভয়ংকর ক্রিয়াকাণ্ডও আকাশের আঙিনায় ঘটে। বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে কবি যখন বলেন-

ইচ্ছে করে চোখ থেকে ক্লান্তির জড়তা মুছে

হেঁটে চলি নবীন সাহসে

দশদিক দ্বিখণ্ডিত করে ভেঙে ফেলি হিংসার আকাশ

তোমার ভুবনে, বাংলাদেশ।

তখন পাঠক বুঝতে পারেন- হিংসার আকাশ রূপকে কবি বলেছেন জীবনানন্দ কথিত অদ্ভুত আঁধার সংবলিত জিগীষাপরায়ণ হৃদয়ের কথা। বাংলাদেশের অনাকাঙ্ক্ষিত আর্থ-রাজ-সামাজিক অবস্থান মূলে তো ওই হিংসার আকাশ। মানুষ নামের মধ্যে যদি মানুষ না এগোয়, তবেই যত সমস্যা। তবু মানুষই পারে- এ বিশ্বাসে কবি আপ্লুত। রবীন্দ্রনাথের মতো বিমল গুহও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারান না। পুরোনো আকাশে (অর্থাৎ হিংসার হৃদয়ে) বৃষ্টির (অর্থাৎ ভালোবাসার আশীর্বাদের) সম্ভাবনায় কবি রোমাঞ্চিত হন। কবি ‘বর্ণবাদী পাংশুটে গিট’ কবিতায় বলেন-

তোমার দক্ষিণ জুড়ে বৃষ্টিসম্ভবা মেঘ

পুরানো আকাশ ছেয়ে আছে

আগামী বৃষ্টির গানে আমরাও রোমাঞ্চিত হই।

রোমাঞ্চকর ভালোবাসায় কবি যখন অনুভব করেন যে, প্রিয়ার হৃদয়ের দরজা তার জন্য খোলা; তখন তিনি মেঘের নিমিত্ত খুঁজে পান। বুঝে আসে মেঘের আনাগোনা। কবির উক্তি-

সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে দেখি

উড়ন্ত হাওয়ায় তুমি ভেসে বেড়াচ্ছো ঝিলমিল

তোমার জন্যেই যেনো আকাশে মেঘের আনাগোনা।

আকাশ কখনো কবির অভিজ্ঞতায় অগম্য দূরত্বের অজ্ঞাত দেশ। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ কেমন ভালবাসা/মানুষ ও পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে আকাশে উড়াল দেয় স্মৃতি’। এই অজ্ঞাত দেশ- আকাশ আবার অস্থির বাংলাদেশে অপ্রাপ্তির ও অশান্তির অন্য রকম খরার রূপকে- ‘কম্পমান চোখের ইশারায় কাঁপে চৈত্রের আকাশ’ পঙ্‌ক্তি হয়ে ওঠে। ‘মাটির তিলক’ কবিতায় যদিও লক্ষণীয় ‘কৃষিনির্ভর দেশে সম্পদের সুষম বণ্টনবর্জিত ভালবাসা’; তজ্জন্যই ‘মানুষের দুঃস্থ কপালে আঁকে/ ক্লেদাক্ত মাটির তিলক।’ তবুও আশার সোনাঝরা আলোর মতো-

‘আকাশের বিশাল ক্যানভাস ছেয়ে

তীব্র রোদ নেমে আসে ফসলের দেহে

আশেপাশে ঝিলিক দেয়’। 

এভাবেই আকাশ হয়ে ওঠে প্রতীকায়িত আশার ভরসাস্থল- অগ্নিবীণা সকালের লাল-এর উদয়স্থল। তাই বুঝি নগর ভবনের প্রহরীও আকাশকে পায় আশা ও আশ্বাসের আস্থায়। ‘বৃদ্ধ প্রহরী হাঁকে’ কবিতায় কবির বাণী-

নগর ভবনের গেটে চোখে তাকায় প্রহরী ঐ

আকাশের দিকে, আগামী প্রজন্ম তাকে

ডাকে ইশারায়।

‘প্রজন্ম ২০০০’ শীর্ষক কবিতায় দেখি- ‘আকাশের নীলে/ আগামীর স্বপ্ন বুনে যুবক-যুবতী/ উর্বর নিজস্ব ভুবনে।’ বিমল গুহর আকাশ স্থিরদৃশ্য নয়। রূপ বদলায়। রূপের বদল দর্শকনির্ভর। ‘তিনভাগ জল ও মানব সন্তান’ কবিতায় একই আকাশের এত রূপ ধরা পড়ে। ‘শতাব্দীর ছায়া কাঁপে’ নামীয় কবিতায় আকাশ হয়ে ওঠে মানবিক গুণাবণি সম্পন্ন ‘মানুষের দশা দেখে কাঁদে এই গুমোট আকাশ’। লালন ফকিরের গানে পাই প্রকৃতির প্রত্যেক সৃষ্টিই মানবজন্ম আশা করে। মানুষ নামের মধ্যে মানুষ হয়ে উঠলে জন্মমুক্তি হয়। লা-লন অর্থাৎ লা অর্থ নাই এবং লন অর্থ গ্রহণ। শূন্যে বিলীন-এর তত্ত্বই নির্বাণ। সুফির ফানা। তবে কি আকাশও মানুষ হতে বাঞ্ছা করে? তাই কি কবি বিমল গুহ আকাশকে মানুষ বানিয়ে কাঁদালেন! আমার অন্তত তা-ই মনে হয়। বিমল গুহর আকাশ শেষ পর্যন্ত চেতন-আকাশ। তা নইলে কাঁদে কেন? ‘চোখ’ শীর্ষক কবিতায় পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকে আকাশ। লক্ষ কোটি মানুষের চোখে ছায়া ফেলে। চোখ রূপান্তরিত হয় আকাশে। ‘মানুষের চোখ/ তবু আকাশের মতো নয়,/ এই চোখ সীমায়িত খণ্ডিত আকাশ।’ কবি বাংলাদেশের মাটির মানুষ; পৃথিবীর সন্তান। রাজনীতি আর রাজভীতির শিকার এমন কি আকাশ। তাই তার বাস্তবতা-

হিংস্রতা মানি না আমি, রাজনীতি ধারণ করেছে এইসব;

শুধু ভীতি, রাজভীতি ছড়ায় আকাশ অহরহ।

‘চূড়া’ শীর্ষক ছোট্ট কবিতায় আকাশ ও পাহাড় যার যার মতো করে অবাক হয় বঙ্গবন্ধুর নিরিখে। মুজিবের হৃদয়ের বিশালতায় আকাশ বিস্মিত। তাঁর অত্যুচ্চ পৌরুষের প্রাণতায় পাহাড় বিস্মিত। কবি বিমল গুহ মতো, যেন ধরনের শব্দ ব্যবহার না করে উপমান-উপমিত-এর সম্পর্ক অনন্য কাব্যিকতায় রূপ দিয়েছেন। সবকিছুর পরেও কবির অবস্থান- ‘আমরা রয়েছি মাটি ছুঁয়ে’। অনেকেই জানেন আকাশ-শীর্ষক পদ্যই কবির লেখকজীবনের প্রথম রচনা। সেই আকাশ আদতে বিমল গুহর কাব্যে বহুমুখী উপমান। কখনো উপসিত। কখনো রূপক। কখনো প্রতীক। এভাবেই মৃত্তিকাসংলগ্ন কবির সৃষ্টিরাজ্যজুড়ে নানামাত্রিক টক, ঝাল, তিতা মিঠা হয়ে অধরা আকাশ ধরা দেয়। তাই আমার বিবেচনায় কবি বিমল গুহ স্বভাবত আকাশচারী মৃত্তিকাপত্র।

উদ্ধৃতিসূত্র: নির্বাচিত কবিতা, বিমল গুহ, পলল প্রকাশনী

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়