ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গিরিজা দেবীর প্রয়াণ: উজ্জ্বল সংগীত সফরের সমাপ্তি

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গিরিজা দেবীর প্রয়াণ: উজ্জ্বল সংগীত সফরের সমাপ্তি

দীপংকর গৌতম: গিরিজা দেবী অতঃপর চলে গেলেন নিরন্তরের পথে। ‘ঠুমরির রানি’খ্যাত এই শিল্পী বিদুষীকে আমাদের অনেকেরই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বয়স যে কণ্ঠের কারুকাজ ঠেকাতে পারে না তা তার সাংগীতিক পরিবেশনা দেখে বুঝেছি। ওই বয়সে সংগীত, তাল-লয়ের অপূর্ব সম্মীলন সংগীতকে কতটা বেশি মোহময় করে তোলে তা গিরিজা দেবীকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। সংগীতের সুরধারায় রসধারার মিশ্রণ তাকে কতোটা বাঙময় ও মনোহর করে তোলে তা গিরিজা দেবীর পরিবেশনা ছাড়া বোঝা যাবে না।

এই বিদুষী বাংলাদেশে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে তৃতীয় ও শেষবারের মতো এসেছিলেন গত বছরের নভেম্বরে। সেই উৎসবে গান গাওয়ার পর নিজের সংগীত জীবনের ইতি টানার কথা বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এরপর ভারতের রায়পুর ও পুনে- মাত্র এই দুটি আসরে গাইবেন তিনি। তিনি আবারও বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। তবে গাইতে নয়, শিশুদের গান শেখাতে। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না, চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। গিরিজা দেবী গান গাইতেন প্রাণের টানে। যে কারণে তার পরিবেশনায় দেখা যেত আশির উপরে বয়সী এক নারী কত প্রাণবন্তভাবে সুরের ইন্দ্রজালে ভরিয়ে রাখেন পুরো আর্মি স্টেডিয়াম। তিনি বেশির ভাগ সময় ঠুমরি গাইতে সাচ্ছন্দ বোধ করতেন। এবং তার গায়কী ও ঠুমরির প্রতি একাগ্রতা দেখে মনে হতো লক্ষ্মৌয়ের আখতারী বাঈ বা বেগম আখতার যে সুর দিয়ে তার ভক্তকূল জাগিয়ে রেখেছেন, গিরিজা দেবী বেগম আখতারের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করার ব্রত নিয়ে তার কণ্ঠে সেই সুর তুলে নিয়েছিলেন। পাঠকের সুবিধার্থে ঠুমরি প্রসঙ্গে প্রাথমিক একটি ধারণা দিতে চাই-

ঠুমরি চঞ্চল স্বভাবের লোকপ্রিয় গান। ঠুমরি ভাব প্রধান গীতি। ভাবের অকৃত্রিম প্রকাশ ঠুমরির ধর্ম। প্রাচীনকালে গান ও নাচের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল। সেকালের গান ‘ঠমক’ চালে লোকগীতি পরিবেশিত হতো। ‘ঠমক’ শব্দ থেকে ঠুমরির উৎপত্তি। এটা প্রচলিত ধারণা। ঠুমরি গান প্রেমের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। গানের বাণীতেই তার প্রকাশ। প্রেয়সী নারী তার প্রেমিক মনের মানুষকে প্রিয়তম, প্রাণেশ্বর, প্রেমিক, প্রাণনাথ, নাগর এ ধরনের অনুরাগের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। গানের বাণীতে অভাব-অভিযোগ থাকে। রাগ-অনুরাগ থাকে। বিবাদ, চাঞ্চল্য, প্রগলভতা, অভিমান, অভিযোগ ইত্যাকার প্রেম বিষয়ক কথা ঠুমরি গানে স্বাভাবিক নিয়মেই এসে পড়ে। একটা বিষয় লক্ষণীয় ঠুমরি গানের ভাষায় পুরুষের প্রতি ‘নারী’র প্রেমাসক্তিই বড় হয়ে ধরা পড়ে। তাই ‘নারী’ সুলভ প্রকৃতির গান হিসেবেই ঠুমরি আখ্যায়িত।

ঠুমরি হিন্দি, উর্দু ও ব্রজবুলি ভাষায় রচিত। ভাষা প্রাঞ্জল ও সাবলীল। তাই ঠুমরিতে একটা কাব্যময়তা বিরাজ করে, যা অনায়াসে শ্রোতার মন আকর্ষণ করতে পারে। প্রেমিক-প্রেমিকাকে তো অবশ্যই। ঠুমরি গানে নাটকীয়তা থাকে। এই নাটকীয়তা ঠুমরি গানে বিশেষ মাত্রা সংযোজন করে। ফলে ঠুমরি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ঠুমরি গানে মূলত দুটো স্তবক থাকে। ঠুমরির বিষয়বস্তু মুখ্যত প্রেম। ঠুমরি শৃঙ্গার রসের অভিব্যক্তিতে সিক্ত। ঠুমরি গায়িকাদের মধ্যে বেগম আখতার, রওশনারা বেগম, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, রেবা মহুরী, সিদ্ধেশ্বরী বাঈ, কিশোর আমোনকর, গহরজান, হীরাবাঈ বরোদেকার, মাল্কা পোখরাজ, গিরিজা দেবী, অভিনেত্রী নার্গিসের মা জদ্দান বাঈ প্রমুখ সংগীত ভুবনে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। ঠুমরি আনন্দ ও বিরহের মেল বন্ধনের গান।

যেমন: ‘আনন্দ ঠুমরি, বাজুবন্দ খুল খুল জায়, জায়রে।

অব গাঁবরিয়া নে জার্দু সারা, জাদু কী পুড়িয়া ভর ভর মারে অবরা উড়ি উড়ি জায়, জায়রে।’

[বঙ্গানুবাদ: ওগো, আমার হাতের তাগা খুলে খুলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এবার প্রিয়তম আমায় গুন করেছে। জাদুর কাগজের টুকরো আমার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। তাই কাপড়ের আঁচল আমার বার বার খসে পড়ছে।]

ঠুমরি ও  গিরিজা দেবী সমার্থক হয়ে উঠেছিল। অন্য গান গাইলেও ঠুমরি গানে তিনি সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তার সাধনার ফল হিসেবে দেখি তার স্বীকৃতি। ছয় দশকের বেশি বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনে গিরিজা দেবী অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা, যার মধ্যে রয়েছে পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী, সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার এবং সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কলকাতা আইসিটি সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে সংগীত গুরু ছিলেন তিনি। এই শিল্পী ১৯২৯ সালের ৮ মে ভারতের বারাণসীতে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গিরিজা দেবী কণ্ঠশিল্পী ও সারেঙ্গিবাদক সারজুপ্রসাদ মিশ্রর কাছে প্রথমে খেয়াল ও টপ্পায় প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে চাঁদ মিশ্রর কাছে বিভিন্ন সংগীতরীতি রপ্ত করেন। বেনারস ঘরানার শিল্পী ছিলেন তিনি। ধ্রুপদী ও শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি ঠুমরিকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিসীম। হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সংগীতকে তিনি ভিন্ন এক মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। বারাণসী থেকে একসময় কলকাতায় চলে আসেন গিরিজা দেবী। বেনারসে জন্ম হওয়া শিল্পী গিরিজা দেবীর ছোটবেলার শিক্ষা বাদ দিলেও প্রায় সাত দশকের সংগীতজীবনে অনেক খেয়াল আর টপ্পা গেয়েছেন। গেয়েছেন কাজরি, চৈতি ও হোলি গান। পৃথিবীর সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র ‘গিরিজা’।

গিরিজা দেবীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি লিখেছেন: ‘গিরিজা দেবীর মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীত অন্যতম মধুর কণ্ঠের একজনকে হারালো। ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীত প্রসারে তার অনন্য অবদান চিরকালের স্মরণীয়’। কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর লিখেছেন: ‘মহান শাস্ত্রীয় ও ঠুমরি গায়িকা গিরিজা দেবী আমাদের মাঝে নেই। এই খবর শুনে আমি খুবই শোকাহত। আমার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন।’ সরোদশিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী খান লিখেছেন: ‘ঠুমরি হৃদয় দিয়ে গাইতে হয়। গিরিজা দেবী ছিলেন সেই গায়কির শেষ মহান শিল্পী।’ তবলাশিল্পী ওস্তাদ জাকির হোসেন লিখেছেন: ‘কী সৌভাগ্য, আমি মহান গিরিজা আপার সঙ্গে তানপুরা বাজিয়েছিলাম। নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি।’

এছাড়াও শোক জানিয়েছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, ওস্তাদ রশিদ খান, কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ উদাস, শঙ্কর মহাদেবানসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের সংগীতশিল্পীরাও শোক প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গিরিজা দেবীর প্রয়াণের মাধ্যমে একটা বিষয় স্পষ্ট যে বিশ্বখ্যাত একজন শিল্পীর জন্ম হতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। এটি ছাড়া একজন শিল্পী নিজস্ব উদ্যোগে যতদূর এগোতে পারে ওইটুকুই তার পথ। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতাম বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের পরিবেশনা। এর ধারাবাহিকতায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের শ্রোতা ও একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো বাংলাদেশে। শুধু কি তাই উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ‘পরম্পরা’ অন্যতম। এখানে যেসব ক্ষুদে প্রতিভা তৈরি হয়েছে তা ঈর্ষণীয়। কিন্তু এবারে নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ করা হয়েছে। এ দেশে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা শিল্পী তৈরির বৈরী পরিবেশ সর্বত্র।

এবার উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠানটি হলে সেটা গিরিজা দেবীর নামে উৎসর্গ করা যেত। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? যিনি বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের বীজ বপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিস্মিত হয়েছিলেন এদেশের শিল্পপ্রিয় মানুষের ঢল দেখে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান দেখানোর কোনো পথই থাকলো না। তবু গিরিজা দেবী বেঁচে থাকবেন তার জীবন ও কর্মের মধ্যে। গানের ভুবনে, অজস্র ভক্তের হৃদয়ে অমর থাকবেন শিল্পী বিদুষী গিরিজা দেবী। তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়